ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৪৮
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
সকাল! সবসময়ই নতুন কিছু নিয়ে আসে। নতুন একটা দিন, নতুন আলো, নতুন সময়, নতুন চিন্তা। আজকের দিনটাও আমার জন্য নতুন একদম নতুন। সূর্যের নতুন মৃদুর আলোর রশ্মি মুখে এসে পরাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে নিজেকে আদ্রিয়ানের বুকে আবিষ্কার করলাম। ওর লোমহীন উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে শুয়ে আছি আর ও নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে রেখেছে আমাকে। কালকে রাতের কথা মনে আসতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম আমি। নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ঘুমন্ত মুখ, এলোমেলো চুল কতো সুন্দর লাগছে ওকে যদিও সবসময়ই সুন্দর লাগে। আমি ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে উঠতে নিলেই ও আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেই বলল,
— ” জানপাখি নড়োনাতো। আমার ঘুম হয়নি এখনও।”
আমার এমনিতেই ওর কাছে থাকতে লজ্জা লাগছে, তাই ও ওঠার আগেই উঠে পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনতো এ ছাড়ছেনা। কিন্তু ও উঠে গেলে তো ওর দিকে তাকাতেও পারবোনা আমি। আমি কাঁপা গলায় বললাম,
— ” ত্ তুমি ঘুমোও, আমাকে অ্ আটকে রেখেছো কেনো?”
ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— ” তোমাকে ছাড়লে আর ঘুম আসবেনা চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।”
আমি এবার মহাবিপদে পরলাম। এই ছেলে আমাকে ছাড়ার নামও নিচ্ছে না। কিন্তু ও কেন বুঝতে পারছেনা ওর কাছে থাকতে এই মুহূর্তে আমার লজ্জা লাগছে। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,
— ” প্লিজ ছাড়ো এখন, বেলা হয়ে গেছে।”
এবার ও অাস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। ওর চোখে চোখ পরতেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। ও বলল,
— ” এখন উঠে কী করবে হ্যাঁ? সবে সকাল হয়েছে।”
আমি নিচের দিকে চোখ রেখেই ইতস্তত কন্ঠে বললাম,
— ” বেড়োবেনা আজ?”
— ” হ্যাঁ বেড়োবোতো। কিন্তু আরও পরে এতো তাড়াতাড়ি কী?”
— ” ন্ না ফ্রেশ হয়ে র্ রেডি হতে সময় লাগবে তো।”
— ” তুমি নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছো কেনো, আর তোতলাচ্ছো কেন?”
— ” ক্ কই?”
ও এবার আমার থুতনি ধরে আমার মূখটা উঁচু করে ধরল। কিন্তু আমি এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। ও আমার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
— ” এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? এতোদিন পেতে তাও না হয় বুঝতাম। কিন্তু কাল রাতের পর… ”
আমি সাথেসাথেই ওর বুকে মুখ গুজে দিলাম। ও আমায় আলতো হাতে জড়িয়ে নিলো। কেউ কিছু বললাম না। দীর্ঘসময় দুজনেই চুপ করে ছিলাম। বেশ অনেকটা সময় পর আদ্রিয়ান বলল,
— ” জানো আজ এতোদিন পর নিজেকে হালকা লাগছে। যেই মুহূর্তে তুমি ভালোবাসি শব্দটা বলেছো আমার মনে হয়েছে আমি সব পেয়ে গেছি আর কিচ্ছু চাইনা আমার। কিন্তু তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। সবকিছু পেয়েও যদি হারিয়ে ফেলি। যদি কোন দমকা হাওয়া সব এলোমেলো করে দেয়?”
