ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৬০
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
গভীর রাত। মিষ্টি ঘুমিয়ে পরেছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ান আর মাঝে মাঝে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। কিছুক্ষণ গম্ভীর অন্ধকার বিলাশ করে রুমে চলে এলো ও। মিষ্টিকে ঘুমন্ত মুখটা দেখে মুচকি হাসলো। কিছু একটা ভেবে কাবার্ড খুলে কাবার্ড থেকে একটা প্যাকেট বের করল। প্যাকেটা নিয়ে খাটে এসে বসল। প্যাকেটটা খুলে সেটার মধ্যে থেকে একটা কার্ড আর একটা লকেট বেড় করল। লকেটটা অনিমারই আর কার্ডটাও অনিমার দেওয়া সেই কার্ড। অনিমা বলেছিল, “যখন আমি থাকবোনা তখন এটা পরো।” আদ্রিয়ান লকেটটাতে কিছুক্ষণ হাত বুলালো। কার্ডটা খুলল। কার্ডে লেখা আছে,
” এইচিঠিতে আপনি করেই বলছি আমি। জানেন বিয়ের প্রথম দিকে আপনার ওপর রাগ হত যে এমন খবিশ মার্কা লোক আমারই হাজবেন্ড কেন? কিন্তু ধীরে ধীরৈ আপনার সেই খবিশ মার্কা ব্যাবহারগুলোই আমার চরম ভালোলাগায় পরিণত হল। প্রেমনামক অনুভূতি ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল আমায়। একপর্যায়ে আপনার সেই ভালোবাসার পাগলামোর রোগ আমাকেও পাগল করে দিলো। ভালোবেসে ফেললাম আপনাকে। আমি আপনাকে আপনার মত করে ভালোবাসতে না পারলেও নিজের মত করে ভালোবাসি। আমি থাকি বা না থাকি। আমার ভালোবাসা সবসময় আপনার সাথে থাকবে, আমার স্মৃতি আপনার সাথে থাকবে। ভালোবাসি আপনাকে। খুব বেশি ভালোবাসি।”
চিঠিটা পড়ে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো আদ্রিয়ান। ওগুলোকে যত্নসহকারে কাবার্ডে রেখে এসে মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরল।
_________________
পরেরদিন বিকেলে আদ্রিয়ান, মিষ্টি, জাবিন, অভ্র মিলে আবার গেল সেই আশ্রমে। জাবিন আর অভ্র বিয়ে হয়েছে একবছর হয়ে গেছে। পার্কে যেতেই আদ্রিয়ান দেখল অদ্রিজা দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রিজা কাল রাত থেকে শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। বারবার মনে খচখচ করে গেছে কী হয়েছিল এরপর? অনিমা কোথায়? এসব প্রশ্ন আর অস্হিরতা ওকে শান্তি দিচ্ছে না। ওরা যেতেই মিষ্টি দৌড়ে অদ্রিজার কাছে গেল। অদ্রিজা মিষ্টিকে কোলে তুলে আদর করল কিছুক্ষণ। তারপর আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান বুঝে গেল অদ্রিজা কী চাইছে। আদ্রিয়ান অভ্র আর জাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তোমরা মিষ্টিকে নিয়ে বাচ্চাদের কাছে যাও আমি আসছি।”
ওরা তাই করল। আদ্রিয়ান অদ্রিজাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। আদ্রিয়ান বলল,
— ” এরপল কী হয়েছিল জানতে চাইছ তো?”
অদ্রিজা দ্রুত মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,
— ” তোমার কৌতূহল খুব বেশি তাই বলছি। এর আগে কাউকে বলিনি সেই ভয়ংকর দিনটার কথা। তোমাকেই প্রথম বলছি।”
অদ্রিজা কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে আছে, অস্হির হয়ে উঠছে শুনবে বলে। আদ্রিয়ান ওকে বলতে শুরু করল সেদিনের কথা আর ফিরে গেল তিনবছর আগে-
_________________
সেদিন রাতে ডায়েরিটা লেখার পর হঠাৎ করেই অনিমার পেইন শুরু হয় যা ধীরে ধীরে বাড়তে । যেহেতু ও নিজেও একজন উড বি ডক্টর তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে যায় যে ওর যে প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। ব্যাথাটা ধীরে ধীরে এতটাই তীব্র হতে থাকে যে ও মৃদু চিৎকার করে ওঠে। অনিমার চিৎকার শুনে আদ্রিয়ান ধরধরিয়ে উঠে বসল। পাশে অনিমাকে না পেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে টেবিলে অনিমা পেট চেপে ধরে ফোঁপাচ্ছে। আদ্রিয়ান উঠে অনিমার সামনে হাটু ভেঙে বসে বলল,
— ” ক-কী হয়েছে অনি? কষ্ট হচ্ছে?”
অনিমা ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করেই অস্ফুট স্বরে বলল,
— ” সময় হয়ে গেছে।”
মুহুর্তেই আদ্রিয়ান যেন থমকে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অনিমা আবার চিৎকার করতেই আদ্রিয়ানের হুস এলো। ওর ইতিমধ্যে ঘাম বেড়িয়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে ফোনটা বেড় করে ইফাজকে ফোন করে সবটা বলল। ফোন রেখে আদ্রিয়ান অনিমার গালে হাত রেখে বলল,
— ” কিচ্ছু হবেনা। আরেকটু সহ্য কর। ভাইয়া গাড়ি বেড় করতে গেছে।”
বলে অনিমাকে কোলে তুলে নিল। এই মুহূর্তে অনিমার শরীর বেশ ভারী, আদ্রিয়ানের মত মানুষের পক্ষেও ক্যারি করাটা খুব মুসকিলের। তবুও অনেক কষ্টে ওকে কোলে নিয়ে বাইরে হাটা দিলো। এরমধ্যেই হিয়া জাবিনরা চলে এসছে। আদ্রিয়ান অনিকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে এলো। ইফাজ সামনে বসল আর হিয়া ফ্রন্টসিটে। আদ্রিয়ান আর জাবিন অনিকে নিয়ে ব্যাক সিটে বসল। অনিমার ব্যাথা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ও ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করছে আর আদ্রিয়ানকে খামচে ধরে বসে আছ মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে। আর অনিমার এই কষ্ট আদ্রিয়ানের সহ্য হচ্ছে না। জাবিন বারবার হাতের তালু ঘষে দিচ্ছ আর অনিমার গাল হালকা করে চাপড়ে দিচ্ছে। আদ্রিয়ান বারবার ইফাজকে তাড়া দিচ্ছে। ইফাজও সমস্ত সিগন্যাল ব্রেক করে চলে যাচ্ছে। অনিমা তো চোখ মুখ খিচে একটু পরপর ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠছে। আদ্রিয়ানের চোখ মুখ অলরেডি ছলছল করে উঠছে।
হসপিটালে পৌছনোর সাথে সাথেই অনিমাকে নেওয়ার সাথেসাথেই ওটিতে ঢোকানো হলো। কারণ ইফাজ আগেই ফোন করে হসপিটালে সব রেডি করে রাখতে বলেছে। অনিকে একা ওটিতে যেতে দিতে চাইছিল না আদ্রিয়ান ওরা সবাই মিলে ধরে রেখে সামলে নিয়েছে। ইফাজও রেডি হয়ে ওটিতে ঢুকলো। যদিও ও গাইনোলজিস্ট না বাট ডক্টর তো তাই ওটিতে থাকার পার্মিশন আছে ওর আর বাড়ির একজন ভেতর থাকলে সবার মনে একটু হলেও স্বস্তি থাকবে। যাওয়ার আগে আদ্রিয়ানকে শান্তনা দিয়ে গেল এটা বলে যে, অনির কিচ্ছু হবেনা’। ওটির লাইট ওন হওয়ার সাথে সাথেই সবার মধ্যেই টেনশন শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানিক আবরার রা সবাই চলে এলেন। আদ্রিয়ান বেঞ্চে বসে দুহাতে মুখ চেপে ধরে বসে আছে, ওর ভেতরে কী চলছে ঐ জানে। বাকি সবাই খুব চিন্তায় আছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে অনিমার বাবা মায়েরাও চলে এলো। ওটির ভেতর থেকে এখনও কোন খবর আসেনি। যত সময় যাচ্ছে আদ্রিয়ানের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে, যেন এখনই কেঁদে দেবে। ভেতরে ওর জানপাখি কতটা কষ্ট পাচ্ছে সেটা ভেবেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর। বাকিরাও এদিক ওদিক পাইচারি করছে আর ঘরি দেখছে। দীর্ঘ দুইঘন্টা পর ওটির লাইট অফ হলো। আদ্রিয়ান উঠে একপ্রকার দৌড়ে ওটির সামনে গেল। ইফাজই সবার আগে বেড়িয়ে এলো আদ্রিয়ান বলল,
— ” ভ্ ভাইয়া জা.. অনি কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?”
এরমধ্যেই ডক্টরও বেড়িয়ে এলো। আর সবার টেনশন দূর করে দিয়ে ডক্টর জানালো যে অনিমার একটা মেয়েবাবু হয়েছে আর মা-বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স কোলে করে তোয়ালে পেঁচানো একটা ফুটফুটে বেবী নিয়ে এসে আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিল। আদ্রিয়ান কাঁপাকাঁপা হাতে নিজের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দুফোটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। এতক্ষণ চেপে রাখা কষ্ট, আবেগ, ভয় সব একসাথে প্রকাশ পেয়ে গেল। এটা ওর মেয়ে, ওর অংশ। ও নিজের সাথে আলতো করে জড়িয়ে চুমু দিলো বেবিকে। এরপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
— ” অনি..”
ইফাজ মুচকি হেসে বলল,
— ” চিন্তা করিস না। ক্লান্ত ছিল, এখন ঘুমোচ্ছে। কেবিনে দিলেই ওর কাছে যেতে পারবি।”
সবাই আস্তে আস্তে বেবীকে দেখে নার্সের হাতে দিলো। নার্স বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল ভেতরে। সবার ভেতরেই এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। বাড়ির সবচেয়ে ভালোবাসার দুজন মানুষের ঘর আলো করে আরেকটা ভালোবাসার মানুষ এলো। এতক্ষণ সবাই টেনশনে থাকলেও এখন সবাই ভীষণ খুশি।
অনিমার ঘুম ভাঙতেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ সবটা মনে পাশে তাকিয়ে আদ্রিয়ানকে দেখে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে বলল,
— ” চিন্তা করোনা। আমাদের বেবি একদম ঠিক আছে।”
আদ্রিয়ান পাশে রাখা দোলনা থেকে বেবীকে কোলে নিয়ে অনিমার পাশে শুইয়ে দিলো। অনিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। এটা ওর সন্তান? দীর্ঘ এই ন-মাস নিজের গর্ভে ধারণ করেছে ওকে? ওর অস্তিত্বের অংশ ওর পাশে এত সুন্দর কচিকচি হাতপা দুলিয়ে এদিক ওদিক দেখছে? এটা ওর মেয়ে? আদ্রিয়ানের দিকে অশ্রুভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই আদ্রিয়ান চোখের ইশারায় বলল ‘হ্যাঁ এটাই’ এটাই আমাদের মেয়ে। অনিমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। ও কাঁপাকাঁপা হাতে আলতো হাতে ওর মেয়েকে ছুঁয়ে দিলো। ওর মেয়েও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীরভাবে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
— ” থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ সো মাচ। এতো কষ্ট সহ্য করেও আমাদের সন্তানকে জন্ম দেওয়ার জন্যে। আমাদের অস্তিত্বকে জন্ম দেওয়ার জন্যে।”
অনিমা আদ্রিয়ানের গালে হাত রেখে বলল,
— ” তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ আমাকে মা হওয়ার সুখ দেওয়ার জন্যে। ভালোবাসি।”
— ” খুব বেশি ভালোবাসি।”
হঠাৎই ওদের বেবী মৃদু আওয়াজ করে উঠল। আদ্রিয়ান আর অনিমা দুজনেই তাকাল। এরপর একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। আদ্রিয়ান ওর দু আঙ্গুল দিয়ে বেবীর গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ শোনা আমরা তোমাকেও খুব ভালোবাসি।”
পরেরদিনের সারাটাদিনই অনেক আনন্দে কেটেছে সবার। যেহেতু অনিমা নরমাল ডেলিভারী হয়েছে তার তেমন কোন কম্প্লিকেশন ছিলোনা তাই আজই চলে যেতে পারত কিন্তু ইফাজ বলল যে আরেকটা দিন হসপিটালে ডক্টরদের অবসারবেশনে থাকাই বেটার হবে। তাই আরেকটা দিন হসপিটালে থাকবে। জাবিন বেবীর হাতপা গুলো নাড়তে নাড়তে বলল,
— ” কী কিউট হয়েছে আমার মাম্মাটা দেখতে। একদম ভাইয়ার মত হয়েছে, না ভাবীর মতও হয়েছে। দূর! আমি কনফিউসড হয়ে যাচ্ছি কার মত হয়েছে!”
অভ্র বলল,
— ” আরে গাধি এখনও কিছুই বোঝা যাবেনা কার মত হয়েছে। আরেকটু বড় হতে দাও তারপর বলো।”
জাবিন মুখ ফুলিয়ে ওর আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” দেখ ভাইয়া তোর সামনে আমাকে গাধি বলল।”
আদ্রিয়ান অভ্র দিকে তাকাতেই অভ্র একটু দমে গেলো। আদ্রিয়ান ভ্রু বাঁকিয়ে জাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তো? গাধিকে তো গাধিই বলবে না।”
অভ্র যেনো দারুণ মজা আর স্বস্তি দুটোই পেল আর জাবিন মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল। এরকমি নানারকম দুষ্টুমি খুনশটি আনন্দে দিন পার হয়ে গেল। দুই বাড়ির সকলেই ছিল হসপিটালে সারাদিন। রাতে শুধু আদ্রিয়ানই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। যেহুতু অনিমা টোটালি সুস্হ আর বেবীও তাই একজনের বেশি থাকার দরকার নেই। তবুও হিয়া থাকতে চেয়েছিল হিয়াজ ছোট তাই আদ্রিয়ান বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।
বেশ রাত হয়েছে বেবী কান্না করছিল তাই অনিমি ওকে ফিডিং করাচ্ছে। আদ্রিয়ান গালে হাত দিয়ে দেখছে নিজের দুই শ্রেষ্ঠ সুখকে। বাবু ঘুমিয়ে পরতেই অনিমা আস্তে করে ধরে শুইয়ে দিলো ওকে। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— ” কী দেখছো?”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” কাল অবধি যে মেয়েটা নিজেই বাচ্চা ছিল। যাকে আমায় সামলাতে হতো। আজ সে নিজেই একটা বাচ্চা সামলাচ্ছে। একদিনেই কেমন মা হয়ে উঠেছে।”
অনিমা মুচকি হাসলো। আদ্রিয়ান উঠে এসে বেবীর ঘুমন্ত মুখে আলতো করে একটা চুমু দিলো। তারপর অনিমার পাশে বসে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। অনিমাও আদ্রিয়ানের বুকে গুটিয়ে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণের নিরবতার পর আদ্রিয়ান বলল,
— ” এতোদিন একটা ভয় কাজ করত। আমার সন্তানের জন্ম নেওয়া, ওকে কোলে দেওয়া, ওর এই কচি হাত-পা দিয়ে এই খেলা করা, এই হাসি, এই কান্না দেখতে পাবো কী না। কিন্তু আমার ভাগ্যটা এতটাও খারাপ হয়নি।”
অনিমা আদ্রিয়ানের মিশে থেকেই বলল,
— ” সব ঠিক থাকবে তো?”
— ” অবশ্যই থাকবে! আমি আছি তো তোমার সাথে। আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দেব না।”
অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো মনের ভেতরের খচখচানি টা কিছুতেই কমছেনা। কিছু একটা ভেবে অনিম আদ্রিয়ানকে বলল,
— ” আচ্ছা তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?”
আদ্রিয়ান আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— ” ভয় হচ্ছিল। তোমার একেকটা চিৎকার আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। পারছিলাম না সহ্য করতে। কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাতে পারব না আমি। পারবোনা।”
— ” আমিও..”
অনিমা কথাটা শেষ করার আগেই গোটা হসপিটাল জুড়ে হৈচৈ শুরু করে গেল। আদ্রিয়ান আর অনিমা দুজনেই ভ্রু কুচকে তাকালো চারপাশে। অনিমা বলল,
— ” কী হয়েছে বলোতো?”
আদ্রিয়ান বলল,
— ” তুমি বসো আমি দেখছি।”
আদ্রিয়ান বাইরে গেল দেখতে। অনিমা টেনশনে পরে গেছে হঠাৎ এতো আওয়াজ কীসের? কী হয়েছে? বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান একপ্রকার দৌড়ে এসে হাফানো কন্ঠে বলল,
— ” অনি তাড়াতাড়ি ওঠো। হসপিটালে টেরোরিস্টরা বম রেখেছে। তোমাকে আর বেবীকে বের করে নিতে হবে আগে।”
অনিমা হতভম্বভাবে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে ওর। আদ্রিয়ানকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা টেনশনে আছে। আদ্রিয়ান একহাতে বেবীকে কোলে নিয়ে আরেক হাতে অনির হাত ধরে বলল,
— ” তাড়াতাড়ি চলো। যেকোন মুহূর্তে ব্লাস্ট হবে। তোমাদের বার করে আমায় আবার ভেতরে ঢুকতে হবে সবাইকে বার করতে।”
বলে আদ্রিয়ান অনির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল। মধ্যরাত বরে আহামরি ভীর নেই হসপিটালে। কিন্তু তবুও সবাই চেচামেচি করতে করতে দৌড়ে বেড়োচ্ছে হসপিটাল থেকে সবাই আতঙ্কে আছে। কিছুদূর যেতেই করিডর দিয়ে একটা বাচ্চা আর একটা মহিলার চিৎকার ভেসে এলো। তারা সাহায্যের জন্যে চেচাচ্ছে। অনি আদ্রিয়ান দুজনেই থামল। এপাশের করিডরে কেউ নেই সব বেড়িয়ে গেছে। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” ওনারা বিপদে পরেছে হয়তো। তুমি যাও দেখ। আমি বাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছি।”
আদ্রিয়ান চিন্তিত স্বরে বলল,
— ” কিন্তু..”
