ভালোবাসা ২৫তম_পর্ব

0
726

ভালোবাসা
২৫তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বুঝলাম আজাদ, সুজন আর রুখসানা মিলে কিছু একটা চক্রান্ত করেছে আমার বিরুদ্ধে। ইচ্ছাকৃতভাবে যেন সবাই তাড়াহুড়ো করে সব চেয়ারে বসে পড়ে আমাকে আর লম্বা মতো বাচ্চা বাচ্চা চেহারার আরেকটি মেয়েকে পাশাপাশি বসতে বাধ্য করলো। তাদের হাবেভাবে যা বুঝলাম, সেই মেয়েটিই বোধহয় প্রীতিকা।

খুব সম্ভবত সকলের এমন আচরণে সে ও বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো। আমি কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বসে পড়ে তাকেও বসতে বললাম। আর অমনি সবার খিখি খিখি শুরু হয়ে গেলো।

ভেবে নিলাম যে ডোন্ট কেয়ার এটিটিউডে থাকবো। যতক্ষণ আছি স্বাভাবিক বিহেভ করে বুঝিয়ে দেবো যে, এসব জাল বিছিয়ে তোদের রাজকার্য সম্পাদন হবে না। ফের খাবার আসতেই আজাদ আর সুজন সবাইকে সার্ভ করে করে এসে শুধু আমাকে আর প্রীতিকাকেই কিছু না দিয়ে ডিস এগিয়ে দিলো। আমি কটমট করে তাকাতেই আজাদ রুখসানার দিকে আর সুজন রেস্টুরেন্টের এসি দেখতে লাগলো মন দিয়ে। একফাঁকে আজাদ আমায় ইশারা করলো প্রীতিকাকে খাবার সার্ভ করতে। আমি ইশারায় চোখ পাকিয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে তোদের আজ খবর করে ছাড়বো। সুজন ফিচেল হাসি দিলে রাগে কটমট করে বুঝিয়ে দিলাম যে পরে সব ক’টাকে দেখে নেবো।

প্রীতিকা বেচারি কি কিছু লক্ষ্য করলো কিনা জানিনা…সে উঠে গিয়ে আমার প্লেট সাজিয়ে দিয়ে নিজের প্লেটেও খাবার বেড়ে নিলো। তারপর শিশুসুলভ হাসি দিয়ে বললো, খাও খাও খাবারের ওপর রাগ করতে নেই।

আমি রীতিমতো থ বনে গেলাম। সে আমায় তাজ্জব হতে দেখে বললো…আমি না কারোকে আপনি বলতে পারি না, ছোট-বড় কিংবা চেনা-অচেনা সবাই তুমি। আর বন্ধুরা তো মজা করবেই, ওসব তুমি সিরিয়াসলি নিয়ো না।

একটা বাচ্চা মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধিজ্ঞানে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। তারপর খানিকটা হেসে নিয়ে বললাম, তুমিতো দেখছি বেশ বুঝদার আছো।

সে মলিন মুখ করে বললো, বাড়িতে যার সৎমা আছে তাকে বুঝদার হতেই হয়।

আমি আর কথা বাড়াতে চাইলাম না, চুপচাপ খেতে শুরু করলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষে সুজন আর আজাদ পালাক্রমে আমার গুণকীর্তন করতে লাগলো এমনভাবে, যেন মেয়েপক্ষের কাছে ছেলের সুনাম গাওয়া। প্রীতিকা হঠাৎ কিছু না বুঝেই বলে উঠলো, সে যে ভালো মানুষ তা এমনিতেই বোঝা যায়…প্রথম দেখেই আমি বুঝেছি। আর অমনি সবার হাসির রোল পড়ে গেলো।

সুজন অট্টহাসি দিয়ে বললো, কি দারুণ বোঝাপড়া।

খেয়েদেয়ে আড্ডা দিয়ে বেরুতেই ফুচকার গাড়ি দেখে মেয়েদের দল পড়িমরি করে ছুটলো সেদিকে। আর আমি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিলাম এদের থেকে নিস্তার পাই কি করে।

হঠাৎ আজাদ আমায় বলে উঠলো, বিজয় তুই প্রীতিকাকে আজ ওর বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে পারবি না?

আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, সুজনকে বল না।

দূর থেকে প্রীতিকা দেখে কি বুঝলো কে জানে…সে বললো, আমি একাই যেতে পারবো কোন সমস্যা হবে না।

আমি একটু যেন অপ্রস্তুতবোধ করলাম আর তাই প্রীতিকা চলে যাওয়ার সময় তার সাথে সাথে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম।

কিছুদূর যেতেই তার মুড ঠিক করতে বললাম, বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

বাবা, সৎমা আর সৎ ভাই।

আমি বলে উঠলাম, মা তো মা’ই হয় আর ভাইতো ভাই। সৎ আপন এসব বিশেষণ মুখে এনে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কি মানে বলো…

সে শুকনো হাসি হেসে বললো, সব মা মা নয় আর সব ভাই ভাই হয় না…এটা কারোকে বোঝানো যায় না। নিজে ফেস করলেই মানুষ বোঝে।

ওর সাথে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ আমার কি জানি হলো মনে হয় অরুকে দেখতে পেলাম। তাকে দেখতে পেয়ে যেন অস্থিরতায় ভুগছিলাম। প্রীতিকা সেটা খেয়াল করে বললো, বাসে উঠে গেলে বাড়ির কাছটায় নামিয়ে দেবে তাই সাথে আসতে হবে না আর…তুমি যাও তোমার জরুরি কাজে।

শুনে একটু দ্বিধায় ভুগলেও প্রীতিকা আস্বস্ত করায় আর দাঁড়ালাম না সেখানে। আজ যেন পিছু নিলাম অরুর। সে কোথায় যায় জানতে হবে আমায়।

একটা লেডিস হোস্টেল টাইপ বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি যেতেই আমি দ্রুত পায়ে গেটের সামনে গিয়ে তার পথ আটকালাম। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, তুই পিছু নিয়েছিস কেন আমার!!!

