Story: #ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 23+24
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
জ্বর উঠেছে খুব! বাটিতে করে পানি এনে রুমালের সাহায্যে জলপটি দিতে লাগলো।জ্বর যে বেড়েই চলেছে, এদিকে মেহেদীর মনের ভয়ও বেড়ে যাচ্ছে!
প্রায় বিশ মিনিট ধরে জলপটি দিয়ে যাচ্ছে মেহেদী। মাত্রই নাফিসা চোখ খুলে তাকালো। চোখ খুলে তাকাতে দেখে মেহেদী যেন প্রান ফিরে পেলো! সাথে সাথেই কপালে একটা চুমু দিয়ে বসলো! নিভু নিভু চোখের পাতা বারবার খুলছে আর বন্ধ করছে। চোখে পানি ঝরছে। মেহেদী চোখের পানি মুছে দিয়ে জলপটি লাগিয়ে দিচ্ছে। নাফিসা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হতটা নাড়াতে গিয়েও পারলো না! ব্যাথা লাগছে। তাকিয়ে দেখলো সেলাইনের সিরিঞ্জ লাগানো! নাফিসার চোখ গড়িয়ে অনবরত পানি পড়ছেই! মেহেদী জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন লাগছে এখন?
নাফিসা অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো,
– আমি আর মায়ের ঘরে যাবো না। আর তোমাকে আমার মুখ দেখাবো না। আর থাকবো না এখানে। পারলাম না আমি, হেরে গেছি আমি। তোমাকে সঙ্গ দিয়ে তোমার একাকীত্ব দূর করতে এসেছিলাম। পারলাম না তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে। আর থাকবো না আমি এখানে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে মেহেদী!
মেহেদী তার মাথাটা বালিশ থেকে একটু তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারও অশ্রু ঝরছে! মাথায় গভীরভাবে চুমু দিলো। নাফিসা আবার বলতে লাগলো,
– আমাকে আমার বাসায় পৌছে দিতে পারবে? বাচবো না মনে হয়। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমার পরিবারকে। খুব ইচ্ছে করছে তাদের সাথে আগের মতো সময় কাটাতে। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না কখনো। বাচতে ইচ্ছে করছে আমার, মেহেদী। রেখে আসবা আমাকে আমার বাসায়? একটু পৌছে দিতে পারবা? সত্যি বলছি, আর আসবো না তোমার কাছে। এই অলক্ষুণে মুখ আর দেখতে পাবে না, আর কখনো এই খুনিকে দেখতে পাবে না। বিশ্বাস করো, আমি খুব ব্যাথা পেয়েছি। তুমি যখনই মেরেছো আমি খুব ব্যাথা পেয়েছি! খুব কষ্ট লাগছে আমার কথা বলতেও। আমি চলে যাবো এখান থেকে।
মেহেদীর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে! প্রত্যেকটা কথা তার হৃদপিণ্ডটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে! এতোটা জঘন্য সে কিভাবে হতে পারে! দুদিন মুখ না দেখতে পেয়েই তো ছটফট করছিলো! সে চলে গেলে থাকবে কিভাবে! ইচ্ছে করছে নিজের কলিজাটা ফাক করে নাফিসাকে সেখানে রেখে দিতে! তার কষ্ট এখন সহ্য হচ্ছে না! হারিয়ে ফেলার ভয় করছে খুব!
