ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ১৬
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
মুখে ঠান্ডা কিছু অনুভব করে ভ্রু কুচকে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। প্রথমে সবকিছুই ঝাপসা দেখছিলাম তারপর কোনোরকমে চোখ ঝাপটা দিতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম ইফাজ ভাইয়া, জাবিন, আদিব ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, সকলের চোখে মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আর বাকি অনেকেই আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাম পাশে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আপি বসে আছে। আদ্রিয়ান কোথায়? উনি নেই কেনো? এসব ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলাম আমি কারো বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আছি, কারো বুকে মাথা দিয়ে রেখেছি আমি। মাথাটা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেলাম ওটা আদ্রিয়ানই। আমি ওনার দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান পকেট থেকে রুমাল বেড় করে আমার মুখ মুছে দিলেন। হয়তো পানির ছিটা দিয়েছিলেন মুখে। মুখ মুছে গালে হাত রেখে বললেন,
— ” ঠিক লাগছে এখন?”
আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে ওনার থেকে সরে বসলাম। ইফাজ ভাইয়া আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” দুঃখিত। বিব্রত করলাম আপনাদের।”
আঙ্কেল হেসে দিয়ে বললেন,
— ” আরে না না। কী বলছো বলোতো? তোমরা তো আমার নিজের লোকই। আর ও তো আমার মেয়ের মতোই। কিন্তু কী হয়েছিল বলোতো হঠাৎ এভাবে ভয় পেয়ে গেলে কেনো?”
ইফাজ ভাইয়াও বলল,
— ” হ্যাঁ তাইতো? কী হয়েছিল তোমার?”
আমি একবার অসহায় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। আর কেউ কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
— ” থাক এখন এসব কথা। এখন ও ঠিক আছে। আমরা উঠছি তাহলে আজ?”
আন্টি এসে বললেন,
— ” উঠছি মানে কী? না খেয়ে যাওয়া যাবেনা। আমরা তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ভেতরেই করেছি চলো।”
আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ” আসলে ওর শরীরটা ভালো নেই তাই বলছিলাম..”
আদ্রিয়ানকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আঙ্কেল বললেন,
— ” আরে কিচ্ছু হবেনা। ও আস্তে আস্তে খেয়ে নিতে পারবে। তাইতো মামনী?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— ” জ্বী।”
আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” আর ইউ শিউর?”
— ” হুম।”
এরপর আমরা সবাই ডাইনিং এ গেলাম। আমার সামনে প্লেট দিতে গেলেই আদ্রিয়ান বললেন,
— ” ওকে প্লেট দিতে হবেনা আন্টি। আমি খাইয়ে দিচ্ছি ওকে।”
আন্টি মুচকি হেসে প্লেটটা সরিয়ে নিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। নিজের হাতে খাইয়ে দেবেন উনি আমাকে? কিন্তু কেনো? আদ্রিয়ান নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে এক চামচ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি উনি গলা ঝেড়ে বললেন,
— ” আমাকে দেখছো ভালো কথা একটু হা করে তাকিয়ে দেখো তাহলে খাবারটা দিতে পারবো।”
আমি সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলাম। সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। জাবিন তো হালকা শব্দ করেই হেসে সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরলো। আমার এবার ভীষণ রাগ হলো ওনার ওপর সবসময় এভাবে সবার সামনে লজ্জায় ফেলেন আমাকে। আমি ভ্রু কুচকে বিরক্তি ওনার দিকে তাকালাম। উনিও ঠোঁট চেপে হাসছেন। আমি আবার মুখ ঘুরিয়ে নিতে গেলেই উনি আমার থুতনি ধরে মুখ নিজের দিকে নিয়ে খাবার খাইয়ে দিলেন। আমিও আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আদিব ভাইয়া নিজের গাড়ি করে ওনার বাড়িতে চলে গেলেন। গাড়ির কাছে আসতেই আদ্রিয়ান বললেন,
— ” ভাইয়া আজ তুই ড্রাইভ কর। আমি ওকে নিয়ে পেছনেই বসছি।”
ইফাজ ভাইয়া মাথা নেড়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। আপি বসেছে ফ্রন্ট সিটে। আমি, উনি আর জাবিন পেছনে বসলাম। আদ্রিয়ান এক হাত দিয়ে জরিয়ে ধরে রেখেছেন। আমি বললাম আমি ঠিক আছি কিন্তু উনি শোনেন নি। আপি এবার পেছনে ঘুরে বলল,
— ” সত্যি করে বলতো অনি কী হয়েছিল তোর? আর ঐ গাছটার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলি কেনো? কী দেখেছিলি?”
