Story: ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 1+2
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
-আমাদের মাঝে এখন গান নিয়ে আসছে নূর নাফিসা।
শিক্ষক বলার সাথে সাথে নাফিসা মঞ্চে উঠলো আর সবাই সিটি বাজিয়ে চিৎকার করে অভিনন্দন জানালো। আজ নবীন বরন প্রোগ্রাম ভার্সিটিতে। মেয়েটি তার সুরেলা কন্ঠে গান গেয়ে মুগ্ধ করে দিলো সবাইকে। শিক্ষকবৃন্দ পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেছেন। সবশেষে গান গাইলো মেহেদী। ভার্সিটির সব প্রোগ্রামে গানের জগতে চ্যাম্পিয়ন সে। ভার্সিটি থেকে বাইরের বিভিন্ন প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করেছে সে। এই ভার্সিটি থেকেই অনার্স কমপ্লিট করে বর্তমানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। শিক্ষকগণ সহ ভার্সিটির প্রায় সবাই চিনে তাকে। কিন্তু অবশেষে ফলাফল কি হলো! নাফিসা ফার্স্ট হলো কিভাবে! মেহেদী সেকেন্ড! বন্ধুরা পাশে দাড়িয়ে বলাবলি করছে নানান কথপোকথন! তাদের বিশ্বাস ছিলো প্রতিবারের মতো আজও মেহেদী ফার্স্ট হবে। আর এদিকে মেহেদী রাগে ফাটছে!
-এই মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসলো কোথা থেকে! আগে তো দেখিনি তাকে। এতো বছরের চ্যাম্পিয়নকে অতিক্রম করে চলে গেলো সে! কে এই মেয়ে!
মেহেদীর বন্ধু আবিদ বলে উঠে,
– স্যারদের কোন আত্মিয় টাত্মিয় নয় তো আবার!
প্রত্যুত্তরে রিসাদ বললো,
– কি বলছিস! স্যার দের আত্মিয় ভার্সিটির প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করবে কেন! আর পার্টিসিপ্যান্ট করলেই বা পুরস্কারের অধিকারী হবে কেন!
– আহ! নিজেরা এতো কথা না বলে ওই মেয়েকে বা স্যারদের জিজ্ঞেস কর না কোথা থেকে ধরে আনছে!
মেহেদী খুব বিরক্তি নিয়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে সেখান থেকে চলে গেলো সে। কিছু ভালো লাগছে না! এটা কিভাবে সম্ভব! লাগবে না তার এই পুরস্কার। গেইটের কাছাকাছি আসতেই সাউন্ড বক্সে মেহেদীর ডাক পড়লো পুরস্কার নেয়ার জন্য। সামনে আবার পড়লো এক স্যার!
– কোথায় যাচ্ছো মেহেদী? ওদিকে তোমাকে ডাকছে।
– এদিকটায়ই যাচ্ছিলাম স্যার।
– চলো স্টেজে।
অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুরস্কার হাতে নিতে হলো। কষ্ট করে আর কাউকে খোঁজ নিতে হয়নি মেয়েটির। পরিচালক স্যার নিজেই পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে।
– প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, ও নাফিসা। অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী। আমাদের ভার্সিটিতে নতুন। কোনো রকম প্রিপারেশন ছাড়াই আজ সে গান গেয়ে ১ম স্থান দখল করেছে। করতালির মাধ্যমে আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই….
সবাই করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানালো নাফিসাকে। অত:পর এককভাবে স্যার নাফিসাকে মেহেদীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
– নাফিসা, ও হচ্ছে মেহেদী। মাস্টার্স স্টুডেন্ট অর্থাৎ তোমাদের বড় ভাই। খুবই মেধাবী স্টুডেন্ট। আর ভার্সিটি প্রোগ্রামে গানের জগতে চ্যাম্পিয়ন!
– হ্যালো
পরাজয়ের অভিমান ও কষ্ট চাপা রেখে মুখে হাসি নিয়ে মেহেদীও প্রত্যুত্তরে হ্যালো জানালো।
সেদিন আর বেশিক্ষণ থাকেনি ভার্সিটিতে। দুতিনদিন পর ভার্সিটি যাওয়ার পর শুধু নাফিসার গুনগান শুনছে সবার মুখে।
– দোস্ত মেয়ে তো এক গানেই চারিদিকে নাম ছড়িয়ে নিয়েছে!
