ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ২,৩
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ২
স্টেজ ছেড়ে আসার পর নোরিনকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। নোরিন কারো কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমে চলে এলো। ব্যাটা বজ্জাত! বাবার সাথে মিলে ঐ অশান্ত ছেলেটাকে ইচ্ছে মতো গালি দিতে ইচ্ছে করছে। কারো উপর মন বেজার হলে, নোরিন আর তার বাবা দুজনে মিলে একসাথে গালি দেয়। এতে তারা দুজনেই শান্তি পায়।
নোরিন কি মনে করে ফোন আর দিলো না বাবাকে। গোসল করে খানিকক্ষণ বাদেই টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো বাথরুম থেকে। হঠাৎ মনে হলো দরজায় ক্রমাগত কেউ নক করছে। নোরিন স্বাভাবিক পা ফেলে দরজা খুললো। মকবুল দাঁড়িয়ে আছে। মকবুল ছোটবেলা থেকেই তুতলায়। নোরিনকে বললো,
—- আ-আ-ফা আপনাকে ম-মা-মী ডাকতাছে…
মকবুল ঠোঁট বামদিকে কাত করে অতিকষ্টে বলা শেষ করলো। নোরিন মাথা নাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো।
মকবুল দরজা বন্ধ করার পরেও দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটাকে প্রচন্ডরকম ভয় পায় সে। সে তো মামীমাকেও এতো ভয় পায় না। এইতো সেইদিন, মামীমা তাকে ক্ষ্যাতে গিয়ে একটা কচি লাউ তুলে আনতে বলেছিলো। কিন্তু সে লাউ না এনে “ভালোবাসা কারে কই” ছবি দেখতে চলে যায়। উফফ শাবনূর-রিয়াজের কি মাখোমাখো প্রেম! মকবুল বাড়ি ফেরে রাতে। মামীমা বকা দিলেও গায়ে মাখেনি। কাউকে ভয় পায় নাকি সে!!!
বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে এখনো। মকবুল জানিয়েছে আজ সারারাত ধরে গান চলবে। শিল্পী ভাড়া করে এনেছে শহর থেকে। বাড়িতে কেউ নেই বললেই চলে। সবাই গানের ওখানে। নোরিন জিন্স আর অফশোল্ডার টপ পরে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো। মাথায় একটা কমলা রঙের মানকি টুপি। হালকা শীত পরেছে। নানুমণির রুম হালকা ভেজানো। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে কিনা। পানের বাটা সামনে নিয়ে নানু একধ্যানে পান চিবুচ্ছে। ঠোঁটদুটো একেবারে টকটকে লাল হয়ে গেছে। নোরিন একটু শব্দ করলো,
— নানুমণি আসবো?
—- সুন্দরী বানু তুমি আইছো? বুড়িটারে তো ভুলে গেছিস একেবারে।
নোরিন মিষ্টি করে হেসে তার নানুরে জড়িয়ে ধরলো। নানু এবার কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,
— মাঝেমধ্যে আসিস নানুভাই। তোরে দেখলে তোর মায়ের অভাব পূরণ হয়। আজ এমন একটা খুশির দিনে আমার মাইয়াটা আল্লাহর কাছে….
নোরিন চুপ করে আছে৷ বিরক্ত লাগছে তার। এসব কথা শুনলে তার রাগ লাগে। নিজেকে অসহায় মনে করতে চায়না সে।
—- নানুভাই মাথায় কি দিছো তুমি? এখন তো পুতুলের লাখান লাগতাছে তোমারে। ঘরে বইসা রইছো ক্যান? যাও বাইরে গিয়া সবার সাথে মজা করো।
নোরিন কথা বাড়ালো না। গায়ের চাদরের উপর একটা জিন্সের জ্যাকেট পরে বাইরে বেরিয়ে এলো। নানুমণির বয়স হয়েছে। কথার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সাধু- আঞ্চলিক মিশিয়ে তিনি নাতিদের সাথে কথা বলেন।
উঠানের মাঝখানে চেয়ার টেনে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। স্টেজে গানের দলের প্রস্তুতি চলছে। জায়ান ভাইয়াকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। নারকেল গাছের গুঁড়িতে বসে জেরু আর কিছু সমবয়সী কাজিন বসে আছে। নোরিন তাদের পাশে গিয়ে বসতেই,
জেরুঃ এই এটা কে? নোরিন তুই!!! চেন্জ করে ফেললি কেনো?
