ভালোবাসা
২০তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
মাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতেই ইমার্জেন্সি পেশেন্ট হিসেবে দ্রুত এডমিট করা হলো। ডক্টররা দেখছেন মাকে, আমি এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি আর অরু অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। আমি অরুকে ডেকে বললাম, তুই বাড়ি যা…দাদা ফিরে এসে কারোকে না পেয়ে টেনশনে ভুগবে।
অরু রাগে ফেটে পড়ে আমাকে বললো, মা কি শুধুই তোর? আমার কেউ হয় না…
আমি তার অগ্নিমূর্তি দেখে খানিকক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললাম, ঘরে তালা দেখে দাদা কোথায় কোথায় আমাদের খুঁজে মরবে বল তো?
অরু হঠাৎ বলে উঠলো, সে বাচ্চা ছেলে নয় যে হারিয়ে যাবে…এই মূহুর্তে মাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবোনা।
বিপদাপদ এলে যে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে বুদ্ধি হারায় তা আজ যেন টের পেলাম। দাদার যে একটা মোবাইল সেট আছে আর সেটা সবসময় সে সাথে ক্যারি করে তা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা।
ডক্টর এসে বললেন যে, মায়ের হার্টে সমস্যা করছে। উনারা অবজারভেশনে রেখে বলতে পারবেন যে এখন কি করণীয়। অরু আর নড়লো না সেখান থেকে। তাকে কিছু বলার সাহস করতে পারলাম না আমি। হসপিটালের রিসেপশন থেকে দাদার নম্বরে কল দিয়ে বিজি পাচ্ছিলাম বারবার। চারবারের বার লাইনে পেয়ে হ্যালো বলতেই যেন উদ্বেগ প্রকাশ পেলো তার কন্ঠে।
তোরা কই গেছিস বলতো? সকাল সকাল ঘরে ফিরে তালা দেখে মনে হলো যেন কেউ আমার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে …
আমরা হাসপাতালে, মা’র হার্ট এটাক হয়েছে…তুমি জলদি এসো বলে আর দেরি না করে এড্রেসটা জানিয়ে কলটা রাখলাম।
এখন আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার। সেরকম পরিস্থিতিতে নেই আমি। তাই সকালে কিভাবে কি হলো তার সবটাই এড়িয়ে গেলাম। অরু থেকে পরে জেনে নিতে পারবে দাদা। এই মূহুর্তে এসব কথার চেয়ে বেশি জরুরি মা’র চিকিৎসার ব্যাপারে ডক্টর কি বলে। বাবাকে বাঁচাতে পারিনি কিন্তু মা’র জন্যে চেষ্টার কোন অন্ত থাকবে না। সবচেয়ে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বিজু কোন কার্পণ্য করবেনা।
দাদা এলেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে। তার চোখে জল যেন কান্না আটকে রেখে কোনক্রমে এসেছেন। কথা বলতে গিয়ে গলায় দলা পাকিয়ে কন্ঠস্বর রোধ হয়ে যাচ্ছিলো আমার। তবুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম। দাদা আমায় জড়িয়ে ধরে নির্বাক অবস্থায় রইলেন। ডক্টর এসে দাঁড়াতেই আমরা সেদিকে ছুটে গেলাম। তিনি জানালেন মায়ের ইমিডিয়েটলি ওপেন হার্ট সার্জারীর প্রয়োজন।
চিকিৎসার ব্যয় যা শোনালেন তাতে দাদা হতবাক হয়ে গেলেন। আমি আর এক সেকেন্ড ও দেরি করতে চাইছিলাম না যেন। টাকার জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়লাম। বাস লড়ির পুরো ব্যাবসাটাই বেঁচে দিতে হবে হয়তো। মা জীবিত থাকলে কামলা দিয়ে হলেও সংসার চালাতে পারবো কিন্তু মা না থাকলে!!! নাহ…আমি কিছুতেই মাকে হারাতে পারবো না।
সুজনদের বাড়ির অবস্থা ভালো, তার দাদারা কানাডা থাকে। সে কিছুতেই ব্যবসাটা অন্য কারো হাতে যাক তা চাইছিলো না। তাই সব শুনে সুজন বললো, আমি রাখছি তুই যখন চাইবি ফিরে আসতে পারবি।
