ভালোবাসা ৮ম_পর্ব

0
669

ভালোবাসা
৮ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

সকাল হতেই নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। কাল ফিরে যাবো তাই যতটা সম্ভব আজকেই দেখে নিতে হবে। লাল কাঁকড়া দেখতে পেয়ে অরুর যেন খুশির আর ঠিকানা থাকেনা। খুশির চোটে আমার হাতের বাহুতে এক হাত রেখে আরেক হাত দিয়ে আঙুল উচিয়ে এদিক সেদিক দেখাতে থাকে। আমি তখন কাঁকড়া দেখার চেয়ে বরং অরুর হাসিমাখা মুখটা দেখেই বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম।

দাদা যেহেতু আগে এসেছেন তাই তার আগ্রহ কম। আর গোটা ট্যুরেই দেখেছি বেশিরভাগ সময় জরুরি ফোন কলেই ব্যস্ত। আমি সাথে থাকাতে যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজ ও সারছেন। দাদার কান্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে আমি না আসলে অরুটা যেন একা একা খুব বোর হতো।

ফিরে গিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার বের হলাম কাছাকাছি স্পট ঘুরতে। কাছেই রানওয়ে থেকে প্লেন দেখা যায় শুনে অরুতো নাছোড়বান্দা যে সেখানে যাবেই। আমিও বললাম দাদাকে, চলো না যাই।

দাদা বললেন, এ ক’দিন তো ঘুরেছিই তোরা যা দেখে আয়। আমার কিছু জরুরি কল করতে হবে। বাহিরের শব্দে ভালোভাবে কথা বোঝা যায়না আমি বরং হোটেলেই থাকি। গাড়ির ড্রাইভার যখন পরিচিত হয়েই গেছে তখন তোদের তো আর পথঘাট চেনার সমস্যা নেই।

আমি শুনে খুশি হলেও দেখলাম অরুর মুখটা যেন পাথরের মতো থমথম করছে। সে কিছু বলতে না পারলেও আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে তার দাদাকে ছাড়া যেতে ইচ্ছে করছেনা।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম অরু কি করে সেটা দেখার জন্যে। তারপর হঠাৎ কি মনে করে কে জানে মুখে হাসি এনে বললো, চল যাই। রানওয়ে দেখে আরেকটু ঘুরে যখন আমরা চলে আসতে নিলাম ঠিক তখনই আমি বললাম, ট্যুরটা ভালোই গেলোরে তাইনা?

হুম…ভালো, বললো অরু।

সমুদ্র ভালো লেগেছে তোর?

সমুদ্রের কথা বলতেই যেন অরুর মুখ শুকিয়ে গেলো। ওর চেহারায় আষাঢ়ের মেঘ দেখলাম বলে মনে হলো।

আমি তার হাতটা ধরে বললাম, চল আমার সাথে।

সে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, কোথায়?

আমি কিছু না বলে শুধু একটু হাসলাম। তারপর তাকে নিয়ে গেলাম সমুদ্র সৈকতে। অরু যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলো। ফের বললো, কি হয়েছে তোর? আমায় এখানে নিয়ে এলি কেন!

আমি বললাম, কাল তো চলেই যাবো। তোর সাথে তো আমার ঠিকভাবে সমুদ্র দর্শনই হলোনা।

অরু ঘাবড়ে গিয়ে বললো, মানে?

আমি বালুতটে বসে অরুর হাতটা টেনে তাকেও বসিয়ে দিয়ে বললাম, এভাবে বসে থেকে ঢেউয়ের গর্জন শোনার মজাই আলাদা আর ঐ দেখ চাঁদের আলো পড়ে কেমন চিকচিক করছে জলরাশি।

এতক্ষণে যেন অরু কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সাগর পানে চাহিলো। ওর মুগ্ধ দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিলো যে তার মনের সকল মেঘ কেটে গেছে। খুশি হয়ে আমায় বললো, থ্যাংক ইউ বিজু…এত সুন্দর কিছু আমি আগে কখনো দেখিনি।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফের আমি বললাম, চল ফিরে যাই…নইলে দাদার টেনশন হবে।

অরু বললো, আরেকটু থাকি…প্লিজ।

আমি মৃদু হেসে বললাম, আচ্ছা কিন্তু বেশিক্ষণ না।

অরু তার হাটুর উপর মুখ রেখে এমনভাবে সমুদ্র দেখতে লাগলো যেন আর কিছুরই তার খেয়াল নেই। সেই চাঁদের আলোয় আমি অরুকে দেখতে লাগলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কি মায়াময় মুখ তার! এই সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রালোক, ঢেউয়ের গর্জন সবকিছু ছাপিয়ে আমার মন যেন বারবার তার দিকেই ছুটে চলেছে। এত সুন্দর পরিবেশ আর তার চেয়েও বেশি সুন্দর সে। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না আমি। আরো কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো নিজের আবেগকে সংযত রাখা কঠিন হবে, আর তাই অরুকে তাগাদা দিলাম ওঠার জন্য।

একটু যেন মন খারাপ হয়ে গেলো তার। দেখলাম শাড়ির আঁচলের প্রান্তে চোখের জল মুছতে। আর তাই অস্থির কন্ঠে বললাম, কিরে কাঁদছিস যে! আমার কোন আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি তবুও কান্না করিস না।

অরু বললো, নারে… বেশি সুন্দর কিছু দেখলে আনন্দে চোখে জল আসে আমার।

আমি হেসে বললাম, তুই ভালোই পাগলী আছিস।

শুনে অরু আমায় বললো, তুইও কম পাগল না। দেখতে হবে না বন্ধুটা কার, পাগলের পাগলী। ফের হি হি করে হাসতে লাগলো।

