ভালোবাসা
২৬তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
অরুর কথা শুনে বিজুর চোখে জল চলে এলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে সে বললো, পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস অরু। আমার জন্যেই আজ…অন্য কোথাও তোর বিয়ে হয়ে গেলে এমনটা ঘটতো না হয়তো।
অরু শুকনো হেসে বললো, তুই তো আমার ভালোই করতে চেয়েছিলি রে। কিন্তু ভাগ্যটাই খারাপ তাই… তোর তো করার কিছু ছিলো না। আর তোর দাদার ও আসলে কোন দোষ নেই, তার ওপর রাগ রাখিস না। বিলেতি মেমদের মতো সুন্দরী নই আমি, তাই হয়তো সে ভুলতে পারেনি তাকে…বলতে না বলতেই অরুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
বিজু দু’হাতে তার মুখখানি তুলে ধরে বললো এসব কি বলছিস আবোলতাবোল, তোর চেয়ে বেশি সুন্দরী আর কেউ নয় আমার চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, এই প্রিয় মুখখানি দেখি কত মুগ্ধ নয়নে আর তোকে দেখাটা যেন আমার কাছে আরাধ্য বস্তু। কখনো কি লক্ষ্য করিসনি তুই?
সে কথার জবাব না দিয়েই অরু তার চিবুক থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো…বাড়ি ফিরে যা বিজু, অনেক রাত হয়ে গেছে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বললাম, তুই ও চল।
সে অবাক বিস্ময়ে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, ডিভোর্স হয়েছে শুনেই…ছিঃ বিজু, তোকে আমি ভালো ভাবতাম আর তুইও…ডিভোর্স মেয়েদের থেকে সুবিধা নেয়াদের দলেরই হয়ে গেলি!!!
আমি হতাশ চোখে চেয়ে থেকে বললাম, বাবা-মা তোকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতো অরু।দাদার সাথে সম্পর্ক না থাকলেও তাই সে বাড়ি যতখানি আমার আর দাদার ততখানি তোর ও। নিজের বাড়ি থাকা স্বত্বে তুই কেন হোস্টেলে পঁচে মরবি বল তো?
অরু তখন বললো, আমার কথা আর ভাবিসনে বিজু…নিজেকে সামলে নিয়েছি আমি, একটা স্কুলে চাকরি করি আর ক’টা টিউশন পড়িয়ে চলে যাচ্ছে আমার…পিএসসি’র জব এন্ট্রান্স এক্সাম দেবো সামনে, কিছু না কিছু হয়তো জুটে যাবে। তারপর ওরা পোস্টিং যেখানে দেবে সেখানেই থাকবো।
রাস্তায় লোকেদের ভীড় বাড়ছিলো তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। কান্না আটকে রাখতে রাখতে গোটা পথ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়ে গলার ভেতরটায় দলাপাকিয়ে আসছিলো আমার। নিজের ইচ্ছার খামখেয়ালী জেদে যেন বিনাদোষেই অরুর জীবনটা ছারখার করে দিলাম।
ফের বাড়ি ফিরে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছিলো না কিছুতেই, শুধু অরুর কথা ভেবে ভেবে বুকটা যেন হাহাকার করে উঠলো আমার। নিজের অজান্তেই কান্না এসে গেলো৷ কাঁদতে কাঁদতে কখন যে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলাম তা নিজেও জানিনা…
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আজ। শোয়া থেকে উঠে বসে একটুক্ষণ ভাবনায় ডুব দিলাম। একে একে গতকাল ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মনে পড়তেই আমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে অরুর সেদিনকার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম একটু আড়াল করে।
সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থেকে মনে হচ্ছিলো যেন একযুগ পার হয়ে গেছে। আমি আসতে পারি ভেবে কি সে আরো আগেই বেরিয়ে পড়েছে!…নিজের মাথায় এসব চিন্তার উদ্রেক হলেও ফের একসময় অরুর দেখা পেলাম। সে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা সামনে গেলে তার পাশাপাশি চলতে চলতে বললাম, তুই আর বিয়েশাদি করবি না রে অরু?
বিজুর অকস্মাৎ এমন প্রশ্নে যেন হকচকিয়ে গিয়ে অরু বললো, এসব কি বলছিস!!!
আমি বললাম, যা বলেছি তা তুই ঠিকই শুনেছিস…
এখনো ভেবে দেখিনি আর যখনেরটা তখন ভাববো, রুক্ষ স্বরে জবাব দিলো অরু।
আমি তার কাধে হাত রেখে আমার দিকে ওর মুখ ঘুরিয়ে বললাম, আমাকে তোর কেমন লাগে? আচ্ছা তুই কি বুঝিস না যে আমি তোকে…
অরু আমাকে আর কথা শেষ করতে না দিয়েই ফের বললো, ডিভোর্স মেয়েদের অমন অনেক প্রপোজালই পাওয়া হয়। সেসব ভাবতে বসলে আর জগতে একা চলা লাগবে না…যেতে দে আমায়, লোকের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে চলতে এখন আর চেনা পরিচিত কেউ গায়ে হাত দিলেও সহ্য করতে পারি না।
আমি অতর্কিতভাবে অরুকে জড়িয়ে ধরলাম যেন আষ্টেপৃষ্টে। বুকের সাথে মিশিয়ে ওকে নিজের মাঝে আটকে রাখতে চাইলাম। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হতে একসময় হাল ছেড়ে দিলে আমি তাকে আমার বাহুবন্ধনী থেকে মুক্ত করে তার চোখে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমার ছোঁয়াতেও কি তোর তেমন মনে হলো বল তো?