– তো যা গিয়ে তোরাও পুরস্কার দিয়ে আয়।
– দূর…! আমি সেটা বলছি নাকি! এভাবে যদি সব প্রোগ্রামে গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে তাহলে এমনও হতে পারে এক্সটার্নাল প্রোগ্রামে স্যার তোকে বাদ দিয়ে ওই মেয়েকে নিয়ে যাবে।
– ভার্সিটিতে তো নতুন তাই না?
– হুম
– এবার দেখ আমিও কি করি!
– কি করবি তুই?
– এতোদিন তোরা যা করতি আর আমি নিষেধ করতাম। এখন আমিও সেটা করবো।
– রেগিং!!!
– ইয়েস ব্রো….
– হাউ ইন্টারেস্টিং!
– আবিদ কইরে?
– ব্যাটা চাকরির পিছনে দৌড়ায়!
– এমন করে বলছিস কেন? তোর বাপের মতো তো আর সবার বাপ কোটিপতি না।
– সরি, আমি সেটা মিন করিনি। চাকরির জন্য এপ্লাই করছিলো না, আজ ইন্টারভিউ।
– ভালোই ভালোই টিকলেই হয়! আংকেল তো অসুস্থ। একটা চাকরি খুব দরকার ওর।
– তোর ও তো একটা দরকার। কোচিং এ আর কতো বেতন দেয়!
– আলহামদুলিল্লাহ, মাকে নিয়ে আমার এতেই দিন চলছে। তাছাড়া গান গাওয়া নিয়ে বড় একটা স্বপ্ন আছে। দেখি কি হয়…
– হুম।
এতোক্ষণ মেহেদী গেইটের পাশে আম গাছটার নিচে রিসাদের সাথে রিসাদের বাইকে বসে কথা বলছিলো। ৩য় ক্লাসের ঘন্টা পড়লে হঠাৎ দেখলো পার্স কাধে নিয়ে নাফিসা একা একা গেইটের দিকে আসছে। চলে যাবে বোধহয়!
– রিসাদ, ওই মেয়েটা না? কি যেন নাম!
– হ্যাঁ, নাফিসা। আজকে আবার চশমা লাগিয়েছে! সেদিন তো ছিলো না!
– মেবি বলদি টাইপ। হাহাহা….
– হাহাহা….
– ডাক এদিকে
– এই যে চশমাওয়ালী…. দোস্ত মেয়ে তো ফিরেও তাকায় না!
– এই মেয়ে! এই তোমাকে ডাকছি কানে যায় না কথা!
– আযব মেয়ে! কানে কালা নাকি!
নাফিসা কোন ভ্রুক্ষেপ না করে গেইটের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।
– এই নাফিসা….
এবার নাফিসা তাদের দিকে তাকিয়ে তাদের কাছে এলো। রিসাদ ও মেহেদী পূর্বের ন্যায় একসাথে বাইকেই বসে আছে।
– জ্বি, বলুন
– কতোক্ষন ধরে ডাকছি! কানে শুনতে পাও না?
– এতোক্ষণ তো চশমাওয়ালী, এই মেয়ে এভাবে ডাকছিলেন। আমার নাম ধরে তো মাত্র ডাকলেন।
– ওহ! তোমাকে বারবার নাম ধরে ডাকলে তারপর সারা দিবে, তাই তো?
– অবশ্যই। মানুষের নাম রাখা হয় ডাকার জন্য।
রিসাদকে থামিয়ে এবার মেহেদী বলতে লাগলো,
– ভার্সিটিতে নতুন তুমি। তোমার নাম তো আমরা না ও জানতে পারি। এটা মাথায় নেই তোমার?
– হ্যাঁ এটা মাথায় আছে। আর এটাও মাথায় আছে, স্যার সেদিন আপনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। দুদিনের ব্যবধানে একটা নাম ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। এতো বেশি কথা না বলে ডেকেছেন কেন সেটা বলুন।
– অনেক তাড়া দেখাও আমাদের! চশমা পড়েছো কেন? এখনি চোখে দেখো না, বাকি দিন তো পড়েই আছে!
মেহেদী ও রিসাদ দুজনেই হাহাহোহো করে হেসে উঠলো।
– চশমা পড়বো কি পড়বো না এটা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে। এতে আপনাদেরকে নাক গলাতে হবে না। এসব ফালতু কথা বলার জন্য আমাকে ডেকেছেন?
– বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলে জানো না সেটা! বেয়াদব মেয়ে।
– হ্যাঁ খুব ভালো করেই জানি। তাইতো আপনাদের এখনো আপনি বলে সম্বোধন করছি।
– খুব বেশি কথা বলতে জানো দেখছি! প্রথম তো ভেবেছিলাম বলদি টাইপের মেয়ে! হাহাহা…. যাক আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আমার জুতোটা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে। একটু পরিষ্কার করে দাও দেখি কেমন পারো! তোমার ওড়না দিয়ে করো না হলে আবার জুতো নষ্ট হয়ে যাবে। গান তো ভালোই গাইতে পারো দেখতে চাই বাকি কাজে কেমন পারদর্শী।
নাফিসা এবার কাছে এসে তার এক পা বাইকের চাকার উপর রেখে দাড়ালো। রিসাদ ও মেহেদী দুজনেই তাকে এভাবে দাড়াতে দেখে অবাক হয়ে নাফিসার দিকে তাকালো।
– আল্লাহ তায়ালা জুতো পড়ার জন্য আপনাকে যেমন দুটি পা দিয়েছেন আর ঠিক তেমনি তা পরিষ্কার করার জন্য দুটি হাতও দিয়েছেন। সো ডু ইট বাই ইউর হ্যান্ডস। গুড বাই….
কথাটা বলেই নাফিসা চাকার উপর থেকে পা সরানোর সময় পা দিয়ে বাইক ধাক্কা দিলো। এমনিতেই বাইকে দুজন বসে ছিলো। তারউপর অপজিট পাশে ঢাল হয়ে বাইক দাড়িয়ে ছিলো বিধায় নাফিসার পায়ের হালকা ধাক্কাতেই বাইকসহ দুজনেই উল্টে পড়ে গেলো। এরকম কাজে দুইবন্ধু হতম্বর!
– কি, এবার আমি হাসি! হিহিহিহি…. ভার্সিটির বড় ভাই হওয়ায় যদি ভেবে থাকেন ছোটদের রেগিং এ রাখবেন। তাহলে ভুলে যান ভাবনা। অন্তত নাফিসার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হবে না। মাইন্ড ইট…
নাফিসা গেইটের বাইরে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেলো। দুজনেই আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো। পেছনে ইট থাকায় মেহেদী কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে। রিসাদ ব্যাথা পায়নি। বালি ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিলো দুজনে।
– এএএ! আমার বাইক! আজ সকালে মাত্র ওয়াশ করে আনলাম!
– তোর বাইকের গুল্লি মারি। আমার কোমড় গেছে! ওই মেয়েরে তো ইচ্ছামত ওয়াশ করতে ইচ্ছা করতাছে!
– প্রায় ৫ বছর ধরে ভার্সিটিতে আছি। এমন মেয়ে চোখে একটাও পড়েনি।
– অতিরিক্ত সাহসী না! ভার্সিটি তো আসবেই, সাহসী গিরি বের করবো।
– এখন দয়া করে আমার বাইক তোল।
দুজনেই বাইক তুলে সোজা করলো। রিসাদ বাইক স্টার্ট করে দেখে নিলো ঠিক আছে কি না! মেহেদী পেছনে বসলো। রিসাদ মেহেদীকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মেহেদী আস্তে আস্তে হেটে ঘরে প্রবেশ করলো। মেহেদীর মা বারান্দায় বসে সেলাই কাজ করছিলো। ছেলেকে আস্তে আস্তে খুড়িয়ে হাটতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে এভাবে হাটছ কে? কি হইছে পায়ে?
– কিছু না।
– আমি তো দেখছি কিছু হইছে। পায়ে ব্যাথা পাইছস?
– না।
– তাহলে?
– কোমড়ে ব্যাথা পাইছি।
মেহেদী আর দাঁড়িয়ে না থেকে তার রুমে চলে গেলো। এখানে দাড়ালেই নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। জুতো খুলে ফ্যান ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে উল্টো হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মেহেরুন্নেছা বেগম সেলাই কাজ ছেড়ে ব্যাথার মালিশ নিয়ে ছেলের রুমে এলো।
– কোনদিকে ব্যাথা, দেখা…
– মা, যাও তো। কিছু হয়নি, একটু পর ঠিক হয়ে যাবে।
– (ধমকের সুরে) কোনদিকে ব্যাথা?