আমি মনে মনে যেন একটু খুশিই হলাম, ভুল করে হলেও তো বললি যে তুই আমার…সেটাই তো আজ পরম পাওয়া।

হোটেলে ফিরে যেতেই দেখি দাদা গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু যেন রেগে গিয়ে বললেন, কি রে বিজু তোর কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই? কত রাত হলো দেখেছিস! একটু ছাড় দিতেই…বলে কথাটা আর শেষ করলেন না।

আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনছিলাম, বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

অরু হঠাৎ বলে উঠলো, ওর কোন দোষ নেই। আমিই ওকে বলেছিলাম যে, দেখ বিজু…কত সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, কাল তো চলেই যাবো, চল না আজ আরেকটি বারের মতন সমুদ্র দেখে নেই।

আমি অবাক বিস্ময়ে অরুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, একরাশ ভালোলাগায় যেন মন ছুয়ে গেলো আমার।

দাদা সেটা নিয়ে আর কিছু না বলে বললো, চলো চলো আগে ডিনারটা সেরে আসি নইলে আর খাবার জুটবে না পেটে।

ডিনার টেবিলে আজ অরুকে সাবলীল দেখে বেশ ভালো লাগছিলো আমার। একটু পরপর যেন চোখে চোখে কথা বলছিলো আর দুষ্টুমির হাসি হাসছিলো মুচকি মুচকি।

হোটেলে ফিরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সব রেডি করে শুয়ে পড়লাম। কাল ফিরে যাবো তাই আজ রাতের ঘুমটা ভালো হওয়া চাই। কিন্তু কিছুতেই যেন ঘুম আসছেনা। অরুর কথা মনে হচ্ছে বারবার। আজ সারাদিন যা কিছু হলো, তারপর সন্ধ্যের পর থেকে শুধু আমরা দু’জন আর সেই বালুতট, অরুর আমার পক্ষ নিয়ে দাদার সামনে কথা বলা, এসব কি সত্যি ছিলো! স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে যেন। চোখ বন্ধ করলেই তার সেই মায়াবী মুখ আর সব কিছুই যেন আমার জগতে শুধুই অরুময়। কি করবো আমি, তার কথা ভাবতে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে।

সকাল হতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। ঘুমঘুম চোখে দরজাটা খুলতেই অরুকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে গেলাম। চোখ কচলে নিয়ে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি অরু হাসছে। তার হাসির খিলখিল শব্দে মন ভরে গেলো আমার। মাথায় ঘোমটা টানা বেশ বৌ বৌ ভাব তার চেহারায়। পরনে একটা অফহোয়াইট শাড়ি সবুজ পাড়। আঁচল আর পাড় দুটোই সবুজ। হাতে একগাছি সোনালী চুড়ি, কানে ছোট দুল। ঠোটে মেরুন রং লিপস্টিক। চোখে হালকা করে কাজল ছোয়া আর কপালে একবিন্দু টিপ। আমি অপলকভাবে যেন তাকিয়ে দেখছিলাম দরজায় দাঁড়িয়ে।

অরুর ডাকে সম্বিৎ ফিরতেই, একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সেটা কাটাতেই বললাম, অত বৌ বৌ সেজে লাভ নেই। ফিরে গিয়ে সেই বোরিং ইউনিফর্মই পড়তে হবে। তোর কাল থেকে আবার ক্লাস শুরু।

অরু ভেংচি কেটে বললো, তোর ও ক্লাসেই ফিরতে হবে…বাউন্ডুলে পণা আর চলবেনা।

দাদা এসে তাগাদা দিয়ে বললেন, তোদের হলো? তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে যাদুঘর আর কিছু জায়গা দেখে নিয়ে ফিরে এসে ট্রেন ধরতে স্টেশনে যেতে হবে।

আমি বললাম, এগুলো না দেখে ফিরে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে!

অরু কপট রাগ দেখিয়ে বললো, কিচ্ছুতে আগ্রহ নেই…না পড়ায়, না দেখায়, না শেখায়।

আমি মনে মনে বললাম, আগ্রহ তো আছে শুধু তোর ব্যাপারে। মুখে বললাম, আচ্ছা বাবা আসছি আসছি।

ঘুরে এসে হোটেল থেকে চেক আউট করে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতেই ঘাম ছুটে গেছে দাদার। আমি হেসে বললাম, এই একটুতেই হাপিয়ে গেলে!

দাদা চোখ পাকিয়ে বললেন, তোর বয়সের ছিলাম যখন অমন কথা আমিও বলতাম…বয়স বাড়ুক তখন দেখবো কত দম থাকে।

অরু আমাদের কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছিলো। দাদা রাগবে ভেবেই হয়তো জোড়ে হাসতে পারছেনা। আমিও একফাঁকে অরুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম।

ভালো-মন্দে ট্যুর সমাপ্তির পর আমরা বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছি। অরুর সাথে যে সব আগের মতন সহজ হয়ে গেছে তা দেখে মনে খুব শান্তি লাগছে। কাল থেকে আবার একসাথে ক্লাসে যাওয়া, পাশাপাশি বসে ক্লাস করা আর ছুটির পর একসাথে বাড়ি ফেরা…সব চলবে ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগছিলো। জীবনটা যেন সবসময় এমনই সুন্দর থাকে, এর বেশি আর কিছু চাইবার নেই আমার।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here