ভালোবাসা ৫ম_পর্ব

0
807

ভালোবাসা
৫ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

সমুদ্রে যাবার চেয়ে অরুর পাগলামো দেখতেই বেশি ভালো লাগছে আমার। সে কিভাবে কিভাবে জানি সব তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছে এ ক’দিনে। কোথায় কোথায় ঘুরবো আর কি কি খাবো সব।

আমার ঘরে এসে আমাকে শোনাতেই আমি হেসে বললাম, তো মিস টপার পড়াশোনার মতো ভ্রমণের সিলেবাস ও কমপ্লিট করার পুরো রুটিন করে ফেলেছেন নাকি?

অরু হাসিমুখে বললো, আমাদের একসাথে দূরে কোথাও প্রথম কোন ট্রিপ…জানার আগ্রহটা একটু বেশি তো থাকবেই।

অকস্মাৎ এমন কথা শুনে আমার মুখটা যেন অমনি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল…তোর আর দাদার প্রথম ট্যুর তাই এত উৎসাহ? জানতে চাইলাম আমি।

অরু অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে যেন পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আমায়…তারপর হঠাৎ বলে উঠলো, তোর হয়েছে টা কি বলতো? কোন কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই।

কই নাতো! আমার আবার কি হবে, আমি যথেষ্ট উৎসাহী তোর কথা শুনতে…বলে মুখে জোড় করে হাসি-খুশি ভাব আনার চেষ্টা করলাম।

তাহলে সব কথার কেন উল্টো মিনিং দাঁড় করাস?

হয়তো জীবনটাই উল্টে গেছে তাই…আনমনে খুব ধীর স্বরে বলে উঠলাম।

কিছু বললি আমায়? বলে যেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অরু।

নাহ্…তোর সব প্যাকিং করা শেষ? দেখিস অতিরিক্ত কিছু নিতে গিয়ে দরকারী জিনিস না ফেলে যাস।

কি নেবো আর কি নেবোনা তাইতো ভেবে পাচ্ছিনা।

শীতের কাপড় নিস, তোর যা ঠান্ডার ধাত।

এই রে…ভালো কথা মনে করেছিস, আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম।

হুম…শুধু পড়া মনে থাকে, আর সব ভুলে যাস। গুড স্টুডেন্টদের এটা কমন সমস্যা। মাথায় রাজ্যের পড়া চাপালে কতটা আর ধরবে, আমি আছি বলে রক্ষে।

তুই না থাকলে আমার কি যে হতো…বলে চোখ পাকায় অরু।

দাদার সাথে বিয়ে না হয়ে অন্য কারো সাথে বিয়ে হতো…বলে ক্ষেপাতে চাইলো বিজু।

দাদা এসে কখন যে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে তা আমরা দুজনের কেউই টের পাইনি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে আমার যেন মেরুদণ্ড বরাবর একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেলো। দাদা কখন থেকে কথা শুনছে, আমার কথা শুনে কিছু কি তবে বুঝে ফেললো!

ফের আমার সব ভয় দূর হয়ে গেলো দাদার মুখে হাসি দেখে…সে ঘরে এসে অরুর পাশে বসে বললো, তোকে আমি আলাদা করে বলিনি দেখে তোর নাকি খুব অভিমান হয়েছে! কিরে এতদিনে এই চিনলি তোর দাদাকে? তোকে কি আমি কম স্নেহ করি যে এখন আমি মুখে না বললে কিছুই আর বিশ্বাস করতে পারিস না!

বিজু মাথানিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। নিজের উপর খুব রাগ হয় তার। মনে মনে বলে, তুই কি রে বিজু? দাদা তোকে কত ভালোবাসে আর তুই কিনা! ছিহ…যেন নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেয়।

দাদা উঠে যাবার সময় তার পিঠে হাত রাখে, গলাটা যেন কান্নায় বুজে আসতে চায় বিজুর। সে খুব খারাপ নইলে অমন ভাবনা তার মনে আসতোনা কখনো। এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে যেন শেষ হয়ে যায়।

অরু নিজের মতো বকবক করে খানিকক্ষণ, তারপর পড়তে চলে যায়।

বিজু পরদিন সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরে ফিরে আসতেই অরুর মুখোমুখি হয়। কিরে তোর চেহারার একি হাল হয়েছে! ট্যুরে যাবার আগেই এত কাহিল হলে পরে ঘোরার এনার্জি পাবি কি করে?

