ভালোবাসা
৬ষ্ঠ_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
আমার ঘুম ভাঙলো অরুর চেচামেচিতে। এই বিজু ওঠ না, আরে চলে এসেছি তো আমরা। আমি ঘুম ভাঙতেই উঠে স্লিপিং বার্থ থেকে নেমে এসে দেখি তখনও গন্তব্যের অনেকটা পথ বাকি।
চোখ কচলাতে কচলাতে অরুকে বললাম, আরেকটু পর ডেকে দিলেই তো পারতিস…কাচা ঘুম ভেঙে দিলি আমার।
অরু অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, আর কয় ঘন্টা ঘুমোলে তোর কাচা ঘুম পাকা হতো বলতো!
আমি আর কিছু না বলে ব্যাগ থেকে টুথব্রাশ বের করে ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে ট্রেনের ওয়াশরুমের দিকে রওনা দিলাম।
দাত ব্রাশ করতে করতে ভাবছিলাম, রাতগুলো তো না ঘুমিয়ে ছটফট করেই কাটাই এখন…দুচোখ ছাপিয়ে ঘুম আসছে তাই। কিন্তু উপায় নেই যে, নামতে হবে একটু পরেই।
ফিরে এসে দাঁড়াতেই দেখি অরু মার পাঠানো কৌটো আর টিফিন বক্স খুলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে সবার জন্যে।
আমাকে দেখে বললো, তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম…তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, গিয়ে হোটেল পেয়ে খেতে খেতে সেই দুপুর হবে।
অরুর গিন্নি গিন্নি ভাবটা বেশ উপভোগ করছিলো দাদা, তার চোখে-মুখে থাকা প্রশান্তির ছাপ যেন সেটা বলে দেয়।
চুপচাপ কিছু মুখে দিয়ে বললাম, আর খাবো না আমি।
অরু চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো, এই এতটুকুতেই তোর হয়ে গেলো?
খিদে নেই, বললাম আমি।
দাদা জোর দিয়ে বললো, খেয়ে নে রে বিজু…পরে কখন খাওয়াদাওয়া হয় তার তো ঠিক নেই।
আমি আরো কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু অরু দেখি তার আগেই আমার মুখে ঠেসে খাবার ভরে দিয়ে বললো, তর্ক করা বন্ধ…চুপচাপ খা নইলে এভাবেই খেতে হবে।
আমি হতভম্ব হয়ে দাদার দিকে তাকাতেই দেখি দাদা মুচকি মুচকি হাসছেন।
অরুর পাগলামো স্বভাবটা হয়তো দাদার ও বেশ লাগে, যেমনটা আমার। কিন্তু মাঝেমাঝেই আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে যাই যখন অরু সকলের সামনে এমন কান্ড করে বসে।
স্টেশন আসতে আর বেশি বাকি নেই তাই দাদা তাগাদা দিতেই খাবার-দাবার সব ব্যাগে গুছিয়ে নেয় অরু। আমিও লাগেজ নামিয়ে প্রায় রেডি হয়ে যাই। কাধের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট আয়না বের করে অরু চোখের কাজলটা আরো বেশি করে দেয়। আয়নাটার দিকে চোখ পড়তেই আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। বৈশাখী মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলাম অরুকে…তাও সে ক’বছর আগে তা যেন আমার নিজেরই মনে নেই। অরু সেটা সাথে করে নিয়ে এসেছে বিয়ের পর। একরাশ ভালো লাগায় মন ছুয়ে যায় আমার। সকালটা বড় বেশি মিষ্টি লাগে।
স্টেশনে নেমে তাকাতেই মনে হলো কোথায় যেন একটা ভিন্নতা আছে। একটু যেন সাজানো গোছানো এর স্ট্রাকচারাল দিকটা। বের হতেই চারপাশ থেকে হাকডাক শুরু হয়ে যায়। ট্যুরিস্ট আর কত লোকের ভীড় এই স্টেশনকে ঘিরে। অরু যেন একটু ঘাবড়ে গিয়ে দাদার একটা হাত জড়িয়ে ধরে। দাদা হেসে বলে, ঘুরতে এলে তো লোকের ভিড় দেখতেই হবে। ভয় নেই, তোমায় আমি কিছুতেই হারাতে দেবো না।
