ভালোবাসা ১৮তম_পর্ব

0
536

ভালোবাসা
১৮তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

নিজের বিছানায় শুয়ে খাটের এপাশ ওপাশ করতে করতে আমি ভাবছিলাম অরুর কথা। সে আমার অস্বস্তি, দ্বিধা, সংশয় সব কি করে এত সহজেই বুঝে ফেলে কে জানে…তার মতো কেউ কখনোই বুঝতে পারেনি আমায়। তাইতো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সেই হতে পেরেছে। নাকি আমাকে দূরে সরাতেই তার এমন কঠিন রুপ ধারণ। জানিনা আসলে কি চলছে অরুর মনে! তবে সে যেহেতু সব বুঝেও কিছু বলেনি আমায় তাই মনে করাই যায় যে তার কাছে হয়তো আমি অপরাধী নই।

এখনো কতটা খেয়াল রাখে… আমার যে কাল রাতে ঘুম হয়নি ভালো মতো, সকাল থেকে যে একটু দম ফেলার ও সময় পাইনি, জিরিয়ে নিতে না পেরে যে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা টেনে টেনে চলছি তা ও তার নজর এড়াতে পারেনি। ভালো তো বাসে, বন্ধুর মতো হলেও বাসে তো, এইটুকু স্বান্তনা নিয়েই যেন বিজুর চোখে ঘুম নেমে এলো।

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজে। ফের অরুর যে আজ ন’টায় ক্লাস ছিলো সেটা মনে পড়তেই হুড়মুড় করে উঠে বসে।
তারপর কোনরকমে বাথরুমে গিয়ে দাত ব্রাশ করে, মুখ হাত ধুয়ে, পোশাক পাল্টে রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো অরু নেই কোথাও। দাদা মার সাথে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে। আমার ঘুরে ফিরে এদিক সেদিক তাকানো দেখে বললেন, এসে বোস তো একসাথে নাস্তা করি।

আমি মার দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মা বললেন, অরু কলেজে চলে গেছে। কী নাকি ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে আজ। তুই ও বসে পড়, আমি নাস্তা দিয়ে দেই।

বাইরে কোথাও খেয়ে নেবো, দেরি হয়ে যাচ্ছে…বলে চললাম আমি।

মা বললেন, সে কিরে…সকালের নাস্তা এই এতবেলা উঠেও না খেয়ে চলে যাবি, কাল রাতেও তো কিছু খেলিনা!!!

দাদা বললেন, শুধু কাজ করলেই হবে…শরীরটা তো আর মেশিন নয়।

অফিসে নাস্তা আনিয়ে নেবো, এখন না গেলে অনেক লোকসান গুনতে হবে…কালকের হিসেব ও তো নেইনি।

বলে আর থামলাম না, বাড়ি থেকে বের হলাম। তারপর একটানা হিসেব পত্তর দেখতে আর সকলের কাছ থেকে জবাব নিতে নিতে কখন যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো সেদিকে খেয়াল করতে পারিনি। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই পড়িমরি করে দিলাম এক ছুট। তারপর যখন ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে ভীড় বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক অরুর কলেজের গেটের কাছাকাছি চলে এসেছি, তখনই যেন চোখে পড়লো একটু দূরে দাদা আর অরু ফুচকা খাচ্ছেন। দাদা নিজে খাচ্ছেন কম, অরুকেই খাইয়ে দিচ্ছেন বেশি। সাথে আরো কিছু ছেলেমেয়ে, অরুর বন্ধুবান্ধবই হবে হয়তো। হাসিঠাট্টা চলছে দেখেই জোর গুঞ্জন শোনা গেলো। দাদা মানিব্যাগ বের করে তাদের সকলের বিল মিটিয়ে দিতেই যেন সমস্বরে হইহই করে বাহবা দিতে লাগলো।

অরুর মুখে যেন গর্বিত একটা হাসি দেখতে পেলাম আমি। চেহারায় খুশির ঝিলিক আর লাজুক লাজুক মুখ করে খুব উপভোগ করছে সময়টাকে। আমি আর দাঁড়ালাম না, দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। দাদা তবে সকালেও বুঝি অরুকে কলেজে দিয়ে আসতে গিয়েছিলেন? অথচ কেউই আমায় বললো না। না মা, না দাদা…সবাই যেন আমার থেকে গোপন রাখতে চাইছিলো। ওরাও কি কিছু বুঝে গেছে!!! নাহ…সেটা হবে কেন, হয়তো এটা এতো বেশি স্বাভাবিক ঘটনা যে কেউ আর আমায় বলার প্রয়োজনই বোধ করেনি। কিংবা আলাদা করে বলার খেয়াল ছিলো না। হয়তো দাদা তার কাজ কমিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অরুর সব দায়িত্ব করতে যে তার ভীষণ ভালো লাগে। অরুর জন্যে যা কিছু করে তা তো সে ভালোবেসেই করে, তার একটুও কষ্ট হয় না। বরং তাদের মাঝে আর কেউ এলেই খারাপ লাগে তার…আচ্ছা অরুর কেন সকালে একবারও তাকে ডাকার কথা মনে হলো না? নাকি তাকে এখনো অবুঝ ভেবে মা আর দাদার মতো পাত্তা না দিয়ে সে করুণা করতে শুরু করেছে!