– এদিকটায়…
মেহেরুন্নেছা মালিশ করতে করতে আবার বললো,
– কেমনে ব্যাথা পাইলি? মারামারি করছস?
– কি বলো এসব! মারামারি করবো কেন!
– ফুটবল খেলছস?
– না।
– ব্যাথা কি আর এমনি এমনি আইছে?
– পড়ে গেছি বাইক থেকে।
– কিহ! চলন্ত বাইক থেকে পড়ছস?
– না, রিসাদের সাথে স্থির বাইকে বসে ছিলাম। বাইক উল্টে পড়ে গেছি।
– কতোবার না করি বাইকের ধারে কাছে যাবি না। কতো এক্সিডেন্ট হয় এই বাইক থেকে। একটা কথাও শুনাতে পারিনা।
– মা, শুধু শুধু এতো টেনশন করো না তো। যাও তুমি, আমি ঘুমাবো।
মা চলে গেলে মেহেদী ভাবতে থাকলো কিভাবে নাফিসাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া যায়!
.
চলবে……
Story: #ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 2
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় গানের সুর শুনতে পেল মেহেদী। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা গান গাইছে। ক্লাসে স্যার ও আছে। তারমানে স্যার বলেছে গান গাইতে। দ্রুত পায়ে হেটে সে সামনের দিকে চলে গেলো। কেন জানি সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগে এই গলাটা। ক্লাসে এসে দুটো ক্লাস করার পর বন্ধুদের নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলতে নেমে গেলো মেহেদী।
ক্লাস শেষ করে নাফিসা একা একা মাঠের সাইড দিয়ে গেইটের দিকে আসছিলো। মেহেদী তাকে দেখতে পেয়ে বল আস্তে আস্তে এগিয়ে নাফিসার দিকে খুব জোরে একটা লাথি দিলো। বল গিয়ে নাফিসার পায়ে লাগলো। ব্যাথা পেয়ে নাফিসা “ওফ!” শব্দ করে উঠলো। বন্ধুরা সব মাঠে দাঁড়িয়ে রইলো। মেহেদী শয়তানি হাসি দিয়ে বল নেয়ার জন্য নাফিসার কাছে এলো।
– আহ! খুব ব্যাথা লেগেছে না! আমারো লেগেছিলো কাল। কিন্তু দেখো, আজ আমি একদম সুস্থ। আল্লাহ যা করে সব ভালোর জন্যই করে। হাহাহা…..
নাফিসা হাটার জন্য পা ফেলতেই পায়ে খুব ব্যাথা অনুভব করলো। মেহেদী উপহাসস্বরূপ আবার বলতে লাগলো,
– হাটতে পারবে তো! লুলা হয়ে যাও নি তো আবার! অবশ্য লুলা হলেও সমস্যা নেই, গান গাইতে পারবে। আঘাত তো আর গলায় লাগেনি!
মেহেদী হাহাহোহো করে হাসতে হাসতে বল নিয়ে মাঠে ফিরে এলো। নাফিসার কাছে এবার পানির মতো পরিষ্কার, নাফিসা গান গাইছে বলে মেহেদী তার সাথে এমন শত্রুতা শুরু করেছে! সে ও এর শেষ দেখে নিবে। গান এতোদিন তার শখ থাকলেও এখন তা নেশা ও পেশায় পরিনত করবে!
.
পরের দিন গেভ ক্লাসে নাফিসা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলো। হঠাৎ কেউ বললো,
– তোমার সাথে বসতে পারি?
নাফিসা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে সে দেখেছে তাদের ক্লাসে। স্যার যখন প্রশ্ন করছিলো, মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে গুছিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলো। এখন মেয়েটির চেহারায় অন্যরকম একটা ভাব দেখলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছে। মেয়েটি কোন উত্তর না পেয়ে আবার একই প্রশ্ন করলো।
– তোমার সাথে এখানে বসতে পারি?
– কেন?
– কেন আবার! এমনি..
– এমনি হলে বসতে পারবে না। যদি ফ্রেন্ড হতে চাও তাহলে বসতে পারো।
মেয়াটি অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে দ্রুত বসে পড়লো নাফিসার কাছে। নাফিসা বইয়ের দিকে তাকাতেই মেয়েটি বললো,
– এখন তোমার সাথে একটু কথা বললে কি তুমি খুব বিরক্ত হবে?
