ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ২৮
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সারা শরীর মৃদু কম্পিত হচ্ছে আমার। ওনারা প্রতিটা কথা আমার হৃদয়ে গিয়ে লেগেছে। নিজের চোখ কান অনুভূতি কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। নিজের হাজবেন্টের কাছ থেকে এরকম লাভ কনফেশন পাওয়া যেকোন মেয়ের কাছেই ভাগ্যের বিষয়। ওনার প্রতিটা শব্দের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার এরকম মনে হচ্ছে আমি কোনো স্বপ্নের রাজ্যে আছি।উনি মাথা সরিয়ে আমার চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বললেন,
— ” কী হলো? কিছু বলছো না যে?”
আমি স্হির দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। আমি কী বলবো? আমার সব কথা গলাতেই আটকে গেছে। আমি ভাবতেও পারিনি আজকে এমন কিছু হবে। উনি মুচকি হেসে বললেন,
— ” আচ্ছা কিছু বলতে হবেনা। জাস্ট ওয়েট আ মিনিট।”
এটুকু বলে উনি পকেট থেকে একটা গ্রে রং এর চেইন বের করলেন যেটাতে গ্রে রং এর একটা লাভ শেপের সুন্দর লকেট, লকেটের ওপর হোয়াইট স্টোনের ডিজাইন করা। এগুলো ডায়মন্ড না কী? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি লকেটটার দিকে। উনি আমার দিকে ঝুকে আলতো করে কাধ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে লকেটটা পরিয়ে দিলেন। লকেটটা পড়িয়ে উনি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমার হাত অটোমেটিক গলায় চলে গেলো। উনি মুখে সেই মোহনীয় হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— ” চেক ইট?”
আমি লকেটটা উঁচু করে ধরে দেখলাম লকেটটার গায়ে ছোট ছোট হোয়াইট ডায়মন্ড দিয়ে ইংলিশ এ আর ও ওয়ার্ড দিয়ে ডিজাইন করা আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি ইশারা করে লকেটটা খুলতে বললেন। আমি লকেটটা খুলে আবারও অবাক হলাম। কারণ ডান পাশে ওনার একটা ছবি আর বামপাশে আমার ছবিটা আছে। ছবিটা আপির এনগেইজমেন্টের দিনের। সেই পিংক গাউন পরা। ছবিটাতে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছি। আমি অবাক হয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” এই ছবিটা? ”
আদ্রিয়ান আমার দুকাধে হাত রেখে বলল,
— ” ছিলো আমার কাছে। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
আমি লকেটটার দিকে একবার তাকিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। এখনও শক থেকে বেরোতে পারছিনা আমি। কোন কথায় কীভাবে রিয়্যাক্ট করবো বুঝতে পারছিনা। উনি হঠাৎ করেই আমায় আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এরআগেও একদিন নিজে থেকে হাগ করেছেন আমায় সেটাতো শুধু আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই। কিন্তু আজ এমন মনে হচ্ছে যেনো ওনার ভেতরের সমস্ত আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন উনি আমায়। আমি আস্তে আস্তে ওনার পিঠে হাত রেখে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভালোবাসাময় একটু ছোঁয়ায় যে এতো সুখ লুকিয়ে থাকে আজকের আগে কখনও বুঝিনি। এতো ভালো কেনো লাগছে আমার? বেশ অনেকটা সময় পর উনি আমায় ছেড়ে সোজা করে দাঁড় করালেন। নদীর পার থেকে আসা বাতাসে আমার মুখে উড়ে আসা চুলগুলো সরিয়ে দুই কানের ওপর দিয়ে হাত রেখে কপালে বেশ সময় নিয়ে একটা চুমু দিলেন। আমি চোখ বন্ধ করেই ওনার গেঞ্জি খামচে ধরলাম। এটাই ওনার আমার কপালে ভালোবেসে এঁকে দেওয়া প্রথম স্পর্শ ছিলো। সারাজীবনেও হয়তো এই স্পর্শটা ভুলতে পারবোনা আমি। আমি চোখ বন্ধ করে আছি এখনও। উনি বললেন,
— ” অনি, আমি তোমার জন্যে এতো কষ্ট করে এতো সব কিছু ডেকোরেট করলাম অথচ তুমি ভালো করে দেখছোও না। নট ফেয়ার।”
