ভালোবাসা
১৭তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
বিকেলের দিকে অরুর বাবা-মা আর তার ছোট বোনেরা এলো। ওদের আগমনে আমাদের বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। দাদা সবার সাথেই বেশ খুশিমনে আজ কথা বলছেন। একটু বেশিই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলেন, যেন বহুদিন পর মন ভরে কথা বলছেন। কথাবার্তার একফাঁকে ইশারায় অরুকে সংকেত দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। ফিরে আসতে নিতেই দেখলাম, তার আর অরুর হাতভরা উপহার সামগ্রী। মনে করে করে, প্রত্যেকের নাম লেখা প্যাকেট হাতে তুলে দিলেন।
গিফট পেয়ে অরুর ছোট বোন মিরু আর তরু ভীষণ খুশি হলো। দাদা যে এবার সকলের কথা মনে করে এত গুছিয়ে সব এনেছেন তা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। এই দাদা যেন সেই দাদা নন, সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি গোছানো আর পরিপাটি হয়েছেন। সবার মন জয় করে নিলেন তাই অল্প সময়েই। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কেউ একদিনেই যুদ্ধ জয় করে আর কেউ কেউ আমার মতো গোটা জীবন ব্যয় করেও কারো প্রিয় হতে পারেনা।
অরুর মাকে দেখে খুব প্রসন্ন মনে হলো। মেয়ে জামাইয়ের একটু যেন বেশিই প্রশংসা করছেন আজ।
ফেরার সময় আগামী পরশু দুপুরে তাদের ওখানে যাওয়ার জন্যে নেমন্তন্ন করে গেলেন অরুর বাবা। জোড় দিয়ে বলতে লাগলেন যেতে কিন্তু হবেই, অরুর বড় তিন দিদি আর জামাইবাবুরাও নাকি আসবে সেদিন।
দাদা হাসিমুখে মেনে নিয়ে বললেন, অবশ্যই যাবো।
ফের আমাকে বলতেই আমি বললাম, দেখি যদি কোন কাজ না থাকে…তবে যেতে আপত্তি নেই।
আমার কথা শুনে অরুর মা বললেন, পরশু তো ছুটির দিন আর সেজন্যই ঠিক করা…ওর বড় জামাইবাবুদের অফিস নেই বলেই সেদিন ডেকেছি।
আমি ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দিয়ে তারপর বললাম, বিজনেসম্যানদের ছুটির দিন বলতে তো কিছু থাকতে নেই।
মা উনাদের রাতে খাওয়াদাওয়া করে যেতে বললেন বহুবার। অরুকেও বললেন, অরু মা…আমার কথাতো উনারা শুনছেন না, তুইই বল না তোর বাবা-মাকে।
অরু হেসে বললো, অতটা পথ যাবেন তারা আবার মিরুর সামনে মাধ্যমিক আছে…আজ থাক মা, পরে কোনদিন নাহয় আবার এলো।
তরু বললো, মাসিমা দিদিকে বলে কোন লাভ নেই…এই মিরুদিটার জন্যে কোথাও গিয়ে যেন আমাদের শান্তি নেই। কি যে গোল্লা মারবে পরীক্ষায় তা ভগবানই জানেন।
মিরু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই তরু ভয় পাওয়ার ভান করলে, সকলেই হেসে উঠলো তাদের খুনসুটি দেখে।
অরুর মা ওদের থামিয়ে মায়ের কাছে এসে বললেন দিদি মিরুটার জন্যে খুব দুশ্চিন্তা হয়…পড়ে ভালোই তবে স্মরণশক্তি কম, আশীর্বাদ করে দিন যাতে ভালো ফল করে মাধ্যমিকে।
মা ফের মিরুর মাথায় হাত রেখে বললেন, সব ভালোই হবে দেখো।
মিরু হেসে বললো, ওদের বলে কি হবে…কারো বিশ্বাসই নেই আমার প্রতি।
অরুর মা আর কথা বাড়ালেন না, মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার সময় বারবার করে যেতে বলে চলে গেলেন সন্ধ্যে নাগাদ।
সাথে মিরু আর তরু রয়েছে তাই তাদের খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসলাম আমি। অরুর বাবা একটা ধন্যবাদ সূচক হাসি হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর আমায় বললেন, ভালো থেকো বাবা আর ওদের সাথে এসো কিন্তু।
আমি তার জবাবে শুধু একটু হাসলাম আর মিরু তরুর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বায় দিলাম।
ঘরে ফিরতে এখন আর মন চাইছে না। তাই অগ্যতা হাঁটা ধরলাম বন্ধুদের খোঁজে। আজাদের বাড়ি কাছেই তাই সেখানে গিয়ে দরজায় নক দিতেই চাচী এসে দরজা খুলে দিলেন। ফের আমি কুশলাদি জিজ্ঞেস করে আজাদকে ডেকে দিতে বলতেই আমায় বললেন, আরে এসো এসো…দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি!!!