জাবিনও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এক্সাক্টলি ভাবি কী হয়েছিলো বলতো? এভাবে রিঅ্যাক্ট করলে যে?”
ওদের প্রশ্ন শুনে সেই দৃশ্য আরো বেশি আমি করে মনে পরছে। আর ভয়ও বাড়ছে। আমি না চাইতেও ভয়ের জন্যে আদ্রিয়ানের হাত আর সুট এর সামনের একসাইড খামচে ধরলাম। উনি এবার বিরক্তিকর কন্ঠে বললেন,
— ” বললাম তো এই টপিকটা থাক। ও এখন ঠিক আছে। এমনিতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনা তো। উইক লাগছিলো হয়তো তাই মাথা ঘুরে গেছে।”
জাবিন একটু গলা ঝেড়ে বললেন,
— ” তোদের বিয়ের তো মাত্র কটা দিন হলো রে ভাইয়া? এরমধ্যেই ভাবির মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেলো? তুইতো খুব ফাস্ট!”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকালো জাবিনের দিকে। আপিও মিটমিটিয়ে হাসছে। ইফাজ ভাইয়ার রিয়াকশনটা ঠিক বুঝতে পারছিনা। উনি সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছেন। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি জাবিনের দিকে নিজের বড় ভাইকে কেউ এভাবে বলতে পারে? আল্লাহ মালুম। আদ্রিয়ান জাবিনের মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন,
— ” চুপ কর বেয়াদব। দিন দিন চরম অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস। বড় ভাই আমি তোর। বুঝে শুনে কথা বলবি।”
জাবিন মুখ ফুলিয়ে মাথা ডলতে ডলতে ভেংচি কাটল। ইফাজ ভাইয়া বললেন,
— ” কেনো আদ্রিয়ান? অস্বাভাবিক কিছুতো বলেনি তাইনা। কয়েকটা দিন তো হয়েই গেছে বিয়ের? গুড নিউস তো পেতেই পারি?”
ইফাজ ভাইয়ার কথায় এবার বেশ লজ্জা পেলাম। এভাবে বলে কেউ? সম্পর্কে তো আমার ভাসুর তাইনা। আরেক দিক দিয়ে যদিও দুলাভাই। কিন্তু তবুও আমায় এভাবে অস্বস্তিতে ফেলার কোনো মানে হয়? আর তাছাড়াও ওনার যা নিরামিষ মার্কা ভাই। তাতে কয়েক দিন কেনো কয়েক বছরেও কিছু হবে কি না আল্লাহ্ জানেন। ছিঃ কী ভাবছি আমি এসব? এই অসভ্যগুলোর সাথে থেকে থেকে আমিও অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। আদ্রিয়ান মেকি হেসে বললেন,
— ” আমারতো কয়েকদিন হলো কিন্তু তোর তো বিয়ের চারমাস হয়ে গেলো। প্রথম গুডনিউসটা তো তোর দেওয়া উচিত তাইনা?”
এবার আপিও লজ্জা পেলো। লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইফাজ ভাইয়াও গলা ঝেড়ে ড্রাইভিং এ মন দিলেন। সেদিন ইফাজ ভাইয়া ঠিকই বলেছিলেন আদ্রিয়ানের সাথে কেউ কথায় পারবেনা। কিন্তু এই তিন ভাইবোনই মারাত্মক লেভেলের অসভ্য। এক নম্বরের বেহায়া। কথাবার্তার কোনো লাগাম নেই। নিজেরা লাগাম ছাড়া কথাবার্তা বলে আর লজ্জায় পরতে হয় আপি আর আমাকে।
___________________
কোচিং এর ভাইয়া লেকচার দিচ্ছেন আমি আর ইশু দুজনেই একটু পর পর হাই তুলছি। একদমি বোরিং ক্লাস চলছে। কিছু কিছু ক্লাস এমনই হয় মাথার ওপর দিয়েও যায়না কপাল বরাবর এসে ইউটার্ন মারে। এটা ঠিক তেমনই ক্লাস। আমাকে এভাবে টলতে দেখে ইশু ভ্রু কুচকে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ” কীরে সমস্যা কী তোর বলবি? রাতে জিজু ঘুমাতে দেয় নি নাকি?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,
— ” আমাকে না হয় তোর জিজু ঘুমাতে দেয়নি। আমি বিবাহিত সো ইটস নরমাল। কিন্তু তুই কেনো ঝিমছিস হ্যাঁ ? রাত জেগে বি এফ এর সাথে প্রেমালাম করেছিস?”
