ভালোবাসা ৩য়_পর্ব

0
857

ভালোবাসা
৩য়_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

দাদার বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিলো বিজুর। বিয়ের আয়োজনের সবদিক সে একাই সামলাতে চাইতো। সব যেন একেবারে মনমতো হয় তাই কারো হাতে ভার দিয়ে থাকতে পারতোনা। এই করে করে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে যে কতদিন তার ইয়ত্তা নেই। পড়ালেখায় এমনিতেও খুব একটা মনোযোগ ছিলো না তার। দস্যি ছেলে তাই ক্রিকেট খেলে, পাড়া বেরিয়ে আর এর ওর গাছের ফল চুরি করেই দিন কাটাতে ভালোবাসতো। যা একটু আধটু পড়ালেখা করতো সে ও বাবার ভয়ে। দাদা ছিলো বিলেতে আর মা বেশি বয়সের সন্তান বলে একটু বেশিই যেন লাই দিতো।

অরুর তার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো খুনসুটিময়। পড়ালেখায় ভালো হলেও দুরন্তপনায় কিছু কম ছিলো না সে। আর তাই বিজুর সাথে মেলায় ঘোরা, ক্রিকেট খেলা সব কিছুতেই অরু ও হাজির। তবে অরুর আবার সবটাই যেন মাপ-জোখের মতো সময় মেনে চলা। কোন কাজে কতখানি সময় বের করবে এসব যেন আগে থেকেই সে ভেবে রাখে। এক্সাম এলে অরুই তাকে ঘাড় ধরে পড়াতো, যেন বিজুটা কিছুতেই ফেল করে আর এক ক্লাস নিচে না পড়ে থাকে। কিন্তু বিজু আর তার অরুর সাথে কই পড়তে পারলো! সে পিছেই পড়ে গেলো আর এগুতে পারলো না।

না জীবনে, না পড়ালেখায় কোনটাতেই অরুর সাথে সে তাল মেলাতে পারেনি । অরুর সাথে তার মতো ব্যাকবেঞ্চারের কিভাবে যায়, আর তাইতো সেটা কখনো তার মনেও আসেনি। অরু বেস্ট আর সে বেস্টটাই ডিজার্ভ করে। দাদা আর অরু দু’জনে মিলে পারফেক্ট জুটি, এসব ভেবে ভেবেই তো তার খুশি লাগছিলো।

অরুদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না কোনকালে। তার বাবা কটন মিলের সাপ্লায়ারের কাজ করে যৎসামান্য রোজগার করতো। সে টাকায় তাদের খাওয়া-পরা কোনরকমে চলতো। ছেলের শখ করে করে একে একে ছয়টি কন্যার জনক হয়ে তার বাবা যেন হিমসিম খাচ্ছিলো সংসার চালাতে। অভাব অনটন থেকে বাঁচতেই বোধহয় বড় দুই দিদি প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলো। সেজদির বিয়ে দিতে বাবাকে জমি পর্যন্ত বিক্রয় করতে হয়েছিলো।

মা বলতো, দেখ অরু তুই তো জানিস আমাদের সামর্থ্য কতদূর…তোর লেখাপড়ায় আগ্রহ আছে সে তো ভালো কথা, কিন্তু আমি আমার মেয়েদের বড়জোর মাধ্যমিক বা এর বেশি দুয়েক ক্লাস হয়তো পড়ার খরচ চালাতে পারবো বাদবাকি তো আর আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তোর ছোট আরো দুটো বোন রয়েছে, ওদের ও তো পড়ার খরচ বাড়ছে দিন দিন, আমরা এভাবে আর কুলোতে পারছিনা।

অরু বলতো, আমি নাহয় টিউশন খুঁজে নেবো, তুমি অত চিন্তা করো না মা।

মা বলতেন, আমাদের এ পাড়াটা ভালো নয়, বখাটে ছেলেদের জন্য তুই বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমার খুব ভয় করে, তার উপর আবার টিউশন! তারচেয়ে বরং শিক্ষিত ভালো পাত্র দেখে তোর বিয়ে দিয়ে দেই, বিয়ের পর পড়িস।

অরু বলতো, পরে যদি আর না পড়ায়?

মা বললো, সে আমরা তাদের বলে নেবো আগেই আর খোজখবর না নিয়ে তো তোর বিয়ে দেবোনা, ভালো পরিবার হলে নিশ্চয়ই পড়াবে, তুই অত চিন্তা করিস না।

অরুর দুশ্চিন্তা তবু্ও যায়না, যদি বিয়ের পর সংসার সন্তান এসব দায়িত্বের মাঝে পড়ে তার আর পড়াশোনা না হয়, সে ভাবনা তার মাথায় জেকে বসে। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলে যে অনেক কিছু মেনে নিতে হয় তা যেন সে তার এই ক্ষুদ্র জীবনে বেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছে। মেনে আর মানিয়ে নিয়ে কোনমতে সম্মানটুকু বাঁচিয়ে চলার নামই তো জীবন তাদের কাছে।