নাফিসা বই বন্ধ করে তাকালো মেয়েটির দিকে। এবার সে নিজেই প্রশ্ন করা শুরু করলো,
– নাম কি তোমার?
– দিলশাত দিনা।
– খুব সুন্দর নাম। আমার নাম নূর নাফিসা। বাসা কোথায় তোমার?
– গাজীপুর। কিন্তু এখন পরিবারসহ মোহাম্মদপুর থাকি।
– আমিও মোহাম্মদপুর। ভাইবোন কতজন তোমার?
– আমরা এক ভাই এক বোন।
– আর আমি একা। উইথয়াউট ভাইবোন। হিহিহি…. পড়াশোনা করতে ভালো লাগে তোমার?
– হুম, ভালো লাগে বলেই তো ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া!
– আমার এতোটা ভালো লাগে না, তাও ভর্তি হয়েছি। তোমার প্রিয় শখ কি?
– ছবি আকা।
– আমার প্রিয় শখ ভ্রমণ করা আর গান গাওয়া। তবে মাঝে মাঝে ছবিও আকি। প্রিয় রঙ?
– আকাশী।
– আমার গাঢ় নীল। খেলতে জানো?
– কি খেলা?
– যেমন ধরো, ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন…
– ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলতে জানি। কিন্তু ফুটবল না…
– আমি মোটামুটি সব ধরনের খেলা খেলতে জানি। এবার তুমি আমাকে কোন প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারো।
দিনা অবাক হয়ে ভাবতে থাকলো, এই মেয়েকে এই কয়দিনে দেখে বুঝেছি মেয়েটি চুপচাপ থাকে। এখন তো দেখছি আমার চেয়েও বেশি স্ট্রং! এতোক্ষণ উত্তর দিতে দিতে মনে হচ্ছিল চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম!
দিনার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নাফিসা বললো,
– মনে মনে বললে আমি শুনবো কিভাবে! জোরে বলো না… এতো কি ভাবছো?
দিনা হেসে জবাব দিলো,
– ভাবছি আমি আর তোমাকে কি প্রশ্ন করবো! প্রশ্ন করার আগেই তো সব উত্তর দিয়ে দিয়েছো!
– হিহিহিহি….. যাইহোক, চট করেই ফ্রেন্ড হওয়া যায় না। ধীরে ধীরে কথাবার্তা, মেলামেশার মাধ্যমেই ফ্রেন্ডশিপ তৈরি হয়।
– নাফিসা তুমি যতো সুন্দর করে গান গাইতে পারো, তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি সুন্দর করে কথা বলতে পারো। সবাই তোমার গান শুনে মুগ্ধ, আমি এখন তোমার কথা শুনে মুগ্ধ।
– উহুম, আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। তুমি আমার কথাগুলো সুন্দরভাবে শুনেছো, তাই বলছো আমার কথা সুন্দর।
– হিহিহি…. তুমি সুন্দরভাবে না বললে আমি শুনবো কিভাবে! ভিন্ন ধরনের মানুষ তুমি! নিজের প্রশংসা শুনতে চাচ্ছো না। তবুও বলবো তুমি বক্তা হিসেবে খুব সুন্দর।
– উহুম! সুন্দর না সুন্দরী!
– অহ হ্যাঁ! বক্তা হিসেবে খুব সুন্দরী! হিহিহিহি…..
– আমি বক্তা হিসেবে সুন্দরী হলে তুমি শ্রোতা হিসেবেও খুব সুন্দরী। চলো এবার ক্লাসে যাওয়া যাক….
– হুম, চলো।
.
ক্লাস শেষে দিনার সাথে নাফিসা গেইটের দিকে আসছিলো। দেখলো কৃষ্ণচূড়া বাগানের দিকটায় ছোট খাটো একটা ভীড়। বিষয়টা বুঝার জন্য নাফিসা দিনাসহিত, একটু কাছে যেতেই গানের গলা শুনতে পেলো। সামনে গিয়ে দেখলো মেহেদী গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। আবার চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই কারো আওয়াজ শুনতে পেল,
– ও সুন্দরী, চলে যাচ্ছো কেন? গান শুনবে না? নাকি হিংসে হয় অন্যকে গান গাইতে দেখলে?