অরু আমায় কষে একটা চড় লাগিয়ে ফের কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।
আমি তার পিছে পিছে গিয়ে দেখি সে মেল ট্রেনে চড়ে বসেছে। ওর পাশের সিটে বসে তাকে বললাম, বিয়ে তো কখনো না কখনো তুই কারোকে না কারোকে করবি…তবে আমায় নয় কেন!!!
সে বেশ কড়া ভাবে বললো, আর যাকেই করি তোকে কখনো করবো না।
যে কারোকেই করতে পারবি কিন্তু আমায় নয়…কেন রে আমার দোষটা কোথায় বল?
তোর দোষ হলো যে তুই আমায় তোর দাদাকে বিয়ে করতে জোড় করেছিলি।
এখন কি এভাবে তার শাস্তি দিবি!!!
হ্যাঁ দেবো…তোর তো আরো বড় শাস্তি হওয়া উচিত।
আর কি অপরাধ আমার?
তোর অপরাধ হলো যে তুই আমার বিয়ের পর আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছিলি…
সেটা কি আমি জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে করেছি!!! তুই বন্ধু ছিলিস, ভালো হয়তো তোকে আগেও বাসতাম কিন্তু বুঝতে পারিনি তখন। আচ্ছা তুই কখনো আমায় ভালোবাসিসনি?
বন্ধুর মতো ভালোবেসেছি, একইসাথে স্কুল থেকে চলেছি তাই ভাবতাম বাদবাকি পড়ালেখাও একই সাথে করে নিয়ে একসাথে চাকরির জন্যে এপ্লাই করে এক্সাম দেবো, ক্যারিয়ার গড়বো, তুই সবসময় আমার সাথে সাথে পড়াশোনা করবি।
ও আচ্ছা, লেখাপড়া করিনি বলেই তাহলে তোর আমাকে পছন্দ নয়। একসাথে পড়ালেখা করতে করতে আগে গিয়ে যদি ভালো ক্যারিয়ার হতো তখন কি তুই ভেবে দেখতিস আমার কথা? বারো ক্লাস পাশ বলেই তাহলে আমি তোর হিসেবের খাতায় বাদ পড়ে গেলাম। এমন কারোকে তো আর বিয়ে করা যায় না…তাই বুঝি রিজেক্টেড?
দেখ তুই কিন্তু এখন আমায় ভুল বুঝছিস, আমি তেমন কিছু মিন করিনি। আর তুই অযোগ্য হতে যাবি কেন!!! তোর জন্যে অযোগ্য তো আমি, ডিভোর্স হওয়া মেয়েকে কেন তুই অবিবাহিত ছেলে হয়ে বিয়ে করতে যাবি?
কেন যাবো সেটা কি তুই জানিস না? তোকে যে আমি অনেক ভালোবাসি তাই…
জানি, আরে তুই কি ভেবেছিস তোর আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, মিল করে পোশাক পরা, আমার হাতে ভাত খেতে চাওয়া আর যখন যা লাগে তা চাওয়ার আগেই এনে হাজির করাটা আমি ঠিক বুঝিনি! তোর দাদা ফিরে এসে আমায় নিয়ে যাবে সেই শোকে যে তুই মদ গিলেছিলি তাও কি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছিস! তোর সিগারেট খাওয়া থেকে শুরু করে আমার হাতে পরিয়ে দেয়া সোনার বালা পর্যন্ত সবই বুঝতে পেরে লক্ষ্য করেছি আমি।
তাহলে কখনো আমায় বারণ করিসনি কেন? দৃঢ়কন্ঠে জানতে চাইলো বিজু।
করিনি কারণ আমি চাইনি এসব কথা তুলে তোর আর আমার সম্পর্কটা খারাপ করতে…জীবনটাকে আমি জটিলতায় পরিপূর্ণ হিসেবে দেখতে চাইনি তাই চুপ থেকেছি।
তাহলে দাদা ফিরে আসার পর প্রথমে আমার সাথে কাটকাট হয়ে থাকছিলি কেন?
তখন তুই এত বেশি ইমোশনালি আমার প্রতি উইক হয়ে পড়েছিলিস যে, আমি ভয় পাচ্ছিলাম তোর দাদা না কিছু টের পেয়ে যায়।
মায়ের মৃত্যুর পর তাহলে আবার ফিরে এলি কেন আমার কাছে?
তখন তোর জন্যে আমার খুব মায়া হচ্ছিলো তাই, মনে হলো তুই বড় বেশী একা হয়ে গেছিস।
আমিতো এখনো একা, এখন আর তোর মায়া হয় না?…বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অরুর চোখের পানে চেয়ে রইলো বিজয়।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।