– কোথাও যাবি না তুই। আ..আমার কাছে থাকবি তুই। তুই চলে গেলে আমি একা থাকবো কি করে! তুই ছাড়া আর কে আছে আমার! আমি আমি চাকরি করছি তো। প্রতিদিন অফিস যাচ্ছি। কোথাও যেতে দেবো না আমি। আর মারবো না আমি। হুম! আর মারবো না। কিছু হবে না তোর। আল্লাহ একটু রহম করো। নিয়ো না ওকে! সুস্থভাবে ফিরিয়ে দাও।
অতি কষ্টে মেহেদী পাগলের মতো আলাপন করে যাচ্ছে। খুব শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে নাফিসাকে। কেউ কেড়ে নিতে চাইলেও দিবে না সে! এদিকে নাফিসার আর কোন সাড়া পাচ্ছে না! সে তাকে বালিশে শুয়িয়ে দিয়ে দেখলো নাফিসা চোখ বন্ধ করে আছে! আর কিছু বলছে না! গালে হাত রেখে নাড়িয়ে ডাকতে লাগলো মেহেদী।
– নাফিসা, এই নাফিসা। তাকাচ্ছো না কেন। তাকাও আমার দিকে।
নাফিসা জোর করে চোখ একটু ফাক করে তাকালো। মেহেদী তাকে ঘুমাতে দেখলেও এখন ভয় পেয়ে যায়! জ্বরে কাপছে নাফিসা৷ মেহেদী দুইটা কাথা তার গায়ে দিলো। তবুও যেন কাপুনি থামছে না! শার্ট খুলে সে নিজেই কাথার ভেতর শুয়ে পড়লো। নাফিসাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বারবার ডেকে ডেকে তার চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করছে। আবার এদিকে জলপটি দিয়েই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তার কাপুনি বন্ধ হয়ে গেলো। শরীর ঘামছে খুব। মেহেদী ভেজা কাপড় নিয়ে মুছে ফ্যান ছেড়ে দিলো। সেলাইন শেষ হলে সিরিঞ্জ খুলে দিলো। সারারাত নাফিসার সেবা করতে করতে কাটিয়ে দিলো। ফজরের আযান দিলে সে উঠে নামাজ আদায় করে নিলো। আবার এসে নাফিসার পাশে শুয়ে পড়লো। কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখলো শরীর ঘামায় জ্বর কিছুটা কমেছে। নাফিসা ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মুখে মেহেদী ঠোঁটের ছোয়ায় ভরিয়ে দিলো। সন্ধ্যা থেকে এসব করতে করতে তার নিজের শরীরেও ক্লান্তি নেমে এসেছে। চোখ তার নিভু নিভু করছে। একসময় নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে সেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
কারো ডাকে ঘুম ভাঙলো মেহেদীর। নাফিসাও চোখ খুলে তাকিয়েছে। ঘুমঘুম চোখে মেহেদী নাফিসার দিকে তাকালো। আবার ডাক শুনে বুঝতে পারলো ডাক্তার এসেছে। মেহেদী উঠে বসে নাফিসার চোখের পানি মুছে দিলো। ডাকে সাড়া দিয়ে আশেপাশের আসবাবপত্র পরিষ্কার করে দরজা খুললো। বেলা হয়ে গেছে অনেক। ডাক্তার এসে নাফিসাকে চেকাপ করলো। মেহেদীর কাছে কিছু ওষুধ দিয়ে বললো,
– আল্লাহর রহমতে অনেকটা আশঙ্কা মুক্ত। খাবার খায়িয়ে ওষুধগুলো সময়মতো দিয়ো। শরীর অনেক দুর্বল, খেয়াল রেখো।
– ওকে। মামা টাকাটা আমি দুতিনদিন পরে দেই। আসলে এখন একটু হাতটান!
– আচ্ছা।
ডাক্তার চলে গেলো। নাফিসা উঠার চেষ্টা করতেই মেহেদী এসে তার পাশে বসে আবার শুয়িয়ে দিলো।
– উঠছো কেন?
– চলে যাবো তো আমি। আর বিরক্ত করবো না তোমাকে। এগিয়ে দিয়ে আসবে একটু?
