ভালোবাসা
২য়_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে পড়তে বসে অরুণিমা। তার সুর করে পড়ার শব্দ শুনতে ভীষণ ভালো লাগে বিজুর। পড়াশোনায় তো বরাবরই সিরিয়াস ছিলো অরু। কিন্তু তবুও কেন যে পরীক্ষাকে এত ভয় পায় কে জানে! এসব কথাই ভাবছিলো বিজু নিজের ঘরের খাটে শুয়ে। শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা তার আজকাল, যদিও সে বাড়িতে কারোকে কিছু বুঝতে দেয়না তবু একবার বোধহয় ডাক্তার দেখানো দরকার।
দাদা ফিরতে ফিরতে বেশ রাত করে। থিসিস এর কাজ চলছে ছাত্রদের, সেসব দেখে হয়তো। কথাবার্তা ও বিশেষ বলেনা কারো সাথে, অরুকে কিছু বলে থাকতে পারে। মানুষ বলতে ঘরে তারা এই চারটে প্রাণী। যদিও সংযোগ বলতে মা, অরু আর তার মধ্যেই যা আছে। দাদা যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতন, তাদের সাথে থেকেও কেমন ছন্নছাড়া।
দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে পড়ালেখার সুবাদে দূরে থাকার কারণে একটু যেন বেশিই নিভৃতচারী। প্রবাস থেকে দেশে ফিরে এসে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে শুধু ছাত্রদের সাথেই যা কথা বলতে দেখা যায় তাকে। বিয়ের বয়স যে পেরিয়ে যাচ্ছিলো তা নিয়েও কোন মাথাব্যথা ছিলো না।
অরুর সাথে দাদার বিয়েটা হয়েছিলো বাবা বেঁচে থাকতেই। বিলেত ফেরত মলয় তখন শহরের মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলরদের একজন। সুদর্শন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পিএইচডি ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত পাত্রের জন্য পাত্রীর অভাব ছিলো না। আর তাই যখন একের পর এক পাত্রী দেখে তারা কেউই সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলো না, ঠিক তখনই কাকতালীয়ভাবে ঘটকের কাছে অরুর ছবি আর বায়োডাটা দেখে বিজুর মুখে যেন হাসির ঝিলিক বয়ে যায়। সে বাবা-মাকে ওর কথা বলে বলে পাগল করে একপ্রকার জোড়পূর্বক নিয়ে যায় অরুণিমাদের বাড়িতে। দাদার তেমন না করার মতো কোন কারণ অবশ্য ছিলো না। বিজুর পাগলামো দেখে দাদা বরং প্রশ্রয়ই দিতে ভালোবাসতো।
ফের এক সন্ধ্যায় তারা যখন অরুণিমাদের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষারত তার জন্যে, ঠিক তখন অপরপ্রান্তে থাকা অরু জানতো ও না যে কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। প্রথম কোন পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে এসেছে, আর তাই একটু বেশিই যেন নার্ভাস ছিলো সে। সেজদি তাকে তার বিয়ের সময়ে পাওয়া উপহারের শাড়ি থেকে একটি কলাপাতা সবুজ রঙের বালুচরি সিল্ক দিয়েছিলো পড়তে। আর গলায় মায়ের দেয়া মটর মালা সাথে কানে ছোট দুল।
চুলে খোপা বেঁধে দিয়ে একটু যেন বয়সে বড় সাজানোর মিছে চেষ্টা। মাথায় খোপা বরাবর ঘোমটা টেনে, হাতে চায়ের কাপ-কেটলির ট্রে সাজিয়ে, সে যখন ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তখন তার চোখ কিন্তু মেঝেতেই নিবদ্ধ। নত মস্তকে কুশল বিনিময় পর্বের পর যখন পাত্রের মায়ের কথায় সে মুখ তুলে চাইলো তখন বিজুকে দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ। বিজু মুখ টিপে টিপে হেসেই চলেছিলো আর তাকে হাসানোর চেষ্টা করছিলো ইশারায়।
বাড়ি ফিরে যেতেই বিজু সকলের কাছে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, পাত্রী নিশ্চয়ই পছন্দ হয়েছে তোমাদের। অরু যেমন মেয়ে, ওকে কারো ভালো না লেগে পারেই না। তাহলে আর মেয়ে দেখবার দরকার নেই, এখানেই বিয়ে ফাইনাল ওকে? বলেই সে একবার করে সকলের মুখের দিকে চাইলো যেন সমর্থনের জন্যে।
মা হেসে বললেন, ওদের ও তো একটা মত আছে তাইনা…দুটো দিন যেতে দে।
ফের বাবা বললেন, মলয়ের সাথে বয়সের বেশ তফাৎ…ওরা রাজি হয় কিনা দেখো।
আর দাদা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, মেয়েটার নিজের ইচ্ছে বলতেও তো কিছু আছে…তার মত না থাকলে আমি কিন্তু এগুবো না বলে রাখলাম।
বিজু দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ওসব তোমরা আমার হাতে ছেড়ে দাও।
আর পরদিন ক্লাসের পুরো সময়টাই সে অরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। ছুটির পর যখন অরু বাড়ির পথ ধরেছে, ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা ডাক শুনে সে ফিরে তাকাতেই দেখলো বিজুকে। এই অরু দাঁড়া…বলে দূর থেকে একছুটে দৌড়ে এসে হাফাতে হাফাতে তার সামনে থামলো। তারপর হাত ধরে তাকে নিয়ে মোড়ের দোকান থেকে দুটো কোল্ডড্রিংকসের বোতল নিয়ে একটা নিজের হাতে রেখে আরেকটা অরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলি! রাগ করেছিস আমার সাথে?
