Story: ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 11+12
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
দিনা নাফিসার পাশে বসে বললতে লাগলো,
– তুই কান্না করছিস কেন! তোর তো খুশি হওয়ার কথা! প্রতিশোধ তো নেয়া হয়ে গেছে! বাসায় চলে যা…
দিনা উঠে চলে গেলো। নাফিসা দিনার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। সে তো এটা চায় নি! মেহেদীর ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু জানতোই না সে! প্রতিশোধ নেয়ার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে সে! তার ফ্রেন্ড ও আজ তার বিপক্ষে দাড়িয়ে! নাফিসা উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। বাসায় চলে এলো। মামির সাথে দেখা হতেই মামি জিজ্ঞেস করলো,
– এতো সকালে কোথায় গেছো? নাস্তাও করোনি! কল করছি রিসিভ ও করছো না!
– একটা জরুরি কাজ ছিলো মামি।
– আচ্ছা, যাও। হাতমুখ ধুয়ে আসো, আমি খাবার দিচ্ছি।
– খাবো না আমি।
নাফিসা রুমে এসে পার্স ঢিল মেরে ফেলে জানালার পাশে, খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার কানে শুধু মেহেদীর বলা কথা গুলোই বেজে চলেছে!
“অভিনয় করতে করতে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোকে! কমপিটিশন জিতে গেলে ক্ষমা চেয়ে নিতাম তোর কাছে! নাম কাটিয়ে নিবো বলেছিলাম, তাহলে মিথ্যে অপবাদ দিলি কেন আমার নামে! আমার পৃথিবী কেড়ে নিলি কেন! বিশ্বাস কর, মা ছাড়া আমার আর কেউ ছিল না! আজ মা ও নেই! মামলা এমন ভাবে উপস্থাপন কর যাতে কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমার ফাসির রায় হয়ে যায়!”
নাফিসার চোখ থেকে টুপটাপ পানি গড়িয়ে পড়ছে! মামি খাবার নিয়ে নাফিসার রুমে চলে এলো। নাফিসার চোখে পানি দেখে প্লেট টেবিলে রেখে মামি পাশে বসলো।
– নাফিসা, কি হয়েছে তোমার? এই মেয়ে, কাদছো কেন?
নাফিসা মামিকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করতে লাগলো।
– নাফিসা এভাবে কান্না না করে বলো আমাকে, কি হয়েছে?
– বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে মামি।
– এই পাগলী মেয়ে, আমি তোর মা না? চুপ, একদম কান্না করবি না। মুখ ধুয়ে আয় আমি খায়িয়ে দেই। কাল রাতেও খাওয়া হয়নি। যা…
নাফিসা ওয়াশরুমে চলে গেলো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে বলতে লাগলো,
– আমি যে মিথ্যে মামলা দিয়ে কোনো মায়ের প্রানে আঘাত করেছি! কোন ছেলের জীবন ধংস করে দিয়েছি! কোন মা আমার জন্য দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে! সেটা কি করে বলবো তোমাকে, মামি!
কিছুক্ষন পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মামির কাছে এলো। মামি খায়িয়ে দিয়ে রুম থেকে চলে গেলো। একটু পর রিসাদ কল করেছে। প্রথম বার রিসিভ করে নি, পরেরবার রিসিভ করলো।
– ভার্সিটি আসবে না আজ?
– না।
– নাফিসা, মেহেদীর মা মারা গেছে আজ। জানাজা পড়লাম মাত্র। আন্টি অনেক ভালো ছিলেন। মেহেদীর বাবা ছোট বেলায় মেহেদীকে সহ আন্টিকে রেখে চলে গেছেন। চরিত্র ভালো ছিলো না উনার। এখন বেচে আছে কি মরে গেছে কেউ জানে না। আন্টি অনেক কষ্ট করে মেহেদীকে লালন পালন করেছেন। মাঝে মাঝে বাসায় গেলে আমাদেরও খুব আদর, সেবাযত্ন করতেন।
রিসাদের কথাগুলো এখন অসহ্য লাগছে নাফিসার কাছে! আগে থেকেই এতোকিছু জানতো তাহলে নাফিসার পক্ষ নিয়ে মেহেদীর সাথে শত্রুতা কিভাবে করতে পারলো সে! নাফিসা না হয় প্রতিশোধ নেয়ার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে, রিসাদ কেন আগে একবার বললো না যে নাফিসা তুমি ভুল পদক্ষেপটা নিয়ো না! নাফিসা রিসাদকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– মেহেদী এখন কোথায়?
