ভালোবেসেছি তোরই মতো,সূচনা_পর্ব

0
3712

ভালোবেসেছি তোরই মতো,সূচনা_পর্ব
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন

মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে এসে চরমভাবে ঝটকা খেলো নোরিন। একটা ছেলেকে দেখে তার বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। চোখে ঝাপসা দেখছে৷ ছেলেটার সামনে যতবার পরছে ততবারই হাত-পা মৃগী রোগীর ন্যায় কাঁপছে। শ্বাস আটকে বুক ধকধক করা শুরু হয়েছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!!! ছেলেটাকে দেখে তার “দিল ধাক ধাক কারনে লাগা” এর বদলে “কুছ কুছ হোতা হ্যায়” টাইপ ফিল হচ্ছে।নিজের এই পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে নোরিন। এই কথা যদি তার ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ জানে, নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে সবাই৷
একটা ছেলের প্রতি নিজের এই অবস্থা দেখে খুব রাগ হচ্ছে নিজের উপর। নোরিনের মনে পড়ে, যেদিন সে শুভ্র রঙা শাড়ি পরে কলেজ লাইফের প্রথম দিন শুরু করেছিলো, সেদিনই শতখানেক বড় ভাইয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। নোরিন তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে এই কথাটাই বলেছিলো,
—— “আমি আপনাদের নিজের ভাইয়ের নজরে দেখি। নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে এসব প্রস্তাব কোনো বোনই আশা করেনা। ভাই-বোনের সম্পর্ক হচ্ছে হাইড্রোজেন প্লাস অক্সিজেন সম্মিলিত পানির মতো সরল।”

নোরিনের কথা শুনে কিছু ছেলে মাথা হেট করে চলে গেলো। আর কিছু ছেলে ছ্যাছড়া হয়ে তার পেছনেই পরে রইলো। ভাই বলেছে তো কি হয়েছে? ইতিহাস সাক্ষী, ভাই-ভাই সম্পর্কগুলোই প্রেম অব্দি গড়ায়। তারপর বিয়ে। ছেলেগুলো অবশ্য এখনো হাল ছাড়েনি। কখনো ফুল, চিরকুট বা গিফট দিয়ে নিজেদের চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। মেয়ে মানুষের মন। কখন গলে যায় তার ঠিক আছে?
কিন্তু নোরিন তো নোরিনই। সে জানে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ছেলেদের নজর তার দিকে যায়। ক্লাস করার সময় দরজা-জানালা দিয়ে ছেলেরা উঁকি বুকি দেয়৷ স্যারদের মধ্যমণি আর সুন্দরী হওয়ার সুবাদে মেয়েরা তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। নোরিন কারো সাথে কথা বলে না। এতো বন্ধুত্ব,টাইম পাস করার সময় কোথায়? তার স্বপ্ন সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত আর্মি অফিসার হবে। এইসএসসির পরই আবেদন করবে সে। এসব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না।
একদিন কি হলো? একজন কলেজ টিচার নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তার বাবার সাথে করে নোরিনের বাড়িতে এসে হাজির। এদিকে নোরিনের বাবা আজমল আলী সেরনিয়াবাত সাহেবের তো নাজেহাল অবস্থা। মা মরা মেয়ে তার৷ ভয়ে মেয়ের উপর কিছু বলতে পারেন না। বাড়ি এসে এসব শুনলে তো তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে। বিসিএস প্রাপ্ত এতো শিক্ষিত একজন মানুষকে কি বলে ফেরত দেবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও নোরিনের বাবার ঘাম ছুটে গেলো, ওই মাস্টারকে বিদায় করতে। তিনি মনে মনে লোকটাকে এক কঠিন গালি দিলেন, ব্যাটা বেআক্কল! ললিতা আলু, তরমুজের মতো পেট নিয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছিস? সাহস কত!!! কিন্তু বাস্তবে আজমল সাহেব এসব কথার একটিও বলতে পারলেন না৷ তিনি মনে মনে অনেক কিছুই বলেন কিন্তু মুখ দিয়ে, ভেবে রাখা কথার একটি কথাও বলতে পারেন না।