আমি কিছুই বললাম না কারণ এই একই ধারণা আমার মনের মধ্যেও এসে জেকে বসে আছে। কিছুতেই মন থেকে বেড় করতে পারছিনা। আজ সব ভালো হচ্ছে, দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে কিন্তু সাথে একটা ভয়ও কাজ করছে। এসবকিছু কপালে সইবে তো হারিয়ে ফেলবো না তো সব? ও আবার বলল,
— ” ভালোবাসি জানপাখি। ভীষন ভালোবাসি। আর যাই হোক কখনও আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। আমি পারবোনা তোমাকে ছাড়া বাঁচতে। আমি নিজেও জানিনা কীকরে তোমার মায়ার নিজেকে এতটা জড়িয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই মায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবোনা। প্লিজ কখনও ছেড়ে যেওনা আমায়।”
আমি ওর বুকে মুখ গুজে রেখেই বললাম,
— ” এসব কথা কেন বলছো। আমি কেন তোমাকে ছেড়ে যাবো। আর তাছাড়া আমার সবটা জুড়েই তো শুধু তুমি আছো। তোমাকে ছেড়ে যাবোটা কোথায়?”
— ” আই লাভ ইউ।”
— ” আই লাভ ইউ টু।”
ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল আর আমিও ওর বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। আর নিজের ভারাক্রান্ত মনটাকে ভালো করার চেষ্টা করছি।
শাওয়ার নিয়ে দুজনে ফ্রেশ হয়ে ইফাজ ভাইয়াদের কল করে চারজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে নামলাম। ব্রেকফাস্ট এর সময় আজ আপি বা ইফাজ ভাইয়া কেউই আমাদের পঁচাতে আসেনি কারণ কাল এদের দুজনের সজ্জিত রুম দেখেছি আমি। তাই কিছু বলতে আসলে যে ওদের লেগ পুল করতেও যে আমরা কোন অংশে বাকি রাখবোনা সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে ঠিক করলাম মিউজিয়াম যাবো। সুইজারল্যান্ড যখন এসেই গেছি এদেশের ইতিহাস, শিল্প সম্পর্কে জানবোনা সেটা কী হয়? তো চারজনেই আমাদের ভাড়া করা গাড়িতে করে গেলাম মিউজিয়াম অফ আর্ট এন্ড হিস্ট্রি তে। আদ্রিয়ান আর ইফাজ ভাইয়া বলল এই মিউজিয়াম টা নাকি ওখানকার সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম। ভেতরে গিয়ে আমি বেশ অবাক হলাম এখানে আঠারো উনিশ দশকের সুইজারল্যান্ডের যেসব স্হাপত্য, ঐতিহাসিক জিনিসপত্র, ঐতিহ্য সবরকমের জিনিস সাজানো আছে। ঐসময়ের মানুষের জীবণযাপনের নমূনা তাছাড়াও বর্তমানের সমস্ত জিনিসপত্রও আছে ওখানে। আর এসব কিছুই কখনও আদ্রিয়ান কখনও ইফাজ ভাইয়া আমাদের দেখাচ্ছে আর এক্সপ্লেইন করছে। প্রায় দু ঘন্টার মত সময় নিয়ে মিউজিয়াম ঘুরে দেখার পর আমরা ওখান থেকে বেড় হলাম। এরপর লাঞ্চ করতে “Manora” তে গেলাম। ওখানে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ পার্কে রেস্ট করলাম এরপর “জেড ডি’ আউ” তে গেলাম। এটা জেনেভার সবচেয়ে বিখ্যাত আর আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। একটা দারুণ জলজেট। জল পাম্প থেকে তীব্র গতিতে জল বয়ে চলেছে। আল কৃত্রিম ঝর্ণাটি এই জেট এর সৌন্দর্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরে গিয়ে আমি আর আদ্রিয়ান, আপি আর ইফাজ ভাইয়া আলাদা আলাদা হয়ে গেলাম। জলে অনেকে সুইমিং কস্টিউম পরে সাতার কাটছে মজা করছে। আমি আর আদ্রিয়ান পাশাপাপাশি হাটছি আর চারপাশটা দেখছি। জলের কলকল আওয়াজটা ভীষণ ভালো লাগছে। সত্যিই এই জল জেট টা ভীষণই সুন্দর। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান বলল,
— ” ভালো লাগছে?”
