ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৫১
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
পুরো বাড়ি ফাঁকা, তারওপর রূপকে দরজা বন্ধ করতে দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলো। কী করতে চাইছে কী ও? আর হঠাৎ করে এভাবে টেনে রুমে এনে দরজা বন্ধ করার মানে কী? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু ভেতরে জমে থাকা ভয়টাকে প্রকাশ না করে আমি রেগে বললাম,
— ” এটা কেমন অসভ্যতা মিঃ রূপ।”
রূপ খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
— ” আই এম রিয়েলি সরি। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনতেই চাইছিলেনা আর আমার বলাটা ভীষণ জরুরি ছিল তাই।”
– ” তাই আপনি এরকম অসভ্যতামো করবেন?”
রূপ একটু অধৈর্য হয়ে বলল,
— ” আ’ম সরি। কিন্তু আমার আর কোন উপায়ই ছিল না। তুমি কোনমতেই আমার কথা শুনতে চাইছিলে না।”
— ” আপনাকে কে বলল যে আমি এখন শুনবো? দেখুন আপনি রিকোয়েস্ট করেছেন তাই আমি আদ্রিয়ানকে এখনও কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আপনি আপনার লিমিট ক্রস করলে আমি আদ্রিয়ানকে সবটা বলে দিতে বাধ্য হব।”
রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে আমি গিয়ে দরজা খুলতে গেলেই রূপ এসে আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি এবার বেশ রেগে গিয়ে ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,
— ” আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন এবার। আমারই বাড়িতে আমার সাথে অসভ্যতামো করছেন।”
রূপ একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,
— ” প্লিজ আমার কথাটা একটু শুনে দেখো। জাস্ট দশ মিনিট নেবো আমি। আমার কথাটা শোনা তোমার দরকার ট্রায় টু আন্ডারস্টান।”
আমিও এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” আমিও তো আপনাকে বলেছি যা বলার আদ্রিয়ানকে বলুন। কিন্তু আপনি তো… আপনার কোন ধারণা আছে যদি আদ্রিয়ান এসব জানতে পারে তাহলে আপনার সাথে কী করবে?”
রূপ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— ” কী আর করবে? আমাকেও মেরে ফেলবে।”
আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
— ” আপনার কী আমার হাজবেন্ডকে খুনী মনে হচ্ছে যে আপনাকে মেরে ফেলবে?”
রূপ একই ভঙ্গিতে বলল,
— ” যে নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে নিজ দায়িত্বে ওরকম নৃশংসভাবে খুন করেছে। তার কাছে আমাকে খুন করা কোন ব্যাপার না।”
আমি চমকে তাকালাম রূপের দিকে। ওর কথাটা মাথায় ঢুকতে কয়েক সেকেন্ড লাগল আমার। আমি কাঁপা গলায় বলল,
— ” ক্ কী।”
— ” হ্যাঁ, ইশরাক কে আর কেউ না আদ্রিয়ান নিজে খুন করেছে।”
আমি বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে।রাগে শরীর কাঁপছে, ইচ্ছে করছে রূপটা সর্বশক্তি দিয়ে একটা অন্তত চড় মারি। লোকটা ভাবল কীকরে যে আদ্রিয়ান ও যা বলবে আমি তাই বিশ্বাস করে নেবো? নিজেকে সামলে নিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আমি বললাম,
— ” আপনার কী মনে হচ্ছেনা আপনার জোকস ওভারলোডেট হয়ে যাচ্ছে? আদ্রিয়ান? মার্ডার করেছে? আপনি জানেন একদিন রাস্তায় ওর গাড়ির সামনে একটা কুকুর চলে এসছিলো, ও জানতো গাড়িটা টার্ন করলে ওটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগবে আর ওর সাথে মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে তবুও কুকুরটাকে বাঁচাতে গাড়িটা টার্ন করেছিল, মারাত্মক কিছু না হলেও কিন্তু ছোট্ট ইঞ্জুরি হয়েছিল, ভয়ংকর কিছুও হতে পারত। আর আপনি বলছেন সেই মানুষটা খুন করেছে? তাও কাকে? ইশরাক ভাইয়াকে? মানে সিরিয়াসলি?