– জানাযা শেষ করার পর পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে।
– কথা বলতে ভালো লাগছে না আমার। বাই…
– ইগনোর করছো কেন আমাকে!
– ইগনোর কোথায় করলাম! বললাম কথা বলতে ভালো লাগছে না। শরীরটা আমার খারাপ লাগছে।
– অসুস্থ তুমি? কি হয়েছে?
– কিছুনা, এমনি দুর্বল লাগছে। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
– ওকে। বাই…
নাফিসা কল কেটে পুলিশ আংকেল কে কল করলো।
– হ্যাঁ নাফিসা বলো।
– আংকেল, মেহেদী কোথায়?
– একটু আগে থানায় নিয়ে এলাম। আজ ওর মা মারা যাওয়ার আজ নিবো না, কাল সকালে কোর্টে চালান করবো।
– আংকেল কোর্টে চালান করবেন না প্লিজ। আমি মামলা উঠিয়ে নিতে চাই।
– কি বলছো তুমি! অপহরণের মামলা এতো সহজ না। কঠিন শাস্তি পাবে সে।
– আংকেল আমি মিথ্যে মামলা দিয়েছি।
– হোয়াট!
– জ্বি আংকেল। ও এমন না, মেহেদী খুব ভালো ছেলে। ওর সাথে ছোট খাটো একটা ঝগড়া হওয়ায় ও আমাকে ভয় দেখানোর জন্য হুমকি দিয়েছিলো শুধু। তাই আমি মিথ্যে মামলা দিয়েছি।
– তুমি জানো, তুমি কি করেছো! একটা লাইফ নষ্ট করে দিয়েছো! আইনের হাতে কোন কাজ এলে সেটা সহজে সরে না। তোমার এ কাজের জন্য তোমার এবং সাক্ষীদাতার শাস্তি হতে পারে।
– প্লিজ আংকেল, একটু চেষ্টা করুন। ওকে মুক্তি দিয়ে দিন, প্লিজ।
– তোমাকে মামলা উঠানোর জন্য এখন আবার কেউ হুমকি দিচ্ছে না তো!
– না আংকেল, আমি এখন সত্যি বলছি। প্লিজ, মামলা নিষ্পত্তি করে দিন। বিনিময়ে আমার শাস্তি হলে আমি তাতে রাজি আছি।
– হুহ্! আইনের কর্মকাণ্ড পুতুল খেলা না নাফিসা। কোন কাজ করার আগে ভেবে করতে হয়। আর জেদ করে কোন কাজ করা ঠিক না। তোমার জন্য ছেলেটার যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ সম্ভব না। যাক, ভালো হয়েছে এখন কল করেছো। কোর্টে চালান করলে এ শাস্তি হতে মুক্তি পাওয়া যেত না। আমি চেষ্টা করছি ছাড়ানোর। এখন ছাড়বো না। দুপুরে দেখি…
– ওকে, আংকেল।
– দুপুরে তোমাকে আসতে হবে। মামলা উঠিয়ে নেয়ার দলিলে স্বাক্ষর করতে হবে।
– আংকেল এটা পরে করলে হবে না? মানে, আমি মেহেদীর সামনে যেতে চাচ্ছি না।
– স্বাক্ষর না করলে ছাড়া যাবে না।
– তাহলে এখন এসে স্বাক্ষর করে যাই, দুপুরে ছেড়ে দিবেন।
– আচ্ছা, আসো।
নাফিসা পার্স আর ফোন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। আংকেলের সাথে কথা বলে মামলা উঠিয়ে নিলো। কাজ সম্পন্ন করে বাসায় এসে দিনার কাছে কল করলো। রিসিভ করছে না, বারবার কেটে দিচ্ছে । মেসেজ সেন্ট করলো, ” মেহেদীকে নিয়ে জরুরি কথা আছে, প্লিজ একবার রিসিভ কর।” এবার রিসিভ করতেই নাফিসা বলতে লাগলো,
– আবিদ ভাইয়া কোথায়?