আমি হেসে বললাম, অসুবিধে নেই…আমরা তো বাইরে কোথাও আড্ডা দেবো।
উনি বললেন, আজাদ কিপটেটা তোমায় কোনদিন কিছু খাওয়ালে তো…খাওয়াদাওয়া করে যাবে আজ। আড্ডা নাহয় ঘরেই দিলে, যাও যাও ওর ঘরে গিয়ে বোসো।
অগ্যতা আমাকে জুতো খুলতেই হলো। ওর ঘরে গিয়ে দেখি এই অবেলায় শুয়ে আছে, আমাকে দেখে উঠে বসলো। তারপর দু’জনেই চুপচাপ…কে কতক্ষণ নীরব থাকতে পারে, মনে হলো যেন তা দেখার বাজি ধরেছি আমরা। কে আগে কথা বলবে আর কি বলবে তা ভাবতে নিয়েই আমি অস্থিরতায় ভুগছিলাম। আজাদ বেশ ঠান্ডা মাথার ছেলে তাই সে নিচু স্বরে বললো, ছাদে চল…ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা।
আজাদদের ছাদের চারদিকে নারকেল গাছ। শীতল বাতাসে যেন মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। আশেপাশের কারো বাসার ভেতর থেকে ওস্তাদ রাহাত ফতেহ আলি খা’র গজল ভেসে আসছিলো, খুব মৃদু সুরে শোনা যাচ্ছিলো কানে তাই সবমিলিয়ে পরিবেশটা আমার বেশ ভালো লাগছিলো। আমি মনে মনে আজাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম। আর তার প্রকাশ স্বরুপ একটা সিগারেট আজাদের দিকে বাড়িয়ে লাইটার ধরিয়ে নিজেও একটা টেনে নিলাম।
আজাদ সিগারেটে একটা টান দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, সব ঠিক আছে তো?
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।
সে আমার দিকে ফিরে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলো…আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো তাই বললাম, তুই কি জানতে চাস সরাসরি বল?
আমি কি জানতে চাই তা তো তুই ভালো করেই জানিস বিজয়…তোর বলতে কষ্ট হলে, হ্যাঁ আর না তেও জবাব দিতে পারিস।
জবাব দেয়াটা যে অত সহজ নয় আজাদ। সব ঠিক আছে আবার নেই। আরো ভালো করে বললে বলতে হয়, সবাই ঠিক আছে কিন্তু আমি ঠিক নেই।
হুম…তুই যে ভুল পথে আছিস তাহলে তা বুঝতে পেরেছিস এখন?
যে পথে চলতে মন চায় সে পথ কি মানুষ বেছে নিতে পারে? কখনো কখনো পথই মানুষকে খুঁজে নেয়।
আজাদ আজ তর্ক করতে চাইলো না যেন…সে একটু সময় নিয়ে বললো, দেখ বিজয় আমি বন্ধু হয়ে তোর খারাপ চাইবোনা নিশ্চয়ই…তুই ওসব ভুলে যা। ভাবী তোর বন্ধু ছিলো বন্ধুই থাকনা, কেন শুধুশুধু নিজের এবং তার মধ্যে সম্পর্কটাকে জটিল করে তুলছিস!!!
আমি আর কিছু বললাম না, বুঝতে পারলাম কেউই আমার অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে পারবেনা। রাতে চাচা আসলে খাবার না খাইয়ে চাচী ছাড়লেন না। চাচার সাথে কথা বলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো। আজাদ বারবার বলছিলো রাতে থেকে যেতে। তার বোধহয় ভয় আমি না আবার গতরাতের মতো উল্টোপাল্টা কিছু করে বসি। আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম, ভয় পাসনে…বিজু নিজে শেষ হয়ে গেলেও কারো সম্পর্ক খারাপ হতে দেবেনা।
আজাদ হতাশ হয়ে আমার দিকে চেয়ে বললো, তোকে এত রাতে একা ছাড়তে চিন্তা হচ্ছে আমার। আরে তুই দুঃখ পেলে কি আমার কিছু যায় আসেনা ভেবেছিস!!! বন্ধু হিসেবে কি তোর জন্যে কনসার্ন থাকতে নেই?
আমার জন্যে ভেবে সময় নষ্ট করিসনা, আমার আর কিছু হবার নেই…বললো বিজয়।
বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে দেখি সবাই ডাইনিং রুমে আমার অপেক্ষাতেই যেন বসেছিলো না খেয়ে। দাদা উঠে এসে হাত টেনে বসাতে চাইলে আমি লজ্জায় পড়ে বললাম, আজাদদের বাড়ি গিয়েছিলাম আর চাচী না খাইয়ে ছাড়লেন না।
দাদা হেসে বললেন, কারো বাড়ি গেলে যে তুই কত খাস তা আমার ঢের জানা আছে…বোস আমাদের সাথে।
আমি বললাম শরীরটা ভালো লাগছেনা, ঘুম আসছে আমার…
দাদা বললো, ওসব বাহানা চলবেনা…অরু ওর প্লেটে খাবার বাড়ো তো আগে।
আমি ইতস্তত করেও কিছু বলতে পারছিলাম না।
ওকে যেতে দাও, খাওয়ার চেয়ে বেশি ঘুমের প্রয়োজন ওর, কাল থেকে আজ সারাদিন ছুটোছুটি করে একটুও রেস্ট পায়নি…বেশ স্পষ্ট স্বরেই বলে উঠলো অরু।
আমি বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইলাম অরুর দিকে।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ ।