ভালোবাসি তাই
part :4&5
Writer :Afifa Jannat Maysha
??
সায়ন ভাইয়ার চেচামেচি শুনে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে।.. উনি খালামনিকে জিজ্ঞেস করছেন
– আমার ফোন কোথায় মা?
– তোর ফোন তো তোর হাতেই।
-এই ফোন না মা।.. যেটা সবসময় বাসায় থাকে সেটা।
– ঘরেই হবে হয়তো। খুঁজে দেখ।
– খুঁজে পাইনি বলেই তো তোমার কাছে এসেছি। ঘর গুছানোর সময় কোথায় রেখেছো?
– তোর ঘর তো আমি গুছাই নি।.. মাইশা গুছিয়েছে।
খালামনির কথায় আমার দিকে তাকালেন উনি।.. আমি আমার মুখে যথাসম্ভব ইনোসেন্ট ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছি।
-আমার ফোন কোথায় রেখেছিস?
– আপনার ঘরেই তো আছে। ভালো করে খুঁজেছেন তো?
-তো তোর কি মনে হয় যে তুই বলে দেওয়ার পরে খুঁজবো?
এবার খালামনি বললো
– যাতো মাইশা, ওর ঘরে গিয়ে ফোনটা খুঁজে দে।
– আমি উনার ঘরে যাবো না খালামনি।
– কেনো?
– তোমার ছেলেই আমাকে উনার ঘরে যেতে বারণ করেছে।
– কি বলছিস তুই?
– হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তুমিই বলো উনি না করার পরও আমি কেনো উনার ঘরে যাবো? যদি উনি নিজের মুখে আমাকে উনার ঘরে যেতে বলেন তাহলে যেতে পারি।
আমার কথায় রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন উনি।… তাতে আমার কি?.. তখন তো খুব ভাব নিয়ে বললো “চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড”। এবার বুঝো ঠেলা।..নিজের উপর কেমন প্রাউড ফিল হচ্ছে।.. ইশ! এতো বুদ্ধি আমার মাথায় আসে কিভাবে? রাগে উনার মুখ লাল টোমেটো হয়ে গেছে।… আমি শিউর, আপু যদি এখন এখানে উপস্থিত থাকতো তাহলে ভয়ে সারাজীবনের জন্য বিয়ে করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিতো।.. আপু আমার বোন হয়েও কেনো যে এতো ভিতু এটা গবেষণার বিষয়।.. যেখানে বাবা – মা আমাকে আর ভাইয়াকে হাজার বকলেও আমাদের উপর তার কোনো প্রভাব পড়ে না সেখানে আপুর দিকে রেগে তাকাতেই তার চোখ ছলছল করে ওঠে।… আমদের তিন ভাই – বোনের মধ্যে আপুই সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র, সংসারী একটা মেয়ে।.. সেজন্যই হয়তো খালামনি ওকে সায়ন ভাইয়ার বউ হিসেবে পছন্দ করেছে।.. খালামনির কথায় ঘোর কাটলো আমার।
– কিরে সায়ন, মাইশাকে বল তোর ঘরে গিয়ে ফোন খুঁজে দিতে।
এমুহূর্তে ফোনটা উনার অনেক প্রয়োজন বলে দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে উনার ঘরে যেতে বলে দ্রুত চলে গেলেন উনি। আমিও উনার সাথে হাটছি। উনি কোনো কথা বলছেন না । হয়তো রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু আমি তো তা হতে দেবো না। আমি হেলেদুলে হেটে গুনগুন করে গান গাইছি। আমার এরকম ব্যবহারের ওয়ান এন্ড অনলি উদ্দেশ্য উনার রাগ আরো বাড়িয়ে দেওয়া। আমি সফলও হয়েছি। রাগে যেকোনো মুহুর্তে ফেটে পড়তে পারেন উনি। আচ্ছা, উনি ফেটে গেলে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে নাকি? তবে এই মুহূর্তে গান গাওয়া বন্ধ না করলে আমার মৃত্যু যে নিশ্চিত তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। তাই বুদ্ধিমানের মতো গান গাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
উনার ঘরে এসে ফোনটা খুঁজে বের করে দিতেই সেটা নিয়ে বিছানায় বসে পরলেন উনি।… ফোনে চুপচাপ কিছু একটা করছেন। ভাবটা এমন যেনো এ ঘরে উনি ছাড়া একটা মশাও উপস্থিত নেই।… অথচ আমি আস্ত একটা মাইশা দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে।.. ইশ! বেচারা আবারো হেরে গেলো। তাই হয়তো কথা বলতে চাইছে না আমার সাথে।
– বলেছিলাম না আপনি নিজে আমায় ডেকে আনবেন। দেখুন সেটাই কিন্তু হয়েছে। আপনি হেরে গেছেন আর আমি জিতে গেছি।
– এই খুশিতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যা।
– তাহলে তো আমি মরে যাবো। আমি মরে গেলে আপনাকে ভালোবাসবে কে?
– কেনো, মালিশা।
– আপুর ভালোবাসা ভয়ের নিচে চাপা পরে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। তার থেকে বরং আমায় ভালোবাসুন কাজে লাগবে।
– তোর মুখে সবসময় ভালোবাসার কথা লেগে থাকে কেনো রে?
– ভালোবাসি তাই। এনিওয়ে, কফি আনবো আপনার জন্য?
আমার কথা শুনে উনি উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে আমার ডান হাত চেপে ধরলেন। চোখ থেকে যেনো আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে হাতটা বুঝি ভেঙেই গেলো। ব্যাথায় চোখের কোণে পানি এসে গেছে আমার । কিন্তু সেদিকে খেয়ালই নেই উনার। উনি নিজের মতো বলেই চলেছেন।
– কি ভাবছিস তুই? আমার জন্য রান্না করে, আমার ঘর গুছিয়ে, আমার জন্য কফি এনে আমার মন জয় করে ফেলবি? সেটা কখনো হবে না। আর কতবার, কিভাবে বললে বুঝবি যে আমি তোকে ভালোবাসি না। তুই তো আর অবুঝ বাচ্চা না।বুঝতে পারিস না তোকে আমার সহ্য হয় না? আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ, আই ওয়ান্ট মালিশা। ইয়েস আই জাস্ট ওয়ান্ট মালিশা নট ইউ। বুঝতে পেরেছিস?
“আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ ” কথাটা শুনে আমার একদম খারাপ লাগে নি কিন্তু “আই ওয়ান্ট মালিশা ” কথাটা তীরের মতো লেগেছে মনে। উনার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে চলে এলাম ঘর থেকে। এখন আর ঘুম আসবে না তাই হাটতে লাগলাম ছাদের দিকে।
?
??
রাত কয়টা বাজে জানা নেই। ছাদের দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। আকাশে আজ চাঁদ নেই তবে রয়েছে অসংখ্য তারার মেলা। চারদিকে বিরাজমান নিরব নিস্তব্ধতাই জানান দিচ্ছে অনেক রাত হয়ে গেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আশেপাশের বাসার আলোতে মৃদু আলোকিতো হয়ে আছে ছাদ। বাতাসের ঝাপটায় শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে উঠছে বারবার।
মাথায় নির্দিষ্ট কোনো চিন্তা আসছে না আমার। সব ভাবনাগুলো একসাথে এসে জরো হচ্ছে বলে ঠিক কি ভাবছি সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। তবে “আই ওয়ান্ট মালিশা “কথাটা বেশ ভালো করেই জেকে বসেছে মাথায়। আচ্ছা আমি কি একটু বেশিই করে ফেলছি? আমার কি উচিত সায়ন ভাইয়াকে উনার নিজের মতো ছেড়ে দেওয়া? হয়তো। এতোদিন তো শুধু বলতেন উনি আমাকে চান না কিন্তু আজ তো এর সাথে আরও একটা কথা বললেন উনি আপুকে চান। আমি বোধ হয় উনাকে বেশিই বিরক্ত করে ফেলছি।
যখন আপু আর উনার মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে তখন তো বিয়েটা হয়েই যাবে। আমি তো সেটা আটকাতে পারবো না। আমার উচিৎ এখন থেকে এটা মেনে নেওয়া নাহলে পরে হয়তো আরো কষ্ট পাবো। যে ভালোবাসার ভবিষ্যৎ নেই সেটা নিয়ে পড়ে থাকাটা নিছকই বোকামী।
থাক না উনি উনার মতো।.. ভালোবাসতে হবে না আমাকে। আমিই নাহয় সারাজীবন দূর থেকে ভালোবেসে যাবো উনাকে।.. ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অনেকেই তো আছে যারা নিজেদের ভালোবাসার মানুষটাকে পায় না।… তাই বলে কি তাদের ভালোবাসা মরে যায়?.. যায় না তো। আমিও নাহয় তাদের দলেরই একজন হয়ে গেলাম।
এসব কথা ভেবে মস্তিষ্ককে সন্তুষ্ট করতে পারলেও মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না আমি।… শুধু ভাবছি যখন ওদের দুজনকে একসাথে দেখবো তখন নিজেকে সামলাতে পারবো তো?.. ঠিক রাখতে পারবো নিজেকে?… নাকি ভুল কোনো কাজ করে বসবো?
আজ আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, অনেক ইচ্ছে করছে।কিন্তু কেনো জানি কান্না আসছে না।… চোখের পানিগুলোও আমার কষ্ট বুঝতে চাইছে না।.. তারাও আজ আমার সঙ্গ দিতে নারাজ। আমার ভাবনার মাঝেই ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেলাম।… বুঝতে পারছি এটা সায়ন ভাইয়া। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে উনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না মোটেও।… থাক না উনি উনার জায়গায় আমি বরং চন্দ্রহীন আকাশ দেখি।
তখন হয়তো উনার কথা শুনানো শেষ হয়নি।.. তাই আবার এসেছে আমাকে অপমান করে নিজের মনকে হালকা করতে আর আমার মনে জন্ম দিতে পাহাড়সম বিষন্নতা।.. উনার কথাগুলো শুনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। হয়তো আর কখনো আমাকে অপমান করার সুযোগটাই দেবো না উনাকে।… তাই আজ যতো ইচ্ছা অপমান করে নিক উনি আমি বাধা দেবো না।…আমি যখন চিন্তার জগতে ব্যাস্ত তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে দোলনায় আমার পাশে এসে বসে পরলেন সায়ন ভাইয়া।… আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি সত্যি সত্যিই সায়ন ভাইয়া? উনি নিজে আমার পাশে এসে বসেছেন? ইগোতে লাগছে না উনার? নাকি চ্যালেঞ্জে হেরে গিয়ে পাগল- টাগল হয়ে গেলেন?
আমি এবার ভালো করে তাকালাম উনার দিকে। উনার দৃষ্টিও আমাতে নিবদ্ধ। কেমন যেনো অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন উনি আমার দিকে। কি শীতল সেই চাহনি। উনার এরকম দৃষ্টির সাথে পরিচিত নই আমি।… উনি যখনই আমার দিকে তাকান তখনই উনার চোখে ফোটে উঠে একরাশ বিরক্তি নয়তো রাগ। কিন্তু আজ এই চোখ জোরার ভাষা বুঝতে পারছি না।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে উনি বলে উঠলেন
– সরি।
– সরি কেনো?
– তখন তোর সাথে ওরকম বিহেভ করা ঠিক হয়নি আমার।.. রাগে কি থেকে কি করে ফেলেছি বুঝতে পারি নি।.. হাতে কি খুব লেগেছে?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। হাতে এটুকু ব্যাথা দিয়েছেন তাতেই উনি অনুতপ্ত।.. অথচ মনে যে ক্রমাগত ব্যাথা দিয়েই চলেছেন তার জন্য কি উনার মধ্যে একটুও অনুতপ্ততা কাজ করে না? .. কে জানে? এ মুহূর্তে আমার সামনে বসে থাকা সায়ন ভাইয়াকে ভীষণ অচেনা লাগছে আমার।… উনি আমায় সরি কেনো বলছেন? আমি কষ্ট পেয়েছি বলে নাকি উনি নিজেকে অপরাধী মনে করছেন বলে?… আমার কোনো উত্তর না পেয়ে উনিই বলা শুরু করলেন।
– তখন তোকে ওভাবে কষ্ট দিতে চাই নি আমি।.. কখনো দিতেও চাই না।.. কিন্তু আমি যে কেনো তোকে সহ্য করতে পারি না সেটা আমি নিজেও জানি না।.. তুই যখন আমার সামনে এসে “ভালোবাসি” “ভালোবাসি ” করিস তখন প্রচুর রাগ হয় আমার।.. রাগের বশেই না চাইতেও তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলি।.. আচ্ছা, আমি যতদূর জানি তোর পরিবারের কেউও যদি কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে তুই রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিস ।। তাহলে আমি যে তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করি তবুও তুই আমার কাছে কেনো ফিরে আসিস?
– ভালোবাসি তাই।
– আবারো এই এক কথা। তুই কি বুঝতে পারিস না আমি তোকে কখনোই ভালোবাসবো না? কিছুদিন পর আমার আরেকটা পরিচয় হবে “তোর বড় বোনের হাসবেন্ড “।.. তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দে।
কেনো জানি উনার কথায় প্রচুর রাগ হলো আমার।.. দোলনা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উনার কলার চেপে ধরলাম আমি।.. আমার এমন কাজে উনি যে অনেক অবাক হয়েছেন সেটা উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।.. তাতে আমার কি? আমি আজ বলবো, যতক্ষন ইচ্ছা হয় বলবো।
– সো মিস্টার সায়ন, কি যেনো বলছিলেন আপনি? সব যেনো মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিই।.. তাইতো? এটা কি এতোই সোজা?.. সম্ভব হলে তো আরো আগেই ঝেরে ফেলতাম আমি।.. আপনার বলা তিক্ত তিক্ত কথাগুলো শুনার জন্য বসে থাকতাম না নিশ্চয়ই।.. একদিন আপনিও কাউকে ভালোবাসবেন। হয়তো এই কেউটা হবে আমার আপু। তাতে কি, ভালো তো বাসবেন।.. আপনি সবসময় বলেন না, আমার কোনো আত্মসম্মান নেই। আমার আত্মসম্মান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আপনার।… কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আত্মসম্মানটা কোনো কাজেই আসে না আমার। আমি কি পারতাম না আপনি আমায় অপমান করার পর ইগো দেখিয়ে আপনার থেকে দূরে সরে যেতে?.. অবশ্যই পারতাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ভালোবাসা সামান্য ইগোর কাছে হেরে যায় সেটা আর যা-ই হোক ভালোবাসা অন্তত নয়।.. তাই ইগো নামক ব্যধিটা আমি কখনো আমার মাঝে পুষি নি।.. আপনার কি মনে হয় যখন আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আমার কষ্ট হয় না? হ্যাঁ, আমারও কষ্ট হয়। কারণ আমি কোনো রোবট নই, রক্তে – মাংসে গড়া মানুষ।.. যখন আমার খারাপ লাগে তখন ভাবি আর যাবো না আপনার সামনে। আর কখনো বিরক্ত করবো না আপনাকে।.. কিন্তু বিশ্বাস করুন যখন আপনাকে দেখি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না আমি। কষ্টগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে চলে যাই আপনার কাছে৷ কিন্তু আর না।… এখন থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করবো। আপনার প্রতি ভালোবাসাটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে না তবে সেটা আর প্রকাশও করবো না আমি।.. প্রমিস করছি এখন থেকে আমি আপনার খালাতো বোন হিসেবেই কথা বলবো আপনার সাথে। আমি কাল সকালেই চলে যাবো ।.. সম্ভব হলে এখনি চলে যেতাম কিন্তু সেটা যখন আর হচ্ছে না তখন এটুকু সময়ের জন্য নাহয় সহ্য করে নিন আমায়।
উনার কলার ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে হাটা ধরলাম । উনি কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আমি না শুনেই চলে এলাম।… পিছনে ফিরে নিজেকে আরো দুর্বল করে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। রাত শেষে আসবে নতুন এক সকাল।.. এই নতুন সকাল থেকেই নাহয় নতুন করে শুরু করবো সব।.. হয়তো কাল থেকে সায়ন ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসাটা সুপ্ত হয়ে পড়ে থাকবে মনের কোণে।
চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ ]
#ভালোবাসি তাই
part :5
Writer : Afifa Jannat Maysha
?
??
