ভালোবাসা ১ম_পর্ব

0
2815

ভালোবাসা
১ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে বিজয় যার প্রতীক্ষায় সায়েন্স বিল্ডিংয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার জন্য এভাবে যুগযুগ সে অপেক্ষা করতে পারে। কোন আশা-প্রত্যাশা, চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক নেই তবুও এই একজনের মুখ দেখেই তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। যদিও সে জানেনা তার এই অনুভূতিটা ঠিক না বেঠিক। সম্পর্কের সীমায় থেকেও কখনো যদি মন বিদ্রোহ করে ওঠে তবে তাকে কিভাবে অগ্রাহ্য করা যায় সেটা সে আজও ভেবে পায়নি।ছ’ফুট উচ্চতার ফর্সা বর্ণের বিজয় এখন রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণের হয়ে গেছে। তবুও তার চোখ আর চুল যেন আলাদাভাবে নজর কাড়ে সকলের।ইস্পাতের মতো পেটানো শরীরে যা পড়ে তাই যেন মানিয়ে যায়। আজ সে পড়ে আছে, সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স। হাতে বেশ দামি একটা ঘড়ি, যেটা সবসময়ই তার সাথে থাকে।

ভাবনায় সে যখন বুদ, তখন পাশ থেকে হঠাৎ নিজের নামটা শুনে ফিরে তাকাতেই দেখলো বন্ধু সুজন এসে দাঁড়িয়েছে। বিজয় বলে উঠলো, তুই এখানে?

আমিতো শালা এসেছি মাসতুতো ভাইটার খোজে। মেসো খুব করে ধরেছে রাজনীতিতে জড়িয়েছে কিনা জানতে। আজকালকার ছেলেপুলেদের আবার সেই শখ রাজনীতি করবার। নাক টিপলে দুধ বেরোবে আর এখনই পার্টি করতে চায়। ধুস শালা…বাদ দে সেসব। তোর কি কাজ সেটাই বল? যেভাবে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছিস তাতে তো মনে হচ্ছে নারীঘটিত ব্যাপার স্যাপার।

বিজয় খুব একটা পাত্তা দেয়না সেসব। সুজনের সাথে ব্যবসার খাতিরে বন্ধুত্ব। যদিও এখন অনেকটাই ইনফরমাল রিলেশন হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তাস টাস খেলাও হয় খুব। সুজনই তাকে নিয়ে যায় সেসব আড্ডায়। বিজুর মতন ভদ্রঘরের ছেলেরা যে অমন সব জায়গায় গিয়ে বস্তির ছেলেদের সাথে মেশে না সেটা বলতে বিবেকে বাধে তার।

ওরা কথা বলছে এরই মাঝে কখন যে অরুণিমা এসে হাজির হলো তা দু’জনের কারোরই চোখে পড়েনি। বিজু ডাকে সম্বিৎ ফিরতেই তাকিয়ে দেখলো এই গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে অরুণিমা এসে দাঁড়িয়েছে। অরুর চুল গুলো লেপ্টে আছে কপালে, যত গরমই থাক কোমর অব্ধি লম্বা চুল খোলা রাখা চাই সবসময়। টিপটার আঠা চলে গিয়ে একটু যেন উঠে আছে আলগা হয়ে। তার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যামলা আর তাই বাসন্তী রঙের কামিজ সাথে লাল চুড়িদার আর লাল ওড়নায় তাকে মানিয়েছে বেশ। একহারা গড়নের চেহারায় লাল টিপ আর চোখের কাজলটুকুই তার সাজসজ্জা। তবু্ও যেন খুব মায়াময় মুখখানি। আঁচলের শেষ প্রান্তটুকু দিয়ে কপালটা মুছে নিয়ে সে বললো, খুব দেরি হয়ে গেলো না!