— ” খুব। কী সুন্দর ঝর্ণা টা। আর পাম্প থেকেও ঐ পানিগুলো কী সুন্দর লাগছে। কতো তীব্র গতিতে ছুটছে।”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” হ্যাঁ এই জেটের প্রধান আকর্ষণই হলো এই ঝর্না। এটা প্রতি সেকেন্ড প্রায় ৫০০ লিটার পানি ১৪০ মিটার উচ্চতায় বেড় হয়ে আসে পাম্প থেকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ” এত স্পিডে?”
— ” হ্যাঁ।”
— ” এইজন্যই এতো সুন্দর লাগছে দেখতে।”
কিছুক্ষণ হাটার পর খেয়াল করলাম যে পুলে এনজয় করতে থাকা কয়েকজন মেয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার সুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। একটা গ্রে রং এর টিশার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, টিশার্টে ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাস, কপালে পরে থাকা সিল্কি চুল, সবমিলিয়ে দুর্দান্ত দেখাচ্ছে একে। কিন্তু প্রতিবারের মত এবার আমি মুগ্ধ হচ্ছিনা একদমি হচ্ছিনা, বরং বিরক্ত হচ্ছি। কে বলেছিল হ্যাঁ এতো সুন্দর হতে। দেশের মেয়েরা হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকত তো থাকতো এখন এখন এসব ফরেন কান্ট্রির সাদা চামড়ার মেয়েরাও দেখবে আমার কিউট জামাইটাকে? আমি আদ্রিয়ানের হাত জড়িয়ে ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভ্যাংচি দিয়ে দিলাম। মেয়েগুলো একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হয়তো আমার আচরণে। আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি হকচিয়ে গিয়ে বললাম,
— ” ক্ কী হয়েছে?”
— ” এটা কী ছিল?”
— ” ক্ কই কী ছিল?”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে আমাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ” আমার জানপাখির তাহলে জেলাস ফিলও হয়?”
আমি মুখ ফুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” একদম কথা বলবেনা সব দোষ তোমার।”
ও অবাক হয়ে বলল,
— ” আমি কী করলাম? ওরা তাকায় তাতে আমি কী করব?”
আমি ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বললাম,
— ” কী করবে মানে? এতো স্টাইল করে, পোজ নিয়ে, ফুট বাবু হয়ে ঘোরো কেন হ্যাঁ? সবাইকে দেখাতে? ‘ লুক লুক আমি কতো হ্যান্ডসাম?’ ”
আদ্রিয়ান নিঁচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু হেসে বলল,
— ” বুঝলাম।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” কী বুঝেছো হ্যাঁ?”
— ” আমার বউ আমায় নিয়ে খুব ইনসিকিওর ফিল করছে।”
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম,
— ” বয়ে গেছে আমার।”
— ” তাই? তাহলে আমি গেলাম ওদের কাছে? দেখো কীভাবে তাকিয়ে আছে? এমনিতেও অনেকদিন যাবত সাতার কাটা হয়না।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— ” খুব শখ না সাতার কাটার?”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” হ্যাঁ তো। সাথে যদি এরকম সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা থাকে তাহলে…”
আমি সাথে সাথেই ওকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিলাম। ও হাবুডুবু খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মেকী হেসে বললাম,
— ” নাও এবার মনের মতো সাঁতার কাটো তোমার ঐ সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের সাথে।”
বলে হনহনে পায়ে ওখান থেকে এগিয়ে চললাম। আমার সামনে অন্য মেয়েদের সুন্দরী বলার সাহস কীকরে হয় ওর? কথাই বলবোনা। কিন্তু একা রেখে যাবো ওখানে ওকে? ওখানে তো আবার ঐ পেত্নী গুলা আছে। দূর। ভাল্লাগেনা।
#চলবে…
( দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত। জানি ছোট হয়েছে। আসলে জ্বর ঠান্ডা বাইরে দিয়ে না হলেও ওরকমি লাগছে। লিখতে পারছিলাম না। তবুও এটুকু দিলাম। কাল বড় করে দেবো। পাক্কা।
আর লেট করে বললাম হ্যাপি নিউ ইয়ার সবাইকে।)