সুজন আর আজাদ তাদের পরিবারসহ মাকে দেখে গেলো হাসপাতালে, অরু তার বাবা-মাকে খবর পাঠালে তরুসহ তারা এসে দেখে যাবার পর মিরুও একদিন তার পরীক্ষার মাঝে এসে দেখে গেছে মাকে। আত্মীয়স্বজন সকলের একই কথা, বাবাকে যখন হারিয়েছো তখন মা’ই তোমাদের একমাত্র অবলম্বন। তার চিকিৎসায় বিলম্ব করলে পরে আর আফসোসের সীমা থাকবেনা।
মায়ের বয়স অনুযায়ী ওপেন হার্ট সার্জারীতে রিস্ক বেশি কিন্তু তা ছাড়া আর উপায় নেই আর তাই বন্ড সিগনেচার দিয়ে দাদাকে অনুমতি দিতে হলো।
সার্জারীর পর মায়ের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও ধীরে ধীরে একসময় যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন মাঝরাত আমি ক্লান্তিতে হসপিটালের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো..খবরটা দিতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে অরু কান্না জড়ানো গলায় যতটুকু বলতে পারলো তাতে ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তার কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠতেই সে আমার পিঠে একটা হাত রেখে যেন আগলে রাখলো আমায়…কাঁদতে কাঁদতে আমি বলছিলাম, আমার আর কেউ রইলো না রে অরু…আমার আর কেউ রইলো না।
বাবার পর মা ও আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ায় নিজেকে যেন ঘরবন্দী করে ফেললাম। বন্ধুরা এসে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। বিজুর যেন আর কোন সাড়াশব্দ নেই। দাদা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দেবার চেষ্টা করেও কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায়না।
এরই মাঝে একদিন অরু এসে ঢোকে আমার ঘরটায়। উশকোখুসকো চুল আর খোঁচাখোঁচা দাড়িতে যেন এ ক’দিনে আমার বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে। খাটে হেলান দিয়ে বসেছিলাম আমি, সে আমার হাতটা ধরে টানতে থাকে আর বলে, খেতে চল।
আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
সে বলে, ক’দিন পর তো চলেই যাবো…আর ক’টা দিন নাহয় সহ্য কর।
আমি বলে উঠি, চলেই যখন যাবি তখন আর মায়া বাড়িয়ে কি লাভ!!!
সে যেন নিরাশা ভরা চোখে তাকিয়ে থেকে বলে, যে ক’দিন আছি তোর খেয়াল তো রাখতে পারি তাইনা। নাকি সে অধিকারটাও খুইয়েছি আমি?
আমি শুকনো হেসে বলি, অধিকারের দাবি তো ছেড়েছিস বহু আগেই…অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার চাহিবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।
অরু আর কিছু না বলে মাথা হেট করে চলে গেলো।তারপর ভাতের থালাটা এনে ভাত তরকারি মেখে জোর করে আমার মুখে তুলে দিতে লাগলো। আমি আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। পুরো এক থাকা ভাত খাওয়ানো শেষে সে তার হাত ধুয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিলো তার আঁচল দিয়ে।
মায়ের মৃত্যুর পর তার মাতৃরূপ যেন দেখলাম আমি। আমাকে আর এড়িয়ে না গিয়ে সব বাঁধা ভুলে, দেখে রাখার দায়িত্বটা সে নিয়েছে।
এভাবে দিন যেতে যেতে অরুর ফাইনাল এক্সাম চলে এলো। সে আমায় দিয়ে আসতে বলাতে খুব অবাক হয়ে বললাম, দাদা কোথায়?
জবাবে সে বললো, আমি তোর সাথেই যাবো।
দাদাকে বল তোকে দিয়ে আসতে, বললাম আমি।
তুই যাবি না আমার সাথে!!! বলে বিস্মিত নয়নে চেয়ে রইলো অরু।
দাদার সাথে যা…বেশ কড়া কন্ঠে বললো বিজু।
মাস ছয়েক পর একদিন রাতে জানিয়ে দিলাম যে আমি জহিরের সাথে দুবাই যাচ্ছি, সেখানের আলতাফ ভাই বলে একজনের সাথে জহিরের পরিচয় আছে আর আমারও কথা হয়েছে…তার ওখানেই কাজ করবো আমরা।
দাদা সব শুনে কিছুটা নীরব থেকে তারপর বললেন, এখানে থেকে কি কিছু করা যায়না?