তার কারো দয়ার দরকার নেই…সে নাহয় ভালোবাসার পাগল কিন্তু সিমপ্যাথি দেখিয়ে তার আবেগের কমপ্যানসেশন করার চেষ্টা চলবে না।
অরু তাকে যা খুশি ভাবুক, সে তার মতো করে ভালোবেসেই যাবে। একতরফা হলে একতরফা। কিন্তু তার সত্য অনুভূতির আর অপমান সে সহ্য করবে না।

বাড়ি ফিরে যেতে আর ইচ্ছে করছিলো না। এখন গেলে অরু বুঝে যাবে যে সে কলেজেও এসেছিলো। তার ওপর মনটা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, তাতে ওদের এখনি আবার একসাথে দেখে মুখোমুখি হতে পারবেনা বোধহয়…অগ্যতা সে কাজেই ফিরে গেলো।

বিকেল নাগাদ সুজন এসে হাজির হতেই আমি যেন কাজের কথা শুরু করতে চাইলাম। সে আমায় দেখে কি বুঝলো কে জানে…হাতটা ধরে বললো, ওঠ তো ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার। চল গিয়ে একসাথে কোথাও বসে লাঞ্চ করে নেই। বাদবাকি আলাপ পরে হবে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোর এখনো লাঞ্চ হয়নি?

সে বললো, আমার তো হয়েছে…তবে বিজুর যে হয়নি সেটা তার শুকনো মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারছি।

আমি অফিসে আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। বললাম, চল…কিন্তু ডবল লাঞ্চ করে শোয়ার ব্যবস্থা অফিসে রাখিনি তাই ভেবেচিন্তে খাস।

সুজন ফিচেল হেসে বললো, শুতে চাইলে জায়গার অভাব হয়না রে পাগলা…

আমি কড়া চোখে তাকাতেই বললো, তোর মতো অনেস্ট রোমিওদের আজকাল খুব আকাল চলছে বুঝেছিস। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে যে কতজন যায় কত দিকে ভুলতে তা যদি তুই দেখতিস।

আমি ক্রুর হাসি হেসে বললাম, ভুলতে চাইলে হয়তো যেতাম কিন্তু এই নেশা যে কাটানোর চেয়ে বাড়িয়ে তোলাতেই বেশি আনন্দ লাভ হয় তা যদি তুই বুঝতিস।

সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, অতো বুঝে কাজ নেই আমার…তোর অবস্থা দেখেই শিক্ষা হয়ে গেছে।

আমি তাড়া দিয়ে বললাম, চল চল আর দেরি করলে একেবারে ডিনার সারতে হবে।

খাওয়াদাওয়া করতে করতে বিজনেস রিলেটেড অনেক কথাই হলো। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছিলো না তাই সুজনকে বললাম চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি। সে বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো আর তাই চুপচাপ রাজি হয়ে গেলো।

আমরা বালুচরে বসে নদীপাড়ের মানুষের কাজকর্ম দেখছিলাম। সুজন একহাতে আপনমনে ঘাস ছিড়তে লাগলো। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন সেই পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো…সমুদ্র সৈকতের সেই অস্তগামী সূর্যের লালিমার সাথে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। আজ ও অনেকটা সেদিনের মতো দাদা এসে যেন আমার এত বছরের রুটিনে হেরফের করে দিলো। যা কিছু শুধু আমার আর অরুর ছিলো তার সবই যেন দাদা এসে কেড়ে নিলো।

সুজন কি মনে করে হঠাৎ আমার কাধে একটা হাত রেখে আমায় যেন আগলে রাখতে চাইলো। আমার কি হলো জানিনা…আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম। সুজন আমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। কাঁদতে কাঁদতে একসময় যখন থামলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে প্রায় রাত নেমে এসেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে দাঁড়াতেই সুজন বললো, চল ফিরে যাই। এই অসময়ে না আবার বৃষ্টি নামে।

বাসে করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, সুজন ঠিক যেন আজাদের বিপরীত। সে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস ও করে না আর কারোকে তার বিচারের নিক্তিতে মেপে ঠিক-ভুল আর ভালো-মন্দের সংজ্ঞাও দাঁড় করায় না। যে যেমন তাকে সেভাবেই মেনে নিয়ে পাশে থাকে। কারো আবেগ অনুভূতিকে যথাযথ সম্মান করতে জানে, নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। বন্ধুরা না বুঝলে যে কতটা কষ্ট হয় তা সে গত দু’দিনেই বুঝতে পেরেছে। গত পরশু তো সেভাবে কথা হয়নি সুজনের সাথে, অথচ আজ কত কম কথা বলেও নিজেকে হালকা ফিল করছে। মন থেকে অনেকটা ভার কমে গেছে এমন লাগছে।

মদ খাক আর যাই করুক, সুজনের সবচেয়ে ভালো গুণ সে বন্ধুত্ব রক্ষায় সব করতে পারে। ঠিক-ভুল কিংবা ন্যায়-অন্যায়ের চাইতে তার কাছে যেটা সময়ের দাবি সেটাই সবার আগে। আজ যেভাবে তাকে সাপোর্ট দিয়ে তার পাশে থাকলো সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। আজাদের মতো কড়া কথা শুনিয়ে তার মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করে তো আর দেয়নি…

বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ফের একসময় তার মনে হলো যে, সে এসব কি ভাবছে! বন্ধুদের মাঝে তুলনা! দুজন মানুষ কি কখনো হুবহু একজন আরেকজনের মতো হতে পারে? দোষ-গুণ মিলেই তো মানুষ। আর কেউই পরিপূর্ণ নয়। সকলেরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। তবে সে কেন তাদের মধ্যে তুলনা করতে যাচ্ছে! কে বেশি ভালো নাহয় কে মন্দ এসব যাচাই করার কথা তার মনে আসলো কি করে! নাকি তার বিপক্ষে কিছু বললেই কেউ খারাপ হয়ে যাবে। তবে তার আর আজাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আজাদ যদি তাকে বিচার করাতে ভুল হয়, তবে সে ও আজাদকে সুজনের সাথে বিচার করায় সেই একই দোষে দোষী।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here