– বাইরে গেছে একটু।
– আমি মামলা উঠিয়ে নিয়েছি, ভাইয়াকে বলিস দুপুরে মেহেদীর কাছে যেতে। ভাইয়া গেলে মেহেদীকে ছাড়া হবে।
– উঠিয়ে নিলি কেন? শাস্তি পাওয়া দরকার ছিলো, তাছাড়া তুইও খুব শান্তি পাবি।
– দিনা প্লিজ। বারবার এক কথা তুলবি না। দোষ আমার একা ছিলো না, শুরুটা মেহেদীই করেছে।
নাফিসা কল কেটে দিলো। দুপুরে আবিদ মেহেদীকে নিয়ে এলো তাদের বাসায়। পুরো ভার্সিটি সহ আশেপাশে সবাই জেনে গেছে, মেহেদী অপহরণের দায়ে জেলে ছিলো। একটা দিন, মাত্র একদিনে মেহেদীর পুরো জীবনটা পাল্টে গেছে!
বিকেলটা কাটিয়ে জোর করে আবিদের বাসা ছেড়ে তার নিজের বাসায় ফিরে এলো। মায়ের রুমটা একবার ঘুরে গেলো, নিজের রুমটা দেখলো। প্রত্যেকটা আসবাবপত্র নিয়ে হাজারো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। সন্ধ্যায় আবিদও চলে এসেছে মেহেদীর সাথে থাকতে। একা ছাড়া যাবে না এখন মেহেদীকে!
নাফিসা আজও বই সামনে নিয়ে বসে আছে। রিসাদের কাছে শুনেছিলো ভার্সিটি থেকে নাকি মেহেদীকে বহিষ্কার করা হয়েছে! নাফিসা ভার্সিটি যাচ্ছে না তাই পলাশ স্যার কল করেছিলো প্রাক্টিস এর জন্য। নাফিসা জানিয়েছে এখন একটু প্রব্লেমে আছে পরে প্রাক্টিস করবে। সে ছেলেটার লাইফ নষ্ট করে দিয়েছে! মামা রুমে ঢুকতেই ভাবনার ছেদ ঘটলো,
– এমন বিষন্নভাবে বসে আছো কেন বই সামনে রেখে! কি হয়েছে?
– কিছু না।
– রিসাদকে চেনো?
নাফিসা একটু চমকে উঠলো। রিসাদের কথা মামা জানে কিভাবে!
– চেনো না?
– হ্যাঁ।
– ও তোমাকে পছন্দ করে। তার বাবা আমার খুব কাছের বন্ধু। একসাথেই ব্যবসা করি আমরা। ফ্যামিলিও খুব ভালো। আজ কথা হলো তোমাকে নিয়ে তার বাবার সাথে। পছন্দ করো তুমি রিসাদকে?
নাফিসা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! সে রিসাদকেও পছন্দ করে না। দেখতে যথেষ্ট স্মার্ট হলেও তাকে নিয়ে কোন ফিলিংস নেই। শুধু তার পক্ষ নিয়েছিলো বলে বন্ধুসুলভ মিশেছে! কিন্তু এটা খুব ভালো জানে, রিসাদ তাকে খুব পছন্দ করে। এখন মামাকে না বললেও তো মামা বলবে তাহলে চেনো কিভাবে! নানান কথা ভাবতে ভাবতে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
– ওর বাবা চায় তোমার মতামত থাকলে বিয়েটা দ্রুত সম্পন্ন করতে। তুমি সেখানে থেকেও পড়তে পারবে, এখানেও থাকতে পারবে। সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা। ছেলেটাকে আমার কাছেও খুব ভালো লেগেছে। এখন তুমি কি বলো?