নোরিনের নিজের উপর রাগ লাগছে। কেনো যে এই বিয়ে বাড়িতে আসতে রাজি হলো কে জানে! মা না থাকলে নানাবাড়ির সম্পর্কগুলোও আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যায়৷ সবাইকে অপরিচিত লাগে। নানুমণি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না করলে আসতোই না। এখন এসে ফেঁসে গেছে। এখানে সবাই অবশ্য নোরিনকে আপন করে নিলেও, নোরিন কারো সাথে ফ্রি হতে পারছে না। এরচেয়ে ভালো নিজের রুমে বসে পুরো একমগ গরম কফি আর হাইয়ার ম্যাথ নিয়ে ডুবে থাকা যেতো। এখন যে এই সাদা পাঞ্জাবিওয়ালা ছেলেটাকে দেখে বুকে ব্যাথা হচ্ছে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে কি বাবাকে ফোন করে কথাটা বলবে? না থাক শুধু শুধু চিন্তা করবে। তাহলে কি একটা পেইন কিলার খাবে? পেইন কিলার খেলে ব্যাথা কমে যায়।

নোরিন সত্যি সত্যি পাশের ফার্মেসী থেকে এক পিচ্চিকে দিয়ে পেইন কিলার কিনিয়ে আনলো। ওষুধ খাওয়ার জন্য যখন পানির জন্য টেবিলে গেলো, হুট করে সাদা পাঞ্জাবিওয়ালা ছেলেটা তার হাত থেকে পানির গ্লাসটা কেড়ে নিলো। পানি খেয়ে তারপর হেলতে-দোলতে চলে গেলো। নোরিন বুকে হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ার টেনে বসে পরলো। বুকটা অস্বাভাবিক হারে লাফাচ্ছে, ধকধক করছে। কোনোমতে কাঁপা কাঁপা হাতে আবার একগ্লাস পানি ঢেলে ওষুধটা খেলো নোরিন। আশ্চর্য! ব্যাথা আরো বেড়ে গেলো কেনো? তাহলে কি পেইন কিলারটাও তার সাথে বেইমানি করলো?

নোরিন পা ফেলতে ফেলতে আগে যেখানে ছিলো সেই জায়গায় গিয়ে বসে বসলো। নিজের মন না চাইতেও, তার চোখ ছেলেটার উপর নিবন্ধ হলো। ছেলেটার পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। বুকের ডান পাশে নীল রঙের ছোট একটা নকশা করা। ডান হাত দিয়ে বারবার নিজের চুল ঠিক করছে। ডান দিকে বিট মার দেওয়া চুলগুলোকে বারবার পেছনে ঠেলে দিচ্ছে সে। নোরিনের মনে হলো চুলগুলোকে সে গুনতে পারবে। কালো কুচকুচে চুলগুলোকে সহজেই যে কেউ একটি অন্যটির থেকে আলাদা করতে পারবে। ছেলেটার বুকের দিকটা বেশ চওড়া। ফুলে আছে বেশ। নোরিনের বুকের ব্যাথাটা আবার নতুন করে জাগ্রত হলো। তবুও পর্যবেক্ষণ করা থামালো না সে। ছেলেটা বেশ নাদুসনুদুস, স্বাস্থ্যবান। নাদুসনুদুস বলতে গুলুমুলু না। না মোটা- না রোগা, ছিপছিপে লম্বা জিরাফের মতো। ছেলেটা আচমকা হাসলো, নিমেষেই নোরিনের বুকে ব্যাথা ফুরফুরে প্রজাপতির ন্যায় আকাশে উড়ে গেলো। নোরিন অবাক হলো। যে ব্যাথা পেইন কিলার খেয়েও সারলো না, সেই ব্যাথাটা হঠাৎ নাই-নাই হয়ে গেলো কেনো? ছেলেটার মুখে আকর্ষণীয় দিকটা আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো নোরিন। সফলও হয়ে গেলো অল্পক্ষণের মধ্যে। তা হলো,ছেলেটার চোখ, যেন সবসময় হাসছে। কিন্তু ছেলেটা আসলে হাসছে না। হাসলে চোখদুটো ফুলে যেন গর্তের ভেতর ঢুকে যায়। ফর্সা মুখটা তখন চকচক করে। যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। হঠাৎ সাদ ভাইয়া ছেলেটাকে “নিবিড়” বলে ডাক দিলো। ওহ! তাহলে ছেলেটার নাম নিবিড়। নিবিড় সাদ ভাইয়ার সাথে বাড়ির ভেতর ঢুকে কোথাও যেন গেলো। চাতকের ন্যায় নিবিড় যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো, ততক্ষণই তাকিয়েই রইল।