আমি তাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বললাম, তার আগে বল যে তুই কাল মিথ্যে বললি কেন?

সে গম্ভীরমুখে বললো, সত্য মিথ্যেয় কি যায় আসে…

তোর বাবা-মার কাছে উঠিসনি দেখে ভেবেছিলাম তুই আর দাদা বুঝি হোটেলে উঠেছিস…কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে আরো বেশি সন্দেহ হচ্ছে আমার। দাদা কোথায় বল?

তোর দাদা বিলেতেই…আমি একা ফিরে এসেছি, বললো অরু।

আমি বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে, তারপর বললাম…কিন্তু কেন?

ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আমাদের……সে বেশ দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো ।

আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম, দাদা এমন কাজ কখনোই করতে পারে না।

সে মৃদু হেসে বললো, ঠিক বলেছিস…তোর দাদা আমায় ছাড়তে চায়নি, ছেড়েছি তাকে আমি।

তুই? কি এমন হলো যে দাদাকে ছেড়ে এলি…তারপর আবার তোর বাবা-মার কাছে না গিয়ে এভাবে লুকিয়ে আছিস!!!

আমরা বিলেত যাওয়ার পর প্রথম প্রথম বেশ ভালোই ছিলাম। নতুন জায়গায় গিয়ে যদিও কিছুটা এডজাস্ট করতে আমার সমস্যা হচ্ছিলো, কিন্তু ভেবেছিলাম যে স্বামী পাশে থাকলে সব মেয়েরাই তো বিদেশবিভুঁইয়ে মানিয়ে নিয়ে পরদেশকে আপন করে নেয়। সে ও হেল্প করতো যতটা সম্ভব। কিন্তু একা সংসার করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, কারো ফোন আসলেই যেন একটু বেশি সিরিয়াস হয়ে যায় সে। তখন আর আমার কিংবা ঘর সংসারের কারো কথা, কোন কিছুই তার মনে থাকে না। আমার সামনে কখনো ফোনে কথা বলতো না। তাই যেন আরো বেশি মন খচখচ করতে লাগলো। ছাত্রদের থিসিস পেপার দেখে একরাতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে, তখন কল এলে ঘুমের ঘোরে উঠে গিয়ে কথা বলে এসে ফোন লক করতে ভুলে যায় সে। আমার সেদিন কি হলো জানিনা তার ফোন থেকে লাস্ট কল আসা নম্বর থেকে দেয়া মেসেজের কনভারসেশনগুলো পড়তে শুরু করলাম। আর পড়তে পড়তেই বুঝে গেলাম যে তোর গুণধর দাদা একইসাথে দুজন মানুষকে বছরের পর বছর একইভাবে ভালোবাসার দাবি করে একজনের আড়ালে আরেকজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলো বারবার। সে কারোকেই ছাড়তে চায়নি। তুইই বল এ ও কি সম্ভব! কেউ কি কখনো একইসাথে দুজন মানুষকে একইরকম ভাবে জীবনে চাইতে পারে?

বিজুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।

একটু দম নিয়ে ফের অরু বলতে লাগলো, বাড়ি ফিরে গিয়ে বাবা-মাকে কি বলতাম। মিরুর বিয়ে সামনে, তখন লোকে জানলে কি আর এগুতে চাইবে। ডিভোর্স মেয়েদের জন্য এ সমাজে টিকে থাকা খুব কঠিন। কিন্তু তোর দাদার এই দ্বৈত সত্তা আমি যেন ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। সে যাকে পিএইচডি প্রোগ্রামের শুরু থেকে ভালোবাসতো তাকে বিয়ে করার কথা বাড়িতে বলার সৎ সাহস তার ছিলো না। কারণ মেয়ে বিলেতি আর ক্রিশ্চিয়ান বলে বাবা-মা মেনে না নিয়ে হুল্লোড় করবে এমনই ধারণা করেছিলো। বাড়ি থেকে মোটা অংকের টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যায় পড়বে ভেবে তাই সে সবটাই চেপে যায়। কিন্তু যখন বিয়েটা হয়ে যায় তখন থেকে অভিনয় করতে করতে সে আমার মায়াতেও জড়িয়ে পড়ে, আর তাই দেরিতে এলেও উপহার দিয়ে দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চাইতো। আবার ওদিকে সেই মেয়েটিকেও আমারই মতো অন্ধকারে রাখতো তোর দাদা। তার সাথেও সম্পর্ক চালিয়ে যেতো সেখানে ফিরে গেলে। একসময় আমায় বিলেত নিয়ে যায় ঠিকই, হয়তো ভেবেছিলেন ঘরকন্নার জন্যে বাঙালি নারীই উপযুক্ত। কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় একদিন। তাদের সকল কনভারসেশন থেকে আমি বুঝে গেলাম যে তোর দাদা মুখে না বললেও এভাবে চলতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আমার প্রতি দায় এড়াতেও পারছিলেন না। আর তাই আমি নিজ থেকেই তাকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিলাম। যাকে স্বামী বলে জেনেছি-মেনেছি কোনদিন, তাকে এই অস্বাভাবিক জীবনে কিভাবে থাকতে দেই বল…সেই মেয়েটি বিলেতি হলেও তোর দাদাকে ভীষণ ভালোবাসে। ওরা একসাথে হয়তো ভালোই আছে লিভ ইন রিলেশনশিপে।

#চলবে

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here