– চুপচাপ শুয়ে থাকো। কোথাও যাবে না।
– আর মেরো না আমাকে, খুব ব্যাথা পাই আমি। খুব কষ্ট হয় সহ্য করতে। আমি আর পারছি না! তুমি যেভাবে চাও সেভাবে চলো। আমি বাধা দিবো না। আর থাকবো না আমি এখানে।
মেহেদী কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না! তাকে শান্ত করার ভাষাও যেন নেই তার! মেহেদী বসা থেকে উপুড় হয়ে নাফিসার গলায় চুমু দিচ্ছে, কানে চুমু দিচ্ছে। গালে গাল স্পর্শ করছে। আর এদিকে নাফিসার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
– চুপ, চুপ, আর একটা কথাও না। কোথাও যাবে না তুমি।
একটু পর নাফিসা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহেদী তার পাশ থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নাফিসাকে একবার দেখে রান্না ঘরে এলো। পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখলো খাবার সব নষ্ট হয়ে গেছে। কাল দুপুরের দিকে হয়তো রান্না করেছিলো। আর এখন দশটা বেজে এগারোটা বাজতে চলেছে। খাবার তো নষ্ট হবেই! মেহেদী এগুলো ফেলে দিয়ে নিজের হাতে কোনোমতে পরিষ্কার করে নিলো। রান্নাবান্না কিছু কিছু জানে। মাঝে মাঝে শখের বসে মা কে রান্না করে খায়িয়ে ছিলো। মেহেদী সবজি দেখে নিয়ে রান্নার আয়োজন করতে লাগলো। হঠাৎ আবিদ কল করেছে। অফিসের কথা তার মনেই ছিলো না। এখন মনে হলো! আবিদ জানতে চাইলে সে বলে দিলো আজ অফিস আসবে না। কল কেটে দিয়ে স্যারের কাছে কল করে বললো হঠাৎ একটা বিপদে পড়েছে। তাই দুদিন আসতে পারবে না। স্যারকে বলে দুদিনের ছুটি নিয়ে নিলো সে। ভাত আর একটা তরকারি রান্না করে রুমে এলো বালতি ভর্তি পানি নিয়ে নাফিসাকে উঠিয়ে মাথাটা খাটের কিনারার নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢেলে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিলো। এখন কাপড় চেঞ্জ করাবে কে! দুজনেরই লজ্জা লাগছে এখন! নাফিসা অতি দুর্বল হওয়ায় পারছে না আর নাফিসার লজ্জা পাওয়া দেখে মেহেদীও আগানোর সাহস পাচ্ছে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যথাসম্ভব নাফিসার সাহায্যে কাপড় পাল্টে দিলো। কাপড়চোপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলো। অন্যান্য দিন নাফিসা যা করে আজ তাকে সব করতে হচ্ছে! নিজেও গোসল করে নিলো। প্লেটে খাবার নিয়ে এসে নাফিসাকে তুলে খাটে হেলান দিয়ে বসালো। নিজের হাতে কয়েক লোকমা খাওয়াতে পেরেছে। নাফিসা আর মুখে তুলছে না! তাকে ওষুধ দিয়ে মেহেদী নিজে খাবার খেয়ে নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রুমে এসে দেখলো নাফিসা বমি করে সব খাবার ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে! এখনো বমি করছেই, মেহেদী দৌড়ে এসে মাথা ধরলো। এতো কষ্টের ফল সব ব্যার্থ হয়ে গেছে! ওষুধ সহ একেবারে পেটে যা ছিলো সব উপচে পড়েছে!
মেহেদী সেসব পরিষ্কার করলো এদিকে নাফিসা অস্থির হয়ে শরীরের সমস্ত ভাড় ছেড়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষন পর জলপটি দিয়ে মেহেদী আবার অল্প করে খাবার আনলো। জোর করেই খাওয়ালো। খাওয়ার শেষে দু তিন মিনিট পর পানি খাওয়ালো, তার দুতিন মিনিট পর আবার ওষুধ খাওয়ালো। শরীরে ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে আবার শুয়িয়ে দিলো। সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। দুপুরের দিকে সেও একটু ঘুমিয়েছিলো। বিকেলে জ্বর মেপে দেখেছিলো একটু কমেছে। রাতে আবার বেড়ে গেছে! নিজের সাধ্যমতো ঘরের কাজকর্ম সে নিজেই করছে। নিজে অসুস্থ বানিয়ে এখন নিজেই সেবা করতে ব্যস্ত। দিন রাত ঠিকমতো বিশ্রামও নিতে পারছে না। তবে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করছে। পরেরদিন সকালে আবার জ্বর কমেছে। নাফিসা উঠে বসতে গেলে মেহেদী ধরে বসালো।
– উঠছো কেন?