– মামা, এতো তারাতাড়ি বিয়ে!
– কতদিন বাচি আল্লাহ ছাড়া কে জানে! তোমাকে কারো হাতে তুলে দিতে পারলে আমি দায়িত্বমুক্ত হবো। বিয়েটা পড়িয়ে রাখলেও তো সমস্যা নেই!
– যা ভালো মনে করো তাই করো।
মামা চলে গেলো। কিছু ভালো লাগছে না তার কাছে! নিজের জীবনটাকে আজ তার কাছে বোঝা মনে হচ্ছে। অন্যদিকে এই রিসাদের কর্মকাণ্ড! ওফ্ফ! অসহ্যকর!
পরেরদিন রিসাদ ও তার বাবা মা নাফিসাদের বাসায় হাজির! নাফিসা তাদের দেখে অবাক হলো! রিসাদের সাথে একা কথা বলে জানতে পারলো, ওর বাবা মা দেখতে এসেছে নাফিসাকে। আর মেহেদী নাকি কোনোভাবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে। তাই নাফিসাকে নিয়ে তার ভয় হয়। এজন্য বিয়েটা একটু তারাতাড়ি করতে চাচ্ছে! কিন্তু নাফিসা সারাক্ষণ মেহেদীর কথাই ভাবছে। নাফিসাকে রিসাদের বাবা-মা দেখে খুব পছন্দ করেছে, তারা আজ আংটি পড়িয়ে যেতে চায়। সেই প্ল্যান নাফিসাকে না জানিয়ে রিসাদ বাসা থেকে আগেই করে এসেছে সারপ্রাইজ দিবে বলে। মামা মামীর সম্মতিতে তারা সেই কাজটা সারতে চাচ্ছে৷ রিসাদের মা নাফিসার হাতে আংটি পড়াতে গেলে নাফিসা হাত টেনে নিয়ে দাড়িয়ে গেলো। সবাই অবাক হলো, তার চোখে পানি! মামা জিজ্ঞেস করলো,
– নাফিসা কি হয়েছে? উঠে গেলে কেন?
– নাহ! মামা, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
– বিয়ে হয়ে গেছে মানে!
– হ্যাঁ, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
নাফিসার কথা শুনে সবাই অবাক! রিসাদের মনে হচ্ছে নাফিসা মজা করছে। তাই বললো,
– নাফিসা, বড়রা এখানে সিরিয়াস হয়ে কথা বলছে। দেখো, এখন মজা করার সময় না।
– আমি মজা করছি না, রিসাদ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
– আচ্ছা! মজা করছো না! বিয়ে কবে হলো! কার সাথে হলো, বলো….
– মেহেদীর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
– হোয়াট!!!
Story: #ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 12
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
– মেহেদীর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
– হোয়াট!!!
রিসাদ বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলো।
– কি যা তা বলছো তুমি! মেহেদীর সাথে তোমার বিয়ে হলো কবে! মিথ্যে বলছো কেন!
– আজ মিথ্যে বলছি না। আমি সেদিন তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আমি কমপিটিশন এর জন্য মেহেদীর নামে মামলা দেইনি। মেহেদী আমাকে বিয়ে করেছে বলে আমি তার নামে মামলা দিয়েছি। সেদিন গাজীপুরে আমি তাকে আমার প্ল্যান জানিয়ে দেই আর থ্রেড দিয়ে নাম উঠাতে বলি, সে রাজিও হয়ে যায়। সব মিটমাট করে সেখান থেকে তোমাদের কাছে আসার পথে গাছের শিকরে হোচট খেয়ে আমি মেহেদীর উপর পড়ে যাই আর মেহেদী আমার ধাক্কা খেয়ে আমাকে সাথে নিয়ে পড়ে যায়। এমন সময় ওদিক থেকে আসা দুজন লোক শুকনো পাতা কুড়াতে এসে আমাদের এ অবস্থায় দেখে ফেলে। আর ভেবেছে আমরা খারাপ উদ্দেশ্যে জংগলে গিয়েছি। তারপর আমাদের দুজনকে বকাঝকা করে সেই পথেই জংগলের পেছনে থাকা গ্রামে নিয়ে যায়। ফোনও নিয়ে নেয়। তারপর মুরুব্বি ডেকে আমাদের অপমান করে আর হুজুর এনে আমাদের বিয়ে পড়ায়। দুজনেই অনেক সত্য মিথ্যা বলে ফিরে আসার চেষ্টা করেছি কিন্তু বিয়ে করার পর আমাদের হাতে ফোন দিয়ে মুক্তি দিয়েছে তারা। তাই বাসের কাছে আসতে অনেক দেড়ি হয়েছে। মেহেদী আমাকে হুমকি দেওয়ার জন্য জংগলের ওদিকে নিয়ে না গেলে হয়তো এসব কিছু ঘটতো না, বিয়েটাও হতো না। এই জেদে আমি তার নামে মিথ্যে মামলা দিয়েছি। আর আমার জন্য আজ মেহেদীর এই অবস্থা!
– কি বলছো তুমি এসব! আচ্ছা, এটা তো একটা এক্সিডেন্ট! এই বিয়ে তো কেউই মেনে নাও নি! দুজনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে! তুমি মেহেদীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে নিবে তাহলেই সব শেষ। আমরা বিয়ে করে নিবো।
– না, আমি ডিভোর্স নিবো না। আমি মানি এই বিয়ে।
– নাফিসা! তুমি আমার সাথে প্রতারণা করতে পারো না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সবসময় তোমার সাপোর্ট করেছি। অন্য কোন কিছু না ভেবে যা বলেছো তাই করেছি।
– প্রতারণা কোথায় করলাম রিসাদ! আমি তো এক্সিডেন্টের স্বীকার হয়েছি, আর নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। প্রতারণা তো করেছো তুমি। মেহেদীর সাথে প্রতারণা করেছো। এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বোকা বানিয়েছো, ধোকা দিয়েছো। আমি না হয় জানতাম না তার সম্পর্কে কিছু, তাই প্রতিশোধের জন্য ওর জীবনে দূর্গতি ডেকে এনেছি। কিন্তু তুমি, তুমিতো ওর স্বপ্ন, ওর সামর্থ, ওর পরিবার সবকিছু সম্পর্কে জানতে। তাহলে আমাকে সাপোর্ট করলে কিভাবে তার সর্বনাশ করার জন্য ! বিনা কারণে তুমি প্রতারণা করলে কিভাবে নিজের বন্ধুর সাথে! আজ মেহেদীর মা মারা যাওয়ার পেছনেও তুমিই দায়ী।
– নাফিসা অনেক বেশি বলছো তুমি। কেন করেছি তোমার খুব ভালো করেই জানা। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি বন্ধুত্ব ত্যাগ করেছি। এখন আমাকেই বিয়ে করবে তুমি।
– করবো না আমি তোমাকে বিয়ে। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
রিসাদের বাবা ধমকে উঠলো,
– তোর সাহস কি করে হয় কারো উপর জোর করার! আর একটা বিবাহিতা মেয়েকে আমি ঘরের বউ করে নিবো তা ভাবলি কিভাবে। চল এখান থেকে…
– না আব্বু, আমি নাফিসাকেই বিয়ে করবো।
– করাচ্ছি তোকে বিয়ে! চল আমার সাথে..
– নাফিসা তুমি ভুল করছো। আমার কথায় রাজি হয়ে যাও। এতো কিছুর পর মেহেদী তোমাকে মেনে নেবে না।
– তা নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে, রিসাদ।
রিসাদের বাবা ধাক্কাতে ধাক্কাতে রিসাদকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মামা মামি দুজনেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তারা বুঝতে পারছে না কিছুই! নাফিসাও ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো। মামা নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– এসব কি হলো নাফিসা? কি থেকে কি হয়েছে কিছুই তো বুঝলাম না!