— ” অাস্তাগফিরুল্লাহ। তুই জানিস না আমি কতো ভদ্র মেয়ে?”
— ” হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো করেই জানি তাইতো বললাম।”
ইশু কনফিউসড হয়ে কিছু বলবে তার আগেই ভাইয়া ওয়ার্ন করে দিলেন আমাদের। আমরও ভদ্র মেয়ের মতো সাময়িকভাবে চুপ হয়ে গেলাম।
ক্লাস শেষ করে ইশু আর আমি গল্প করতে করতে বেড় হচ্ছি। বাইরে বেড়িয়ে আদ্রিয়ানকে দেখতে পেলাম না। কী ব্যপার উনি কী আসেন নি? কিন্তু উনি তো কখনও লেট করেন না। নিজে না আসতে পারলে গার্ড পাঠিয়ে দেন তাহলে? এসব ভেবে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই কালকের সেই ছেলেটাকে দেখতে পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ ছেলেটা উঠলেন,
— ” হেই।”
আমি শুনিইনি এমন একটা ভাব করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু উনি আমার সামনে চলে এলেন। তারপর হেসে বললেন,
— ” হাই। তুমি এখানে? এই কোচিং সেন্টারেই ভর্তি হয়েছো নাকি?”
আমি মেকি একটা হাসি দিয়ে বললাম,
— ” হ্যাঁ।”
— ” ওহ আসলে আমি এখানে এক ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলতে এসছিলাম। আচ্ছা শুনলাম কালকে নাকি তুমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলে? আমি ছিলাম না একটু বাইরে গিয়েছিলাম। ঠিক আছো এখন?”
— ” ঠিক না থাকলে তো আর কোচিং এ আসতে পারতাম না।”
উনি হেসে দিয়ে বললেন,
— ” তা ঠিক। কালতো পরিচয়ই হয়নি।আমি রূপ। তুমি?”
— ” অনিমা।”
— ” অনিমা? ওয়াও! কিউট নেইম। আচ্ছা উনি তোমার ফ্রেন্ড?”
— ” হ্যাঁ ও আমার বান্ধবী ইশরাত।”
ইশরাত মেকি হেসে হাই বলল। লোকটাও বলল। এখন খুব বিরক্ত লাগছে আমার তখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছে। উনি এবার একটু সংকোচ নিয়ে বললেন,
— ” আসলে কালকের জন্য সরি। ওভাবে হাত ধরাটা ঠিক হয়নি আমার। ”
— ” ইটস ওকে। বুঝতে পেরেছেন এতেই হবে।”
রূপ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
— ” তো কী খাবে বলো?”
আমি হেসে বললাম,
— ” কিছুই খাবোনা আমরা। আমরা এখন বাড়ি যাবো।”
— ” আরে যাবেতো চলো দুজনকেই কিছু খাওয়াই। জাস্ট পাঁচ মিনিট নেবো।”
— ” না আসলে আমাদের ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে যেতে হবে এক্ষুনি।”
বলে ইশুর হাত ধরে ওখান থেকে চলে এলাম পেছন থেকে ডেকেছেন উনি কিন্তু শুনিনি। বেড়িয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পরলাম। ইশু সামনের একটা স্টান্ড থেকে বাস নেবে অতোটুকু আমার সাথেই যাক। বাড়িতে পৌছে ফ্রেশ হয়ে, নিচ থেকে কিছু খেয়ে তারপর উপরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে দেখছি। হঠাৎই ধরাম করে দরজা লাগানোর শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার চুলগুলো হালকা এলোমেলো হয়ে গেছে, হালকা ঘেমেও আছেন, ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। আমি একটা ঢোক গিলে ফোনটা রেখে দিলাম। উঠে যে দাঁড়াবো সেই শক্তি পাচ্ছিনা। উনি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে আসছেন। আমি ভীত প্লাস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আবার কী গন্ডগোল করেছি আমি? এতো রেগে গেলেন কেনো? এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো? কী করতে চাইছেন উনি?
#চলবে…
( আগেও দুইবার বলেছি আরও একবার বলছি। এডমিশনের জন্যে প্রিপারেশন নিচ্ছি তাই লেখা ছোট হচ্ছে। আসলে এতো প্রেশারের মধ্যে চাইলেও বড় লেখা যায় না। গল্পটা কন্টিনিউ করাটাই কষ্টের হচ্ছে। আশা করি আমার সমস্যাটা বুঝবেন। ধন্যবাদ।”