– বাথরুমে যাবো।
– চলো।
মেহেদী কোলে নিতে গেলে সে বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো!
সারাদিন শুয়ে থেকে মাথা আরও বেশি ভারি হয়ে গেছে! মাথার ভারটা যেন এই শরীর বহন করতে পারছে না! খাট থেকে নেমে দুকদম যেতেই ঢলে পড়ছিলো, মেহেদী ধরে ফেলায় রক্ষা! বাকি পথ মেহেদী কোলে করে নিয়েই বাথরুমে দিয়ে এলো আবার সেখান থেকে নিয়েও এসেছে। জানালার পাশে দাড়িয়ে কাউকে কল করে বললো,
– কেউ ফোন কিনবে?
-…..
– আচ্ছা, দেখ। আমাকে একটু তারাতাড়ি জানাস।
কল কেটে মেহেদী চেয়ারে বসে রইলো। নাফিসা খাটে হেলান দিয়ে বসে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ফোন বিক্রি করতে চাইছো কেন?
মেহেদী তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কোন জবাব দিলো না। নাফিসা আবারও একই প্রশ্ন করায় এবার বললো,
– টাকা নেই। টাকার প্রয়োজন, ডাক্তারের টাকা দিতে হবে।
– আমার কাছে চেয়েছো একবার?
মেহেদী কোন জবাব দিলো না। নাফিসা আবার বললো,
– ডাক্তারের কতো টাকা? আমার পার্সে কিছু আছে, সেটা দিয়ে এসো।
– লাগবে না।
– মোবাইল কিনবো আমি। আমার কাছে বেচো।
মেহেদী তার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। শুধু এটা ভাবছে, অসুস্থ থেকেও মস্করা থামে না! তবে কথা বলছে এটা ভালো লাগছে তার কাছে। চুপ থাকতে দেখেই ভয় পায় সে। নাফিসা আবার বললো,
– কত হলে বিক্রি করবা?
– বিক্রি করবো না।
– এখন না কল করে জিজ্ঞেস করলে কেউ ফোন কিনবে কিনা!
– হ্যাঁ।
– তো বলো কতো হলে বিক্রি করবা? আমি সিরিয়াসলি কিনবো।
– মোবাইল দিয়ে কি করবা?
– দেখি কিছু করতে পারি কিনা! পার্সটা নাও তো একটু। ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ারে আছে।
– পারবো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো।
– থাক, আমিই নিচ্ছি।
নাফিসাকে নামতে দেখে তাকে নিষেধ করে সে নিজেই নিলো। নাফিসার কাছে দিতেই নাফিসা পার্স না ধরে মেহেদীর হাত ধরলো। হাতে টান দিয়ে বসতে ইশারা করলো। মেহেদী বসলে নাফিসা পার্স খুলে টাকা দেখলো। সাড়ে সাত হাজারের মতো আছে। এখানে আসার পর সে শপিং করেছে, বাজার করেছে তারপরও এতো টাকা দেখে মেহেদী বললো,
– এতো টাকা কোথায় পেলে?
– জমানো টাকা বাসা থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম। বলো কতো টাকায় বিক্রি করবে ফোন? পাচ হাজারে চলবে?
– করবো না বিক্রি।
– আচ্ছা তাহলে সাত হাজারে কিনবো। নাও..
– লাগবে না।
– আশ্চর্য! বাইরের লোকও তো কিনবে, আমিও তো কিনছি। তাহলে নিতে পারছো না কেন?
