ভালোবাসা ১০ম_পর্ব

0
642

ভালোবাসা
১০ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

আজ বাবার রিপোর্ট দেখে ডক্টর জানিয়ে দিলেন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছেন তিনি। দ্রুতই যেন তার চিকিৎসা শুরু হয়। দাদা আর কোন রিস্ক নিতে চাইলেন না, সেজন্য ডক্টরের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে বাবাকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে এডমিট করা হবে।

বাবার সাথে মা আর দাদা যাবেন। পাসপোর্ট ভিসা সংক্রান্ত কাজ নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হলো। আর্জেন্ট সব কিছু এরেঞ্জ করতে একটু ছুটোছুটি তো করতেই হয়। দীর্ঘদিন বিলেতে থেকে দাদা এদেশের হাল-হকিকত সম্পর্কে অতটা ওয়াকিফ না তাই আমিও ছিলাম সাথে।

বাবার অসুখের খবর শুনে আত্মীয়স্বজনরা যেভাবে ঝাকে ঝাকে আসতে লাগলেন, তাতে করে গোটা বাড়িটাকেই একটা মাছ-বাজার মনে হতে লাগলো। রোগী দেখতে এসে যেভাবে এক একজন ঘন্টার পর ঘন্টা বকবক করতো তাতে রাগে আমার গা জ্বালা করতো। কথায় কথায় যেন আগেই বুঝিয়ে দিতো যে বাবা আর বেশিদিন বাঁচবেন না।

তোমরা এখন মন শক্ত রেখো, তোমার মা’কেতো তোমাদেরই দেখতে হবে…এসব কথার মানে কি!রাগে যখন আমি কটমট করে কিছু বলতে নিতাম, ঠিক তখনই অরু এসে যেন সবটা সামলে নেতো। মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামলে নেবার অপার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে অরু।

বাবা-মা, দাদা সবার লাগেজ গোছানোর দায়িত্ব ও খুব ভালোভাবে পালন করতে দেখলাম। এ ক’দিন কেউই আমরা ঠিকভাবে যেন দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। দুশ্চিন্তা, ভয় আর আতঙ্ক যেন আমাদের গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। কি ঘটবে? এই প্রশ্নের জবাবটা যেন আমরা জেনেও না জানার ভান করছি, একে অপরের থেকে আড়াল করতে চাইছি কিংবা অস্বীকার করে বেড়াচ্ছি। আর এই নগ্ন সত্যটাই যেন বাবাকে দেখতে আসা মানুষগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরছে।

এরইমাঝে অরুর বাবা-মা আসলো এক বিকেলে। গোটা বিকেলটা বাবার সাথে কথা বলেছিলেন অরুর বাবা। আর ওর মা আমাদের মাকে বললেন, আমি নাহয় ক’টা দিন এসে এখানে থাকি বেয়ান…ওদের বয়সটাতো কম, তার ওপর এমন দুঃসময়ে একা একা কষ্ট পাবে…তারচেয়ে বরং মায়ের মতো কেউ পাশে থাকলেই দুঃখ ভুলে থাকতে পারবে।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম অরু শুধু আমার সাথে একা বাড়িতে থাকবে সেটা বোধহয় উনার পছন্দ নয়। অরুর দিকে চাইতেই দেখলাম সে চোখ নামিয়ে নিলো। ওর বাবা-মা চলে যাবার আগে সে তার মায়ের সাথে অনেক কথা বললো কিন্তু ঐ ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ করলো না দেখে খুব অবাক হলাম।

বিশ্বাস জিনিসটা বুঝি এখন আর নেই তোর আমার প্রতি। আমাদের মাঝে দূরত্ব নামক বস্তুটা কবে থেকে এত বেশি জায়গা করে নিলো যে সেখানে আর ভরসা বলতে কিছুই রইলোনা। এই দুখের সময়ে যখন তোকে আমার সবচেয়ে বেশি দরকার, যখন তুই বন্ধুর মতো পাশে থেকে আমায় সাহারা দিবি, যখন তোর আমায় সাহস যোগানোর কথা…তখনও তোর আমাকে নিয়ে এত ভয়!!!

আজ মনে হচ্ছে শুধু ভালোবাসার মানুষই না আমি তোর ভালো বন্ধু ও হতে পারিনি। তোর ভালোবাসা যে দাদা সেতো আমি মনে ধারণ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুই যে আমাকে আর বন্ধু ও ভাবিস না সে কথা তো জানা ছিলো না। ঠিক আছে তুই তোর মতন থাক আর আমি নাহয় দেবর হিসেবেই থাকলাম। স্বামীর ভাই বলে যেটুকু কথা বলতে চাস সেটুকুই বলিস। সম্পর্ক রাখতে জোর করবো না।

অরু খুব ইতস্তত করতে লাগলো তার বাবা-মায়ের আনা ফলমূল মায়ের হাতে দিতে। পরিমাণটাই হয়তো তার অস্বস্তির কারণ। মা বুঝতে পেরে বললেন, এখন এই সময়ে তো সবাই কিছু না আনছে আর আমরা যে কেউ অত খেতে পারার মতো অবস্থায় নেই সে তো জানা কথা, খাবারের অপচয় না করাই ভালো, যেটুকু খাওয়া যাবে সেটুকুই এনেছেন। অরু মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের গায়ে লেপ্টে রইলো।