— ” আদ্রিয়ান আমরা কাউকে জেনেশুনে বিপদে ফেলে রেখে যেতে পারিনা। আমি বাইরে চলে যাচ্ছি বেবীকে নিয়ে তুমি ওদের গিয়ে বাঁচাও প্লিজ। আর হ্যাঁ তাড়াতাড়ি করবে কিন্তু। আমি টেনশনে থাকবো।”
আদ্রিয়ান মাথা নেড়ে বেবীকে অনির কোলে দিয়ে চলে গেল। অনিমা আদ্রিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস নিল। আদ্রিয়ানকে একা ভেতরে একা রেখে যেতে ওরকতটা যদি বেবীটা না থাকতো তাহলে অনিও থাকত আদ্রিয়ানের সাথে কিন্তু এখন ওদের বাচ্চাটাকেও বাঁচানোও ওর দায়িত্ব। তাই বেবীকে কোলে নিয়ে দ্রুতপদে হেটে বাইরের দিকে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই এইপাশের করিডর ফাঁকা হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই ওর সামনে মাস্ক পরা একটা লোক এসে দাঁড়ালো। অনিমা থমকে দাঁড়ালো। এই মাস্ক, এই পোশাকের সাথে ও খুব পরিচিত ও। ওর সেই অতীত ওর সামনে দেখে ভয়ে নিজের সন্তানকে বুকে জাপটে ধরে কাঁপা গলায় বলল,
— ” কে আপনি?”
মাস্কের আড়ালের লোকটি বলল,
— ” এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে আমাকে?”
বলে মাস্কটা খুলে ফেলল। লোকটার মুখ দেখে অনিমা ভয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেল। কারণ ওর সামনে রূপ দাঁড়িয়ে আছে। অনিমা ভীত দৃষ্টিতে নিজের মেয়ের দিকে তাকালো। এখন ওর বেশি ভয় ওর সন্তানের জন্যেই হচ্ছে। ও দৌড়ে পালাতে নিলেই রূপ ওর হাত ধরে ফেলল। অনিমা ছাড়ানোর জন্যে বেশি জোরাজোরিও করতে পারছেনা কারণ ওর বেবী ওর হাত থেকে পরে যাবে। অনিমা ‘আদ্রিয়ান’ বলে ডাকতে নিলেই রূপ ওর মুখ চেপে ধরল। অনিমা চেষ্টা করেও চিৎকার করে ডাকতে পারছেনা। রুপ একহাতে অনিমার মুখ আরেক হাতে অনিমা হাত ধরে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে যেতে লাগল। বাচ্চাটা কান্না করছে।অনিমার শরীর এমনিতেও ভীষণ দুর্বল আর বাকি শক্তিটুকু শুধু নিজের সন্তানকে আগলে ধরে রাখতে ব্যবহার করছে তাই পারছেনা রূপকে আটকাতে। রূপ অনিমাকে টেনে একেবারে ওপরের ফ্লোরে নিয়ে কর্ণারের একটা রুমে নিয়ে গেল। রুমটাতে কিছুই নেই ফেলনা কিছু ফার্নিচেয়ার, আর অপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ফেলে রেখে দেওয়া হয়েছে। রূপ ভেতরে নিয়ে অনিকে একপ্রকার ছুড়ে মারল। অনিমা কোনরকমে ওর বাচ্চাকে বুকে জাপটে নিয়ে পরে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কান্নাভেজা চোখে তাকাল। রূপ বাঁকা হেসে এগিয়ে এলো অনিমার দিকে মুখে হেসে রেখে বলল,
— ” বলেছিলাম না আবার দেখা হবে আমাদের?”
অনিমা বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে পেছাতে পেছাতে কেঁদে দিয়ে বলল,
— ” রূপ প্লিজ আমায় যেতে দিন। প্লিজ! দেখুন আমার মেয়েটা কাঁদছে। প্লিজ ছেড়ে দিন।”
রূপের মুখে এখনও বাঁকা হাসি ঝুলে আছে। ও এগিয়ে এসে বলল,
— ” এত ভয় পাচ্ছ আমাকে। এই ভয়টা কখন ছিল? যখন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলে। আমায় ঠকিয়েছিলে? তখন মনে হয়নি ওর পরিণাম কী হতে পারে?”
অনিমা পেছাতে পেছাতে একটা বক্সের সাথে আটকে গিয়ে পরে গেল ও কিন্তু বাচ্চাটাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখায় বাচ্চার কিছু হয় নি। রূপ এক হাটু ভেঙ্গে অনিমার সামনে বসল।অনিমা এবার একটু গুটিয়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। ও শুধু ভাবছে কখন আদ্রিয়ান আসবে আর ওকে এই জঘন্যতম লোকটার হাত থেকে বাঁচাবে। অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ রূপ আপনি..”
আর কিছু বলার আগেই রূপ অনিমার কোল থেকে ওর বাচ্চাকে টেনে নিয়ে গেল। বাচ্চাটা জোরে কেঁদে ফেলল। অনিমা এবার শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
— ” রূপ! রূপ! প্লিজ আ-আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন। যা করার সব তো আমিই করেছি। আমার সাথে যা ইচ্ছা করুন কিন্তু আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন। ও একটা সদ্যজাত বাচ্চা। প্লিজ দয়া করুন প্লিজ..”
