ভালোবাসা ১২তম_পর্ব

0
663

ভালোবাসা
১২তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

দাদা চলে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের মুখভার। এই দুঃসময়ে যে তার বড় সন্তান পাশে না থেকে এরুপ আচরণ করবে তা যেন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। বিলেতে গিয়ে দাদা কল করলেন কিন্তু মা তার সাথে কথা বলতে চাইলেন না। আমি আর অরু কথা বলে মার প্রসঙ্গটা যেন দাদাকে খুব বেশি না ভাবায় সেই চেষ্টা করলাম।

কি এক অদ্ভুত নিয়মেই যেন মাকে সামলানোর দায়িত্বটা অরু আর ব্যবসা দেখার দায়িত্বটা আমি ভাগ করে নিলাম। অল্প ক’দিনেই মা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। রান্নাবান্না আর অরুর সাথে গল্পে যেন বেশ ভুলে থাকতে চাইছিলেন পারিবারিক সব দুঃখ। আমিও মাঝেমাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে অরুর সাথে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি আর মায়ের আদরের ভাগ কমে গেছে আমার…বলে কপট অভিমানে গাল ফুলিয়ে মাকে ব্যস্ত রাখতে চাইতাম। অরুকে সবটা আগে থেকে না বলা স্বত্তেও সে বুঝে নিয়ে আমায় বেশ সঙ্গ দিতো।

অদৃশ্য একটা টিউনিং হয়ে গেছে আমার আর অরুর মধ্যে। যা কিছু করি তার ভারসাম্য যেন বজায় থাকে সে জন্য দু’জনেরই সমান অংশগ্রহণ চলে। সংসারের অলিখিত কর্তা আর কর্তী হয়ে উঠলাম আমরা।

ওদিকে আমাকে ব্যবসায় দেখে কিছুটা অবাক হলেও ড্রাইভার থেকে শুরু করে বাদবাকি কর্মচারীরা সকলেই মালিকের ছেলে বলে বেশ সমীহ করতে লাগলো। তারাও যেন বুঝে গেছে যে আমিই তাদের ভবিষ্যত বস…ভেবে একা থাকলেই হাসি পায় আমার আজকাল। বয়সে অনেক সিনিয়র যারা তারা বেশ স্নেহ করতে লাগলেন। এই এতটুকু বয়সে লেখাপড়া ছেড়ে যে কাজে আসতে হয়েছে আমাকে, তার জন্যে আমার প্রতি মায়া তাদের চোখে ভালোই দেখতে পেতাম। তারা বেশ বুঝতে পারতো যে, কতটা বাধ্য হয়ে আমায় এ দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে হয়েছে।

বাবার পরিচিত কাজের সুবাদে বন্ধুত্ব ছিলো যাদের সাথে, তারা সকলেই বেশ আপন করে নিলেন। রহমান চাচাও তাদের মধ্যেই একজন। উনার বাড়িতে প্রায়ই ডেকে নিতেন আমাকে। কাজ বোঝাতেন, কাজ শেখাতেন…উনার সাথে কথা বলে সব সহজ মনে হতে লাগলো আমার কাছে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে যখন মনে হচ্ছিলো যে আমার মাথার উপর আর কোন ছায়া রইলো না, ঠিক তখনই যেন রহমান চাচা তার স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় দিলেন আমায়। বাবা যেমন বটবৃক্ষের মতন আগলে রাখতেন, রহমান চাচাও তেমনি বলতেন… আমার কাছে আজাদ যেমন, তুমিও তারচেয়ে কিছু কম নও।

চাচার ছেলে আজাদের সাথে আমার এখন গলায় গলায় বন্ধুত্ব। সে অবশ্য বলে ভাইভাই ইয়ার। ঈদ, পূজো আমরা এখন দুজন দু’জনকে ছাড়া ভাবতেই পারিনা। তার সাথে অনেক কথা অবলীলায় বলে ফেলতে পারি। শুধু অরুর প্রসঙ্গটা ছাড়া সে বলতে গেলে প্রায় সবই জানে আমার ব্যাপারে।