ফের সুজনকে দেখে অরু জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বিজয় একটু হেসে বললো, পরিচয় করিয়ে দেই ও হচ্ছে সুজন…আমার বন্ধু।

সুজন বিজয়ের বিজনেসের সুবাদে পরিচিত আর তাই অরুণিমাকে আগে কখনো দেখেনি। বারো ক্লাসের পর বিজয়ের আর সেভাবে লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার দায়িত্ব সবটাই তার কাধে এসে চেপেছে। সেটা নিয়ে খুব বেশি দুঃখ ও নেই তার। অতবড় দায়িত্ব কারোকে না কারোকে তো নিতেই হতো। বাস লড়ির যেই ট্রান্সপোর্ট বিজনেস তাদের সে লাইনে পিএইচডি হোল্ডার মলয়কে মানায়না। বিজয়ের মুখ দেখেই সুজন ভেবে নিলো কিছু একটা ঘোট পাকছে।

আর ওর পরিচয়টা দিবিনা?…বলে ইয়ার্কি টাইপ একটা হাসি দিলো সুজন।

ও হচ্ছে অরুণিমা, আমার ভাবী…বিজয় পরিস্থিতি সামাল দিতে খুব দ্রুত বলে ফেললো।

সুজন যেন ভেবাচেকা খেয়ে গেলো একদম আর তাই কেমন একটা বোকাবোকা হাসি দিয়ে নমষ্কার বলে একটু তাড়া দেখিয়ে বিদায় নিলো।

যতবার এই ভাবী ডাকটা ডাকতে হয় সে একনিঃশ্বাসে বলে ফেলে। তবুও যেন কেমন একটা দমবন্ধ করা কষ্ট বুকে এসে দলাপাকিয়ে যায়। মনের আকাশে জমে ওঠা মেঘের গুমোট ভাবটা কাটাতেই সে অরুণিমাকে বলে, এই অরু…চল আইসক্রিম খাই…যা গরম পড়েছে না, একটু তো শান্তি মিলবে।

সবার সামনে তুমি করে বললেও আড়ালে সে এখনো তুই করেই বলে। সবার জন্য অরুণিমা আর তার জন্য অরু। অরুর অবশ্য সেসব হ্যাপা পোহাতে হয়না। বিয়ের আগে বন্ধু ছিলো তাই বিজুকে তুই করেই ডাকতো আর এখন মলয়ের চেয়ে বয়সে ঢের ছোট তাই সম্পর্কে সিনিয়র হবার সুবাদে তুই করেই ডাকে।

অরুণিমা একটা বাটার স্কচ ফ্লেভারের আইসক্রিম বেছে নেয় আর বিজু নেয় ক্যারামেলাইজ। দু’জনেই খেতে খেতে হেটে যায় সামনের দিকে।

তাদের পাশ ঘেষে গাড়ি যাচ্ছে সাই সাই করে আর তারা চলছে রাস্তার কিনার ধরে। আইসক্রিম, ফুচকা আরো কতসব স্ন্যাকস যে পাওয়া যায়…সব ঐ কলেজ পড়ুয়াদের ঘিরে পসার জমিয়ে বসেছে।

অরু যেভাবে খুব দ্রুত আইসক্রিম গলে যাবার ভয়ে মুখভর্তি করে খায় সেটা দেখতে বেশ ভালো লাগে বিজয়ের। বাতাসে চুল উড়ে মাঝেসাঝে বিজুর শার্টে এসে আছড়ে পড়ছে। অরুটা সেই স্কুল থেকেই ফ্রেন্ড অথচ তখন যেন এমন কিছু মনেই হতোনা তার। কি থেকে যে কি হয়ে গেল সেটা বোঝা বড় দায়…

বিজুই বলে, কিরে অরু আজ যে এত চুপচাপ? কলেজে কোন ঝামেলায় পড়িসনি তো আবার?