আর কিছু বলার আগেই রূপ অনিমার গাল চেপে ধরে ধমক দিয়ে বলল,
— ” চুপ! একদম চুপ! দয়া? আমাদের মধ্যে দয়া মায়া বলে কোন বস্তু নেই। আর তোমাকে দয়া? কেন করব? তোমার জন্যে শুধু তোমার জন্যে আমাদের এতদিনের সব প্লান নষ্ট হয়ে গেছিল। তোমাকে ছেড়ে দেব? আমাকে ঠকিয়ে অনেক বড় ভুল করেছিলে তুমি। আর তার দাম তোমাকে দিতেই হবে।”
বলে রুপ বেবীকে ফ্লোরে রাখল। অনিমা ধরতে গেলেই রূপ ওর হাত ধরে ফেলল। অনির হাত চেপে ধরে বলল,
— ” তোমার পেছনে তাকাও!”
অনিমা পেছনে তাকিয়ে দেখল একটা বম রাখা আছে, বোমটা অদ্ভুত দেখতে স্বাভাবিক নয়, তবে সেখানে টাইম সেট করা আছে। অনিমা ভীত দৃষ্টিতে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” প্লিজ এমন করবেন না। আমার বাচ্চাটা তো আপনার কোন ক্ষতি করেনি। প্লিজ যেতে দিন আমাদের। ”
আর রিক রূপ একটু ভাবার ভান করে বলল,
— ” ঠিকই বলেছো। এই বাচ্চাটাতো কিছু করেনি তাই একটু দয়া দেখাতেই পারি তাইনা? ওয়েট।”
অনিমার মাথায় রুপের কোন কথাই ঢুকছে না ও বারবার ওর মেয়েকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু রূপের জন্যে ধরতে পারছেনা রূপ ওকে বারবার টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। রূপ ওর পকেট থেকে একটা ইনজেকশন সিরিঞ্জ বেড় করল যার ভেতরে লিকুইড ভরা আছে। রূপ সিরিঞ্জটা খুলে বাঁকা হেসে অনিমার দিকে তাকাতেই অনিমা ভীত দৃষ্টিতে ইনজেকশটার দিকে তাকিয়ে তারপর রূপের দিকে তাকালো। রূপ হেসে বলল,
— ” বলেছিলেনা ছেড়ে দিতে? যাও, ছেড়ে দেব। এটা কী জানো? এই ইনজেকশনটা তোমার শরীরে দেওয়ার সাথে সাথেই তোমার শরীরের নিচের ভাগ কয়েক ঘন্টার মধ্যে অবস হয়ে যাবে। যার অর্থ আমিতো তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো। কিন্তু, তুমি যেতে পারবেনা এখান থেকে। আর তারপর যখন বমটা ফাটবে তখন তোমরা দুজনেই…”
অনিমার বুক কেঁপে উঠল এটা শুনে ও রূপের সামনে হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ এরকম করবেন না। আমি এখানেই থাকব শুধু আমার মেয়েটাকে বাইরে যেতে দিন।”
রূপ কোন প্রকার মায়া না করেই ইনজেকশনটা পুশ করে দিলো অনিমাকে। অনিমা মৃদু স্বরে আওয়াজ করে উঠল। রূপ এবার অনিমার গাল চেপে ধরে বলল,
— ” বলেছিলাম না তোমাকে দেখে নেব? কী যেন বলেছিল তোমার আদ্রিয়ান? তোমাকে ছুঁতে গেলেও নাকি আদ্রিয়ান নামক বলয় পার করতে হবে? আজ আমিও তো দেখি আদ্রিয়ান নামক বলয় তার অনিকে কীকরে বাঁচায়।”
অনিমা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পরছে কোমর থেকে নিচের দিকটা অবশ হয়ে আসছে। রূপ বলল,
— ” এখানে তোমরা দুজন আছো। আর হসপিটালে কেউ থাকবেনা কারণ গোটা হসপিটালে মোট পাঁচটা বোম আছে। সবাই জানে যে এগুলো ডিএক্টিভ করা একমাত্র ঐ সফটওয়্যার দিয়েই সম্ভব যেটা করতে অনেক সময় লাগবে। তাই দেখ পুলিশও বাইরে ঘীরে দাঁড়িয়ে আছে সবাইকে বেড়িয়ে আসার জন্যে এলার্ট করছে, কারণ কোন লাভ নেই এতক্ষণে সব বেড়িয়েও গেছে। কেউ নিজের জীবন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলবে না। এখন তোমাকে বাঁচাতে কে আসবে? শুধুই আদ্রিয়ান। তুমিতো হেটে যেতে পারবেনা? আর তোমার বেবিও পরে আছে। কিন্তু দুজনকে তো একটা মানুষ তুলে নিয়ে যেতে পারবেনা? আর তোমাকে যেখানে এনে রেখেছি ও খুঁজে এখানে আসতে আসতে অতোটা সময় বেঁচেও থাকবেনা যে এক এক করে নিয়ে যাবে। এবার দেখব আদ্রিয়ান কাকে বেছে নেয় তোমাকে নাকি ওর বেবীকে।”
অনিমা কেঁদেই যাচ্ছে ও বুঝে গেছে ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে। খুবই ভয়ংকর। ও রূপের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— ” প্লিজ রূপ।”
