ভালোবাসা ১৩তম_পর্ব

0
588

ভালোবাসা
১৩তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

সুজনদের বাড়িতে নেমন্তন্নে আসা অনেকেই যখন অরুর খুব প্রশংসা করছিলো তখন আমিও কিন্তু আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলাম অরুকে। কত সুন্দর যে লাগছিলো তাকে, ঠিক যেন নতুন বৌ। প্রতিমার মতো মুখখানি তার স্নিগ্ধ ভোরের মতন সতেজ।আমার প্রফুল্ল চিত্তের খবর আর কেউ না জানলেও সুজনের চোখ এড়াতে পারেনি ঠোটের কোণে লেগে থাকা হাসির রেখাটুকু। আর তাই কাকিমা যখন বলতে নিলেন, বিজু তোমার বৌকে একটা উপহার দেবো ভাবছিলাম…ঠিক তখনই সে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলো, বৌদিকে? ও আচ্ছা…আমি ডেকে দিচ্ছি।

সুজন ফের অরুকে ডেকে এনে তার মার সামনে হাজির করলো। সে ওদের বাড়ির মেয়েদের সাথে খাতির জমিয়ে নিয়েছিলো। আলাপ শেষ করে তাই ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। অরুকে বলতেই সে বললো, আমি কি করবো বল…ওরা যেন ছাড়তেই চাইছিলো না।

আমি বুঝতে পারছিলাম যে, অরুর খুব খাতির হয়ে গেছে সুজনদের বাড়ির বৌ-ঝি’দের সঙ্গে। অত রাতে ট্যাক্সি না পেয়ে তাই বেশ খানিকটা পথ হাটতে হলো। আমি বললাম, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে নারে?

তুই হেসে বললি, আমার কষ্ট হলে তো তোর ও কষ্ট হবার কথা…পথ তো দুজনের জন্যে একই।

খুব সাধারণ কথা যার অর্থ ও সাধারণ কিন্তু আমি তখন সবকিছুই যেন অন্য সুরে শুনি। তাই মনে মনে বললাম, ঠিক বলেছিস তোর কষ্ট হলে আমারও কষ্ট হয়…আর পথ দু’জনের এক হলেতো ভালোই হতো কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব!

অটো পেয়ে যেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। শাড়ি পড়ে হাঁটতে যে তোর খুব কষ্ট হচ্ছিলো তা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। সেই রাতে রাস্তার নিওন বাতির আলো আঁধারির মাঝে তুই আর আমি যখন অটোতে করে বাড়ি ফিরছিলাম তখন বাতাসের তোড়ে তোর চুল এসে যেন ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো আমার মুখ-ঠোট। ভীষন ভালো লাগছিলো জানিস, মনে হচ্ছিলো এই পথ যেন শেষ না হয়। এভাবেই অনন্তকাল আমি তোর পাশে বসে থাকি।

ফের অটো যখন ব্রেক কষে বাড়ির সামনে থামলো তখন হোঁশ ফিরলো আমার। ভাড়া চুকিয়ে ঘরে ঢুকে নিজের রুমের পড়ার টেবিলের সাথের ফিক্সড ড্রয়ারটা খুলে বের করে আনলাম সেই বালা জোড়া। মন চাইছিলো আজই পড়িয়ে দেই তোর হাতে। কিন্তু কিছু একটা যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকছে, সেটা কি তা আমার জানা আছে আবার জানা নেই…যা মস্তিষ্ক জানে কিন্তু মন মানতে চায়না তাকে এর বেশি ভালো আর কি বলবো বুঝতে পারি না।

অরু বোধহয় খুব টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলো তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি গোটা রাত আর ঘুমুতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিলো এভাবে আর কতদিন পারবো নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে। অরুকে যে আমি কতখানি ভালোবাসি তা না বলতে পেরে যেন দম আটকে মরছি প্রতিনিয়ত। এক একদিন মনে হতো আজ বলেই দেই, অভিনয়ের বন্ধুত্ব আর রাখতে পারছি না। অরু তো শুধুই আমার বন্ধু নয়, অরু আমার ভালোবাসা।

সকাল হতেই আবার সব আগের মতন। রোজকার স্বাভাবিক নিয়মেই আমি মায়ের খোঁজখবর নিয়ে, একসাথে নাস্তা করে, অরুকে দিয়ে আসার সময় বাজার করে ফের কাজের জন্যে বেরিয়ে পড়ি। দুপুর নাগাদ অরুকে আনতে যাই, তারপর তাকে নিয়ে এসে লাঞ্চ করে কখনো বেরুনো হয় কখনো বেরুই না। বিকেলটা হয় বাড়ির ছাদে, নয়তো সেই বন্ধুদের আড্ডায় কাটে। আর নাহয় কাজের মাঝেই পার হয়। সন্ধ্যেবেলা খাটে শুয়ে শুয়ে অরুর পড়া শুনতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। ডিনার টেবিলে মার সাথে কিছু কথাবার্তা আর অরুর নোকঝোঁক সব মিলিয়ে বেশ ভালোই যাচ্ছে জীবন।

ছুটির দিনগুলোতে বন্ধুরা মিলে দূরে কোথাও যাবার প্ল্যান হলে আমি একটু যেন উশখুশ করি না যাবার বাহানা দেবার জন্যে। সেটা বুঝতে পেরে আজাদ আমায় বলে, কি ব্যাপার বল তো…অন্য কোথাও প্রোগ্রাম আছে নাকি তোর?

আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে বলি, কি যে বলিস! আরে ধূর…একটা দিনই তো একটু রেস্ট পাই বাসায় থেকে ঘুমানোর জন্য।

জহির বলে উঠে, বিজয় তোর ভাবসাব কিন্তু সুবিধার না। মেয়েঘটিত কোন ব্যাপার-স্যাপার থেকে থাকলে আমাদের বল, যদি সমস্যা থাকে সমাধান করে নাহয় বিয়ের আয়োজন করি।

আমি শুকনো হাসি হেসে উড়িয়ে দেই সেসব। বলি, সুজনের সাথে থেকে থেকে তোদের মাথায়ও মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নেই।

আজাদ বলে উঠে, ভালোবাসার মানুষ থাকা কি খারাপ?

আরে মেয়েমানুষের ভালোবাসা ছাড়া কি কেউ বাঁচতে পারে না নাকি?…রাগটা যেন ওদের চেয়ে বেশি নিজের ওপরই আসে আমার। প্রশ্নটাও হয়তো তাই নিজেকেই করে বসি।

চলে আসি সেখান থেকে। বেরিয়ে গিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গোটা পথটুকু ভাবতে থাকি…রোজ তো অরুকে দেখি, তবু কেন দেখার তৃপ্তি আসেনা। মনে হয় যেন অতৃপ্ত হৃদয় আরো বেশি চায় অরুকে, চোখ ভরে মন ভরে দেখতে। একটা ছুটির দিন আলসেমি করে যখন সে একটু বেশি ঘুমিয়ে ওঠে, তখন যেন তাকে আরো বেশি আদুরে আহ্লাদী স্বভাবের জন্যে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

চায়ের কাপটা হাতে ধরিয়ে যখন সে ফিরে যেতে নেয় মন চায় তাকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসাই। এক কাপ চা দু’জনে ভাগ করে খাই। কাপটার ঠিক তার চুমুক দেয়া জায়গাটাতেই চুমুক দেই। সে লাজুক হাসি হেসে আমায় সরিয়ে চলে যেতে নিলেই তাকে আরো বেশি নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখি বাহুডোরে।এসব ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন চেয়ে দেখি সে মায়ের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প জুড়ে বসে হাসাহাসি করছে কিছু একটা নিয়ে। কি কথা বলছে তারা আমি তা আর শুনতে পাই না। যেন একটা ঘোরের মধ্যে আমার সময় কেটে যায়।

অরুর মায়া কিংবা মোহ যাই বলিনা কেন আমায় আচ্ছন্ন করে রাখে। নিজেকে মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে, মনে হয় যেন আমার জগতে অরু ছাড়া ভাবনার আর কিছু নেই। কোথাও ঘুরতে যাবার চেয়ে সারাদিন অরুর সাথে থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

কিন্তু অরুর বোধহয় তেমনটা লাগেনা, আর তাই সে প্রায়ই ছুটির দিনগুলোতে বন্ধু-বান্ধব নয় এসাইনমেন্ট আর নাহয় তার বাবার বাড়ি কোথাও না কোথাও গিয়ে কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকতে চায়।

অরুকে তার বাবার বাড়ি আমিই দিয়ে আসি। শুরু শুরুতে ওর মা আমাকে তেমন পছন্দ না করলেও এখন যেন বেশ বুঝে গেছেন যে, আমি সংসারের জন্যে কতটা করছি…আর তাই খুব খাতির যত্ন করেন। যদিও সেসবের আমার কোন প্রয়োজন ছিলো না, তবুও যেন জামাই-আদর ভাবতে বেশ অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে।

অরু না বললেও তার ছোট বোনদের জন্যে পূজোয় নতুন জামা কিনে দেই। সে নিতে ইতস্তত করলে বলি, আমার তো কোন ছোট-ভাইবোন নেই, কারোকে কি স্নেহ করে কিছু দিতে ইচ্ছে করেনা বল!

ওদের বাড়ি থেকে থেকে ফেরার সময় প্রায়ই দেখি পাড়া-প্রতিবেশি কেউ না কেউ আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে জানালার পাশ থেকে বলছে, অত পড়াশোনা করা ছেলে এমন নিচু ঘরের মেয়ে নিয়ে যে সংসার করবেনা সে আমাদের ভালোই জানা ছিলো। তাইতো বলি, জামাই কেন শ্বশুরবাড়ি আসেনা!

আরে এমন ভিখিরি মার্কা পরিবারে কি কোন ভদ্দরনোকের আপ্যায়ন হতে পারে।

সেজন্যেই তো বারো ক্লাস ফেল দেবর আসে নিতে। ওদের সাথে এমনই যায়… লজ্জায়, অপমানে অরু মাথা নিচু করে ফেলে। আর আমি চুপচাপ সব হজম করতে করতে ভাবি যে, দাদা আর কত ছোট করবে আমাদের সবার কাছে।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here