আর তাই সেজদি এসে যখন তাকে সাজিয়ে গুজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করলো তখন সে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। পাত্র উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন তাই তার বিশ্বাস ছিলো যে পড়াটা হয়তো আর বন্ধ হবেনা। কিন্তু যখন সে বিজুকে দেখলো তখন যেন একটা ভরসা পেলো যে আর যাইহোক বিজু পাশে থাকলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে যে তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট করবে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তার।

মেয়ের বিয়ের দিন অরুর মা খুব কাঁদলো আর বললো, অরু আমায় ক্ষমা করে দিস মা, তোকে অত বয়সের কারো সাথে বিয়ে দিচ্ছি বলে রাগ রাখিস না মনে, তোর পড়ালেখার আর চিন্তা রইলো না আমার। কি করবো বল, গরীব বাপ-মা চাইলেও সব শখ তো তোদের পূরণ করতে পারিনা, আর তাই বড় ঘরে তোর বিয়ে দিলাম যাতে সুখে-শান্তিতে থাকিস, ভালো থাকিস।

অরু মায়ের হাতটা ধরে মুখে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে যেন মাকে আশ্বাস দেয় যে তার কারো প্রতি কোন রাগ নেই। মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে হাত ছাড়িয়ে একছুটে নিজের ঘরে চলে যান।

বিয়ের পর সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো, বিজু কিছু ভুল বলেনি। মলয়ের মতো উদার মানসিকতার একজন মানুষ স্বামী হিসেবে তার স্বাধীনভাবে পথ চলায় কখনো বাধা দেয়নি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সকলেই যেন তাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। শ্বশুরতো বলতোই, বিজুটাকেও পারলে ধরে বেঁধে পড়িয়ো। কিন্তু বেশিদিন বাঁচলো না লোকটা, লাস্ট স্টেজে থাকা ক্যান্সার ধরা পড়লো তার বিয়ের ছ’মাস না যেতেই। এরপর আর অল্প কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যুর পর থেকে বিজুটা যেন কেমন বদলে যেতে লাগলো, ফাঁকিবাজ থেকে যেন দায়িত্ববান ছেলে রুপে হাজির হলো।

বাবার ব্যবসা সামলে, লোন চুকিয়ে, চিকিৎসাবাবদ ধার-দেনা সব পরিশোধ করে যেন ঘরের অলিখিত কর্তা হয়ে গেলো। মা খুব ভরসা করতে শুরু করলো বিজুকে। কারণ মায়ের অন্ধের ষষ্ঠী তার পিএইচডি ডিগ্রিধারী পুত্র মলয় না হয়ে বারো ক্লাস পাশ বিজুই হয়েছে।

এসব ভেবে প্রথম প্রথম অরুণিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, কিন্তু সে যেরকম পরিবার থেকে এসেছে, তারপর এখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে, তাই সেখানে তার মতামত দেয়া তাও আবার অতো বয়সের ব্যবধানের স্বামীকে…কতটা সমীচীন সেটা ভেবে চুপসে যেতো।

আমি বিজু, প্রথম যেদিন অরুকে গায়ে হলুদের সাজ পোশাকে দেখি তখন মনে হচ্ছিলো যেন অরুটা পর হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, আরে বোকার মতো ভাবছি কেন! অরুতো বিয়ে করে আমাদের বাড়িতেই আসছে। নিজের বোকামিতে নিজেরই খুব হাসি পাচ্ছিলো, কিন্তু পরে ভাবলাম অরু আমার ছেলেবেলার বন্ধু তাই হয়তো একটু মন কেমন করছে। কিন্তু আমরা তো চিরকাল বন্ধু থাকবো আর সেজন্যেই অরুর বিয়েতে তেমন কিছুই যায় আসবেনা। সব থাকবে আগেরই মতন।

কিন্তু বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগলো অরুকে দেখলে ততই যেন মন কেমন করতো। তখন আমি কারোকে কিছুই বলতে পারতাম না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন গুমরে যেতাম। বৌ সাজে অরুকে যে কি সুন্দর লাগছিলো! এত বেশি ভালো লাগছিলো যে আমার চোখে জল এসে গেলো। কেউ দেখে ফেলার আগেই সেটা আড়াল করলাম।

অরু বাড়িতে এসে গৃহপ্রবেশ এর পর থেকে সময় যত পার হলো আর কালরাত্রির পরের দিন পেরিয়ে রাত বাড়তে লাগলো, ততই যেন আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছিলো। সবার হাসিঠাট্টায় ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি যে অরু এখন আমার চেয়ে বেশি দাদার। সে রাতে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সারারাত যেন ছটফট করছিলাম কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়। ভোর থেকে বাসায় যত অতিথি এসেছিলো সবার সামনে হাসিটা ধরে রেখেছিলাম ধরা না পড়ে যাই সে ভয়ে, কিন্তু নিজের হাসিটা যেন কান্নার মতো শোনাচ্ছিলো নিজেরই কানে।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here