সকাল সাতটার কাছাকাছি। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। রাতে আর ঘুমানো হয়ে উঠে নি আমার। চোখদুটো হালকা জ্বলছে। কাল রাতের পর আর সায়ন ভাইয়ার সামনে পড়তে চাই নি। তাই এই সকালবেলাতেই চলে এসেছি উনাদের বাসা থেকে। কাউকে অবশ্য বলে আসিনি। খালামনি জানতে পারলে এতো সকালে কখনোই আমাকে আসতে দিতো না। খুব ভোরে খালামনিকে তার নিজের ঘরে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম। পরে আর দেখা হয় নি। বাসার মেইন গেটটাও খোলা ছিলো। হয়তো আঙ্কেল মসজিদে যাওয়ার সময় খুলে ছিলেন পরে আর বন্ধ করা হয়ে উঠে নি।
ভাবছি এখনই কোনো গাড়িতে উঠবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত না হয়ে যাই ততক্ষন পর্যন্ত হাঁটতেই থাকবো। এই ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ত সকালটা এভাবে অনুভব করার সুযোগ হয়ে উঠে নি কখনো। রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখন সকাল না দুপুর। মনে হচ্ছে কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। জীবীকার তাগিদে যে হাজারো মানুষ রোজ চোখের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ছুটে চলে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে তার এক বিরাট বড় উদাহরণ এই সকাল। চারদিকে ইট -পাথরের দেয়ালের কৃত্রিমতা ভেদ করে বিশুদ্ধ বাতাসটাও যেনো প্রবাহিত হতে চাইছে না এই শহরে। কারো মাঝে একটু বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করছি না আমি। সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত, আশেপাশের কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের নেই। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকের দিনটাও যদি আমার কাছে স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আমিও ভাবতাম না এসব। কিন্তু আজ আশেপাশের পরিবেশটাকে নিয়ে ভাবার ইচ্ছেটা নিজের মাঝে প্রবলভাবে অনুভব করছি।
খালামনির বাসা থেকে আমাদের বাসার প্রায় এক ঘন্টার মতো দুরত্ব। আমি ঠিক কতক্ষন ধরে হাঁটছি তা খেয়াল নেই আমার। হাতঘড়িটায় সময়টা দেখার ইচ্ছেও করছে না। আজ তো আমার কোনো তাড়া নেই, তাই আজ সময়জ্ঞানহীনভাবেই হাঁটতে থাকবো।
হঠাৎ করেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কেউ আমার পেছন পেছন আসছে। কিন্তু পিছনে ফিরে সন্দেহ করার মতো কাউকেই দেখছি না আমি। তবুও মনে হচ্ছে কেউ একজন আড়াল থেকে খুব সুক্ষ্যভাবে লক্ষ্য করে চলেছে আমায়।
কিন্তু কে এমন করবে? আমার পিছু নিয়ে কার কি লাভ? একবার ভাবছি হয়তো মনের ভুল। আরেকবার ভাবছি সত্যিই কি মনের ভুল? এতোটা ভুল করছি আমি? হ্যাঁ, মনের ভুলই হবে হয়তো। সব চিন্তাভাবনা ফেলে রেখে আবারো হাঁটতে লাগলাম আমি।
পাশ দিয়ে যাওয়া একটা লোকের সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে পার্সটা পরে গেলো নিচে। আমি সেটা তুলতে গেলেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটলো আমার সাথে। আচমকাই কেউ একজন ধাক্কা দিলো আমায়। আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলাম তখনই আবার কেউ আমায় ধরে ফেললো।
গাড়িগুলো শনশন শব্দ করে ছুটে চলেছে রাস্তায়। কি ভয়ানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। কোনোভাবে যদি পড়ে যেতাম, বাঁচার কোনো আশাই থাকতো না আমার। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। হার্ট এতো জোরে বিট করছে যে মনে হচ্ছে সে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য বিদ্রোহ শুরু করেছে।
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনে তাকালাম আমি। উদ্দেশ্য কে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তাকে দেখা। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারা। চোখের আকার দেখে মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে সে। কিন্তু তার রাগের কারণটাই বুঝতে পারছি না আমি।
– সারা, তুই এখানে?
– কেনো, আমার জায়গায় আজরাঈল থাকলে খুশি হতি নাকি?
– কিসব বলছিস ? আজরাঈল কেনো থাকতে যাবে?
-আমি কি বলছি তুই বুঝতে পারছিস না?
– তুই বুঝিয়ে বললে না বুঝবো ।
– সুইসাইড করতে কেনো গেছিলি?
– কি? পাগল হয়ে গেছিস তুই? আমি সুইসাইড করতে যাবো কোন আনন্দে?
-মানুষ আনন্দে নয় দুঃখে সুইসাইড করে।
– আমার এমন কোনো দুঃখ নেই যে মরে যেতে চাইবো।
– তাহলে কি গাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য তার নিচে পড়তে চাইছিলি?
– তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। ট্রাস্ট মি, আমি ইচ্ছে করে পড়ি নি। কেউ ধাক্কা মেরেছে আমাকে।
আমার কথায় চুপ করে গেলো সারা। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো
– কিন্তু তোকে ধাক্কা মারতে যাবে কে?
– সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। আমার পার্সটা নিচে পরে গেলো, আমি সেটা তুলতে গেলাম আর তখনই কেউ ধাক্কা মারলো। তাই কে ছিলো তাকে দেখতে পারি নি।
-পার্সটা পড়লো কি করে?
– পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা লোকের গায়ের সাথে লেগে পরে গেছিলো।
– তাহলে হয়তো তুই পার্স তুলার সময় আবার অন্য কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলি। আই মিন, পুরো ঘটনাটাই অনিচ্ছাকৃত। নাহলে তোকে ধাক্কা মেরে কার কি লাভ?
সারার কথা শুনে আমারো তাই মনে হচ্ছে। সত্যিই তো আমাকে কেউ কেনো ধাক্কা মারতে যাবে? সারার কথাই হয়তো ঠিক। এতো লোকের ভীরে কারো সাথে ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনিচ্ছাকৃত হলেও কতো বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। সারা না থাকলে হয়তো এতক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকতো আমার নিঃপ্রাণ দেহ।
– আচ্ছা তুই এতো সকালে এখানে কি করছিলি? তুই না সায়ন ভাইয়াদের বাসায় গেছিলি?
– হ্যাঁ, ওখান থেকেই বাসায় যাচ্ছিলাম।
– তাই বলে এতো সকালে? আরেকটু পরে বের হতি।
– এমনি ভালো লাগছিলো না। তাই চলে যাচ্ছিলাম।
– কি হয়েছে বলতো?
– কি হবে?
– কিছু তো হয়েছে। নাহলে যে তুই সায়ন ভাইয়াদের বাসায় গেলে আসতেই চাস না সেই তুই বলছিস ভালো লাগছে না। ব্যাপার কি বলতো?
– কোনো ব্যাপার নেই। সবসময় পরিস্থিতি এক থাকে না।
– হুম বুঝলাম। কি হয়েছে বলতে হবে না। চল আমাদের বাসায় যাই।
– তোদের বাসায় কেনো যাবো? আমি এখন আমাদের বাসায় যাবো।
– তো যা না। যাওয়ার পরে আন্টি যখন জিজ্ঞেস করবে এতো সকালে কেনো চলে এলি তখন কি উত্তর দিবি? বলবি যে সায়ন ভাইয়ার সাথে কোনো কারণে ঝামেলা করে চলে এসেছিস?
সত্যিই তো একথাটা আগে আমার মাথায় আসে নি। বাসার সবাই জানে আমি খালামনির বাসায় যাওয়ার জন্য পাগল। এখন সেই বাসা থেকেই এতো সকালে চলে এসেছি দেখলে সবাই ভাববে কিছু হয়েছে। তার থেকে বরং সারার সাথে ওদের বাসায় চলে গেলে ভালো হবে। আরেকটু পরে নাহয় বাসায় চলে যাবো।
– কিরে ভাবনা শেষ হলো?
– হুম।
– যাচ্ছিস তো?
– হ্যাঁ, চল।
?
??
সারাদের বাসার সবাই বাসাতেই আছে। সকালবেলায়ই ওদের বাসায় কেমন উৎসব উৎসব ভাব। সারার বড় আপু বেড়াতে এসেছে বলে এতো আয়োজন। ভাবছি আমার আপুও যদি বিয়ের পরে বাসায় আসে তখন কি আমাদের বাসায়ও এমন আনন্দ হবে? হবে হয়তো। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি মন থেকে আনন্দ করতে পারবো কি না। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই সারার সাথে তার ঘরে চলে এলাম। তখনই দৌড়ে এলো কিউট গুলুমুলু একটা ছোট ছেলে। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা সারার আপুর ছেলে।
– সালা, তোমায় হাতা থেস?
– হ্যাঁ, বাবা আমার হাটা শেষ।
– আমায় দন্য তক্কেত এনেতো?
– এই রে একদম ভুলে গেছি। কালকে এনে দেবো ঠিকাছে?