বিজুর বলতে ইচ্ছে করে, কোথাও যাচ্ছিনা আমি।তোর আর দাদার মাঝে আমাকে টানিসনা। কিন্তু দাদা শুনতে পেলে কি ভাববেন? আর অরু? সে তো কত সরলমনে মিশে তার সাথে, যদি এসব জানে তবে বোধহয় কস্মিনকালেও আর কথা বলবেনা।

সারাক্ষণ কি অত ভাবিস বলতো?…অরু অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে জানতে চায়।

কিছু না, যাই ব্যাগপ্যাক রেডি করে ফেলি…বলে একপ্রকার পালিয়ে এলাম যেন।

কাল ট্রেনে যাচ্ছি আমরা। আর তাই আজ থেকেই খুব তোড়জোড় চলতে লাগলো। মা যে কত রকমের নারু, পিঠা আর হাতে তৈরি খাবার দিতে লাগলো তা দেখে দাদা আর আমি হেসেই কুটিপাটি।

অরু মার হয়ে আমাদের বেশ শাসাচ্ছে, মা ও অরুকে পেয়ে যেন ভুলে গেছে তার দুই ছেলেকে। অরু যা বলবে তাই সই।

বাবা শুধু একবার এসে যাবার সব ব্যবস্থা জেনে দাদাকে বললেন, সাবধানে যেয়ো আর বৌমার দিকে খেয়াল রেখো। বাচ্চা মেয়ে একটু বেশিই চঞ্চল।

দাদা হেসে বললো, বিজুর সমবয়সীই তো…ওর খেয়াল রাখতে বলবে না?

ওটা ভালো বিচ্ছু আছে, তুই ওকে ছেড়ে আসলেও একা চলে আসতে পারবে।

বাবার কথা শুনে, দাদা আর আমি হাসছি কিন্তু মা ভীষণ রাগ করলেন। বাবাকে বললেন, আমার লক্ষীমন্ত ছেলের নামে কিসব অপবাদ! ও হারিয়ে গেলেই বুঝি তুমি খুশি হবে?

বাবা অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তোমার বুদ্ধিমান ছেলের সুনামই তো করলাম।

এবার মা, অরুসহ আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।

স্টেশনে যাবার আগে অরু পা ছুয়ে আশীর্বাদ নিয়ে নিলো বাবা-মার কাছ থেকে। মা বললেন, ভালোভাবে থেকো।

বাবা বললেন, বিজুর পাল্লায় পড়ে দুষ্টুমি কম করো।

দাদা মৃদু হেসে বললো, তোমরা চিন্তা করোনা…ওরা ভালোই থাকবে।

আমার যেন প্রাণটা ছটফট করে উঠলো, ওরা মানে আমি আর অরুই তো। আচ্ছা আমি আর অরু মিলে আমরা হতাম যদি, তবে কি কারো খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?

পরক্ষণেই নিজেকে শাসালাম, বিজু তুই খুব খারাপ… এসব আর ভাবিস না।

স্টেশনে পৌছার পর থেকে অরুর যেন খুশির কোন ঠিকানা নেই। সে বড়বড় চোখ করে চারপাশ দেখছে।লোকের জটলা, ভিড়ভাড়, কুলিদের হট্টগোল সবই যেন তার ভালো লাগছে। কখনো বোধহয় বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যায়নি আগে। স্টেশনে ট্রেন আসবে কখন জানার জন্যে সে একটু পরপর দাদার হাতে থাকা ঘড়ি ঘুরিয়ে সময় দেখছে। আমি চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসার এনাউন্সমেন্ট শুনে আমরা লাগেজ সমেত ছুটে গেলাম।

অরুর যেন ভীষণ মজা…সে শাড়ি পরে দৌড়াতে গিয়ে হিল জুতোর কারণে হোঁচট খেতে নিতেই, আমি তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিভাবে যেন ঠিক আগ মূহুর্তে দাদা তার কাধে হাত রেখে তাকে আগলে রাখলো।

ফের আমি অপ্রস্তুত হয়ে যেন একটু ইতস্তত ভাব কাটাতেই খুব দ্রুত ট্রেনে উঠে কেবিন খুজতে লাগলাম।

পেছন থেকে দাদা আর অরু এসে হাজির হতেই সবাই যার যার সিটে বসে পড়লাম। দাদার এক কলিগও যাচ্ছে আমাদের কেবিনে শেয়ারে। আমরা একপাশে বসেছি, আরেকপাশে তারা। অরু বসেছে মাঝে, দাদার সেটা নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কত সহজেই যেন আমাদের বন্ধুত্বের জন্য জায়গা করে দিয়েছেন। অথচ আমি….খুব খারাপ, ভীষণ খারাপ।

অরুর দিকে ভালো করে তাকালাম এতক্ষণে, বেশ বৌ বৌ ভাব নিয়ে সেজেছে। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক, দু’হাতে চুড়ি, কানে বড় দুল আর গলায় এক লহড়ি হার। একটা কমলা রঙের ঢাকাই জামদানী পরনে। অরুকে দেখতে ভালো লাগছে, তার ঘুমঘুম চোখ যেন আরো বেশি টানছে আমায়।

হঠাৎ করে ঢুলে পড়তে নিতেই দাদা তাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো যেন। সে নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে দাদার কাধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে।আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ফের…আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আমি বরং স্লিপিং বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়ি বলে আর অপেক্ষা না করেই উপরে উঠে শুয়ে পড়লাম।

মাথার ভেতরটা দপদপ করে যেন একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে লাগলো। ভুলতে চেয়েও পারছিনা কিছুতেই। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে হঠাৎ মাথা ধরলো নাকি দাদাকে অরুর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে তা আমার জানা নেই।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here