শুনে আমার যেন কান গরম হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁত চেপে রাগটাকে দমন করার বৃথা চেষ্টা চালালাম।
বেশ দামদর করে একটা রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে নিলো দাদা। পথ চলতে শুরু হতেই, অরু এদিক সেদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর একটু পর পর তার স্বভাব মতো বিজু দেখ এই… বিজু দেখ ঐ করছে।
আমি হঠাৎ আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলাম, পুরনো দিনের কথা। যখন স্কুল থেকে ফেরার পথে কোন দিন মেলায় ঘুরতে যেতাম ঠিক তখনও অরু এমনই করতো।
স্কুল ছুটির পর মেলায় যাবার প্ল্যানটা সবসময় ক্লাস শুরু হবার আগেই করে নিতাম। তারপর একে একে যখন সব পিরিয়ড শেষ হয়ে ছুটির ঘন্টা বাজতো তখন অরুর খুশি আর দেখে কে…আমায় খুব তাগাদা দিতো, তাড়াতাড়ি চল নইলে নাগরদোলায় চড়া আর হবেনা।
আমার চেয়ে বেশি আগ্রহ যেন অরুরই থাকতো। তারপর এটা সেটা কেনা আর হরেক রকমের কদমি বাতাসা খেয়ে পুরো মেলা ঘুরে বাড়ি ফিরতো। সে দেখতো মেলা আর আমি দেখতাম তার পাগলামো। ভালো বোধহয় তখনও বাসতাম শুধু বুঝতে পারিনি তাই দেরি হয়ে গেছে।
সম্বিৎ ফিরতেই দেখি অরু আমার কাধ ধরে ঝাকিয়ে বলছে, এই বিজু… কই আছিস রে তুই…কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাসনি বুঝি!
আমি যেন অস্বস্তিতে পড়লাম। তারপর ইতস্তত ভাব কাটাতে বললাম, কি এত দেখাচ্ছিস সেই তখন থেকে…এখনো তো সমুদ্র দর্শনে যাইনি আর তাতেই তোর এই অবস্থা! তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই সমুদ্র দর্শনে না পথ ভ্রমণে বেরিয়েছিস, যা দেখছিস তাতেই মুগ্ধ হচ্ছিস…বলে ক্ষেপাতে চাইলাম অরুকে।
অরু না ক্ষেপে হেসে দিলো আর বললো, কি ভাবছিলিস বলবি নাতো আমায়…আচ্ছা যা তোর সিক্রেট আর ঘাটাবো না।
চারপাশ দেখতে দেখতেই একসময় পৌছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে হোটেল রুম বুক করে দাদা আর অরু তাদের রুমে আর আমি আমার রুমের চাবি বুঝে নিলাম। লাগেজ রেখে হোটেলের ফোন থেকে বাড়িতে একটা কল করে দিলাম মাকে। ঠিকভাবে পৌছে গেছি জেনে মা আশ্বস্ত হলেন। ফোন রাখতে না রাখতেই দেখি অরু এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। একটু যেন অভিমান করে বললো, আমাকে ডাকতিস যদি তবে মার সাথে কথা বলে নিতে পারতাম।
দাদা এসে তাগাদা দিতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম লাঞ্চ করতে। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরে হোটেলে ফিরে গিয়ে যার যার মতো কিছুক্ষণ রেস্ট করে নিয়ে বিকেল হতেই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র দর্শনে। আমরা উঠেছি সৈকত থেকে খুব কাছের হোটেলে। এখানকার বালুতট আর ঝাউগাছের হাতছানি মন কেড়ে নেয়। বড় বড় ঢেউ অবাক চোখে দেখছে অরু। তারপর সারিসারি ঝাউ গাছের ধারেকাছেই একটা জায়গা দেখে দাদা বসে পড়ে আমাদেরও বসতে ইশারা করে। অরু কোমরে হাত রেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে থেকে বললো, আমরা কি এখানে বসে দূর থেকেই সমুদ্র দেখবো!