রূপ হেসে দিয়ে বলল,
— ” এখন এখান থেকে বেড়োলেই পুলিশ ধরে নেবে। কিন্তু তবুও আমি ফিরেছে। এই তিনবছরে পরিকল্পনা করে সবটা সাজিয়েছি। শুধু তোমাদের শিক্ষা দেব বলে। আমি চাইলেই তোমাকে মেরে ফেলতে পারতাম এখন। কিন্তু আমি চাই আদ্রিয়ান নিজে তোমাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে যাক এটাই ওর শাস্তি হবে। সারাজীবন গুমরে মরতে এই অপরাধবোধে।”
অনিমা মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। রূপ আবার বলল,
— ” তোমাকে নিজের করতে চেয়েছিলাম আমি কিন্তু তুমি ঐ আদ্রিয়ানের জন্যে ওর কথায় আমায় ঠকিয়েছ। এবার আমিও দেখি তোমার আদ্রিয়ান তোমাকে বাঁচায় নাকি তোমার বাচ্চাকে। গুড বাই।”
বলে অনিমাকে ওখানে ফেলে রেখেই দরজা বাইরে দিয়ে তালা মেরে চলে গেল রূপ। অনিমা কাঁদতে কাঁদতে অনেক কষ্টে হাত বাড়িয়ে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিলো আর বেবীর কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগল।
এদিকে আদ্রিয়ান গোটা হসপিটালে খুঁজছে অনিমাকে। সবাইকে বের করেছে এরা। এতক্ষণ ধরে পুলিশরাও অনিমাকে খুঁজেছে কিন্তু বোমের টাইমার অনুযায়ী মাত্র কয়েক মিনিট সময় আছে বলে তারা বেড়িয়ে গেছে। যেহেতু এটা নরমাল বোম নয়, তাই এটা ডিফিউজ করার জন্যে বোম ডিফিউজার ডাকা বোকামি ছাড়া কিছুই না। ওরা আদ্রিয়ানকেও বেড়িয়ে আসতে বলেছে কিন্তু আদ্রিয়ান বেড়োয় নি। অনিকে ছেড়ে ও কীকরে বেড়োবে।
অনিমা ওর বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বারবার বোমার সময়ের দিকে দেখছে। হঠাৎ করেই দরজা খুলে কেউ ঢুকলো তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানকে দেখে অনিমা জোরে কেঁদে দিল। আদ্রিয়ান দৌড়ে এসে অনিমার সামনে বসে বলল,
— ” জানপাখি, কিচ্ছু হয়নি আমি চলে এসছি। চল!”
অনিমাকে ওঠাতে গিয়ে আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমা উঠতে পারছেনা। অনিমা অস্ফুট স্বরে বলল,
— ” রূ-রূপ ইনজেকশন..”
এটুকু বলেই আরো জোরে জোরে কেঁদে দিল। আদ্রিয়ানের বুঝতে বাকি রইল না কী হয়েছে। আদ্রিয়ান অনিমার গালে হাত দিয়ে বলল,
— ” ভয় পেওনা আমি আছিতো। কিচ্ছু হবেনা।”
— ” আমার, আমার মেয়েকে বাঁচাও আদ্রিয়ান।”
আদ্রিয়ান বোমের দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র নয় মিনিট আছে। হসপিটালটা বেশ বড় আর নামতে অনেক সময় লাগবে। আদ্রিয়ান ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভেবে প্রথমে বেবীকে কোলে তুলে নিলো। ওপর হাত দিয়ে অনিকে ওঠানোর চেষ্টা করেও পারলোনা। কারণ অনিকে ওঠাতে গেলে বেবিকে শক্ত করে ধরতে হবে। একদিনের বাচ্চাতে এত জোরে ধরে এতোটা পথ নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, প্রাণের ঝুকি আছে। আদ্রিয়ান কী করবে সেটাই ভাবছে। চোখ ছলছল করে উঠেছে ওর। দুজনেই যে ওর প্রাণ। অনিমা শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে, “আমার মেয়েকে বাঁচাও”। আদ্রিয়ান এবার বেবীকে নিচে রেখে অনিমাকে কাধে তুলে নিলো। একহাতে অনিকে কাধে ধরে রেখে আরেক হাতে বেবীকে কোলে নিয়ে প্রচুর কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে অনেক কষ্ট করে লিফটের কাছে গিয়ে আদ্রিয়ানের শেষ আশাটাও শেষ হয়ে গেল। লিফট বন্ধ। আর এভাবে সিড়ি দিয়ে নেমে নিচে যাওয়া অসম্ভব। ফোন করে যে কাউকে ডাকবে সেটাও পারবেনা কারণ ফোনটা কোথায় ফেলে রেখেছে জানেনা। আর প্রাণের ঝুকি নিয়ে কেউ হসপিটালের ভেতরে আসবেনা কারণ মাত্র সাত মিনিট বাকি আছে। লিফটের সাথে লাখানো বোমা টা সেটাই দেখাচ্ছে। আর এত অল্প সময়ে প্রথমে বেবীকে রেখে এসে পরে আবার অনিক নেওয়া পসিবল না। আদ্রিয়ান দুজনকে নিয়ে ওখানেই বসে পরল। ওর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। একহাতে নিজের স্ত্রী ওপর হাতে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ও। অনিমা আদ্রিয়ানের গালে হাত রেখে বলল,
