ভালোবাসা ১৪তম_পর্ব

0
524

ভালোবাসা
১৪তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

আজ অরু আমায় খুব জোর করে তার শিক্ষা সফরে নিয়ে চললো। শিক্ষা সফর না বলে বনভোজন বলাই ভালো, এসব ইভেন্টে এলে আমি খুব অস্বস্তিবোধ করি। একেতো আমি অরুরই বয়সের হওয়া স্বত্ত্বেও আমার শিক্ষাদীক্ষার বালাইষাট, তার ওপর আবার যে কেউ সামনে এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলে অরু দেবর বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। অরুর মুখে দেবর শুনলে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।

অবশ্য অরুকে দোষ দিয়ে কি লাভ…বন্ধুও তো সে বলতে পারেনা, কারণ আমি ওদের সাথে পড়িনা। আবার পুরনো বন্ধু বললে লোকে ভিন্ন কিছুও ভাবতে পারে। শত হলেও সে বিবাহিতা আর তাই সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু এমন কোন সম্পর্ক রাখতে নেই তার।

এসব পিকনিকে গিয়ে নিজেকে গোবেচারা টাইপ কিছু একটা মনে হয়। বোকা বোকা হাসি দিয়ে যেন সবার সাথে কথা বলতে হয়। অরুর ধারণা সে আমার খুব ভালো হাওয়াবদল এর ব্যবস্থা করে, সেসব জায়গায় নিয়ে গিয়ে। অথচ হয় তার উল্টো, আমি বরং ভাবতে থাকি কতক্ষণে এখান থেকে বেরুতে পারবো।

পড়ালেখা ছেড়ে দেবার পর থেকে আর শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় গিয়ে অপ্রস্তুত হতে ভালো লাগেনা আমার। কিন্তু অরুকে সেসব কে বোঝাবে! আমি নিজ থেকে কিছু বললে ভাববে দুঃখ করছি, লেখাপড়া করবার জন্যে বুঝি আমার আফসোসের শেষ নেই…

এমনভাবে এসে বলে যে, বিজু তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো? সেখানে গেলে দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে তোর…

শুনে খুব হাসি পায়, আমি অবাক হবার ভান করে বলি…তাই নাকি! মন ভালো করার মতো জায়গা! তুই সেরকম কিছু চিনিস! ফের হাসতে থাকি।

অরু গোমড়া মুখে বলে, নাহ…আমিতো কিছুই চিনিনা, সব তুইই চিনিস।

আচ্ছা, আমার মন খারাপ তোকে কে বললো বলতো?…জানতে চাইলাম আমি।

তুই এত কাজ, দায়িত্ব সব ঘাড়ে চেপে যে খুব সুখে নেই তা বেশ ভালো করেই জানি…একটু গম্ভীরমুখে যেন বললো অরু।

আমি কথা কাটাতে বলি, যাবো ঠিক আছে কিন্তু তোর বন্ধুবান্ধবদের সাথে আবার বন্ধুর মতন মিশতে বলিস না…ওদের সাথে কথাবলার মতো কিছু খুঁজে পাইনা আমি।

ফের মনে মনে বলি…আমার এখন টেস্ট চেঞ্জ হয়ে গেছে। সুজন, আজাদ, জহির এরাই প্রাণের বন্ধু। যদিও সুজন মনে হয় অনেকটা বুঝে ফেলেছে অরুর ব্যাপারটা। কিন্তু সে খুব বুঝদার পাব্লিক তাই হয়তো কথাটা তুলে আমায় লজ্জা দিতে চায়নি।

ঈদে একবার রহমান চাচার বাসায় খুব করে যেতে বলায় আমি মাকে বলি, মা…চাচী কিন্তু সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছেন…তুমিও চলো না।

মা বললেন, আমার এখন আর কোথাও যেতে ভালো লাগেনা রে বিজু…তাই আমাকে আর জোর করিস নে। যতদিন তোর বাবা ছিলো গিয়েছি এখন বরং তোরা যা। আমি বাড়িতেই ঠিক আছি।

অগ্যতা আমি অরুকে নিয়েই গেলাম দাওয়াতে। রহমান চাচার পরিবার সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের চিনে। বাবার ব্যবসায়িক সূত্রে পরিচয় হলেও এতবছরে বেশ পারিবারিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। দাদার বিয়েতেও এসেছিলো তাই অরুকে দেখেই চিনতে পারলেন।

আজাদ ভাবী ভাবী করে বেশ মেহমানদারির নজির স্থাপন করতে চাইলে অরু হেসে বলে, আমি কিন্তু বলতে গেলে ঘরেরই লোক আর সম্পর্কে ভাবী হলেও বয়সে অত মুরুব্বি নই তাই আমায় বরং অরু বলে ডাকলেও চলবে।

আজাদ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বলে, তা কি হয়!!! আম্মি আব্বু শুনতে পেলে কান মলা খাওয়া থেকে আর নিস্তার নেই।

জহির বলে উঠে, ভাবী আপ্যায়ন কিছু কম হলে কিন্তু ফুপাজি আমাদের আস্ত রাখবেন না…ঈদ বলে কথা।

ওদের ওখান থেকে বের হওয়ার সময় আজাদ যেন ইচ্ছে করেই বেশ জোরালো কন্ঠে বলে উঠে, বিজয় তোর ভাবীকে নিয়ে আবার আসবি কিন্তু।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারি সে কিছু একটা নিরীক্ষণ করছে আমার চেহারায়।

