ভালোবাসা
১১তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
মানুষ চেনা যায় বিপদে-আপদে। অরুকে যেন এক নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম আজ। আমার কিছু না বলা স্বত্বেও সে যেন আড়াল থেকে সব খেয়াল রাখে। সব জানে, সব বুঝে…আমার মনে কি চলছে সব পড়ে ফেলে। সে রাতের পর ভোর অবধি আমি অরুর দেয়া গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ভালো ও লাগছিলো, আবার খারাপ ও লাগছিলো…
কেমন জানি একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিলো আমার মধ্যে। ভালো লাগছিলো এই ভেবে যে, আমার অরু সবার কথা ভাবে। আর খারাপ লাগার কারণটা ছিলো অরুর বিয়ের গয়না বিক্রি করতে হবে আমায়।
বুকে পাথর বেঁধে আমি যা কিছু করা সম্ভব তার সবটাই করতে লাগলাম। যেভাবেই হোক আমাকে টাকার জোগাড় করতেই হবে, এভাবে ইমোশনাল হয়ে গেলে চলবেনা। বেঁচে থাকলে মাকে…অরুকে আবার গয়না গড়িয়ে দিতে পারবো, কিন্তু এই মূহুর্তে বাবার ট্রিটমেন্ট সবচেয়ে বেশি জরুরি। ভেঙে পড়লে চলবেনা, আমাকে শক্ত হতে হবে।
দেখতে দেখতে অনেকখানি টাকার জোগাড় হয়ে গেলো। কিছু ধার, সেভিংস আর বাদবাকি গহনা বিক্রির। অরু আমাকে দিব্যি দিয়ে বলেছিলো যে, তার গয়না বিক্রির কথাটা যেন সে ও আমি ছাড়া আর কেউ না জানে। আমি বললাম মাকেও বলবোনা!!!
ফের সে একটু ইতস্তত করে বললো, বিজু শুধু শ্বাশুড়ি মা-ই নন…আমার মা ও যেন না জানে কথাটা।
আমি বেশ অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম। বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হলো না যে, উনি জানলে কিন্তু কিছুতেই অরু গহনাগুলো দিতে পারতোনা। আর তাই সে রাতের আধারে চুপিসারে এসে নীরবে দিয়ে গিয়েছিলো, যখন তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলেন। অরুর সেদিন উনার সামনে কথা না বলার কারণটা বুঝতে পেরে এখন আর তার ওপর আমার কোন রাগ রইলো না। সে চেয়েছে কিছুতেই যেন উনার সন্দেহ না হয়, অরু আমাকে বন্ধু ভেবে হেল্প করতে পারে।
মনটা যেন হঠাৎ খুব হালকা লাগতে শুরু করলো। এ ক’দিন এমনিতেই সব মিলিয়ে মন ভার-ভার ছিলো। বাবার অসুখ, টাকার জোগাড়, অরুর দূরে সরে যাওয়া সব মিলিয়ে বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলাম আমি। ফের ভোর হতেই টাকা পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে এসে দাদার কল পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম যে বাবার ট্রিটমেন্ট ঠিকঠাক চলছে।
যখন একে একে সবকিছু ঠিক হবে ভেবে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মনে স্বস্তি খুঁজে পেলাম, ঠিক তখনই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অকস্মাৎ বাবার মৃত্যু সংবাদ পেলাম। বাবা বাড়ি থেকে গিয়েছিলেন পায়ে হেঁটে আর ফিরলেন কাধে চেপে। বাবার শবদেহটা নিয়ে যখন আমি আর দাদা শেষকৃত্যের জন্য বাড়ির চিরচেনা আঙিনা ছেড়ে বের হলাম, তখন পেছন থেকে মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ যেন আমার হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিচ্ছিলো।
অরু মাকে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরে রেখে কাঁদছিলো অঝোর ধারায়।
আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সকলেই স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলো। অরুর বাবা-মা আর নিকটাত্মীয় দু’চারজন থেকে গেলেন খানিকটা সময় বেশি, তারপর তারাও উঠলেন। ঘরের ভেতর আমরা এই চারটে প্রাণী যেন বোবা হয়ে গেছি। কারো মুখেই আর কোন কথা নেই।
দেখতে দেখতে সময় বয়ে যায় আর শোক তার স্বাভাবিক নিয়মেই কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসে।হয়তো বাস্তবতাই আমাদের শোক পালনে বাধা সৃষ্টি করে। বাবার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়ে উঠলো আমাদের আর্থিক অবস্থান যে পড়তির দিকে সেটার কি করা যায় ভাবার সময় এখনই। দাদা তার রিসার্চ ওয়ার্ক নিয়ে খুব ব্যস্ত, তাকে তো হাতের নাগালেই পাওয়া যায় না। মা যা বলার আমাকেই বলেন, কিন্তু ভেবে ভেবেও আমি কোন কুল কিনারা করতে পারিনা। একরাতে মা বসলেন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে। অরু চলে যাচ্ছিলো দেখে মা তাকেও বসতে বললেন।
তোর বাবার বিজনেসের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে এখনই কেউ শক্তহাতে এর হাল না ধরলে সব ভেস্তে যাবে…মা বললেন।
দাদা আর আমি দু’জনেই চুপ…অরু পালাবদল করে আমাদের প্রত্যেকের দিকেই তাকাচ্ছে বারবার।
নীরবতা ভেঙে দাদাই কথা বললেন, আমাকে কি করতে বলো?
