ভালোবাসা ৭ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
দরজায় নক করার শব্দে শোয়া থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম দাদা এসেছেন। ঘর আঁধার দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন, কি রে এই সন্ধ্যেবেলা ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন!
আমি বললাম ঘুম আসছিলো তাই আর লাইটের সুইচ অন করিনি। দাদা দাঁড়িয়ে আছেন দেখে আবার বললাম, ভেতরে এসে বসো…আলো জ্বালছি।
দাদা খাটে বসে বললেন, ভাবছিলাম তোদের আরও কিছু জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবো।
এই এখন? রাতে!
দাদা হেসে বললেন, রাতে সাগর দেখার সৌন্দর্য্যই আলাদা।
তুমি কি করে জানো! আগে কখনো এসেছিলে নাকি?
দাদা যেন স্মৃতি হাতড়ে বললেন, এসেছিলাম একবার বন্ধুদের সাথে। তারপর আবার বললেন, ঘুরতে এসে এই সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত এতটা সময় হোটেলে বসে থাকা বেকার…তার চেয়ে বরং যত বেশি স্পট কাভার করা যায় সেই ভালো।
আমি এখন কেন জানি আর অরুর সামনে পড়তে চাচ্ছিলাম না। আর তাই দাদাকে বললাম, তোমরা যাও ঘুরে এসো…আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।
সেকিরে…আমায় ডাকলি না কেন? তোকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে ঘুরতে চলে যাবো ভাবলি কি করে!
শুধু একটা ঘুম দিয়ে উঠলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার জন্যে কিছু ক্যানসেল করো না।
দাদা খানিকক্ষণ বসে কি যেন ভাবলেন, তারপর উঠে দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেলেন।
দাদারা বেরিয়ে গেছে ভেবে আমি আবার চোখ বন্ধ অবস্থায় শুয়ে রইলাম। একটু তন্দ্রা মতো আসতেই মনে হলো কে যেন খুব ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে…ভালো করে তাকাতেই দেখলাম অরু এসেছে বসেছে আমার খাটে, তারপর পেছন থেকে যেন আমায় হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো…বিজু আমায় ক্ষমা করে দিস, না বুঝে তোর মনে দুঃখ দিয়েছি।
আমি ওর দিকে ফিরে বললাম, তোর কোন দোষ নেই অরু…আমি একটুও রাগ করিনি বুঝলি…তোর ওপর রাগ করে থাকা যে সম্ভব না আমার, সেটা তোকে কি দিয়ে বোঝাই বলতো!
অরু আর কিছুই যেন শুনতে পায়না, সে একনাগাড়ে অশ্রু-বিসর্জন করতেই থাকে…অরুর চোখের জল দেখে বুকটা আমার হাহাকার করে ওঠে আর তাই ন্যায়-অন্যায় কিছু না ভেবেই ওকে বুকে টেনে নেই।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। ধরমর করে উঠে পড়তেই বুঝলাম যে, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। ঘড়ির কাটায় চোখ পড়তেই দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম, দাদা বোধহয় ডিনারের জন্যে ডাকতে এসেছেন আমায়। ফের দরজা খুলে দাদাকে দেখেই ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছিলো তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম।
দাদা আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, এখন ভালো আছিস তো?
একটা তীব্র অনুশোচনায় যেন আমার বাকরুদ্ধ, তাই গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুলো না। শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম।
দাদা বললেন, খেতে চল…তোর অসুখ শুনে অরুও আর যেতে চাইলোনা। সেই সন্ধ্যে থেকেই কিছু না খেয়ে ঘরে বসে আছি। ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।
অরুর কথা শুনে আবার একমূহুর্তেই যেন আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। অরু আমাকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে যায়নি, এই খুশিতেই যেন একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো চেহারায়।
দাদা হঠাৎ বলে উঠলেন, কি রে তোর কি জোকস মনে পড়ছে যে এভাবে একা একা হাসছিস!
আমি একটু সতর্ক হয়ে বললাম, মা অত কিছু সাথে দেবার পর ও খিদে পেলে বাইরের কিছু না হলে তোমার দেখছি চলেই না…মা জানলে কিন্তু ভীষণ রাগ করবে দাদা।
মা’র কাছে আর কত বছর আমার নামে কমপ্লেইন করবি, এবার তো একটু বড় হ রে বিজু….বলে দাদা হেসে আমার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিলেন।
দরজায় লক দিয়ে দাদার সাথে বের হতেই দেখি অরু একটু সামনে দাঁড়িয়ে করিডোরে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। আমাকে দেখতে পেয়ে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলো, মাথাব্যথা কমেছে তোর?
আমি অরুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, হুম…এখন ঠিক আছি।
পরক্ষণেই মনে হলো, দাদা আছে সাথে। এভাবে অরুর দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার ঠিক না…আর তাই চোখ নামিয়ে নিলাম।
খেতে বসে কে কি খাবে জানতে চাইলো দাদা। আমি বললাম একটা কিছু হলেই হবে আমার। অরুও দাদাকেই বললো অর্ডার করতে। খাবার আসা পর্যন্ত আমি আড়চোখে অরুকেই দেখতে লাগলাম। ওর এই আড়ষ্ট হয়ে চুপ করে বসে থাকাটা যেন মানতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে ওর কাধ ঝাকিয়ে বলি, ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলি যে তাতে কি এমন ক্ষতি হয়ে গেছে তোর? এমন করছিস কেন বলতো! আমি কি তোর পর…একদম অচেনা কেউ? নতুন দেখছিস আমায়?
আরে দু’দিন আগে দাদার সাথে বিয়ে হতে না হতেই এখন সেই তোর আপন হলো, আর একযুগ ধরে যার বন্ধু ছিলিস তার কথায় তার পছন্দের পাত্রকে তুই বিয়েতো করলি কিন্তু তাকেই আর আপন ভাবা যায় না তাইনা!
নাহ…সে কিছু বলবেনা। অরু যদি তার থেকে দূরে সরে গিয়ে খুশি থাকে তবে তাই সই। সে তো সুযোগ ও করে দিয়েছিলো ওদের একসাথে ঘুরতে যাবার। তবে কেন আর মিছেমিছি সব আদিখ্যেতা। তার জন্যে কেউ কনসার্ন না হলেও চলবে।
খাবার এসে যাবার পর নীরবে খেয়ে উঠে হোটেল রুমে ফিরে যেতে চাইতেই দাদা বললেন, আশেপাশে আরেকটু ঘুরে যাই। গায়ে ঠান্ডা বাতাস লেগে একটু যেন শীত শীত করছিলো, অরুকেও মনে হয় কাপতে দেখলাম। তাই দাদাকে বললাম, তোমরা এগিয়ে যাও আমি এই গেলাম আর এই এলাম। একছুটে হোটেল রুম থেকে দুটো জ্যাকেট আর শাল নিয়ে ফিরে এসে একটা দাদাকে আর আরেকটা অরুকে দিয়ে নিজেও জ্যাকেট পড়ে নিলাম।
অরু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, আমি বুঝতে পারলাম যে সে বুঝে গেছে তার জন্যেই আবার গিয়েছি।
এইতো ভালো লাগছে, আস্তে আস্তে আবার আগের মতন সহজভাবে মিশবে আমার সাথে। একটু তো সময় দিতে হয়, আমিও না বড্ড বেশি অভিমান করে ফেলি। কি করবো বল, তুই আমার সাথে অমন দূরত্ব বজায় রেখে চললে যে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়।
দাদা একটা গাড়ি ডেকে আমাদের নিয়ে রাতের শহর ঘুরতে বেরুলো। আলোর ঝলকানিময় শৌখিন জিনিসের দোকানপাট আরো কিছুটা ঘুরে রাতের সমুদ্র দর্শন করে ফিরে গেলাম হোটেলে। বেশ ভালো লাগছিলো মনটা।
নিজের রুমে ঢুকে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আজকের দিনটা অন্য সব দিনের চেয়ে একটু যেন আলাদা। ভালো মন্দের মিশেলে বিশেষ একটা দিন।
স্বপ্নটার কথা মনে হতেই খুব লজ্জা করছিলো। অরুর আমাকে সমুদ্রের জলে আঁকড়ে ধরাটা নিয়ে এত বেশি ভেবেছি যে সেটা ভাবতে ভাবতে স্বপ্নেও তাই দেখতে পেলাম।
আচ্ছা, আমি কি ভালোবাসি অরুকে? নাকি সবটাই বয়সের দোষ…জানিনা, আর জেনে লাভটাই বা কি! ফের মনে পড়লো দাদা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে বলেছেন, তাই চোখ বন্ধ করে জোড়পূর্বক ঘুম আনার চেষ্টা করতে লাগলাম।
সকাল হতেই নাস্তা সেরে ফের আমরা বেরিয়ে পড়লাম গাড়িতে করে ঘুরতে। একের পর এক দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার পর অরুর সে কি খুশি। বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ চেহারাটা যতবার দেখি ততই যেন আরো ভালো লাগে।
আজ সারাদিন ঘুরে ফেরার পথে অরু দেখলাম আবার আগের মতন হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে। এটা সেটা দেখিয়ে কথা বলছিলো যখন তখন বেশ লাগছিলো আমার।
অরু তুই এমনই থাকিস চিরকাল, আমি নাহয় একটু আধটু অধিকার চুরি করে তোকে ভালোবাসি, কিন্তু তার জন্যে অভিমান করে দূরে সরিয়ে দিস না আমায়। কি করবো বল, তোকে ভালো না বেসে যে থাকতে পারিনা। সম্পর্কের দাবি নিয়ে কিছু চাইতে আসবো না যদিও, তবে কথা দিচ্ছি ভুল করেও আর তোকে কখনো দূরে সরে যেতে দেবো না।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।