ভালোবাসা
২৭তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
অরু সেদিন আমার সেই প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই চুপচাপ বসে থেকে একসময় তার গন্তব্য এলে পরে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো।
আমি একবুক হতাশা নিয়ে তার গমন পথের দিকে চেয়ে যতক্ষণ চোখ তাকে দেখতে পেলাম দেখে ফের দাঁড়িয়ে থেকে ফিরতি ট্রেনে বাড়ি চলে আসলাম।
বাড়ি ফিরে এসেছি পর ফোন বের করে দেখি যে আজাদ বারবার কল দিচ্ছিলো, কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। আর তাই কল রিসিভ না করে আমি মোবাইলটা সুইচড অফ করে রাখলাম।
শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে যতখানি পারলাম জলের স্রোতে যেন পুড়ে যাওয়া হৃদপিণ্ডটার জ্বালা কমাতে চাইলাম। অন্তরের ভেতরে যে দহন তার আগুন কি নিভবে এই জলের তোড়ে…সে আমার জানা নেই, তবুও যেন বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ঠিক কতক্ষণ এভাবে রইলাম জানিনা…যখন ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করেছি, তখন কাপড় বদলে এসে শুয়ে পড়লাম। ফের যখন উঠেছি তখন ঘরের আয়নায় দেখি যে, চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে আমার। জ্বর আসছে বোধহয়…একটা ক্রুর হাসি হেসে যেন আমি নিজেকেই উপহাস করলাম।
ফোনটা অন করতেই দেখি আজাদ আর সুজনের মেসেজেস। আমায় না পেয়ে পেয়ে বোধহয় খুব দুশ্চিন্তা করছিলো।
বেশ রাতে সুজন কল করে বললো, আজ সারাদিন কোথায় কোথায় ছিলি বল তো?
আমি সেটার জবাব না দিয়ে বললাম, এখন তো বাড়িতেই আছি আর ঘুমুচ্ছিলাম তাই হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গিয়ে ফোন অফ ছিলো।
অরুর ব্যাপারটাকে সে আমার ভ্রম বলেই ভাবছিলো, আর তাই আমিও সেটা খুলে বললাম না। ফের সে জানালো, জরুরী কাজে তাকে এখনই কোথাও যেতে হচ্ছে… কবে নাগাদ ফিরতে পারবে বলতে পারছেনা। আমি ক’দিন দেশে আছি জানতে চাইলে বললাম, ছুটি আছে আরো দিন দশেকের।
খানিকক্ষণ সে চুপ থাকায় আমি তাকে আবারও বললাম, সাবধানে যাস…এলে দেখা করিস।
ভালো থাকিস, পরে কথা হবে…বলে সুজন তারপর কল রাখলো।
গোটা রাত আমি জেগে থেকে ভাবলাম, অরু কেন বুঝতে চাইলো না যে আমি ওকে এভাবে একা ছাড়তে পারি না…ওর প্রতি দায় কি শুধুই দাদার কারণে ছিলো আমার!!! তাকে বন্ধু জেনেছি যেদিন থেকে সেদিন থেকেই তো কখনো একা ছাড়িনি। সব বিপদাপদ থেকে তাকে রক্ষা করাটা যেন অলিখিত সংবিধান হয়ে গিয়েছিলো আমার জীবনে।
সে হয়তো ভাবছে, তার ডিভোর্সের কথা শোনামাত্রই কেন আর দেরি না করেই তাকে বিয়ে করতে চাইলাম? কিন্তু সত্যটা হলো যে, সে যতই এভাবে একা পথ চলবে ঠিক ততই সমাজের কণ্টকাকীর্ণ মানুষের আচরণের পঙ্কিলতায় ভেঙে পড়বে। তার মনে আর কেউ আঘাত করুক তা বিজু সইবে কি করে!!! বিজুর ভুলের জন্যেই তো আজ সে কষ্ট পাচ্ছে, আর তাই তার ক্ষতে মলম লাগানোর কাজটাও সেই করবে। ভালোবাসার প্রলেপ দিয়ে তার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে।
ভোরের আলো ফুটতেই সে মুখহাত ধুয়ে পোশাক পাল্টে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মোড়ের চায়ের দোকানটা থেকে চা-নাস্তা সেরে স্টেশনে এসে ঘড়ি দেখতে লাগলো। রোজ রোজ ওর মেয়েদের হোস্টেলের সামনে দাড়িয়ে থাকায় অরুর সমস্যা হতে পারে। আচ্ছা অরুকে একটা মোবাইল সেট গিফট করলে কেমন হয়…অন্তত তার খোঁজখবর তো সে রাখতে পারবে।
আর একটু নাহয় কথাও বলা যেতো। কিন্তু অরু কি নিতে চাইবে এখন আর? যে বিয়েটা দিয়ে সে অরুকে কাছে রাখতে চাইছিলো চিরদিন, সেই বিয়েই যেন তাকে চিরতরে অরুর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই দূর থেকে অরুকে আসতে দেখলাম। বিজু এগিয়ে গিয়ে বললো, আচ্ছা…আমি কি তোর শত্রু যে আমায় দেখামাত্রই তুই এভাবে মুখভার করে রেখেছিস?