তুই বাড়ির বড় ছেলে, দায়িত্বটা তাই তোর ওপরেই বর্তায়, বাবার অবর্তমানে সংসারের কর্তা হয়ে সবদিক সামলে নেবার চেষ্টা কর…বললেন মা।
দাদা হঠাৎ একটু যেন রাগের স্বরে বলে উঠলেন, ওসব কর্তা টর্তা হবার শখ নেই আমার। সেসব নাহয় বিজুই করুক।
আমি চমকে তাকালাম দাদার দিকে।
মা বিস্মিত নয়নে চেয়ে থেকে বললেন, ও তোর ছোট ভাইরে মলয়…বয়সে এখনও কত ছোট, আর তুই কিনা ওর ঘাড়ে এই বয়সেই দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাস!!!
তাহলে বলো, এখন আমি পিএইচডি ডিগ্রী কাজে না লাগিয়ে বাস আর লড়ির ব্যাবসা দেখি…আমার কি কোন সম্মান নেই সমাজে!!! বিজুর তো পড়ায় তেমন মন নেই, ওর জন্য বরং ঠিকই আছে ব্যবসা দেখার কাজ শুরু করে দেয়া…দাদার কন্ঠস্বরে যেন বিরক্তি ঝড়ে পড়লো।
যে ব্যবসা করে তোর বাপ তোদের খাইয়ে-পড়িয়ে, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে, আজ সে ব্যবসা করতেই তোর অত অপমানবোধ হয়!!! ব্যবসাটাকে গাল দিয়ে তুই আজ তোর বাবাকে ছোট করলি।
আমি এসব আর সহ্য করতে পারছিলাম না তাই মাকে থামিয়ে দিতে বললাম, ঠিকই তো আছে মা, আমি থাকতে দাদা এসব কেন করতে যাবে! দাদার মতন উচ্চশিক্ষিত মানুষের তো কাজের অভাব নেই। আমি যেহেতু পড়াশোনায় ভালো নই তাই আমার নাহয় এভাবেই একটা কর্মসংস্থান হলো। পড়ালেখা ছেড়ে দিতে আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগবেনা, তুমি দেখে নিয়ো ব্যবসাটায় আমি ঠিক উতরে যাবো। আর আমার মতো ফেল্টুস ছাত্রদের জন্যে তো বাবার বিজনেস জয়েন করা মানে আশীর্বাদ। চাকরি-বাকরি তো ইহজনমে পেতাম না…বলে যেন নিজের উদ্দেশ্যেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।
ফের সমর্থনের জন্য একে একে সবার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখি, অরু একছুটে চোখের জলে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
মা থমথমে চেহারায় বসে রইলেন, দাদা আর একটি কথাও বললেন না।
তারপর নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে বসে ভাবতে লাগলাম, এই দাদা কি সেই দাদা! নাকি সে বরাবরই এমন ছিলো? আমায় এত অযোগ্য আর অকর্মার ঢেঁকিই বোধহয় ভেবে এসেছে চিরকাল। তার সব স্নেহ ভালোবাসাই কি তবে মিথ্যে!!! নাহ…সেটা হবে কেন, যেটা সত্যি সেটাই তো সে বলেছে। আমি যদি যোগ্যই হতাম তবে অরুর পাশে নিজেকে ভাবতাম, তার কথা কখনো মনেও আসতোনা আমার।
যেভাবে দিন চলছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো কিছুই আর ঠিক হবার নয়। কিন্তু সময়ের নিজস্ব গতিতেই যা যখন ঘটবার তা ঘটে থাকে। এভাবে আমাদের একে অপরের সাথে কথাবন্ধ অবস্থার পরিসমাপ্তিও ঘটলো দাদার একদিন ডিনার টাইমে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে সবার উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যে, তার আবার কিছু কাজ পড়েছে তাই ফের বিলেত যেতে হবে।
আমাদের প্রত্যেকের রোজকার চুপচাপ থেকে টেবিলে খাওয়াদাওয়া করার ব্যত্যয় সেদিন ও ঘটলো না। তবে আমি বেশ বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি থেকে পালাতেই দাদার এ সিদ্ধান্ত।
ফের দেখতে দেখতে দাদার চলে যাবার দিনটিও চলে এলো। শুধু আমি তাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসতে গেলাম। অরু যেন একটু কাঠকাঠ হয়ে রইলো দাদার সাথে, তাই এবার সে আর গেলো না সি অফ করতে। বেশি বয়সের পিএইচডি ডিগ্রীধারী স্বামীর মুখের ওপর কিছু বলতে না পারলেও তার এই সংসারের প্রতি দায় এড়িয়ে পালিয়ে যাবার মানসিকতাটাকে অরু যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।