ছেলেটা কে হতে পারে? নানুবাড়িতে তো এমন কাউকে কোনোদিনই দেখিনি। সাদ ভাইয়া ডাকছিল তারমানে, সাদ ভাইয়া তাকে চেনে। ছেলেটার হাবভাবে মধ্যে কেমন যেন একটা স্মার্ট স্মার্ট ভাব আছে। হাঁটাচলার মধ্যে, কথা বলার ধরণ সবকিছুই এখানকার সবার চেয়ে আলাদা। এই গ্রামীণ পরিবেশে এই শহুরে টাইপ ছেলেটা কে হতে পারে!!!

—– এই হা হয়ে দেখছিস কি তুই? চল হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে আসি ভাইয়াকে।
নোরিন ভাবনায় মগ্ন ছিল। পাশ থেকে জেরুর ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের চেয়ারে তাকালো। জেরু তার আপন খালাতো বোন। দুজনেই প্রায় সমবয়সী। নোরিন বিরক্ত চোখে সামনে তাকালো।
—- ভালো লাগছে না। যাবো না।

—- আরে ফ্যামিলির সবাই যাচ্ছে। তুই যাবি না?

—- এখানে আমাকে তেমন কেউ চেনে না। সমস্যা হবে না।

—- চিনবে কেমনে! বছরে ছ’মাসে তো দুইবার আসিস তাও নানুমণিকে সালাম করতে। খালামণি মারা যাওয়ার পরতো তাও আসা কমিয়ে দিয়েছিস এখন।
নোরিন ভাবলেশহীনভাবে স্টেজের দিকে তাকালো। বড় নানুর প্রথম নাতি প্রফেসর জায়িনুর রহমানকে সবাই হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। জায়িনের মুখ হাসিখুশি। হাতে হলুদ তোলার আগেই মুখটা সেদিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাতে সামনের ব্যক্তির বেশি কষ্ট করতে না হয়। ছেলেটার বিয়ে নিয়ে খুব শখ ছিল।

—– চল…
জেরুর হাত ধরে নোরিন স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে বুটিকের ফুল তোলা সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে আজ সে। বুকের দিক দিয়ে আঁচলটা সুন্দরমতো ভাজ করে সেফটিপিন দিয়ে সুন্দরমতো আটকে দিয়েছে। নাকে ছোট্ট নোলক, কপালে একটা বড় টিকলি দিয়ে, চুলগুলোকে মাঝ বরাবর সিঁথি করে খোঁপার মতো বেঁধেছে। লম্বা আঁচলটাকে একহাতে পেচিয়ে স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই, ছেলেদের মধ্যে একটা চাপা চিৎকার শোনা গেলো। নোরিন আর জেরু জায়িনের দুইপাশে দাঁড়ালো। নোরিনের মুখে হাসি নেই। এখান থেকে চারপাশের সবকিছুকে একনজরে দেখা যায়। তার চোখ খুঁজছে একজনকে।নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটাকে বাড়ির সদর দরজার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায়। দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে, একহাত দিয়ে থুতনি চেপে গল্পে মত্ত সে। নোরিনের রাগ এখন তুঙ্গে। সব ছেলেদের চোখ তার দিকে। কেউ নিজেদের মোবাইল নিয়ে ছবি তুলছে, নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে চাপা গুঞ্জন। এমনকি নিবিড়ের পাশে দাঁড়ানো ছেলেগুলোও তার দিকে নজর দিচ্ছে। আর এই অশান্ত নিবিড় একবার তাকিয়ে এমনভাবে চোখ ফিরিয়ে নিলো যেন নোরিন কিচ্ছু না। যেন নোরিন একটা ধুলোকণাও না। নোরিন একটা বিচ্ছিরি গালি দিয়ে জায়িনকে হলুদ না লাগিয়েই, রাগে গজরাতে গজরাতে স্টেজ ত্যাগ করলো।

চলবে…..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here