অরু চুপচাপ কোকের বোতলে স্ট্র টানছিলো আর আকাশপাতাল ভাবছিলো। ওদিকে বিজু তখন বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকাঢক নিজের গলায় ঢেলে চলছিলো। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। যেন কারো আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। ফের অরু হঠাৎ বলে উঠলো, তুই আগে থেকেই সব জানতিস না?
বিজু হেসে বললো, হুম জানতাম সব।
আমাকে তবে কাল বলিসনি যে, বললো অরু।
আরে বাবা, আগে থেকে বললে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো নাকি!
ঘোড়ার ডিমের সারপ্রাইজ আমার, বলে ভেংচি কাটলো অরু।
অট্টহাসি দিয়ে বিজু বললো, দেখ তুই কিন্তু আমার দাদাকে রীতিমতো অপমান করছিস এখন।
তোর দাদার জন্য অন্য মেয়ে দেখ, আমাকে বরং তুই মাফই কর।
কেন রে অরু, দেখ বিয়ে তো তুই করবিই…আজ নাহয় কাল। তবে দাদার মতন পাত্রের কিন্তু জুড়ি মেলা ভার আর ঠিক তোর ও। দাদা কত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আর তুই ও টপার। দু’জনকে মানাবে ভালো, বেশ বুঝবি একে অপরকে। তুই আর না করিসনা অরু, এর চেয়ে ভালো পাত্র যে তোর জুটবে না সে আমি বলে রাখলাম।
অরু মৃদু হেসে বললো, নিজের বাড়ির লোকের অমন ঢোল সকলেই পেটায়…কচু জানিস তুই।
আচ্ছা বাড়ির লোক আমার আপন আর তুই বুঝি কেউ নস…দাদা যেমন আমার ভাই, ঠিক তুই ও তো বন্ধু নাকিরে?
হুমম…বলে অরু ডিঙ্কসের স্ট্রতে টান দিলো।
তবে আর কি সমস্যা বল? মুখটা অমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেন!
বয়স বেশি তোর দাদার, অমন গম্ভীর মুখ দেখলেই ভয় করে আমার।
হা হা হা…দাদার সাথে মিশিসনি তো, তাই এটা বলতে পারলি। তোর আর আমার বয়স তো একই, দাদা কিন্তু আমারও বড় অথচ দেখ আমার সাথে কত সহজেই মেশে। আর আমার পীড়াপীড়িতেই তো তোকে দাদা দেখতে গেলো।
ও আচ্ছা সবটাই শুধু তোর ইচ্ছে তাইলে, আর কারো বুঝি আমায় পছন্দ হয়নি…বলে যেন গাল ফোলালো অরু।
বিজু ফিচেল হেসে বললো, এইতো লাইনে এসে গিয়েছিস। মত তাহলে তোর ঠিকই আছে, শুধুশুধু আমায় টেনশনে ভোগালি। নিজের দাম বাড়ানোর জন্য ভাব নিচ্ছিলি তাইনা!
না না, আমি কি সেটা বলেছি নাকি…আচ্ছা তোর ইচ্ছেতেই সবাইকে চলতে হবে, লোকের নিজের কোন মত থাকতে পারেনা!
হুম চলতে হবে কারণ আমি সবার ভালোই চাই। তুই ও আর অত ভাবিস না অরু। আমার ইচ্ছেতেই নাহয় মত দে, কথা দিচ্ছি ঠকবি না জীবনে। নিজের দাদাকে আমি বেশ ভালোই চিনি আর সেই সাথে তোকেও…সুখেই থাকবি।
আচ্ছা, আমাকে তোর দাদার বৌ করে কি লাভ বলতো? এত ইনসিস্ট করছিস দেখে খটকা লাগছে মনে, তাই জানতে চাইলাম।
যদি বলি তোর মতো বন্ধু আমার দ্বিতীয়টি নেই। সেই স্কুল লাইফের শুরু থেকে আছি আমরা একসাথে। বিয়ে করে কোথায় না কোথায় চলে যাবি…তার চেয়ে বরং এই ভালো যে, আজীবন এক বাড়িতেই থাক আমাদের সাথে। আমার সব প্রিয় মানুষদের আমি কাছেই রাখতে চাই বুঝলি?
অরু মাথা দুলিয়ে পাগলের মতো হাসতে থাকে তারপর বলে, খুব বুঝলাম…পন্ডিত মশাই।
এরপর দুয়েক প্রস্থে এর বাড়ি ওর বাড়ি যাতায়াতের পর পাকাপাকি কথা হয়ে গেলো। আর তারপর বেশ ধুমধাম করে বিয়ের মাধ্যমে অরু এসে উঠলো তাদের বাড়ি।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।