ফের বাবা তাকে ডাকতেই সে গিয়ে বসলো সামনে। বাবা বললেন, যাবার আগে একদিন সবাই মিলে একটু গান-বাজনার আয়োজন করলে কেমন হয় বলতো মা…

অরুর চোখের কোণটা যেন ভিজে উঠলো, সে কান্না কান্না কন্ঠে অস্পষ্টভাবে কি বললো দূর থেকে ঠিক বোঝা গেলো না। দেখলাম অরু বাবার একটা হাত ধরে খুব কাঁদছে আর বাবা আরেকটা হাত অরুর মাথায় রেখে কিছু বলছেন।

দেখতে দেখতে বাবার যাবার দিনটি এসে গেলো। আমি, অরু আর অরুর বাবা-মা তাদের এয়ারপোর্টে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। অরুর মা তার বাবাকে তাদের সাংসারিক বিষয়াদি বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ আমায় স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে নিজে গেলেন রান্নাবান্নার জোগাড় দেখতে।

কিন্তু অরুর যেন আর টিকিটির ও দেখা নেই। আমি একবার বাজার-সদাই কিছু লাগবে কিনা জানতে ওর কাছে গেলাম। অরু কিছু বলবার আগেই তার মা বললেন, তুমি এখন থেকে আমার কাছেই জিজ্ঞেস করো, রান্নাবান্না তো আমিই করছি…ওর সামনে পরীক্ষা তাই কিছু করতে দিচ্ছি না আর।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অরুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে কিছু না বলেই ঘরে ফিরে গেলো।

ফের আমি বললাম, আপনার কিছু লাগলে তাহলে আমায় বলবেন বাজার থেকে এনে দেবো। উনি হেসে বললেন, আপাতত কিছু লাগবেনা…তুমি যাও পড়ো, তোমার ও তো সামনে পরীক্ষা।

আমি নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে মাথা হেট করে পড়ার টেবিলের চেয়ারটায় বসে রইলাম।

দাদা কল করে জানালো যে বাবাকে এডমিট করা হয়েছে। ট্রিটমেন্ট চলছে কিন্তু তারা যে পরিমাণ ক্যাশ নিয়ে গেছে সেটা পর্যাপ্ত নয়। আমাকে হঠাৎ বললেন, মা তোকে কিছু বলতে চাইছেন বিজু…মন দিয়ে শোন।

মা বললেন, বিজু তোর বাবার বিজনেস পার্টনার সমীর শেখের বাড়ি চিনিস না তুই…সেখানে গিয়ে কিছু টাকা ধার আনতে পারবিনা?

আমি বললাম, পারবো মা…কত লাগবে?

মা আমাকে সব বুঝিয়ে বলে আরো কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে বললেন।

যখন আমি হন্যে হয়ে ছুটেও টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না, তখন মা আমাকে তার আলমারিতে থাকা গয়নাগুলো বিক্রি করে দিতে বললেন। শুনে আমার মনটা কেমন জানি হু হু করে কেঁদে উঠলো। মায়ের অত শখের গহনা বিক্রি করে দিতে হবে তাও আবার নিজ হাতে আমাকেই…সবকিছু খুব কঠিন মনে হতে লাগলো। পৃথিবীটা যে কত কঠিন তা এরকম রোগশোক আর বিপদের মূহুর্তেই বোঝা যায়। আত্মীয়স্বজন নামক সম্পর্কগুলো যে কতটা নামসর্বস্ব আর লোক দেখানো আদিখ্যেতার ফাঁকি তা বেশ বোঝা যায়।

একরাতে যখন আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি তখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে পড়লাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো, বলতে গেলে তখন মাঝরাত। এতরাতে কি দরকার পড়লো আবার ভেবে দরজা খুলতেই দেখি অরু দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম চুপচাপ। সে কিছু বলছেনা দেখে ফের আমি মুখ খুলতে নিতেই ইশারায় আমায় চুপ করিয়ে দিলো। আমার পাশ ঘেষে ঘরে ঢুকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে দেখলাম একটা গয়নার বাক্স বের করলো, যেটা সে এতক্ষণ কোমরের কাছটায় চেপে রেখেছিলো।

আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকে কিছু বলবার আগেই অরু বললো, তুই আমাকে কিছু না বললেও আমি কিন্তু সবই জানিরে বিজু…এগুলো রাখ, যদি কোন কাজে লাগে।

আমি নিতে চাইলাম না দেখে ফের অরু বললো, এখন সামান্য থেকে সামান্য টাকাও খুব জরুরি, বাবার প্রাণের চেয়ে বেশি আর কিছুরই মূল্য নেই আমার কাছে।

অরুর কথা শুনে চোখে জল এসে গেলো…তোকে বৌ করে এনে ভুল করিনি রে অরু, তুই-ই এ বাড়ির বৌ হবার যোগ্য। বাবা-মা যে তোকে এত ভালোবাসে তার সঠিক মূল্যায়ন আজ করলি তুই। আমার ভালোবাসা ভুল নয়, হীরে চিনতে আমি ভুল করিনি কখনো। আমার না হোক দাদারই সই…তবুও তোকে যে আমরা সকলে বড় ভালোবাসি, তুই যেন সেই ভালোবাসা পাবার মতনই একজন।

অরু আমার হাতটা ধরে বললো, নে বিজু…ফিরিয়ে দিস নে। আমার যদি সাধ্য থাকতো তবে তোকে একা ছাড়তাম না, নিজেও সাথে চলতাম, কিছু করতাম।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here