রূপ চোখ সরিয়ে আফসোসের একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” সবসময় চোখে যেটা দেখা যায় সেটা সত্যি হয়না অনিমা। তুমি ওকে যেভাবে চেনো, বা ওকে যেরকম মনে কর ও একদম সেরকম নয়। ওর ভেতরেও একটা ভয়ংকর নৃশংস মানুষ আছে। যে প্রয়োজনে সব করতে পারে। এমনকি নিজের বন্ধুকে নির্মমভাবে খুন করতে পারে।”
আমি এবার একটু চেঁচিয়ে বললাম,
— ” কিন্তু ও নিজের বন্ধুকে কেন মারবে? যাকে ও এতো ভালোবাসে?”
— ” কারণ আদ্রিয়ান শুধু একজন ইঞ্জিনিয়ার বা সাইন্টিস্ট নয় ও একজন টেরোরিস্ট। ইয়েস, হি ইজ আ টেরোরিস্ট। যার কাজ নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য নিরীহ মানুষের প্রাণ নেওয়া। কারো প্রতি দয়া নেই ওর। কাউকে ছাড়েনা ওরা, কাউকে না। অনেক নিরিহ মানুষকে মেরেছে। আর এই সত্যিটাই ও ইশরাক জেনে ফেলেছিল তাই ইশরাক কেও মেরেছে, আর সেদিন তোমাকেও তিন তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।”
আমি স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রূপের দিকে। এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর নিজেকে সঞ্জত রাখতে পারলাম না, কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে দিলাম রূপকে। রাগান্বিত কন্ঠে বললাম,
— ” ইনাফ হ্যাঁ? আর একটাও কথা না। আমার স্বামী সম্পর্কে এত জঘন্যতম কথা বলার সাহসটা কে দিল আপনাকে? আপনাকে এ বাড়ি থেকে বেড় করার কথা আমি আজই বলছি বাবাকে।”
— ” আমি যা বলছি সব সত্যি বলছি।”
— ” সবটাই মিথ্যে বলছেন আপনি।”
বলে চলে যেতে নিলেই রূপ বলে উঠল,
— ” আর দু-বছর আগেও যা হয়েছিল সেটা?”
আমি থমকে গেলাম। আমি অবাক হয়ে রূপের দিকে তাকাতেই ও একটু হেসে বলল,
— ” দু-বছর আগে ঐ জঙ্গলে যেটা হয়েছে সেটাও মিথ্যে?”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রূপের দিকে তাকাতেই রূপ বলল,
— ” হ্যাঁ জানি। যদিও ঐদিন ওখানে আদ্রিয়ান ছিলো কী না আমার জানা নেই। কিন্তু সেটাও কী মিথ্যে? নবীণ বরণের দিন তোমার ওপর অ্যাটাক হওয়ার পরেও আদ্রিয়ানের এরকম শান্ত থাকাটা মিথ্যে? তোমাকে মারার চেষ্টা করা হলো তারপরেও তোমার কাছে জিজ্ঞেস না করেই আদ্রিয়ানের এটাকে এক্সিডেন্ট বলাটা মিথ্যে? এত বড় বড় ঘটনাগুলোকেও স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সবটা নরমাল? তোমার মনে প্রশ্ন জাগেনা যে কেন আদ্রিয়ানের ল্যাপটপে কাউকে হাত দিতে দেয়না? ইভেন তোমাকেও? কেনো ওর ল্যাবে সহজে কাউকে যেতে দেয়না? আর গেলেও সিকরেট রুমটাতে কাউকে ঢুকতে দেয়না?”
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ওনার থেকে। এসব প্রশ্ন যে কখনও আমার মনেও আসেনি তা কিন্তু না। আজ রূপও বলল। সত্যিই এগুলো নরমাল। রূপ বলল,
— ” কী হলো বল?”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— ” ও যাই করেছে তার পেছনে নিশ্চয়ই ক্ কোন কারণ ছিল। আর এ্ এগুলো তো প্রমাণ করেনা যে ও টেরোরিস্ট, তাইনা? আর ইফাজ ভাইয়ার মার্ডারের কথা বলছেন? ইশরাক ভাইয়া যেদিন মারা গেছিলেন সেদিন আদ্রিয়ান আমাদের সাথেই ছিল। তাহলে কীকরে মারল?”