নাফিসা জোর করেই টাকা মেহেদীর মুঠোয় ধরিয়ে দিলো। মেহেদী পকেট থেকে ফোন বের করে সিম মেমোরি খোলার জন্য হাতে নিলো। কভার খুলতে গেলে নাফিসা টান দিয়ে মোবাইল নিয়ে নিলো।
– আমি ফুল সেট কিনেছি। তাছাড়া ফোন থাকবে না, সিম মেমোরি দিয়ে তুমি কি করবা!
– সিম মেমোরি সহ কেউ ফোন বেচে! আমার ফোন দাও।
– না। এখন এটা আমার।
– দিতে বলেছি।
নাফিসা পিঠের পেছনে ফোন লুকিয়ে রাখলো। মেহেদী ফোন নিতে গিয়ে তাকে দু’হাতে ঘেরাও করলো। ফোন না নিয়ে সে অন্য নেশায় মত্ত হয়েছে! নাফিসার হালকা ভেজা খোলা চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। কাধে ঘাড়ে মাতাল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। নাফিসার চোখে সুখের অশ্রু!
– এতো ভালোবাসা দিচ্ছো কেন আমাকে? চলেই তো যাবো আমি।
– কোথাও যাবে না তুমি। এখানেই থাকবে।
– কেন থাকবো এখানে?
– আমি বলেছি, তাই।
– আমার যে অত্যাচার সহ্য হয় না। আমি যে আর সইতে পারছি না এসব! শুধু শুধু এতো যন্ত্রণা নিয়ে আমি থাকতে পারবো না আর।
– হুশ….!
Story: #ভালোবাসি_প্রিয়
Part: 24
Writer: #Nur_Nafisa
.
.
– এতো ভালোবাসা দিচ্ছো কেন আমাকে? চলেই তো যাবো আমি।
– কোথাও যাবে না তুমি। এখানেই থাকবে।
– কেন থাকবো এখানে?
– আমি বলেছি, তাই।
– আমার যে অত্যাচার সহ্য হয় না। আমি যে আর সইতে পারছি না এসব! শুধু শুধু এতো যন্ত্রণা নিয়ে আমি থাকতে পারবো না আর।
– হুশ….!
মেহেদী তার গরম ঠোঁট জোড়ায় ডুবে গেলো।
পাচ হাজার টাকা সে নিজের কাছে রেখে দু হাজার টাকা নাফিসাকে দিয়ে দিলো।
– দিয়ে দিলে কেন?
– খাবারের বিল।
– রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছি নাকি?
– তুমিই ভালো জানো।
মেহেদী নাফিসাকে খায়িয়ে দিয়ে ডাক্তারের কাছে টাকা দিয়ে এলো। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না সে। নাফিসার খেয়াল রাখছে সবদিক থেকে। তৃতীয় দিন নাফিসা বললো,
নাফিসা- অফিস যাও না কেন? প্রথম প্রথম অফিস মিস করলে চাকরি থাকবে!
মেহেদী- একা একা খেতে পারবা?
নাফিসা- হ্যাঁ।
মেহেদী সকালে খায়িয়ে দুপুরের খাবার রেখে দিলো টেবিলে। অফিসের জন্য রেডি হয়ে নাফিসাকে বললো,
– চলো বাথরুমে।
– বাথরুমে এখন যাবো না।
– যেতে হবে। উঠো…
– আরে প্রয়োজন না হলে কেন যাবো!