দাদা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, বসে বসে সমুদ্র দেখে আমার পোষাবে না আমি যাচ্ছি জলে ভিজতে।
অরু আমার পিছে পিছে এসে হাতটা ধরে বললো, আমিও যাবো তোর সাথে।
আমি ফিরে তাকিয়ে দাদার দিকে দেখতেই দেখি দাদা মৃদু হেসে উঠে আসছে আমাদের সাথে।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে পকেট থেকে সেটটা বের করে কল রিসিভ করলেন।দাদার মুখ দেখে বুঝলাম জরুরি কিছু হবে হয়তো। আর তাই আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারা করলেন যেতে। আমি বেশ খুশিই হলাম। এতক্ষণে যেন মনে হলো শুধু আমি আর অরুই ঘুরতে এসেছি…ঠিক সেই আগেরই মতো।
জলে নামার জন্যে যেন অরুর আর তর সইছিলো না, দাদার অপেক্ষা না করেই সে সমুদ্রের দিকে এগুতে লাগলো। আমিও ছুটে গেলাম সেদিকে। হাপাতে হাপাতে বললাম, খুব ভালো লাগছে না?
অরু হেসে বললো আরো গভীর জলে নামলে বেশ মজা হবে, চল যাই।
আমরা ঢেউয়ের সাথে সাথেই যেন এগুতে লাগলাম। এক একবার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের গায়ে আর অরুর সেকি খিলখিল হাসি। সব মিলে তখন পরিবেশটা অসাধারণ লাগছে। শুধু এটুকু পেয়েই আমি নিজেকে বেশ ভাগ্যবান ভাবছিলাম।
কিন্তু তারচেয়ে বেশি প্রাপ্তি বোধহয় ছিলো আমার ভাগ্যে। আর তাই একটা বড় ঢেউ এসে অরুকে যেন ফেললো আমার বুকে। সে ডুবে যাবার ভয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরতেই আমার সারা শরীরে যেন শিহরণ বয়ে গেলো। মনের সকল দ্বিধাদ্বন্দ ভুলে আমি তার মাথায় হাত রেখে বললাম, আমি আছিতো। ভয় পাসনে…কিচ্ছু হবেনা।
অরু যেন হঠাৎ এহেন কান্ড ঘটায় খুব বেশি অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলো। তার অস্বস্তি আমার চোখ এড়াতে পারলোনা। সে খুব দ্রুত সরে গিয়ে বালুতটের দিকে এগুতে লাগলো। দাদাকে দেখতে পেয়ে সেদিকে চলে গেলো আর একবার ও পেছন ফিরে তাকালোনা।
আমি সেই সমুদ্রের জলে ঢেউয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম অরুর গমন পথের দিকে। এভাবেই কি একসময় দূর থেকে বহুদূরে চলে যাবে অরু। যে মূহুর্তটা ভুল করে হলেও সবচেয়ে সুন্দর ছিলো, তার পরের মূহুর্তটাই যেন অরুকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো।
ধীর পায়ে উঠে এসে ওদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়ালাম আমি। দাদা একটা ফটোগ্রাফারকে ডেকে এনে আমাদের দুজনকে নিয়ে ফের সমুদ্রে নামতে চাইলেন। জলে নেমে দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে দাদা ফটোগ্রাফারকে নির্দেশ দিলো ফটো ক্লিক করবার জন্যে। বেশ কিছু পিক ক্লিক করার পর ফটোগ্রাফার আমাকে ইশারায় বোঝাতে চাইলো যে, কাপল পিক তুলবেন উনি। একটুও দেরি না করে আমি সরে যেতেই দেখলাম দাদা যেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরেছে অরুকে। লজ্জায় অরুর চেহারাটা লাল হয়ে গিয়ে আভা ছড়াচ্ছে গালে।
সেই শেষ বিকেলের সূর্যাস্তের লালিমাটা যেন আমার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হৃদপিণ্ডের সাক্ষী হয়ে রইলো। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আঁধার নামার আগেই আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। নিজের রুমে গিয়ে যেন ঘোরের মধ্য থেকেই বাথরুমের শাওয়ারটা ছেড়ে দাঁড়ালাম নিচে। বুকফাটা কষ্ট যে আর বাঁধ মানতে চাইলো না, তাই কান্না হয়ে মিশে গেলো শাওয়ারের জলে।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।