রূপ আবারও ব্যঙ্গ করে হেসে বলল,
— ” উমহুম, সারাদিন নয়। সকালে বেশ অনেকটা সময় ও গায়েব ছিল তাইতো?”
আমার মনে পরল ও সেদিন সকালে প্রায় তিন ঘন্টার মত কাউকে কিছু না বলেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমি রুপের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত গলায় বললাম,
— ” ওর কাজ ছিল তাই গিয়েছিল। অনুষ্ঠান বাড়িতে অনেকরকমের কাজ থাকে। অনেক কিছু বাজার করে আনতে হয়েছিল ওকে। আর তাছাড়াও ইশরাক ভাইয়া মারা যাওয়ার পর আদ্রিয়ানের অবস্থা দেখেছি আমি। চার চারটা মাস নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সবার থেকে, অনুভূতিহীন, বদমেজাজি, রুড একজন মানুষ হয়ে গেছিল। অনেক কষ্টে ওনাকে স্বাভাবিক করেছি আমরা। এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল লোকটা, আর আপনি এসব বলছেন। আর আমাকে মারার চেষ্টা করবে ও? ও কী বলে জানেন? আমি ওর প্রাণভোমরা। আর তার প্রমাণ ও আমার হসপিটালে ভর্তি থাকার দিনগুলো দিয়েছে। নিজের হাতে নিজেরই প্রাণ ভ্রোমরাকে শেষ করতে পারে কেউ? ”
রূপ আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বলল,
— ” তোমাকে আগেও বলেছি আমি কখনও অন্ধ বিশ্বাস করোনা। হ্যাঁ ইশরাককে মার্ডার করে ও কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ও বাধ্য হয়েই ইশরাককে মেরেছে। ওর কাছে ওর কাজটাই সবার আগে। তারজন্যে ও সব করতে পারে। তোমাকে জানানোটা দরকার ছিল তাই জানিয়েছি। আমার কথা বিশ্বাস করো সেটা বলছিনা তোমায়? কিন্তু এটলিস্ট নিজের বুদ্ধি দিয়ে তো ভাবো? তুমি চাইলেই সব প্রমাণ পেতে পারো। ওর ল্যাবে, ওর ল্যাপটপে হয়ত এমন অনেক কিছু পেতে পারো যাতে তোমার সবটা বিশ্বাস হয়ে যাবে।”
আমার মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,
— ” তার দরকার নেই, আমি ব্ বিশ্বাস করিনা এসব।”
— ” আমিতো বলছিনা যে আমাকে বিশ্বাস কর? শুধু এটুকুই বলছি নিজে একবার যাচাই করো?”
আমি কিছু বলতে পারছিনা। এত কনফিডেন্টলি কীকরে বলছে ও? তাহলে কী আদ্রিয়ান সত্যিই… ন্ না না, ও এরকম কক্ষনো করতে পারেনা। রূপ বলল,
— ” তবে সবকিছুর মধ্যে একটা কথা সত্যি। ও তোমাকে সত্যি ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। ওর সারা দুনিয়া একদিকে আর তুমি একদিকে। হ্যাঁ সত্যিই তুমি ওর প্রাণভোমরা। কিন্তু সেদিন কেন ও তোমাকে তিনতলা থেকে ধাক্কা দিয়েছিল আমি জানিনা। কিন্তু ওই দিয়েছিল। কারণ আপাতত তোমাকে মারার তো কোন কারণ নেই আর ও চাইলেও তোমাকে মারতে পারবেনা হয়তো। তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে যে আমি এতকিছু কীকরে জানি? আর তোমাকে কেন বলছি? আমার স্বার্থ কী? সেটা বলতে পারবোনা আমি তোমাকে। এটা শুনে হয়ত তুমি বিশ্বাস করবেনা আমায় কিন্তু আমি বলিনি আমায় বিশ্বাস করতে নিজেই প্রমাণ খোঁজ।”
আমি জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
— ” প্রমাণ?”