সাইমাঃ নোরিন তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তোমাকে না আমার বলিউডের আলিয়া ভাটের মতো লাগে। হাসলেই টোল পড়ে। তুমি তো হাসোই না। গায়ের রংও সেইম।
নোরিন মনে মনে আবার বিরক্ত হলো। কারো সাথে তুলনা করলে, তার রাগ হয়। কেনো অন্যের মতো হতে হবে? সে নিজে কি কারো আইডল হতে পারে না? হবে। যেদিন সবাই তাকে আর্মি অফিসার নোরিন আলী সেরনিয়াবাত হিসেবে চিনবে, সেদিন অনেকেই আইডল মানবে।
রাইদাঃ ঐ আজকে না একজনের উপরে ক্রাশ খাইছি।
নোরিন আড়চোখে তাকালো।
জেরুঃ আমিও খাইছি ভাই। বিয়েবাড়ি মানেই হলো ক্রাশ খাওয়ার জায়গা। ক্রাশ খাইতে পয়সা লাগে না। বুঝছিস?
হঠাৎ একটা ছেলে নারকেল গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে “জেরু,জেরু” বলে ডাকতে লাগলো। জেরু ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বললো,
—- কিরে মতিন? ব্যাপার কি?
মতিন কিছু না বলে একটা কাগজ ছুঁড়ে মারলো। জেরু কাগজটা খুলে দেখলো একটা নাম্বার দেওয়া আছে। জেরু ভ্রু কুঁচকে মতিনের দিকে তাকাতেই, মতিন নোরিনের দিকে ইশারা করলো। জেরু একগাল হেসে নোরিনকে নাম্বারটা দিলো। নাম্বারটা দিতেই নোরিনের মুখে হাসি খেলে গেলো। মতিনকে ডাকলো সে,
— মতি ভাই, এদিকে আসেন।
মতি একটা ঢোক গিলে নারিকেল গাছের পেছন থেকে হাত কাচুমাচু করে সামনে এসে দাঁড়ালো। নোরিন দাঁড়িয়ে মতিনের কাঁধে হাত দিয়ে চাপড়ে বললো,
— আমার সাথে প্রেম করবা?
মতিন বারবার ঢোক গিলছে। কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! জেরুরা সবাই মুখ টিপে হাসছে।
— দেখি নিউনের তৃতীয় সূত্রটা একটু বলো। তারপর বলবা, তোমার নানির দাদীর নাম কি? শেষ প্রশ্ন, দাঁতের রং সাদা কেনো, কালো হলে কি সমস্যা হতো? সব প্রশ্নের উপর পারলে তুমি চাকরি পেয়ে যাবে নিশ্চিত।
মতিনের পস্রাবের বেগ এসেছে। হাঁটু কাঁপছে তার। চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ। যেন এইমাত্র বরফগলা পানিতে ডুব দিয়ে এসেছে। নোরিন কাঁধের উপর থেকে হাতটা সরাতেই মতিন ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো। দোয়া দরুদ পড়ে নিজের উপর ফুঁ দিচ্ছে সে।
নোরিন হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। মানুষের সাথে এমন করতে তার ভীষণ মজা লাগে। জেরুরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো অনেকক্ষণ।
আচমকা সাদা পাঞ্জাবিওয়ালা মানে নিবিড় নামের অশান্ত ছেলেটা নোরিনদের সামনে এসে দাঁড়ালো। নোরিনরা তখনো হাসছিলো। নিবিড়কে দেখে নোরিনের হাসি থেমে গিয়ে বুকটা আবার লাফাতে শুরু করলো। জ্যাকেটাকে খামচে ধরে সাথেসাথে পেছনে ফিরে গেলো সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আবার সামনে ফিরলো।
নিবিড়ের হাতে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— হেই গার্লস! সবাই পোজ নিয়ে দাঁড়াও। তোমাদের ছবি তুলব। ট্রেডিশনাল থিং, ভেরি সুইট…
নোরিনের হাত পা এখনো কাঁপছে। নিবিড় ক্যামেরায় চোখ রেখে কি যেন করছে। আর জেরু, মিমহা, রাইদারা একে অপরের কোমরে হাত রেখে সুন্দরমতো পোজ নিয়ে দাঁড়ালো। নোরিনের উত্তেজনায় হাতপা কাপছে। চোখের পলক ফেলছে বারবার। সে কি ছবি তুলবে? জেরুদের সাথে দাঁড়াবে? নোরিন একধরনের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে জেরুদের পাশে দাঁড়ালো। নিবিড় ক্লিক করতে গিয়েও করলো না। ক্যামরাটা নিচে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—- এক্সকিউজ মি?
নোরিনকে উদ্দেশ্য করে বলায় নোরিনের ভুরুও কুঁচকে গেলো আপনাআপনি।
— জ্বি?