আমি ক্রুর হাসি হেসে বললাম, তোমার মতো উচ্চশিক্ষিতরাই দেশে থেকে যোগ্যতা অনুসারে প্রাপ্য ভালো কিছু করতে পারছেনা…আর সেখানে আমার মতো বারো ক্লাস অব্দি পড়া লোকের কি ভাত আছে!!!
দাদা আর কিছু বললেন না, নত মস্তিষ্কে যেন অস্বস্তিতে পড়ে বসে রইলেন।
পরদিন ভরদুপুরে আমি যখন ব্যাগ গোছাচ্ছি ঠিক তখনই অরু এসে কিছু না বলেই খাটের একপাশে বসে পড়লো। খানিকক্ষণ আমায় নিরীক্ষণ করে নিয়ে তারপর বললো, কেন চলে যাচ্ছিস রে বিজু?
তোদের যাওয়াটা যেন স্বচক্ষে আমায় দেখতে না হয়…এটাই কি শুনতে চাস তুই?
আমার চাওয়া না চাওয়াতে কি যায় আসে বল…তুই তো তাই করবি যা করার কথা ভেবেছিস।
শুনে তো দেখি, তোর চাওয়ার রকমভেদ কিরকম?
আমি চাই, তুই আবার বিজনেসটা শুরু কর…ছোট পরিসরে হলেও একেবারে ছেড়ে দিস না। বাবা শুরু করেছিলেন তুই অন্তত ধরে রাখ। দেখবি একদিন আগের চেয়েও অনেক বড় কিছু করতে পারবি।
স্মৃতি ধরে বেঁচে থাকাটা খুব বেদনাদায়ক কাজ, সেটার ভার আমি আর বইতে পারছিনা। যে বাড়িতে বাবা-মা নেই…দাদা আর তুই কেউ থাকবিনা সেখানে আমি একা কি করে থাকবো বল তো!!!
অরু একটুখানি চুপ থেকে ফের বললো, যাবার আগে তোকে যদি বিয়ে করিয়ে দিয়ে যাই…তবে আর একা একা লাগবেনা তোর।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললাম, সবকিছু খুব সহজ মনে হয় তোর কাছে তাইনা!!! মানুষ প্রিয়জনদের অভাবে একাকী অনুভব করে, যে কারো সঙ্গ পেলেই একাকীত্ব ঘোঁচে না।
অরু মৃদু হেসে বললো, একসাথে থাকতে থাকতে সে ও তোর প্রিয় হয়ে যাবে দেখিস…একই ঘরে থাকতে থাকতে তো মানুষ তার আসবাবপত্রের ও মায়ায় পড়ে যায়, আর সেতো জলজ্যান্ত একটা প্রাণী।
দাদাকে কি এভাবেই ভালো বেসেছিস তুই?…বলতে মন চাইলেও আর বললাম না আমি।
অরু একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো… সুজনদের বাড়িতে ওর পিসতুতো বোন দিপালীর সাথে কথা বলে তাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো, খুব মিষ্টি মেয়ে…তোর সাথে মানাবে বেশ।
আমি মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, কেমন মানাবে? তোর আর দাদার মতন?
অরু খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললো, আমাদের কথা বাদ থাক…তারপর আবার একমনে বলতে শুরু করলো, ক’বছর পর দেখবি বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে এমন ভরা সংসার হবে যে আর খালি খালি লাগবে না তোর।
ফের আমরা ছুটিতে এলে তোর বাচ্চারা আমায় ঘিরে জ্যেঠিমা জ্যেঠিমা করে পাখির মতো কিচিরমিচির করতে থাকবে…শুনতে বেশ লাগবে আমার।
আমি মুচকি হেসে বললাম…জ্যেঠিমা ডাক শোনা লাগবেনা তোর, তারচেয়ে বরং তুই মা ডাক যেন শুনতে পাস সেই শুভকামনা রইলো।
অরুর মুখটা যেন বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো, সে বোধহয় জেনে গেছে যে…বিজু তার নিজের জীবনে আর কারোকে কখনোই আসতে দেবেনা।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।