নাফিসা মামা মামির কাছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা হয়েছে সব বললো। আর সাথে চোখের পানি পড়া তো আছেই! মামা তাকে বললো,
– আবেগের মোহে তোমরা কি থেকে কি করেছো কোনো ধারণাই নেই তোমাদের। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা পাকিয়েছো! ভুল দুজনেরই আছে! তবে মেহেদীর তুলনায় তোমার ভুলটা বেশি হয়ে গেছে।
– জানি মামা।
– তো এখন কি করতে চাচ্ছো?
– আমি মেহেদীর কাছে যাবো।
– কেন যাবে?
– মামা, ধর্মমতে আমাদের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে যাবো আমি তার কাছে।
– রিসাদ এই কথাটা ঠিক বলে গেছে, এতোকিছুর পর মেহেদী তোমাকে মেনে নিবে না।
– মামা, তবুও আমি যাবো।
– জীবনটা তোমার, এর সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তোমার আছে। আমরা বড়জোর সাপোর্ট করতে পারবো। এর বেশি কিছু হয়তো পারবো না। আগে একবার ভুল করেছো। বারবার ভুল করো না। ভেবে চিন্তা করে তারপর যে কোন সিদ্ধান্ত নিও। এখন বলবো বিষয়টি আরো সময় নিয়ে ভেবে দেখো।
নাফিসা রুমে চলে এলো। সারাদিন এ নিয়েই চিন্তা করেছে। বিকেলে পলাশ স্যারের কাছে কল করে বলেছে সে আর কমপিটিশন প্রাক্টিস করবে না। ফাইনাল রাউন্ডে পার্টিসিপ্যান্টও করবে না। স্যার বারবার বলছে, তাও সে বারবার না করছে। অবশেষে স্যার বললো কাল ভার্সিটিতে দেখা করতে। কিন্তু নাফিসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। সে মেহেদীর কাছে যাবে। মেহেদী জায়গা দেক আর না দেক জোর করেই সেখানে পড়ে থাকবে। মেহেদী কি করবে তাকে! অত্যাচার করবে! খুন করে ফেলবে! করুক, মেহেদীর হাতে খুন হলেও নাফিসার আফসোস নেই। তার দ্বারা যে কোন মা কষ্ট পেয়েছে! মেহেদী দুনিয়াতে একা হয়ে গেছে! এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত সে করবে মেহেদীর কাছে থেকে। আগে ভালোবাসেনি তো কি হয়েছে! এখন অনেক ভালোবাসবে তাকে নাফিসা। মেহেদী সবসময় নাফিসাকে ঘৃণা করবে এটা সে নিশ্চিত। আর যদি কখনো মেহেদীর ভালোবাসা পেয়ে যায় তাহলে তো সেটা হবে তার সৌভাগ্য! যাইহোক, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত মেহেদীর নিসঙ্গ জীবনে সঙ্গ দিয়ে যাবে নাফিসা, এটাই তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত!
.