— আমি তো তোমাকে বলিনি। রাইদা’দের বলেছি। বাই দ্যা ওয়ে, হু আর ইউ।
নোরিনের বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বললো,
— মানে?
নিবিড় স্বাভাবিক গলায় নেমে যাওয়া পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,
—- আমি তো শাড়ি পরা মেয়েদের ছবি তুলবো বলেছি। যেটা আমাদের কালচার। ওয়েস্টার্ন এসব ড্রেস আজকাল উঠতে বসতে দেখা যায়।
মুহূর্তেই নোরিনের চেহারা পাল্টে গেলো। এতোবড় অপমান? নোরিন সেরনিয়াবাতকে রিফিউজ করে? এতো বড় ক্ষমতা!!! নোরিন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মানকি টুপিটা খুলে লক্ষহীনভাবে ছুঁড়ে মারলো।
নোরিন কি রাগ দেখাবে? তার আগেই নিবিড় হাত দোলাতে দোলাতে চলে গেলো। কিছু করতে না পেরে নোরিন ধপ করে বসে পরলো মাটিতে। ঠোঁট চেপে একদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
জেরু স্বান্তনার সুরে বললো,
— নোরিন কিছু মনে করিস না ভাই। নিবিড় ভাইয়া এমনই।
— ছেলেটা কে?
—- ওহ তুই তো চেনার কথা না। আমি বলছি, উনি হচ্ছেন বড় নানুর ছেলের ছেলে। উনারা তো ঢাকায় থাকতেন। নানুর অমতে বিয়ে করায় এখানে কোনোদিন আসেনও নি। এসব আমাদের জন্মের আগের কথা। জায়িন ভাইয়ার বিয়েতে নানুমণি উনাদের দাওয়াত করেছেন। বড়নানুও তো মারা গেছে সেই কবে। দ্বন্দ রেখে কি লাভ বল! জানিস? নিবিড় ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভবিষ্যৎ কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার।
নোরিন পুরো ব্যাপারটা ভাবলো, তার মৃত নানাভাই টানা তিনবারের চেয়ারম্যান ছিলেন এলাকার। তিনি জীবনে দুটি বিয়ে করেছেন। নোরিন ছোটনানুর নাতি। আর নিবিড় বড় নানুর ছেলের ছেলে। ইট মিনস্, নিবিড় নোরিনের সৎ মামাতো ভাই। ব্যাপারটা ভাবতেই নোরিনের মুখ বিস্ময়ে খেলে গেলো। নিজের মনে আবার আওড়ালো,
—- সৎ মামাতো ভাই…. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওহ মাই গড!
নোরিনের মনে পড়ে না তার নানুবাড়ির কোনো আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তো হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে স্বপ্ন। সারা দেশের স্টুডেন্ট ওখানে পড়ার জন্য পাগল। এতো ক্যান্ডিডেট ওখানে!!! আর এই নিবিড় নামের অশান্ত , অসভ্য ছেলেটা ওখানে টিকলো কীভাবে? নোরিনের নিজেকে এবার বোকা মনে হচ্ছে। ধ্যাত এসব কি ভাবছে সে। পরক্ষনেই নিজেকে এটা বলে স্বান্তনা দিলো এই বলে যে, নোরিনের এই ভার্সিটির উপর দুর্বলতা আছে তাই ভাবছে। কিন্তু যাই হোক না কেন এই নিবিড়কে সে ছাড়বে না। এই অপমানের যোগ্য জবাব সে দেবেই দেবে।
চলবে
#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
_________________________________
রাত বাড়ছে। নিস্তব্ধ কুটিল রাত। বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড় থেকে জংলী শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে। ঘোর অমাবস্যায় চাঁদটাও কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। যেন অমাবস্যায় তার ভীষণ ভয়৷
কাঠের প্রকান্ড দোতলা বাড়ির কোনো এক রুমে নোরিন পড়ছে। বিরবির করে পড়ছে। গায়ে হলুদের সমস্ত ফাংশান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। পুরো বাড়ি এখন গভীর ঘুমে নিদ্রাচ্ছন্ন। চার্জলাইটের আলোটা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের পাতার উপর পরেছে। আলো জ্বালায়নি, পাছে কেউ জেনে যাবে যে, ও এতো রাত অব্ধি জেগে আছে। রুটিন অনুযায়ী ফিজিক্সের এক অধ্যায়ের সমস্ত নৈর্ব্যক্তিকের জন্য বরাদ্দকৃত সময় একসপ্তাহ। আজকেই শেষ দিন অথচ এখনো বেশ কয়েকটা পাঠ ছোঁয়াও হয়নি। যেভাবেই হোক রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে। বাস্তবিক জীবনে না হোক, পড়াশোনায় নিজেকে মোটেও আনস্মার্ট প্রমাণ করতে চায়না নোরিন।