অরুর মুখ ভর্তি আইসক্রিম তাই সে হাতের চেটো দিয়ে মুছে নিয়ে বললো, নাহ রে…এক্সামের ডেট দিয়ে দিলো আজ, তাই ভাবছি সিলেবাস কমপ্লিট করতে পারবো তো এইটুকু সময়ে।

বিজু অট্টহাসি দিয়ে বলে, ও এই ব্যাপার…তো মিস টপার এবার ও টপ করতে পারবে কিনা সেই ভাবনায় অস্থির!!! আমি আরো ভাবলাম…বলে যেন কথাটা গিলে ফেললো।

অরু অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, মজা নিচ্ছিস? আমি ভেবে ভেবে মরছি আর তুই…যাহ আমি আর কথাই বলবো না তোর সাথে।

দুজনেই বাস ধরে বাড়ি ফিরে এলো। পুরো রাস্তা অরুর থমথমে চেহারাটা সয়ে বয়ে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো বিজু। দরজা খুলতেই কালিঝুলি মাখা চেহারায় মাকে দেখে অরু বলে উঠলো, কি ব্যাপার তুমি কেন…কাজের মাসি আসেনি আজ?

মা হাসিমুখে বললেন, তোদের জন্য আজ একটু রাঁধতে মন চাইলো তাই…

অরুর মুখে এতক্ষণে যেন হাসি ফুটলো…সে বললো, আচ্ছা চলো কি রাধলে দেখি।

মা বললো, আগে তো হাতমুখ ধুয়ে নে…পাগলী মেয়ে আমার।

আমি যে এখানে আছি সেটাকি কারো নজরে এসেছে…বলে মাকে যেন অভিমান বোঝাতে চাইলাম।

মা বললো, তোকে কি আলাদাভাবে বলতে হবে নাকিরে…হাতমুখ ধুয়ে তুই ও চলে আয় খেতে।

খাবার টেবিলে আবার একপ্রস্থ কাড়াকাড়ি মারামারি যেন চললো ডালের বড়ি আর সর্ষে ইলিশ নিয়ে। তারপর যে যার মতন চলে গেলো ভাতঘুমের টানে।

দুপুরবেলাটা অরু মার সাথে শোয়। ঘুমের চেয়ে বেশি মাকে জড়িয়ে ধরে রাজ্যের সব গল্প জুড়ে বসতেই তার ভালো লাগে।

মাঝেমাঝে বিজয়ের মনে হয়, মায়ের যে একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো তার সবটাই বুঝে অরু পূরণ করেছে।

বিকেলবেলা ছাদে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই অরু এসে ছো মেরে সেটা নিয়ে বললো, ফুসফুসের ক্যান্সার না বাঁধিয়ে বুঝি ছাড়বিনা…

তাতে তোর কি এসে যায়…একটুতেই যেই রাগ দেখাস, তুই নিজেই যে একটা ক্যান্সার সেটা কি বুঝিস…বলে মুখ চেপে হেসে ওঠে বিজয়।

অরুর মুখেও হাসি ফোটে সে বলে, আমাকে না ক্ষেপিয়ে শান্তিতে থাকতে পারিসনা তুই???

বিজু একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে, শান্তিতে থাকা আর কি হবে…তুই যেদিন থেকে পার্মানেন্ট বাসিন্দা হয়ে চলে এলি সেদিন থেকেই তো সব শান্তি উবে গেছে।

অরু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই…সে নিজের দু’হাতে কান ধরে বলে আরে বাবা একটু মজাও করতে পারবো না তোর সাথে!!!

মজার লিমিট ক্রস করে যাস বলেই তো ক্ষেপি।

সম্পর্ক যখন ডবল তখন একটু বেশি বেশি তো হবেই।

সেটা কিরকম?

প্রথমে তোর সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধু আর এখন দেবর…বলে একটা অট্টহাসি দিলো বিজু, মনে হলো তার সেই হাসি যেন নিজেকেই বিদ্রুপ করছে।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here