সকালে নাস্তা করে মামাকে জানিয়ে দিলো তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, সে মেহেদীর কাছে যাবে। তারপর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। স্যারের সাথে কথা বললো। স্যারকে বিভিন্ন অজুহাতে বারবার বললো যে সে পার্টিসিপ্যান্ট করবে না। স্যার যেন মেহেদীকে নিয়ে যায়। স্যার এটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, মেহেদীকে নিবে না। অপবাদের কারণে মেহেদী সবার কাছে ঘৃণ্য পাত্র হয়ে গেছে, এটা বুঝতে বাকি নেই নাফিসার। ভার্সিটি থেকে নাফিসা সোজা আবিদের বাসায় চলে এলো। দিনা আছে বাসায়, আবিদ অফিসে। দিনাও তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। দিনার কাছে মেহেদীর বাসার এড্রেস চাইলো। দিনা জানিয়ে দিলো সে দিবে না। তাও অনেক কষ্টে নাফিসা দিনাকে সম্পূর্ণ ঘটনা শোনালো। সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও দিনাকে জানিয়েছে। এখন দিনা কি করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। ঘটনা শুনে নাফিসা অপরাধ করেছে সেটা তার কাছে স্পষ্ট, আবার তার সিদ্ধান্ত শুনেও মনে হচ্ছে তা ঠিক। কারণ, মেহেদী ভাইয়ার একাকীত্ব দূর করার জন্য সঙ্গ প্রয়োজন। অবশেষে এড্রেস দিয়েই দিলো। কিন্তু নাফিসাকে এটাও সাবধান করে দিলো, সব শেষ করার পর এখন যেন মেহেদীর জীবনটা শেষ না করে। আজ হাফ টার্ম হওয়ায়, আবিদ দুপুরেই বাসায় চলে এসেছে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলো দ্রুত পায়ে হেটে নাফিসা বেরিয়ে গেলো। আবিদ ঘরে এসে, দিনাকে জিজ্ঞেস করলো,
– নাফিসা এখানে কেন এসেছে?
– মেহেদী ভাইয়ার বাড়ির এড্রেস নিতে।
– দিয়ে দিছো?
– হ্যাঁ।
– কেন এখন কি ছেলেটার প্রাণটাও কেড়ে নিতে চাইছে ওই মেয়ে! এড্রেস দিলে কেন তুমি? আমার তো এখন তোমাকেও সন্দেহ হচ্ছে! মেহেদীর জীবন ধংস করার জন্য তুমিও নাফিসার সাথে যুক্ত ছিলে।
– আবিদ, কি বলছো তুমি এসব! না জেনে উল্টাপাল্টা বলো না। এড্রেস ও যেকোনো ভাবে জোগাড় করতে পারতো। আমি সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর এড্রেস দিয়েছি। হ্যাঁ, নাফিসা ভুল করেছে। কিন্তু এই ভুলের শুরুটা মেহেদী ভাইয়াই শুরু করেছে।
– বান্ধবীর জন্য খুব জ্বলছে না?
– তাহলে তো আমিও বলতে পারি, তোমার বন্ধুর জন্য জ্বলছে।
– হ্যাঁ, জ্বলছে। নিরপরাধীর জন্য সবারই জ্বলে।
– অপরাধ দুজনেই করেছে। তারা বিবাহিত। আর স্ত্রীর অধিকার নিয়েই নাফিসা ভাইয়ার কাছে যেতে চায়৷ তাই এড্রেস দিয়েছি আমি।
– হোয়াট! এসব বলে আবার নতুন প্ল্যান শুরু করেছে নাফিসা!
– নতুন কোনো প্ল্যান না। গাজীপুর গিয়ে তারা এক্সিডেন্টলি বিয়ে করেছে।
– কখনোই সম্ভব না এটা। এমন কিছু ঘটলে মেহেদী আমাকে জানাতো।
– কিন্তু এটাই সত্য। আর কি বললে! মেহেদী ভাইয়া জানাতো তোমাকে! মেহেদী ভাইয়া যে নাফিসার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছিলো সেটা কি তোমাকে জানিয়েছিলো? কিন্তু রিসাদ ভাইয়া তো ঠিকই জানতো সেটা। আর সবটা রিসাদ ভাইয়ার সাজানো প্ল্যান ছিলো।
– বিশ্বাস করি না আমি তোমার আর তোমার ফ্রেন্ডের কথা। আজকের পর আর কখনো যেন তোমাকে নাফিসার হয়ে কথা না বলতে শুনি। ওর সাথে কোনরকম যোগাযোগ থাকবে না তোমার।
– ভালো কাজে আগাতে হলে আমি এগিয়ে যাবো।
– না, যাবে না তুমি।
– আবিদ! ভুলে যেও না নাফিসা আমাদের কত হেল্প করেছে। তোমার চাকরিটা কিন্তু সে ই দিয়েছে। তাছাড়া আমাদের বিয়েটাও নাফিসার জন্য হয়েছে।
– তার মানে তুমি যোগাযোগ বন্ধ করবে না! তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। যাও তোমার ফ্রেন্ডের কাছে।
– আবিদ কি বলছো এসব!