– একটু পর প্রয়োজন হতে পারে তখন আবার পারবে না। তাই আগেই চলো।
মেহেদীর জোড়াজুড়িতে যেতেই হলো। খাটের পাশে সব দিয়ে গেলো। খাট থেকে নামতে নিষেধ করলো। বমি করার জন্য পাত্রটা পর্যন্ত দিয়ে গেলো! বেরিয়ে যাবে এমন সময় নাফিসা মেহেদীকে কাছে ডাকলো। মেহেদী কাছে এসে বসলে নাফিসা তাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
– ভালোবাসি প্রিয়।
এদিকে প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা রাখতে গেলে মেহেদী হাত ধরে ফেললো। নাফিসা ধরা পড়ে ব্যর্থতার নিশ্বাস ছাড়লো।
– নিয়ে যাও এটা।
– বেচে দিয়েছি।
– আমি তোমার কাছে ভাড়া দিলাম। ফোন সাথে নিলে তো বিশেষ প্রয়োজন হলে তোমাকে কলও করতে পারবো।
– তোমার সাথে মোবাইল আছে?
– হুম।
মেহেদী মোবাইল সাথে নিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। নাফিসা যাতে বাসা থেকে বেরিয়ে না যেতে পারে সেজন্য বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেলো। আবার লাঞ্চ টাইমে সোজা বাসায় ফিরে এসেছে। এসে দেখলো নাফিসা ঘাড় কাত করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে! সে ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে নাফিসাকে ডাকা শুরু করলো। নাফিসা ঘুমঘুম চোখে তাকালে সে বুকে চেপে ধরলো তাকে।
– এভাবে ঘুমাচ্ছো কেন? খেয়েছো?
– ভালো লাগছে না!
মেহেদী কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আগের মতোই আছে!
– বমি করছো কয়বার?
– দুবার!
– অনেক খারাপ লাগছে?
– তুমি বাসায় কেন?
– লাঞ্চ করতে এসেছি।
– ক্যানটিন নাই?
– আছে। উঠো মুখ ধুবে।
নাফিসাকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো। তাকে অল্প খাবার খায়িয়ে দিয়ে মেহেদী নিজে খেয়ে নিলো। সেদিনের কথা মনে পড়ছে নাফিসার। ভার্সিটির ক্যানটিনে মেহেদী চটপটি খেতে খেতে দুষ্টুমি করে বলেছিলো, “এক প্লেটে খেলে ভালোবাসা বাড়ে গো, ভালোবাসা বাড়ে!”
আজ তো তারা দুজন এক প্লেটে এক হাতে খাচ্ছে। তাদের মধ্যে কি ভালোবাসা বাড়ছে নাকি সে সুস্থ হলে মেহেদী আবার আগের মতো হয়ে যাবে!
মেহেদী তাকে ওষুধ খায়িয়ে দিয়ে আবার অফিস চলে গেলো।
এভাবেই কেটে গেছে আরও একমাস। বারো থেকে তেরোদিন লেগেছে নাফিসার সুস্থ হতে। প্রতিদিনই মেহেদী অফিসের লাঞ্চ টাইমে বাসায় এসে নাফিসাকে খায়িয়ে দিয়ে আবার অফিস গেছে। কিন্তু ঘরে তালা দিতে ভুলেনি। ভয় একটাই ছিলো, নাফিসা চলে যাবে। যদিও নাফিসা চলে যাওয়ার চেষ্টা করেনি কিন্তু মেহেদী তালা দিয়ে যাওয়ার কারণ সে ঠিকই বুঝেছে। এর মাঝে সে তার পরীক্ষাও শেষ করেছে। অফিস জয়েন করার পনেরো দিন পর মেহেদী প্রথম বেতন পেয়ে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দেখে বিল দেওয়া হয়েছে! মাথা খাটিয়ে সন্দেহ হলো এটা নাফিসা ই দিয়েছে! সেদিন বাসায় ফিরে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
– ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করেছে কে?
– আমি কি জানি!
– তুমি ছাড়া কে জানবে? বিলের কথা নিশ্চয়ই অন্যকেউ জানতো না। তুমিই শুনেছিলে। তুমি দাওনি?