দরজায় টকঠক আওয়াজ হচ্ছে। নোরিনের মনোযোগ বিঘ্নিত হলো। বিরক্তি এড়িয়ে পড়তে শুরু করলো আবার। ঠকঠক করতে করতে একেবারে প্রাণ চলে যাক, তবুও সে দরজা খুলবে না। এদিকে দরজায় ক্রমাগত কেউ বারি মেরেই চলেছে। নোরিন সশব্দে বইটা ঠাস করে বন্ধ করলো। গলার মাফলারটা টিকমতো পেঁচিয়ে কপাল কুঁচকে দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিলো কে আছে দেখার জন্য। নোরিন মাত্রই দরজার ছিটকিনিটা খুলছিলো। পুরোটা আর খুলতে হলো না। অমনি অপরপাশে থাকা ব্যক্তি ধাক্কা মেরে পুরো দরজাটা হা করে মেলে দিলো। নোরিন ‘আহ্’ শব্দ করে দূরে ছিটকে পরলো। চোখ বন্ধ করে কপাল ডলছে সে। এভাবে কেউ ধাক্কা মারে? নোরিন আদোআদো চোখে দেখলো, একটা লম্বা লোক হুড়মুড় করে আর বিছানায় শুয়ে পরছে। নোরিন ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় চেঁচিয়ে বললো,
—- একি, আপনি কে? আমার রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পরলেন যে? নানুমণিকে ডাকবো? নানুমণি……. এই নানু…!!! দেখো চোর বেডে উঠে গেছে…. নান…
আর বলতে হলো না নোরিনকে। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তি উঠে এসে তার মুখ চেপে ধরেছে। নোরিন গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে। আলোর অভাবে লোকটার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। চার্জলাইটটাও টেবিলের উপর৷ তারউপর লোকটার কড়া পারফিউমের গন্ধে নোরিনের গা গোলাতে শুরু করেছে। লোকটা ফিসফিস আওয়াজ করল,
—- এই পিচ্চি চুপ!!! আমি কোনো খারাপ মতলবে আসিনি। তুই তো আমার ফুপ্পির মেয়ে। সো, তোর রুমে আসাই যায়।
নোরিন শান্ত হতেই লোকটা তাকে ছেড়ে দিলো। নোরিন অস্ফুটে বললো,
— নিবিড়….
—- এই নিবিড় কি রে? ভাইয়া ডাকবি আমাকে।
—- নিবিড় ভাইয়া তুমি?
— বেয়াদব তুমি কি? আপনি বল। বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?
নোরিন আপাতত অবাকের শেষপ্রান্তে আছে। তার মনে হচ্ছে, সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। সামনে থাকা ব্যক্তি অর্থাৎ নিবিড় তার সাথে এভাবে কথা বলার কারণ সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তখন তো জেরুদের সামনে অপমান করেছে আর এখন সরাসরি ‘বেয়াদব’ সম্বোধন পেলো!! নোরিন নাকে ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ছাড়ছে। বজ্জাত ছেলে! দেখে মনে হয়না এতো খারাপ ব্যবহার। সমস্যা হলো নোরিনের মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। গলা কাঁপছে। হার্ট ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবলো,
— এই ছেলের সামনে আমি নিজের ব্যক্তিত্ব হারাচ্ছি। নো নোরিন নো! তুই যে এই ছেলের উপর দুর্বল কিছুতেই বুঝতে দিবি না। তুই জানিস না? এইরকম ছেলেরা তোর আগেপিছে ঘুরঘুর করে? নিজের ফর্মে চলে আয়৷ বিহেভ ইউরসেল্ফ।
নোরিন শক্ত গলায় নিজেকে ধাতস্থ করে নিবিড়কে বেরিয়ে যেতে বলবে, তার আগেই নিবিড় বালিশের উপর মাথা রেখে বললো,
—- শোন, রাইদার কাছে জেনেছি তুই আমার ফুফাতো বোন হোস। সো, ঘরের মানুষ যখন এতো ফর্মালিটির দরকার নেই। আমরা আমরাই তো, তাইনা? একটা রুমও খালি নেই। আমি না ভীড় করা রুমে ঘুমাতে পারিনা৷ শুনেছি তোর রুমটা খালি। আমি এখন ঘুমাবো। একটা কথাও বলবি না। ওকে? গুড নাইট।
নোরিন দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করলো। নিজের উপর রাগ লাগছে। কিছুই তো বলতে পারছে না। কিছু বলতে গেলেই এই বজ্জাতটা মুখের উপর কথা শোনাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি চিনে, তার মধ্যেই এহেনো ব্যবহার! বলে কিনা বেয়াদব!!!
