ভালোবাসা
২২তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ঠিক করে বাড়ির ঠিকানায় এসে দাঁড়িয়ে চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতেই মনে হলো, বাড়িটাও যেন ঠিক আমারই মতন একা হয়ে গেছে। ঘরের দোরগোড়ায় এসে দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই একটা গুমোট ভাব যেন ছেয়ে আছে সারা ঘরময়। সবকটা জানালা খুলে দিতেই নিমেষে আলো বাতাস ঢুকে একটু যেন পরিবেশটা ঠিক হলো।
চারিদিকে ধুলোর আস্তরণ দেখে এসে আর বসলাম না। লাগেজটা একপাশে সরিয়ে রেখেই ঝাড়ু খুঁজে নিয়ে লেগে পড়লাম কাজে।
সব সাফ সাফাই করতে গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। যখন শেষ হলো এই পরিচ্ছন্ন অভিযান, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। আমি স্নান করে এসে ভাবছিলাম একটা ঘুম দিয়ে উঠি। তারপর চোখ লেগে আসতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে মেইন ডোর খুলে দাঁড়াতেই দেখি সুজন এলো। আমি তাকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে নিতেই সে রাগে ফায়ার হয়ে আমার হাত ঝাড়া দিয়ে বললো, আসার আগে একটা কল তো দিবি নাকি!!! অন্তত এসে একবার ফোন করে জানাতে তো পারতিস…আমরা কি এতই পর হয়ে গেছি তোর, সব একা একা করবি।
আমি মৃদু হেসে বললাম, তোকে কল দিতাম সন্ধ্যার পরে…ভাবলাম একটু জিরিয়ে নেই।
সুজন মুখ ভার করে বললো, আমরা কি তোর শুধুই আড্ডা দেয়ার বন্ধু?
তা হবি কেন…দেখ তুই অযথা রাগ করছিস, বললো বিজু।
নাহলে আমার কিংবা আজাদের কারো বাড়িতে না উঠে তুই এখানে এলি কেন!!!
বিজু চুপ থেকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
আসার আগে বলা নেই, এসে কোন খবর দেয়া নেই…যেন আমরা সব মরে গেছি তোর জন্যে।
বিজু এবার আচমকা সুজনকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল…তোরা রাগ করে দূরে সরিয়ে দিলে আমি কার কাছে যাবো।
নাহ…তোকে নিয়ে আর পারা গেলো না, মন ভোলানো কথা ভালোই জানিস।
রাগের বরফ গলেছে তাহলে বলে ফিক করে হেসে দিলাম আমি।
সুজন বললো…রাগ গলানো, মন ভোলানোর গুরুমন্ত্র জানা আছে নাকি তোর বলতো!!!
সেসব তো জানিনা…শুধু জানি ভালোবাসতে, বললো বিজু।
সুজন আর ঘরে এসে বসতে চাইলোনা, আমাকে বের হবার জন্যে তাড়া দিলো। আমরা যখন বেরিয়েছি তখন ভরসন্ধ্যা বেলা। নীলচে আলোয় ঘিরে ধীরে ধীরে যেন আঁধার নেমে আসছে। সুজন আমায় নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে বেশ ভারী খাবার অর্ডার করলো। আমি আঁতকে উঠে বললাম, এত কিছু খাবো এই অবেলায়!!!
সুজন বললো, এসেছিস অব্দি যে কিছুই খাসনি তা কি আমি বুঝিনি ভেবেছিস?
আমি আর কিছু না বলে নীরবে বসে রইলাম।
খাবার আসতেই সুজন আমার প্লেট সাজিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে রেখে বললো, আগে পেট ভরে খাবি তারপর তোর সাথে কথা বলবো।
আমি ফিচেল হেসে বললাম, তোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছেনা তুই আমার বন্ধু…যেভাবে শাসন করছিস তাতে অন্য কিছুই মনে হচ্ছে।
সুজন কড়া চোখে তাকাতেই আমি চুপচাপ খেতে শুরু করলাম।
খাওয়াদাওয়া শেষে হাটতে হাটতে ব্রীজের কাছ ঘেষে চায়ের দোকানটায় গিয়ে চা খেতে খেতে রাস্তার নিয়ন বাতির আলোয় যেন একে অপরকে ভালো করে দেখছিলাম। আমি তাকিয়ে থেকে বললাম, আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছিস তুই…ভুরি বেরিয়ে গেলো বলে।
আর তুই হয়েছিস শুটকি মাছ, চামড়ায় মোড়ানো কঙ্কাল ছাড়া তোর আছেটা কি!!!