নাফিসা আর কোন উত্তর না দেওয়ায় মেহেদী তার উত্তর পেয়ে গেছে। ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে নাফিসার হাতে ধরিয়ে দিলো।
– এটা রাখো, আগামী বেতনের টাকাটা আবিদকে দিবো। তাই মোবাইলের টাকাটা এক মাস পরে দিবো।
নাফিসা তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা আমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে যেভাবে রাখবে আমি সেভাবেই থাকবো। বাইরের কারো পাওনা থাকলে বরং সেগুলো পরিশোধ করো। আর ঘরে তালা দিও না। আমি যাবো না কোথাও।
মেহেদী কোন জবাব দিলো না। আবিদকে কিছু টাকা পরিশোধ করতে গেলে আবিদ বললো,
– তুই আগে ঠিকঠাক মতো চলার চেষ্টা কর। পরে আমার টাকা দিস। আপাতত আমার টাকার প্রয়োজন নেই।
এভাবেই কেটেছে দিনগুলো। সেই অসুস্থতা কাটিয়ে নাফিসা এখন পুরোপুরি সুস্থ হলেও বমির হার তার বন্ধ হয়নি। সেদিনের পর থেকে মেহেদী তার গায়ে আর হাত তুলেনি। কিন্তু নাফিসা সুস্থ হওয়ার পর সে সিগারেট খেয়েছে। প্রায়ই তার মা মারা যাওয়ার পর সেই পুরোনো অসুখটা আক্রমণ করে তাকে আর রেগে গিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে নাফিসার মুখে।
কয়েকদিন থেকে বমির হারটা বেড়েই চলেছে নাফিসার! মাঝে মাঝে মাথাটাও চক্কর দেয়! দুশ্চিন্তায় আছে সে! মেহেদী গোসল করে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। নাফিসার রান্নাও শেষ হয়ে গেছে। সে প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিলে রাখলো। মেহেদী খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। নাফিসা কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে খাওয়ার জন্য প্লেটে খাবার নিলো। এই বুঝি পেট থেকে সব বেরিয়ে আসছে! খেতে পারলো না আর সে! খাবার রেখে দিলো। হসপিটালে যাওয়া দরকার তার! সে বোরকা হিজাব পড়ে বেরিয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে! সে ডাক্তার শাহনাজের কাছে এলো আর তার কথামতো কিছু টেস্ট করালো। রিপোর্ট হাতে নিয়ে সে বেশ চিন্তিত! যেটার ভয় ছিলো সেটাই হয়েছে! সে প্রেগন্যান্ট!
অন্যমনস্ক হয়ে ধীর গতিতে হাটতে হাটতে হসপিটাল থেকে বের হয়ে এসেছে! হঠাৎ কেউ তাকে হেচকা টান দিলো! সে খেয়াল করলো সে রাস্তার কিনারায়! আর যে টেনে ধরেছে সে রিসাদ! আশেপাশের দুএকজন লোকও তার দিকে কেমন করা যেনো তাকিয়ে আছে। কোন এক লোক বলে গেলো, “পাগল নাকি!” আর এদিকে রিসাদ বললো,
– ধ্যান কোথায় থাকে! এখনই তো এক্সিডেন্ট হতে!
– তাতে আপনার কি?
– পাগলের মতো কি বলছো! কোথায় গিয়েছিলে? আর একা একা এভাবে হাটছো কেন!
সেদিনের কথা মনে হতেই নাফিসার শরীর শিউরে উঠলো! মেহেদী রাস্তায় রিসাদের সাথে দেখেছিলো তাকে আর সেদিন টর্চারও করেছে তার উপর! আজও না জানি কোনভাবে দেখে ফেলেছে! সেই ভয় নিয়ে নাফিসা সাথে সাথে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাটতে লাগলো। আর এদিকে পেছন থেকে রিসাদ বললো,
– নাফিসা, বিশ্বাস করো। আজও আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। তুমি চলে এলে আমি নির্দ্বিধায় তোমাকে গ্রহণ করবো।
নাফিসার অসহ্য লাগছে তাকে! সে দ্রুত হেটে সামনে এসে একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলো।
সারাদিন খাওয়ার কথাও মনে নেই! কোনো কাজকর্মও নেই! শুধু ঘর ঝাড়ু দিয়ে বারান্দার দরজা চাপিয়ে রেখেছিলো। মেহেদী বাসায় ফিরে দেখলো নাফিসা জানালার পাশে চেয়ারটা নিয়ে হাত পা চেয়ারে তুলে বসে আছে। কেউ যে ঘরে এসেছে সেই খেয়ালই নেই! মাথাটা চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে! মেহেদী কাছে এসে দেখলো চোখ গড়িয়ে বিরতি নিয়ে এক ফোটা করে পানি পড়ছে! তার কাছে কাউকে হঠাৎ দেখে ভয় পেয়ে গেছে নাফিসা! বুকে থু থু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো দ্রুত!