ব্যবসায়িক কাজে জড়িয়ে গিয়ে কিন্তু আমি অরুর কথা একটুও ভুলে থাকতে পারিনা। আমার ঠিকঠাক মনে থাকে কবে ওর কোন এক্সাম, ক্লাস আছে কিনা, নোটস কালেক্ট করা হয়েছে কি হয়নি…টিউশন লাগবে কিনা সেটাও জানতে চেয়েছি বহুবার, সে যাতে টাকার সমস্যা ভেবে সংকোচ না করে আমাকে বলতে পারে তাই নিজে থেকেই খোঁজখবর রাখি।

পড়ালেখা ছেড়েছি দেখতে দেখতেই দু’বছর পার হয়ে গেলো। সময় বহতা নদীর মতো বয়ে চলে নীরবে তার নির্দিষ্ট নিয়মে। দাদা এর মধ্যে বার তিনেক এসেছেন। তার হাবেভাবে যা বুঝলাম বিদেশে সেটেল করবেন বলেই মনস্থির করে ফেলেছেন বোধহয়। অরুর গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতেই নিয়ে যাবেন হয়তো…

সে দিনটি যখন আসবে তখন আমি নিজেকে কি করে সামলাবো…ভাবতেই ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমার অরুকে আমি একটি দিন ও না দেখে থাকতে পারবো না। চিরকাল সে আমার চোখের সামনে যাতে থাকে তা ভেবেইতো আমি তাকে বাড়ির বৌ করে আনতে চেয়েছিলাম, আর আজ সে কোথায় থাকবে না থাকবে সে ব্যাপারে কথা বলবার আমার কোন অধিকার নেই!!! সব সিদ্ধান্তই তার স্বামীর, মন্ত্রপাঠে বোধহয় ভালোবাসার চাইতেও বেশি জোর থাকে… দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি আনমনে বসে ভাবি।

মাঝেমধ্যে যখন ব্যবসায়িক কাজ সেরে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে যায় তখন অরুই দরজা খুলে ভাত বেড়ে দিয়ে সামনে বসে থেকে গল্প করে। আমি খেতে খেতে ওর হাত নেড়ে নেড়ে কথাবলার সময় মুখ চোখের এক্সপ্রেশন দেখি। ভীষণ ভালো লাগে তখন অরুকে। মনে হয় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আর দেখতেই থাকি। নিজের অজান্তেই হয়তো খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি অপলকভাবে, তখন অরু থেমে গিয়ে ইশারায় জানতে চায় কি হলো!!! আমি মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বুঝিয়ে দেই কিছু না…কিন্তু আমার মন জানে অনেক কিছু হয়ে গেছে, দাদার অনুপস্থিতি যেন তোকে আরো বেশি আমার ভাবতে বাধ্য করে।

তোর অনার্সের বই, ক্লাস, পরীক্ষা, রেজাল্ট, বন্ধুবান্ধব সবই আমার নখদর্পনে যেন থাকে। তোকে একা ছেড়ে গেছে দাদা, কিন্তু আমিতো শত কাজের মাঝেও তোকে ছাড়তে পারিনি কিংবা যদি বলি ছাড়তে চাইনি তবুও ভুল বলা হবে না। আর সব দায়িত্বের মাঝে তোর দায়িত্বটাও আমি ভালোবেসে নিয়েছি। উৎসবে পার্বণে যখন আমরা একসাথে কেনাকাটা করি তখন কেউ ভুল করে তোকে আমার বৌ ভেবে নিলে এক মূহুর্তের জন্যে যেন আমিও ভুলে যেতে চাই, তোর সাথে সম্পর্কের অধিকার কতখানি আছে আর কতখানি নেই।

ব্যবসায়িক কাজ করতে গিয়ে যে ক’জন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের মধ্যে সুজন, আজাদ আর তার মামাতো ভাই জহিরকে আমার বেশ আপন মনে হয়। এদের সাথে প্রায়ই আড্ডা দেওয়া হয় আর সুজন মাঝেমধ্যেই বিচিত্র সব জায়গায় নিয়ে গিয়ে জীবনের রং চেনাতে চায়। যদিও সেসব জায়গায় যাওয়ার আমাদের বাকিদের কোন আগ্রহ থাকেনা। সুজন হেসে বলে…তোরা বাচ্চাই থেকে গেলি, না মদ… না মেয়েমানুষ…কি ডাল-ভাত জীবন তোদের!