নাফিসা পেছনে তাকিয়ে দেখলো গান থামিয়ে মেহেদী নিজেই কথাটা বলেছে। এতোগুলা মানুষের সামনে এভাবে বলাতে নাফিসা একটু ইতস্তত বোধ করলো! এবার মেহেদীর উক্তির প্রতুত্তরে নাফিসা জবাব দিলো,
– হিংসে করাটা আপনার অভ্যাস হতে পারে, কিন্তু আমার মধ্যে এর অনুপস্থিতি বিদ্যমান ছিলো। যাইহোক, চলে যাচ্ছিলাম কারণ আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম এখানে এতো ভীড় কেন! কিন্তু এখন আপনার গান না শুনে যাবো না। শুনান আপনার গান….
নাফিসার কথায় মেহেদী হেসে আবার গান গাইতে শুরু করলো। গান গাওয়ার পুরোটা সময় নাফিসা এখানে দাড়িয়ে ছিলো। গান শেষ হতেই নাফিসা পার্স থেকে ৫০টাকার নোট বের করে মেহেদীর কাছে দিলো। মেহেদী চোখ বড় বড় করে নাফিসার দিকে তাকালো! নাফিসা এভাবে তাকাতে দেখে বললো,
– কি এতে খুশি হননি? আরো লাগবে? আপাতত এটা রাখুন, নেক্সট টাইম যখন শুনবো তখন না হয় বকশিস বাড়িয়ে দিবো।
মেহেদী রেগে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলো সাথে তার বন্ধুরাও। বাকিলোক হা করে তাকিয়ে আছে শুধু তাদের দিকে! তারাও স্পষ্ট বুঝতে পারছে এভাবে মেহেদীকে অপমান করা হচ্ছে!
– হোয়াট রাবিশ! তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এভাবে অপমান করার!
– অপমান কোথায় করলাম! গান শুনালেন তার বিনিময়ে বকশিস দিলাম।
– আমি কি বকশিস নেয়ার জন্য গান গেয়েছি! তোমা….
আরো কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলো মেহেদী। কিন্তু প্রিন্সিপালের গাড়ি গেইটের দিকে আসতে দেখে চুপ থাকলো। প্রিন্সিপাল গন্ডগোল দেখলে আরো বড় সমস্যা হয়ে যাবে। আর যাইহোক, এতোবছরে শিক্ষকদের মনে যে জায়গা করে নিয়েছে তা হারাতে চায় না সে। এই সুযোগে নাফিসা সেখান থেকে কেটে পড়লো। গাড়ি গেইটের বাইরে বেরিয়ে পড়তেই মেহেদীর মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বারবার তাকে অপমান করে চলে যায়! টাকাটা পায়ের কাছেই পড়ে ছিলো মেহেদী রেগে সেটা পা দিয়ে ধুলোর সাথে পিষে ফেললো!
গাড়ি বের হওয়ার আগেই নাফিসা দিনাকে সাথে নিয়ে বের হয়ে রিকশায় উঠে পড়লো।
– নাফিসা, এই কাজটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। এতে ভাইয়ার অপমান হয়েছে।
– তোমার ভাইয়া হয় নাকি?
– না, আমাদের সিনিয়র। তাই…
– তুমি কি সেটা বুঝতে পেরেছো, আমি গান গাইতে পারি তাই সে আমার প্রতি হিংসে করে?
– হিংসে! হিংসে কেন করবে?
– তা তো আমিও জানিনা। কিন্তু আমাকে তিরস্কারস্বরূপ সে তখন আমাকে সেখান থেকে চলে আসতে বাধা দিয়েছিলো।
– হুম, এটা আমিও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এই ভাইয়াটা খুব ভালো। শিক্ষকরা সহ ভার্সিটির সবার কাছেই খুব ভালো। কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণ সব দিক থেকেই ভালো।
– এতোকিছু জানো কিভাবে তুমি? আমি যতদিন আছি এখানে, তুমিও তো ততদিন। তাহলে?
– আমার কাজিনের কাছে আগেই শুনেছি এই ভাইয়ার কথা।
– অহ, আচ্ছা।
কেউ আর কোন কথা বললো না। নাফিসা মনে মনে বলে নিলো, কতো যে ভালো এই ভাইয়া তা তিন চার দিনেই আমার জানা হয়ে গেছে। আমার সাথে লড়তে আসলে আমি কি চুপচাপ বসে থাকবো নাকি!
.
চলবে…..