আমি চোখ খুলে ওনার দিকে তাকাতেই উনি ইশারা করে বললেন চারপাশটা দেখতে। আমি চারপাশে তাকিয়ে এবার সব দেখতে লাগলাম চারপাশে দড়ি টানিয়ে তাতে বিভিন্ন রঙের বেলুন বাঁধা, আর রঙিন কাগজের বিভিন্ন ডিজাইন টানানো, কালারফুল লাইটস, নিচে মোমবাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো আমি হাটতে হাটতে বেলুন, লাইটস, কাগজ নেড়ে নেড়ে দেখছি পুরোটাই নদীর পার দিয়ে মানে দুকদম এগোলেই নদী। নদীর পার দিয়ে পানির ওপর দিয়েও ফুল সাজানো। লাইটের আলোতে যা চমৎকার লাগছে। সব দেখে আমি হেসে দিয়ে পেছন ফিরে ওনার দিকে তাকালাম। উনি আমার পেছন পেছনই এসেছেন। আমি ওনাকে কিছু বলবো তার আগেই উনি আমাকে ধরে আবার নদীর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। এরপর ফোনে কী জেনো করলেন সাথে সাথে নদীর মাঝদিয়ে এক এক করে একটু দূরে দূরে আলো জ্বলে উঠলো। আমি অবাক হয়ে ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম এগুলো সব নৌকা। প্রায় পঁচিশ ত্রিশটা নৌকা। আর নৌকার মধ্যেই আলো জ্বলছে। আমি অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার দিকে উনি আবারও সামনে তাকাতে বললেন। আমি আবার নদীর দিকে তাকাতেই উনি থ্রি টু ওয়ান কাউন্ট করলেন। ওয়ান বলার সাথে সাথেই এরকমই পঁচিশ ত্রিশটা ফানুস ওপরে উঠে গেলো আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উপরে উঠতে থাকা ফানুসগুলোর দিকে। উনি আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে বললেন,
— ” এসব জিনিস, ন্যাকামো আমি কখনো পছন্দ করিনা আমার কাছে ভালোবাসা ভালোবাসাই সেটা জাহির করার দরকার হয়না, এভাবে তো একদমই না। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমার কোনো দোষ ছিলোনা তবুও তোমায় বারবার কাঁদিয়েছি। তাই তোমার মনটা ভালো করার জন্যে এতোদিনের দেওয়া কষ্ট একটু হলেও পুশিয়ে নেওয়ার জন্যে, তোমার মুখের এই মায়াবী মিষ্টি হাসিটা দেখার জন্যে এটুকু তো করতেই পারি তাইনা?”
আমি স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওনাকে ভালোবাসি কী না জানিনা কিন্তু নিজের স্বামীর এটেনশন, ভালোবাসা সব মেয়েরাই চায়। আমিও চেয়েছি। আর আজ সেটা পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে, সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে। উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— ” আজ এতো চুপ কেনো? এমনিতেতো বকবক করে আমার মাথাই ধরিয়ে ফেলো।”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম। রোজ রেগে গেলেও আজ ওনার এই টিজ করা কথাগুলোও খুব বেশিই ভালোলাগছে। উনি আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
— ” জানো কখনও ভাবিনি কাউকে ভালোবাসবো। আর যখন বাসলাম তখন এতোটা ভালোবাসলাম যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারছিনা আমি। এতোটা জড়িয়েছি যে নিজের থেকে কোনোদিন আলাদা করতে পারবোনা।”
আমি শুধু তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এই আদ্রিয়ান বাসররাতে বলেছিল আমায় কোনোদিনও বউ বলে মানবেনা। অথচ আজ সেই আদ্রিয়ানই আমায় ভালোবাসি বলছে। বারবার বলছে। উনি বললেন,
— ” নদীর মাঝখানে একটা চর আছে চলো যাই। নৌকাতেও ওঠা হয়ে যাবে তোমার?”
আমার অনেকদিন যাবত নৌকায় ওঠা হয়ে ওঠেনা তাই খুব এক্সাইটেড হয়ে বললাম,
— ” সত্যি? নৌকায় চড়বো?”
উনিও হেসে দিয়ে বললেন,
— ” হ্যাঁ চলো।”
উনি ফোন করতেই একটা নৌকা এসে পারে ভিরলো। প্রথমে উনি উঠে হাত ধরে আমাকে ওঠালেন। প্রায় আধঘন্টার নদীপথ ছিলো। ততোক্ষণ আমি আর আর একটা কথাও বলিনি। চুপচাপ ঠান্ডা হাওয়া আর অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশের পরিবেশটাকে উপভোগ করেছি। চরে নেমে দেখলাম চরটা খুবই নিরিবিলি পাশে একটু বাগান বাগান। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,
— ” কী ব্যাপার বলুনতো? সত্যি সত্যিই কী আমায় মেরে টেরে ফেলে দিয়ে যাবেন নাকি?”