অতিরিক্ত অপমানবোধে নোরিন আর নিবিড়কে ডাকলো না। ইচ্ছে হলো না ডাকার। সে বর্তমান পরিস্থিতিটাকে মেনে নিলো। হাট করে খোলা দরজাটা বন্ধ করলো ক্ষীণ আওয়াজে। বাইরের কেউ দেখলে কানাঘুষা শুরু হবে। যেচে বদনাম আনার ইচ্ছে নেই তার।
নোরিন গলা ভিজিয়ে আবার পড়তে বসলো। একধ্যানে সূত্র প্রয়োগ করে ম্যাথ সল্ভ করছে তো, আবার গুণগুণ করে সংজ্ঞা মুখস্থ করছে।
—- যদি বল প্রয়োগের ফলে বলের প্রয়োগ বিন্দু বলের বিপরীতে সরে যায় বা বলের বিপরীত দিকে সরণের উপাংশ….
—– এই বেআক্কল!! এতো জোরে জোরে পড়ছিস কেনো? আমি ঘুমাচ্ছি দেখছিস না? দিলি তো ঘুমটা ভাঙিয়ে?
—- ভাইয়া আমি পড়ছিলাম….
—- আবার বেআক্কলের মতো কথা বলিস! এই তোর কি বিন্দুমাত্র মেনার্স নেই? বুঝেছি আমাকেই ঠিক করতে হবে। মুখে মুখে কথা বললে এবার থেকে কানের নিচে একটা করে পরবে।
লজ্জায়, অপমানে নোরিনের ফর্সা গালদুটো টকটকে লাল হয়ে এলো। সে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার মনে হলো গলাটা কেউ খিঁচে চেপে ধরে আছে। নোরিন উপলব্ধি করলো, সে নিবিড়ের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে। বারবার বোকা বনে যাচ্ছে সে। আরো উপলব্ধি করলো,
—– ছেলেটা চরম অসভ্য এবং বজ্জাত। আদর্শ উদ্ভিদকোষ পেঁয়াজকে যখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে ছোট ছোট লক্ষ লক্ষ কোষ দেখা যায়, তেমনি এই নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটাকেও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখলে প্রমাণিত হবেন,সে একজন আদর্শমানের উৎকৃষ্ট বজ্জাত ছেলে।
রাতটা নোরিন চেয়ারে বসে বসেই কাটিয়ে দিলো। আর নিবিড় বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। ভোর হতেই নিবিড় নিজের রুমে চলে এলো। আর এদিকে নোরিনের ঘুম ভাঙতেই দেখতে পায়, নিবিড় নেই। চলে গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই পারফিউমের গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে এসে লাগলো৷ নোরিন ধরফর করে দাঁড়িয়ে গেলো। কাপড় শুঁকে দেখলো, তার পুরো গা ঐ বজ্জাতের পারফিউমের গন্ধে মাখামাখি। একটা কুৎসিত গালি দিলো আবার নিবিড়কে।
সকালে নাস্তা করতে গিয়েই আরেক বিপত্তি। রান্নাঘরে হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। যে যেখানে পারছে বসে খাচ্ছে। নোরিন কোনোমতে মামীর কাছ থেকে গরুর মাংস,রুটি আর একগ্লাস পানি নিয়ে লেপের উপর কায়দা করে বসলো। এদিকে ভীড় কম।
এদিকে নোরিনের দেখাদেখি অন্যান্য কাজিনরাও তার পাশে গোল করে বসলো। নোরিন বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। হৈ-হুল্লোড় বেড়ে গেছে। হঠাৎ নোরিনের মাথায় একটা চাটি মেরে নিবিড় আয়েশ করে তার পাশে বসলো। জেরু ছিলো নোরিনের পাশে। সে একটু সরে নিবিড়কে বসার জায়গা করে দিলো। নোরিন পানির গ্লাসটা তুলে খেতে যাবে তার আগেই, নিবিড় গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে ফেললো৷ নোরিন রাগে কিড়মিড় করে ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বললো,
—- এই আপনি বারবার আমার পানি খেয়ে ফেলেন কেনো?
উপস্থিত সবাই হতভম্ব। বলে কি মেয়ে….
চলবে