আবিদ আর সেখানে দাড়িয়ে না থেকে টিশার্ট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দিনা ধপাস করে খাটে বসে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। প্রায় এক ঘন্টা পর আবিদ গোসল করে ঘরে এলো। দিনা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলো। আবিদ খাবার না খেয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দিনার ও খাওয়া হয়নি আর।
এক কথা দুই কথা থেকে শুধু শুধু তাদের মধ্যে ঝগড়া বেধে গেল! দিনা বাসায় একা। শশুর শাশুড়ী ও দেবর বেড়াতে গেছে দুদিন আগে। রাতে দিনা একা একা ঘরে বসে অপেক্ষা করছে আবিদের জন্য। হঠাৎ কেউ দরজায় নক করলো। দিনা জিজ্ঞেস করলো, “কে” কিন্তু কোন জবাব এলো না৷ একাধারে নক করেই যাচ্ছে! দিনার ভয় হচ্ছে! একটু পর কেউ বললো, ” দরজা কি ভেঙে ফেলবো! ” দিনা এবার বুঝতে পারলো আবিদ এসেছে। তারাতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আবিদ ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। দিনা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত দশটায় আবিদ বাসায় ফিরেছে। আবার কোন কথা বলছে না তার সাথে।
– খাবে না? খাবার আনবো?
কোন জবাব দিলো না আবিদ। বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে রইলো। দিনা বুঝতে পেরেছে আবিদ আজ খাবে না। লাইটটা অফ করে সেও খাটে এসে আবিদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আবিদ তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কাত হয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। দিনা তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ঝাপটে ধরে শুয়ে রইল। আবিদ হাত সরানোর চেষ্টা করতেই দিনা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– হয়েছে তো। আর কত রাগ করবা! শুধু শুধু ওদের জন্য নিজের সংসারে অশান্তি ডেকে আনছো কেন! সারাদিন না খেয়ে ঘুরে বেরিয়েছো! অসুস্থ হয়ে পড়বে তা কি একবার ভেবেছো! আমি কোন অশান্তি চাই না, শান্তি চাই। তুমি চাইলে আমি নাফিসার সাথে কোন যোগাযোগ রাখবো না। এবার তো স্বাভাবিক হও।
আবিদ দিনার দিকে ঘুরে দিনাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে রইল। দিনাও ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো। একটু পর আবিদ বললো,
– তুমি সারাদিনে খেয়েছো?
– না।
– যাও, খাবার নিয়ে আসো।
– খাবো না এখন।
– আমি খাবো, আমার ক্ষুধা লাগছে।
দিনা এবার মাথা সোজা করে উঠে বসতে গেলে আবিদ আবার টেনে কাছে এনে চোখ মুছে দিয়ে কপালে আর ঠোঁটে আলতো করে চুমু একে দিলো। দিনা হেসে উঠে চলে গেলো খাবার আনতে। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
– মেহেদী ভাইয়ার কাছে গিয়েছো আজ?
– গিয়েছিলাম। ঘরে তালা দেওয়া। দেখা করতে পারিনি। সকালে অফিসা যাওয়ার সময় একবার রাস্তায় দেখেছিলাম, গাড়িতে থাকায় কথা বলতে পারিনি।
– ফোন করলেও পারতে।
– ফোন করেছি। রিসিভ করে না।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার ট্রাই করলে এবার রিসিভ হলো। আবিদ মেহেদীর সাথে একটু কথা বললো। মেহেদীও এখন ঘুমাবে তাই নাফিসার ব্যাপারে আর কিছু বললো না আবিদ। সেও ঘুমিয়ে পড়েছে।
চলবে