অরু কিছু বললো না জবাবে, চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলো।
বাড়িতে তো থাকবি না…তাহলে তোকে বরং একটা মোবাইল সেট কিনে দেই আমি? সাথে সাথে রাখলে শুধু একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম, বললো বিজু।
অরু এতক্ষণে আমার দিকে পাশ ফিরে তাকালো, তারপর বললো…তুই আগে বিয়ে কর, তারপর আসবো তোর বাড়িতে।
তার এমন আকস্মিক আক্রমণে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে একটু ধাতস্থ হতেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, বিয়েই তো করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাত্রী তো রাজি নয়।
সে বললো, তোর জন্যে পাত্রীর অভাব হবে না বিজু।
আমি বললাম, আমার আর কারোকে চাইনা শুধু তোকেই চাই।
কেন শুধু শুধু জেদ করছিস বল তো, এখন আর তা হয়না। দয়া করে, আমাকে আর দয়া দেখাস নে।
কেন হয় না? করুণা করছি ভাবছিস!!! আমি যে তোকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি, তা তো তুই জানিসই।
দেখ বিজু, আমি আর কোন জটিলতা চাইনা আমার জীবনে…আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
রোদের কারণে যেন আমার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠলো। অরু কি বুঝলো কে জানে, সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো…তোকে দেখে মনে হচ্ছে যে তোর শরীর ভালো নেই, অসুস্থ শরীরে কে তোকে এই সাতসকালে এখানে আসতে বলেছে বল তো?
আমার মন বলেছে…শরীর যে খারাপ সেটা তোর চোখে পড়লো, আর মন যে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সেটা কি আমার মুখ দেখেও তুই বুঝতে পারছিস না?
অরু গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর একটা রিকশা ডেকে আমায় উঠে বসতে বললো।
ফের নিজেও সাথে চললো, বেশ ভালো লাগছিলো আমার।
বাড়ির গেট অব্দি এসে আর ভেতরে ঢুকতে চাইলো না যেন…আমাকে ঘরে বিশ্রাম করতে বলে ফের সেই রিকশাতেই ফিরে গেলো।
আমি অরুর কথা রাখতেই বাদবাকি সময়টা আর ঘর ছেড়ে বেরুলাম না। তার কথার বিরুদ্ধাচারণ করার সাধ্যি যে আমার নেই।
বিকেলবেলায় ঘুম ভাঙলো আজাদের ডাকে। রাস্তার দিকের জানালার পাশ থেকে নক করে সে জাগালো আমায়। ফের উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সে ঘরে এসে আমার চোখমুখ দেখে ডাক্তার দেখানোর জন্য অস্থির হয়ে গেলো। ভীষণ বকতে লাগলো আমায় তাদের না জানানোর জন্যে। রুখসানার সামনে আমি বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমার অপ্রস্তুত ভাব দেখে সে বলে উঠলো, বিজয়দা তুমি আমাদের সাথে বাড়ি চলো..একা একা অসুস্থ শরীরে পড়ে থাকলে কে দেখবে তোমায়!!!
তার কথা শুনে মনে হলো, এমন একটি ছোট বোন থাকলে আমার মন্দ হতো না। পরক্ষণেই সে বললো, প্রীতিকাও তোমার খুব খোঁজ করছিলো জানো…
আমি চুপচাপ শুনে গেলাম, কিছু বললাম না।
রুখসানা সাথে করে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছিলো। সেগুলোর মধ্য থেকে কতকটা না খাইয়ে যেন উঠতে চাইলো না। আজাদ ডাক্তার ডাকতে চাইলে আমি বললাম, আরে ঘরে থেকে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো।
ফের আজাদ বললো, ফোন আর যেন সুইচড অফ না পাই…যেকোন প্রয়োজনে কল দিস আমায়। আর দু’দিনের মধ্যে সুস্থ না হলে ডক্টর মাস্ট।
আমি জোর করে মুখে একটা হাসি এনে বললাম, ভালো হয়ে যাবো দেখিস…একদম ভালো।
আর কারোকে একটুও জ্বালাবো না, অস্ফুটে যেন স্বগতোক্তি করে উঠলো বিজু।
কারো বাড়িতে থাকলে তো তোর অপরাধ হবে…কি আর বলবো, তোকে নিয়ে তো আর পারিনা। অন্তত আমার সঙ্গে যোগাযোগটা রাখিস, বলে আজাদ রুখসানা সমেত বেরিয়ে পড়লো।
ফের আজ চারদিন হলো আমি ঘর ছেড়ে বেরুইনি। আজাদ আসে খাবারদাবার নিয়ে যার বেশিরভাগই খেতে পারি না, তাই নষ্ট হয়। মুখে একদম রুচি নেই, কিন্তু সেটা ওদের বোঝাবো কি করে…রুখসানার ছোট বোন সুলভ শাসনে তার জো নেই। ফোন করে টাইম টু টাইম জানতে চাইবে কিছু খেয়েছি কিনা। আবার মাঝেমধ্যে আজাদের সাথে এসেও খবরদারি করতে থাকে।
এর মাঝে একদিন প্রীতিকাও এসেছিলো। দুঃখী দুঃখী চেহারায় তাকিয়ে থেকে একসময় অবাক কন্ঠে বললো, কি হাল করেছো নিজের!!!
আমি হেসে বললাম, যার জীবন বেহাল তার আবার চেহারার হাল ঠিক থাকে কি করে।
সে কি বুঝলো কে জানে! হঠাৎ বলে উঠলো, তোমার অবস্থাটা একদম যেন আমার মতো…তুমিও খুব একা তাইনা?
আমি মৃদু হেসে নীরবে বসে রইলাম।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।