মেয়েমানুষ কথাটা শুনেই অরুর হাসিমাখা চেহারাটা যেন মনে পড়ে…আমার জীবনতো এই একজনেই বাঁধা। হঠাৎ আনমনা দেখে সুজন আবার জিজ্ঞেস করে, কি অত ভাবছিস!!! আমি অট্টহাসি দিয়ে বলি, একজনকে পেয়েও না পাওয়ার মতো অবস্থায় থেকে সিগারেট ধরেছি…আর কারো কাছে যাওয়ার সাহস নেই আমার।

ওরা সকলেই যেন মজা পেয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু কেউই জানেনা যে আমি ভেতরে ভেতরে অহর্নিশি পুড়ে মরছি। দাদা অরুকে চিরতরে নিয়ে যাবে সে ভয় যেন আমায় জ্বালিয়ে মারছে। কত রাতে যে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে আমার তার ইয়ত্তা নেই…

আমার হাত ছুটে যাচ্ছে অরুর হাত থেকে আর দাদা তাকে নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে এয়ারপোর্টে। বুক ধরফর করে ঘুম ভাঙলে আমার। মনে হয় এক ছুটে গিয়ে অরুকে জড়িয়ে ধরি। ফের সকালে অরুর মুখ দেখা অব্দি আর শান্তি থাকেনা মনে। ভোরে অরু ঘরের দরজা খুলতেই হাজির হই তার সামনে। সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবি আমায়? আমি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে না বোধক জবাব দেই। তার মুখ দর্শনেই যেন আমার প্রশান্তি।

একবার ব্যবসায় বেশ লাভ হওয়ায় ভাবলাম মা আর অরুর জন্য কিছু কিনি। মার জন্য সোনার হার আর অরুর জন্য হাতের বালা। তারপর মা’কে তো দিতে পেরেছিলাম কিন্তু অরু কি ভাববে ভেবে আর দেয়া হয়নি। ইচ্ছে করছিলো বালা-জোড়া যেন নিজ হাতে পরিয়ে দেই ওর হাতে।

কখনো কখনো মনে হয়, দাদা না থাকায় যেন আমি ভুল ভাবনাতেই মজে আছি। তোকে এভাবেই সারাজীবন আমার পাশে দেখার সুখ-স্বপ্ন থেকে তাই আর বেরুতে পারছিনা। পূজোয় যখন সুজনের আবদারে ওদের বাড়ির নেমন্তন্নে গেলাম। তখন ও বারবার তোর কথা মনে পড়ছিলো। সুজন কি বুঝলো জানিনা, সে বললো বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম কিন্তু। তুই গিয়ে আবার আয় তবুও এমন অস্থিরতায় ভুগিস না।

আমি বাড়ি গিয়ে তোকে হড়বড় করে কি বোঝালাম কে জানে, তুই রাজি হয়ে গেলি সাথে আসতে। একটা মেরুন রঙের শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে মার কাছে গেলি চুল আঁচড়ে নিতে। আমি সেই ফাঁকে পাঞ্জাবি বদলে আমার পুরনো মেরুন রঙের সিল্কের পাঞ্জাবিটা পড়ে নিলাম। তোর সাথে মিল করে পোশাক পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। লোকে যখন ভুল করে আমাদের কাপল ভেবে নেয় তখন যেন আমিও খানিকটা স্বান্তনা খুঁজে পাই। সত্যিকারের ঘর বাঁধা তো আর সম্ভব নয়, তাই লুকোচুরির সংসারটাই নাহয় করতে দে আমায়।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here