আমি অট্টহাসি দিতেই সুজন বললো, কেমন স্কুলের ছেলেপুলেদের মতন মনে হলো রে তাইনা…
বিজু বললো, তোর ব্যাবসা কেমন চলছে? বাড়িতে কাকু কাকিমা সবাই ভালো আছেন তো?
ব্যবসা ভালোই চলছে…বাবা আছেন আগেরই মতন, মা’র আর্থারাইটিসের ব্যাথাটা বেড়েছে আবার। ডক্টর দেখাচ্ছি, দেখি এবারকার মতন সাড়ে কিনা।
ফের সুজন বলে উঠলো, এবার আর ফিরে যাসনে বিজু। এখানে থেকেই কিছু কর, নাহয় আবার বিজনেসটা বুঝে নে…তোর ছিলো মনে কর তোরই আছে, আমি শুধু দেখাশোনা করেছি ভেবে নে।
আমি একটুখানি চুপ থেকে বললাম, এখানে থাকার মতো মন-মানসিকতা আমার আর কোনদিন হবে না।
এই শহরের অলি-গলিতে, পূজো মন্ডপের আরতিতে, মেলার ভিড়ভাড় ঘেরা হট্টগোল আর স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের কোলাহল আমায় কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেবেনা।
শান্তিতে কি তুই আছিস!!! দেখ আমি তোকে জোড় করছিনা… কিন্তু তবুও বলবো, লাইফে মুভ অন করা খুব জরুরি। পুরনোকে ভুলতেই নতুনের প্রয়োজন।
আমি হেসে বললাম, নতুন করে কি আরেকটা হৃদয় গড়ে নেয়া যায় বলতো? ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া মন কি করে আবার জোড়া লাগায় তা আমার জানা নেইরে সুজন।
বিয়ে-থা করে সংসার শুরু কর, সাংসারিক ঝামেলায় সব ভুলে যাবি।
অত লেকচার যে ঝাড়ছিস, তুই নিজে কেন করছিস না বলতো?
আরে আমার মেঝদা এখনো বিয়ে করেনি আর আমাদের বাড়ির নিয়ম তো জানিস না…নো সিরিয়াল ব্রেক পলিসি…যে আগে এসেছে পৃথিবীর বুকে, সে সব কিছু আগেই পেয়ে নাম ওঠাতে হবে পরিবারের খাতায়।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফের, সে আমার কথা বাদ দে…আমি কোন একসময় করে নেবো ক্ষণ। কিন্তু তুই, তোর ইমিডিয়েটলি কিছু একটা করতে হবে।
মানে!!! কি করতে বলিস আমায়?
বিয়ে…পাত্রী তুই দেখবি না আমি দেখবো?
বিজুর চোয়ালটা যেন রাগে শক্ত হয়ে যায়…সে বলে, আমি ওর জায়গায় আর কারোকে বসাতে পারবো না কখনো।
ওর? কার???
রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে বিজু বলে, তুই জানিস আমি কার কথা বলছি…তাকে ভোলা এই জীবনে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোকে ভুলতে বলছেটা কে!!! সে তার মতন তোর স্মৃতিতে থাক, কিন্তু শুধুমাত্র স্মৃতিচারণ করে তো আর ভালোভাবে বেচে থাকা যায় নারে বিজু, অকপটে বললো সুজন।
আমি ঠিক আছি, অরুকে সরিয়ে আর কারোকে নিয়ে সুখে থাকা আমার পোষাবে না, তারচেয়ে বরং দুঃখে থাকাই শ্রেয়। তার স্মৃতি বুকে আগলেই বাকিটা জীবন আমি বেশ কাটিয়ে দিতে পারবো…একমনে বলে যেতে লাগলো বিজু।
সুজন আর কথা বাড়াতে চাইলো না, চুপচাপ চায়ের বিল মিটিয়ে বিজুর সাথে হাঁটতে লাগলো।
বাড়ি ফিরে এসে বিজু একা একা সারা ঘরময় হেঁটে দেখছিলো। ঘরের প্রতিটি দেয়ালে যেন তাদের হাসিকান্নার প্রতিধ্বনি সে শুনতে পাচ্ছে। কোন একটা পরিবারের কত লক্ষ কোটি মূহুর্তে ঘিরে থাকে বাড়িঘর। মানুষগুলো নেই কিন্তু ঘরের চার দেয়াল আর আসবাবপত্রগুলো যেন সেসব ধারণ করে নীরবে কাঁদছে।
বহুবছর পর আজ সে যখন নিজের ঘরে নিজের বিছানায় ঘুমাতে গেলো, তখন মাঝরাতে হঠাৎ মনে হলো অরু এসে তার বুকে মাথা রেখেছে। তাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখে যেন ছাড়তে চাইছেনা আর। সে আনমনে বলে উঠলো…দাদা এসে যাবে ছাড় অরু, ছাড় আমায়।
ফের ঘুম ভাঙতেই সে দেখলো, ঘেমে নেয়ে জবজবে হয়ে গেছে তার শরীর। উঠে বসে একা একা ভাবতে লাগলো, কেন এতবছর পর ও শুধু তার কথা ভাবলেই শিহরণ জাগে মনে।
পরদিন সকালে বাইরে কোথাও নাস্তা সেরে সে আজাদদের বাড়িতে গেলো। রহমান চাচা আর চাচী গতকাল এসেছে শুনে তাদের বাড়িতে না ওঠার জন্যে অভিমান করলেন। আজাদ এসে আমার হাত টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, তুই যে আসবি আমি জানতাম…আমার যে কি খুশি লাগছে তা তোকে ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবোনা।
আমি হেসে বললাম, খুশিতো লাগবেই বিয়ে বলে কথা। তোর বিয়ে তাও আবার লাভ ম্যারেজ…না এসে কি পারি!!!
আজাদ লাজুক হেসে বললো, আরে ধূর…রুখসানা তো ছোট থেকেই ভাই ভাই করতো বুঝলি, আমি যে ওকে ভালোবাসি তা জানতামই না একদম…হঠাৎ করে একদিন শুনি চাচা আমার বাবাকে ডেকে বলছেন, রুখসানাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। শোনার পর থেকে কি হলো জানিনা…আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। পাত্রপক্ষ দেখে গিয়ে যখন জানালো যে তাদের রুখসানাকে খুব পছন্দ হয়েছে, তারা নিকাহ’র তারিখ পাকা করতে চায়…তখন যে কি হলো আমার জানিনা, ঝড়ের বেগে গিয়ে সবার সামনে বলে বসলাম আমি রুখসানাকে বিয়ে করতে চাই…ততক্ষণে আমার চোখ-মুখ দেখেই সবাই বুঝে গেছে যে ওকে না পেলে আমি হয়তো কিছু একটা করে ফেলবো নিজের সাথে…আর তাই একবাক্যে সবাই রাজি হয়ে গেলো।
আর রুখসানা, তার কি মত? কিছু বলিসনি তাকে?