— ” আদ্রিয়ান আমার মেয়েকে বাঁচাও। ওকে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে।”
আদ্রিয়ান কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
— ” ক-কীকরে তোমাকে…”
অনিমা হিঁচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” আদ্রিয়ান আমার চেয়ে আমার মেয়ের জীবণ বেশি ইম্পর্টেন্ট। প্লিজ ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে সময় নেই।”
— ” আমি পারবোনা তোমাকে এখানে ফেলে যেতে। তোমাকে ছেড়ে বেঁচে থাকতে পারবোনা আমি।”
— ” পারতে হবে আদ্রিয়ান। আমাদের মেয়ের জন্যে পারতে হবে আপনাকে। আমার মেয়ের কিছু হলে আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো। আর ওকে বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব। ধরে নাও এটাই আমার তোমার কাছে শেষ চাওয়া। আমার মেয়েকে বাঁচাও।”
আদ্রিয়ান কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
— ” এতটা নিষ্ঠুর হতে বলো না আমাকে। এতটা কঠিন পরীক্ষা দিতে পারবনা আমি। প্লিজ।”
অনিমা হাফানো কন্ঠে বলল,
— ” হতে হয় আদ্রিয়ান। কখনও একটু নিষ্ঠুর হতে হয় আমাদের। আদ্রিয়ান সময় নেই প্লিজ যাও। তোমাকে আমাদের ভালোবাসার কসম। আমাদের ভালোবাসার চিহ্নকে বাঁচাও!”
আদ্রিয়ানের মত ছেলেও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল এবার। জাপটে ধরল নিজের সাথে নিজের জানপাখিকে। অনিমাও কাঁদছে। আদ্রিয়ান পারছেনা অনিকে ছেড়ে উঠতে। অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” ভালোবাসি তোমাকে।”
— ” খুব ভালোবাসি।”
— ” কথা দাও আমার মেয়েকে আমার অভাব কোনোদিন বুঝতে দেবেনা?”
আদ্রিয়ান শুধু কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অনিমা আবার বলল,
— ” কথা দিচ্ছো তো?”
আদ্রিয়ান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। অনিমা ওর গলার সেই লকেটটা খুলে আদ্রিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— ” এটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি চাইনা আমার সাথে সাথে এটাই জ্বলে শেষ হয়ে যাক।”
আদ্রিয়ান কিছু না বলে শুধু কেঁদে যাচ্ছে।অনিমা কিছু একটা ভেবে বলল,
— ” আদ্রিয়ান সময় নেই যাও প্লিজ।”
নিজেকে বুকে এক পাহাড় সমান পাথর চেপে কাঁপাকাঁপা হাতে অনিমাকে ছাড়তে যেয়েও ছাড়তে পারছেনা। ওর সারা শরীর কাঁপছে। আজ নিজের সন্তানকে বাঁচাতে ও নিজের প্রাণটাকেই এখানে ফেলে চলে যেতে হবে ওকে? নিজের বাঁচার কারণটাকেই এখানে ছেড়ে যেতে হবে? নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে হবে? কীকরে করবে ও এই কঠিন কাজ।
_________________
এটুকু বলেই থেমে গেল আদ্রিয়ান। কন্ঠস্বর আটকে আসছে ওর। সেই মুহূর্তের কথা ভাবলেও ওর দম আটকে আসে। অদ্রিজা তো স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও নিজেও কাঁদছে। কতটা কঠিন মুহূর্ত একজন স্বামী আর একজন বাবার কাছে। যখন তাকে তার স্ত্রী আর সন্তানের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হয়? আদ্রিয়ান কী করেছিল? কাকে বেছেছিল? আদ্রিমা পুরো সুস্থ আছে, তারমানে কী সেদিন অনিমাকেই ছেড়ে এসছিল আদ্রিয়ান? ঐ বিষ্ফোরণে কী অনিমার সাথে শেষ হয়ে গেছিল অনি-আদ্রিয়ানের প্রেমকাহিনী?
#চলবে…