— ” তুমি সবসময় ওর সাথেই থাকো। ওর ল্যাপটপের সব ইনফরমেশন ডেফিনেটলি ওর পেনড্রাইভে থাকবে। তুমি সেটা কালেক্ট করে দেখে দিতে পারো। আর যে করেই হোক তোমাকে ওর ল্যাবের সিকরেট সেই রুমে যেতে হবে। সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তোমার কাছে।”
আমার মাথা কাজ করছেনা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আসলে কী করা উচিত আমার সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। রূপ বলল,
— ” আর হ্যাঁ আদ্রিয়ান যদি জানতে পারে ও কী সেটা আমি জানি তাহলে ও আমাকেও মেরে ফেলবে। এটা ঠিক যে তুমি ওর কাছে অনেক বড় কিছু কিন্তু ওর কাজটা ওর কাছে আরও বড়। আর নিজের সেই কাজের জন্য ও ওর নিজের প্রাণ আর প্রাণভোমরা দুটোই শেষ করে দিতে পারে। তাই যা করবে সাবধানে। একবার যদি ও জেনে যায় এসব ও তোমাকে মারতেও দু-বার ভাববেনা। তোমাকে মেরে হয়তো নিজেও মরে যাবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেবেনা। এতোটাই ভয়ঙ্কর ও। তাই আবেগে পরে নিজের আর তোমার পরিবারের ক্ষতি করোনা। আমি তোমাদের সকলের ভালো চাআ আদ্রিয়ানেরও। তাই তোমাকে বলছি। একমাত্র তুমিই পারবে ওকে সঠিক পথে আনতে। যেকোন ভয়ংকর বিপদে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই ওকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে।”
আমি ভাবছি সঠিক পথ? ধরে নেই যদি রূপের কথা সত্যি হয় তাহলে আদ্রিয়ানেয সঠিক পথে আনার প্রশ্নেই ওঠেনা। এগুলো সত্যি হলে ও কেবল একটা জিনিসেরই যোগ্য সেটা হল শাস্তি। ভয়ংকর শাস্তি। আর যাই হোক না কেন কোন খুনিকে ক্ষমা করা যায়না। কিন্তু এসব সত্যি হতে পারে? আমার মন কিছুইতেই মানতে রাজি নয়। কিছুইতেই না। রূপ চলে যেতে নিয়ে বলল,
— ” আর হ্যাঁ। আদ্রিয়ান মানুষ নৃশংস, ভয়ংকর, খুনি যাই হোক। ও কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে। অতিরিক্ত বেশিই ভালোবাসে। ওর সব মিথ্যের মধ্যে যদি একটা সত্যি থাকে সেটা হলো তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা। শুধু ও যেটা করছে সেটা ভয়ানক অন্যায়। আমার যা বলার বলে দিয়েছি আমি। বাকিটা তোমার হাতে। কিন্তু খুব সাবধান। ও কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। এতোটাই যে তুমি ভাবতেও পারছোনা। ”
বলে রূপ দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। আর আমি ধীর পায়ে আস্তে আস্তে নিজের রুমে গিয়ে বেডে বসে পরলাম। সবটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রূপের বলা প্রতিটা কথা কানে বাজছে। ওর কথাগুলো সব একেবারেই ফেলে দেওয়ার মত নয়। আজ আদ্রিয়ানের সব অস্বাভাবিক ব্যবহারগুলো চোখে ভাসছে। আমার সাথে পরপর এতোগুলো অ্যাটাককে ইগনোর করা, ল্যাপটপে হাত দেওয়ায় ওভাবে কথা বলা, ওর ল্যাবে যেতে না দেওয়া, আর যেদি গেলাম সেদিন এক জায়গায় বসিয়ে রাখা। উফ, কী হচ্ছে এসব? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কিচ্ছু মেলাতে পারছিনা আমি। কিচ্ছু না। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে।
#চলবে…