হয়তো ধরা পড়ে গেছি আমি…সুজনের মতো আজাদের কাছেও। আসলে কথায় আছে না ইশক অর মুশক লাখ ছুপায়ে নেহি ছুপতে। প্রেম কিংবা ভালোবাসার আবেগ-অনুভূতি সে তো লুকিয়ে রাখা যায় না। বন্ধুদের কাছে তো একদমই না।

তবে আরো বড় রকমের ধাক্কাটা খেলাম তখন যখন দাদা আসার আগের দিন রাতে হঠাৎ করেই খবরটা পেলাম। নিজের আবেগকে যতটা সংযত রাখতে পারবো ভেবেছিলাম, ঠিক ততটাই যেন আমি ভেঙে পড়লাম। কষ্টে যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো আমার। সেদিন কাজ শেষে তাই বাড়ির পথ ভুলে যেন কি এক যন্ত্রণা ভুলতে মদের আড্ডায় গেলাম। এত বেশি ড্রিংক করলাম যে নিজেকে নিজেরই বদ্ধ মাতাল মনে হতে লাগলো। আমার রক্ত বর্ণ চোখ দেখে সুজন কি বুঝলো কে জানে সে আমাকে নিয়ে আমাদের পুরনো আড্ডায় গিয়ে আজাদকে কল দিলো।

আজাদ আসতেই ওদের কথাবার্তায় যা বুঝলাম, ওরা দু’জনেই বেশ চিন্তিত আমাকে নিয়ে। এত রাতে কেউই এই অবস্থায় কারো বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে না। সুজন আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলো, আমি সেখান থেকে উঠে ঢুলতে ঢুলতেই ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম…আমি বাড়ি যাচ্ছি, তোরা থাক।

আজাদ আমার পথ আটকে বললো, একা যাওয়ার মতো অবস্থায় আছিস তুই?

আমি বললাম, এখনো যথেষ্ট ব্যালেন্স ঠিক রেখে হাঁটতে পারছি বুঝলি…

সুজন আজাদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ওকে ওর বাড়িতেই দিয়ে আসি চল…ঘুমিয়ে গেলে সকাল নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে।

আমার যেন হঠাৎ জেদ চেপে গেলো তাই বললাম, আমি ঘুমাবো না…সব বলে দেবো…আজ সব বলা থেকে কেউ আমায় থামাতে পারবে না।

সুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, কি বলবি আর কাকে বলবি তুই?

অরুকে বলবো যে পাগলের মতো ভালোবাসি তাকে…বললাম আমি।

আজাদ বললো, তুই সত্যিই একটা বদ্ধ উন্মাদ। নইলে দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে ভাবীর প্রেমে পড়তিনা…ছি বিজয় ছিহ, তোকে বন্ধু ভাবতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে।

আজাদের কথায় বিজু হু হু করে কেঁদে উঠতেই সুজন বললো, আজাদ প্লিজ এভাবে ওকে আঘাত দিয়ে কথা বলিস না…বেচারা এমনিতেই হোঁশে নেই তার উপর আবার তুই যদি এসব বলিস!!!

আরে তুই নিজেই একবার ভেবে দেখনা, শালা নিজের ভাইয়ের বৌকে প্রেম নিবেদন করতে চায়…মানে! কি আর বলবো…বললো আজাদ।

ওর ভালোবাসাটা কিন্তু সত্যিকারের, মানুষটা হয়তো ভুল কিন্তু ওর কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই…যেমনটা তুই ভাবছিস, আজাদের উদ্দেশ্যে বললো সুজন।

দাদা চলে আসার আগেই আমি ওকে বলবো এরপর যা হওয়ার হবে…আসুক দাদা…আমি বলবোই।

আজাদ আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, সে তোকে ভালোবাসেনা বিজয়…তোর ভাবীর ভালোবাসা তোর ভাই, তুই না।

বিজু দুই হাতের তালু দিয়ে কান চাপা দিতে নিলে আজাদ তার হাত সরিয়ে বলে, আজ তোকে শুনতেই হবে। বাস্তবে ফেরত আয়। আরে একজন বিবাহিতা মহিলার জন্যে প্রেমের প্রস্তাব পাওয়া তাও আবার নিজেরই বন্ধু সমতূল্য দেবরের কাছ থেকে, কতটা অসম্মানের তা তুই জানিস!!!

সুজন বলে উঠে, ওকে ছেড়ে দে আজাদ। আজকের মতো যথেষ্ট বলেছিস তুই। এমনিতেই বেচারা কষ্ট পাচ্ছে, ওকে আর দুঃখ দিস না।

আজাদ বললো, সে নিজে থেকেই এসব ঘোট পাকিয়েছে…এখন ভুগতে তো হবেই।

সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, সবকিছু কি আর মানুষের হাতে থাকে…মনের অজান্তে কত কিছু ঘটে যায়।

তারপর বললো, তুই গিয়ে দিয়ে আসতে পারবিনা ওকে। আমিতো কখনো ওদের বাড়ি যাইনি, হঠাৎ গেলে কি না কি ভাবে। আর তাছাড়া আমার বাড়ি ফিরতে পরে বাস পাবো না তাই বলছিলাম।

ফের আজাদ বললো, বিজয়কে দিয়ে আসতে পারবো ঠিকই…কিন্তু এরপর ও শালা কি করবে তা ভেবেই তো ভয় পাচ্ছি।

#চলবে

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here