উনি বাঁকা হেসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার দিকে এগোতে এগোতে বললেন,
— ” হ্যাঁ। মারবোই তো।”
বলে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি পেছানোর ভুলটা করছিনা কারণ পিছিয়ে আর যাবোটা কোথায়? ঘুরে ফিরে তো ওনার কাছেই আমায় আসতে হবে। উনি আমার কোমর চেঁপে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে বললেন,
— ” তবে মেরে ফেলে রেখে যাবোনা। সাথে করে নিয়েও যাবো।”
আমি ওনাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। একেবারে নদীর পারেই দাঁড়ালাম। উনি পেছন থেকে আমার দুই হাতের ওপর হাত রেখে বললেন,
— ” অনি? কখনও একটু মুক্ত স্বাধীন হাওয়াকে চোখ বন্ধ করে দু হাত ছড়িয়ে উপভোগ করেছো?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। উনি আমার দুহাত ছড়িয়ে ধরে বললেন,
— ” এখন করে দেখো নিজেকে মুক্ত উড়ন্ত পাখি মনে হবে।”
আমি ওনার কথা মতো ঠিক তাই করলাম কিছুক্ষণ পর ফিল করলাম হ্যাঁ একদম ঠিকই বলেছেন উনি। সত্যিই আমার নিজেকে মুক্ত উড়ন্ত পাখিই মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই হাওয়া উপভোগ করার পর উনি হাত নামিয়ে আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুই বাহু ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে বললেন,
— ” তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা কতোটা হালকা লাগছে নিজেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ব্যাক্তি মনে হচ্ছে। কারণ আজ তোমাকে নিজের মনের কথা বলতে পেরেছি। তোমাকে ভালোবাসতে পারছি। এন্ড তোমাকে নিজের কাছে পাচ্ছি, নিজের সাথে পাচ্ছি।”
বলে আবারও জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমিও চোখ বন্ধ করে আজ ওনার দেওয়া ভালোবাসা গুলো উপভোগ করছি। এরপর আমরা বেশ অনেক্ষণ ওখান দিয়ে হেটেছি, চারপাশটা ফিল করেছি। কেনো জানিনা আজ সবকিছুই ভালো লাগছে আমার। খুব বেশিই ভালো লাগছে। নৌকা দিয়ে ফেরার সময় দুজনে একটু দূরত্ব নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করে উনি আমাকে পানির ছিটা দিলেন। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে আমিও রেগে গিয়ে আমিও ওনাকে পানি ছুড়ে মারলাম। উনি আবার মারলেন আর আমিও। এমন করতে করতে কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম মাঝি আমাদের দেখছেন আর হাসছেন। তাই দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম। একটু পর একে ওপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই ফিক করে হেসে দিলাম। ওপারে নেমে একটূ এগিয়ে গিয়ে উনি বললেন,
— ” রাত দশটা বেজে গেছে। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? চলো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি।”
আমি একটু ভেবে বললাম,
— ” কিন্তু বাড়িতে সবাই..”
— ” ওদের বলে দিয়েছি ফিরতে রাত হবে।”
— ” আচ্ছা চলুন তাহলে।”
এরপর দুজনে ওখানকার একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করলাম। ওখান থেকে বেড়িয়ে দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। হালকা ফুরফুরে হাওয়ায় মিডিয়াম স্পিডে চলতে থাকা গাড়ি, পাশে মিলিয়ে অসাধারণ লাগছে আমার। হুট করেই উনি গান প্লে করলেন ‘ এগিয়ে দে।’ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আমি ভ্রু নাচাতেই উনি চোখ সরিয়ে নিতে ড্রাইভিং এ মন দিলেন। আমিও হেসে দিয়ে বাইরে তাকালাম।
বাড়ি ফিরতেই মিনু দরজা খুলে দিলো। বাকি সবাই ঘুম। দুজনেই সোজা রুমে গেলাম। প্রথমে উনি ফ্রেশ হয়ে এলেন এরপর আমি গেলাম। আমি বেড়িয়ে এসে দেখি উনি বেডে আধশোয়া হয়ে ফোন দেখছেন। আমার তাকিয়ে বললেন,
— ” খুব টায়ার্ড নিশ্চয়ই? এসো ঘুমাবে।”
এতোদিন যেমন তেমন ছিল। উনি আমায় ভালোবাসে জেনে ওনার কাছে যেতে বা আশেপাশে যেতে কেমন যেনো লাগছে এখন। এটা কী সংকোচ নাকি লজ্জা জানিনা কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কী হলো এসো?”
আমি আস্তে করে বেডে এককোণে গুটিয়ে শুয়ে পরলাম। উনিও লাইট অফ করে শুয়ে পরলেন। বেশ কিছুক্ষণ পুরো ঘরটা নিরব ছিলো। হঠাৎ উনি বললেন,
— ” জানপাখি?”
আমার শরীর সাথে সাথে হালকা কেঁপে উঠল। জানপাখি ডাকটা কেনো জানিনা আমার বুকে গিয়ে খুব জোরেই লাগলো। হঠাৎ এই নামে আমায় ডাকলেন কেনো? আমাকেই ডেকেছেন তো? আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি, চুপচাপ শুয়ে আছি। উনি আবার বললেন,
— ” আমার বুকে মাথা রেখে শোবে প্লিজ?”
আমি অনেক বেশিই অবাক হলাম কিন্তু ওনার এই মিষ্টি করে করা অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। তাই আস্তে করে গিয়ে ওনার বুকে মাথা রাখলাম। উনি সাথে সাথেই একহাতে জড়িয়ে নিলেন আমায়। আর আমি আজ সারাদিনে ঘটা ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসলাম তারপর চোখ বন্ধ করে ওনার হার্টবিট শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরলাম।
#চলবে…