– এখানে বসে আছো কেন?
– কি করবো! কোনো কাজ নেই!
মেহেদী শার্ট খুলে নাফিসার উপর দিলো।
– ঘেমে ভিজে গেছে, ধুয়ে দাও।
– খাবার দিবো?
– না, খেয়েছি।
নাফিসা শার্ট নিয়ে ধুয়ে দিলো। খাবার আর কি রান্না করবে! সকালে যে রান্না করেছিলো সেগুলোই সব আছে। ফ্রিজ থেকে তরকারি নামিয়ে গরম করলো। মেহেদীর কাছে এসে আবার বললো,
– ফ্রিজের ভাত ভেজে দিলে রাতে খেতে পারবে? না পারলে ভাত রান্না করবো।
– ফ্রিজে ভাত কেন? ভাত খাওনি?
– খেয়েছিলাম অল্প।
– কেন? চালের টান পড়েছে?
– না, খেতে ভালো লাগছিলো না তাই খাইনি। নতুন করে রান্না করবো?
– লাগবে না। ওটাই গরম করো।
নাফিসা ঠান্ডা ভাত ভেজে গরম করলো। রাতে খাওয়ার সময়ও তেমন খেতে পারছে না সে! বমি বমি লাগছে তাই খাবার রেখেই চলে গেলো। আবার রুমে এলো। মেহেদী বললো,
– হয়েছে টা কি! বমি হয় কেন? জ্বর কি শেষ হয়নি? নাকি আবার আসছে?
খাওয়ার মাঝেই সে কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর নেই।
– কই, জ্বর তো নেই!
– গ্যাস্ট্রিকে এমনি খারাপ লাগছে। তুমি খাওয়া শেষ করো।
মেহেদীর খাওয়া শেষ হলে নাফিসা সব ধুয়ে গুছিয়ে রুমে এসে দেখলো মেহেদী জানালার পাশে দাড়িয়ে আজও সিগারেট খাচ্ছে! ভালো লাগে না তার এই রূপটা দেখতে! মুখ আটকাতে না পেরে বলেই ফেললো ,
– সিগারেট খাও কেন তুমি? এভাবে তো নিজের শরীরটাকে নষ্ট করে ফেলছো! বাদ দাও না এসব!
মেহেদী নাফিসার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো।
– জানো না তুমি কেন খাই? মাথার ভেতর না অনেক কষ্ট জমা আছে। সেগুলো শেষ করার জন্যই খাই। আর না হলে আমার এই হাতে এতোদিনে মেরে ফেলতাম তোকে। বুঝতে পেরেছিস কেন খাই!
মেহেদী আবারও তার মুখে ধুয়া ছেড়েছে। নাফিসা কাশতে কাশতে সরে এলো। মেহেদী আবার বললো,
– কি অসহ্য লাগে? কষ্ট হয়? আমারও খুব কষ্ট হয় সেই দিন গুলোর কথা মনে হলে! হাজার চেষ্টা করেও পারিনা ভুলতে! মুক্তি পাই না কেন আমি সে কষ্ট থেকে? বলবি আমায়?
নাফিসা আর কোনো জবাব দিলো না। কি বলবে? তাকে বুঝানোর ভাষা তার নেই। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।
চলবে