সারার কথায় মুখটা কালো হয়ে বাচ্চাটার। আমার পার্সে কয়েকটা চকলেট ছিলো। বাসা থেকে আসার সময় ভাইয়া দিয়েছিলো কিন্তু খাওয়ার সুযোগ হয় নি। আমি চকলেটগুলো তার দিকে বারিয়ে দিয়ে বললাম
– এই নাও বাবু, চকলেটস।
বাচ্চাটা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সারার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো অপরিচিত কারোর থেকে কিছু নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তার উপরে। ওর অবস্থা দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছে। আগে যখন স্কুলে যেতাম মা বারবার করে বলতো ” মাইশা, অপরিচিত কেউ কোনোকিছু খেতে দিলে খাবে না। তার সাথে যেতে বললেও যাবে না “।
তখন আমি শুধু মাথা নাড়তাম যার অর্থ হ্যাঁ, যাবো না। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম অবশ্যই খাবো। কেউ আমাকে টাকা ছাড়া চকলেট দিলে আমি কেনো নেবো না? অবশ্যই নেবো। কিন্তু আফসোস, আজ পর্যন্ত এমন অপরিচিত কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটে নি। এটা সত্যি সত্যিই অনেক কষ্টের কথা।
– সালা, আমি কি এই আন্তির তক্কেত নিবো?
– হ্যাঁ, বাবা নাও।
– তুমি অনেক বায়ো আন্তি।
ওর কথায় মুচকি হাঁসলাম আমি। তার সামনে হাটু মুরে বসে জিজ্ঞেস করলাম
– তোমার নাম কি বাবু?
– মুয়াম্মত।
– মোহাম্মদ?
– হ্যাঁ।
– অনেক সুন্দর নাম। কে রেখেছে এই নামটা?
– সালা।
– সালা রেখেছে?
– সালা না তো, সালা।
সারা বললো
– তুমি এখন যাও বাবা। আমরা পরে খেলা করবো।
– থিকাতে। আততায়াইকুম আন্তি।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
মোহাম্মদ চলে যেতেই সারাকে বললাম
– তোর আপুর ছেলে তো দেখি হেব্বি টেলেন্টেড।
– কেনো? এখানে টেলেন্টের কি দেখলি?
– আরে তোকে খালামনি থাকে সোজা শালা বানিয়ে দিলো। এটা কি কম বড় টেলেন্ট?
– ওর এই কথাগুলোর জন্যই তো ওকে এতোটা ভালোবাসি আমি। জানিস মাইশা, মোহাম্মদের জন্মের আগে আমার খুব রাগ হতো। কারণ আমার মনে হতো ওর জন্মের পর আপু আমাকে আর আগের মতন ভালোবাসবে না। হিংসা হতো খুব। কিন্তু ও আমাদের মধ্যে আসার পর আমার ধারণা পুরো পাল্টে গেছে। প্রবাদ আছে না, ” মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি ” আমার ক্ষেত্রে এখন তাই হচ্ছে। ও তো আমার আপুরই অংশ। তাই ওকে ভালোবাসা মানে আপুকে ভালোবাসা। ওদের দুজনকেই আমি খুব ভালোবাসি। আচ্ছা তুই বস আমি একটু আসছি।
সারা চলে গেলে জানালার পাশটায় এসে দাঁড়ালাম আমি। জানালার বাইরে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবছি
” আমি নিশ্চয়ই অনেক সার্থপর? নাহলে নিজের আপুর আনন্দে খুশি হতে পারবো কিনা তা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছি কেনো? আমিও তো আমার আপুকে খুব ভালোবাসি। সারা তার আপুকে যতটা ভালোবাসে তার থেকেও ভালোবাসি। সায়ন ভাইয়ার জন্য আমি নিজের বোনের সাথে দুরত্ব কেনো বারাবো? আমিও আমার আপুর সাথে এভাবেই থাকবো। ওর সাথে অনেক আনন্দ করবো। আচ্ছা, খুব কি ক্ষতি হতো যদি আমি সায়ন ভাইয়াকে ভালো না বাসতাম? বেসেছি তো কি হয়েছে? তার জন্য আপুর সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই খারাপ হতে দিবো না, কখনোই না। ”
চলবে……..
[কালকে অনেকেই বলেছেন যে আমি গল্প দেরিতে কেনো দেই? এতে গল্প পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যায়।গল্প লেখাটা আমার একটা সখ। আমি সখের বসেই গল্পটা লিখছি। কিন্তু আমার তো আরো অনেক কাজ থাকে তাই না? সব কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু গল্প নিয়ে পরে থাকলেতো চলবেনা। আমি যখন সময় পাই তখন লিখতে বসি। তবুও আমি গল্পটা নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো। তারপরেও যদি গল্প দিতে দেরি হয় আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটা বুঝবেন। ধন্যবাদ। ]
next part:https://www.facebook.com/groups/2581414678629687/permalink/2782908968480256/