সে ভীষণ অবাক চোখে তাকিয়েছিলো আমার দিকে, আমি লজ্জায় তার সাথে আর চোখ মেলাতে পারছিলাম না…কয়েকদিন লুকিয়ে ছিলাম বুঝলি।
শুনে বিজু হো হো করে হেসে উঠতেই আজাদ বললো, মূল কথাতো এখনো বলিই নি…রুখসানাই পরে একদিন বাসায় এসে আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলো এসবের মানে কি? আমিতো ঠায় দাঁড়িয়ে, কি বলবো কি বলবোনা করতে করতে শেষ…তারপর সে চলে যেতে নিতেই বলে উঠলাম, ভালোবাসি হয়তো। ফের সে রাগে কটমট করতে করতে বললো আমায়, তুমি এখনো কনফিউজড!!! তাহলে আমার বিয়ে ভেঙে দিলে কেন? আমি বললাম…কনফিউজড না, তুমি অভয় দিলে স্বীকার করতে পারি। আমার কথা শুনে সে হাসতে হাসতে বললো, আজাদ ভাই..তুমি এত ভিতু হয়ে গেলে কবে থেকে বলো তো!!! তার হাসি দেখে আমিও হেসে নিয়ে বললাম, যবে থেকে জানি তোমায় ভালোবাসি।
হয়তো???…বলে রুখসানা আবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
বিজু শুনে বললো, বেশ মিষ্টি প্রেমের গল্প…ভালো লাগলো। কারো ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে তাকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয় আমার। রুখসানাকে নিয়ে সুখে থাকিস যেন সেই আশীর্বাদ করি।
আজাদ হঠাৎ কিছু বুঝতে পেরে বললো, চল চল মা খেতে ডাকছে আর আজ সারাদিন তুই কিন্তু আমার সাথেই থাকবি।
বিজু দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বললো, আর কাল থেকে তো দিনরাত সবই রুখসানার।
আজাদ আমার পিঠে কিল দিয়ে বললো, বেশি পাকামো হচ্ছে না…শালা তোর ও ব্যবস্থা নিচ্ছি দাঁড়া, রুখসানার কিন্তু বান্ধবীদের অভাব নেই।
আমি কথা ঘোরাতে বললাম, অলরেডি এত কিছু জেনে গেছিস…সারাদিন বকবক করিস নাকি!!!
আজাদ মুচকি হেসে বললো, ও-ই বলে যায় আর আমি শুধু শুনি…ফোন রাখতে নিলেই বলি, তোমার অমুক টিচার আর তমুক বান্ধবী কি বলেছে ওদের গল্প তো করলেনা আজ।
বিজু অট্টহাসি দিয়ে তারপর বলে, শুনতে ভীষণ ভালো লাগে না…আমারও লাগতো, যেন আনমনে বলে ওঠে।
বিলেতে ক্লাস ভরা ছাত্রের সামনে রোজ লেকচার দিতে বেশ ভালো লাগে মলয়ের। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর হায়ার স্টাডিজের পর সে বিদেশের মাটিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে পেরেছে। যোগ্য সম্মান আর সম্মানী দুটোই পায় এখন। এর পেছনে বছরের পর বছর রাত-জাগা পড়ালেখা, থিসিস, রিসার্চ সবকিছুরই অবদান রয়েছে। পরিবারের ভুল বোঝাবোঝিকে গ্রাহ্য করলে আজ আর এখানে এসে দাঁড়াতে পারতো না সে।আর্থিক দৈন্যতা না থাকলেও সে যে পরিবার থেকে উঠে এসেছে সেখান থেকে এত ভালো অবস্থানে আসা সহজ ছিলো না তার জন্যে।
ইউনিভার্সিটির টিচার হিসেবে জয়েন করে যে স্যালারি সে এখন পায় তাতে দামী গাড়ি আর ভালো বাড়ি দুটোই সম্ভব হয়েছে। গাড়ি অবশ্য নগদে কিনলেও বাড়ি কিনেছে হোম লোনে। জীবনে অনেক কষ্ট করে ওপরে উঠে যদি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে আর বিলাসিতায় না থাকতে পারে তবে সেটার লাভ কি! এসব ভাবতে ভাবতে ক্লাস থেকে বেরুতেই ফোনটা বেজে উঠলো তার।হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে, আই এম কামিং উইদিন টুয়েন্টি মিনিটস ডিয়ার বলে কল রেখে দিলো।আজ কি রেঁধেছে কে জানে…নিত্যনতুন রেসিপি ট্রাই না করলেই যেন নয়, ভেবে আপনমনে হেসে উঠলো।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।