ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ১৭,১৮
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ১৭
চট্টগ্রামের পূর্বে অরণ্য ছোঁয়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ের হাতছানি আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের অনুপম জলের ঢেউ। এর মাঝেই অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী। নোরিন চট্টগ্রাম এসেছে আজ অনেকদিন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো সে খুব সুন্দরভাবে নিয়মমাফিক উপভোগ করছে। ক্যান্টেনমেন্ট এরিয়ায় খুব ধরাবাঁধা নিয়মে নিজেকে বেঁধে নিয়েছে নোরিন। ভোর ছ’টার মধ্যে রেডি হয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছানো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছয় থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়, টানা উঁচু নিচু পাহাড় অতিক্রম, বিভিন্ন ট্রেনিং আবার মাঝেমধ্যে নানা দুর্গম এলাকায় কয়েকরাত অবস্থান করে ব্যবহারিক অনুশীলন আরো শত শত কাজে নোরিন নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাববারও ফুসরত নেই যেন।
ট্রেনিংয়ের এসব কাজ নোরিনের জন্য সাবলীল হলেও অনেকে মাঝেমধ্যে হাল ছেড়ে দেয়। হাপিয়ে পড়ে। কিন্তু নোরিনের কাছে মনে হয়, এই কাজে কখনো বিরক্তি আসতেই পারেনা। যেসব কাজকে আমরা ভালোবেসে সাদরে গ্রহণ করি, সেসব কাজে কখনো অবহেলা এবং একঘেয়েমি আসতে পারে না।
নোরিন ক্যাম্পের সবার কাছে খুব পরিচিত মুখ। অফিসাররা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একজন নন ক্যাডেট কলেজ স্টুডেন্ট হয়েও নোরিনের মাঝে যে মনোবল আর নিষ্ঠা দেখেছেন তা ক্যাডেট কলেজের ভালো ভালো স্টুডেন্টের কাছেও পাওয়া যায়নি। তাদের ভাষায়, নোরিন বেশ ডিসেন্ট একটা মেয়ে। ক্যাম্পের যে কারো বিপদে, বিপজ্জনক ট্রেনিংয়ে সবার আগে এগিয়ে আসে। পারুক না পারুক সে কখনোই মনোবল হারায়নি এ পর্যন্ত। তার পারফরম্যান্স স্কিল এবং বিচারবুদ্ধি যথেষ্ট উন্নত।
নোরিনের কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেছে ইতিমধ্যে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সখ্যতা হয়েছে আলী সারতাজের সাথে। তার সাথে নোরিনের পরিচয়ও অদ্ভুতভাবে। প্রথমদিকে নোরিনের উপর বেশ ক্ষিপ্ত ছিল সে। একজন নন ক্যাডেট মেয়ের কাছে সে কিছুতেই নত হতে চায় না। বেশ অসহ্য লাগতো নোরিন নামের অহংকারী মেয়েটাকে। কিন্তু একদিন একটা দুর্গম এলাকায় ফায়ারিংয়ের সময় অসাবধানে সারতাজের হাত কেটে যায়। এদিকে মেডিক্যাল অফিসারও বেশ দুরত্বে। তখন নোরিনই জংলী এক ধরনের পাতা দিয়ে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচায়।
— আপাতত এটা দিয়ে কাজ হয়ে যাবে। টেন্ডে পৌঁছে ব্যান্ডেজ করে নিও।
সারতাজ বেশ অবাক হয়। তার চেয়ে বেশি অবাক হয় নোরিনের মুখ দেখে। মেয়েটা ভাবলেশহীন মুখে আবার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন শান্ত মুখে শুট করছে যেন কিছুই হয়নি। সারতাজ নামক কোনো প্রাণীর হাত কেটেছে এবং সে সাহায্য করেছে এমন কোনো অভিব্যক্তি তার মুখে নেই। নোরিনের এই ভাবটার জন্যই সারতাজ তাকে অপছন্দ করতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। সারাদিন নোরিনের কর্মকান্ড, মতিগতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারলো, মেয়েটা আসলে এমনই। ভাবগম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের। অফিসারদের সাথেই তার যত কথা। একদিন গ্রাউন্ডে প্র্যাকটিসের সময় নোরিনকে এককোণে দাঁড়িয়ে পানি খেতে দেখে সারতাজ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
নোরিন বোতলে মুখ পুরে আড়চোখে একবার সারতাজের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ, মুখ স্বাভাবিক। সারতাজ পকেটে হাত গুঁজে বলে,
—- তোমার নামের পরে আলী, আমার নামের আগে আলী। আলী সারতাজ-নোরিন আলী। আমরা আলী স্কয়ার।
নোরিন বোতলের ছিপি আটকে সারতাজকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যেতেই সারতাজ সামনে এসে দাঁড়ালো। নোরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—- তো আমি কি করতে পারি?
সারতাজ একহাত বাড়িয়ে বলে,
— সো ফ্রেন্ডস?
নোরিন হালকা হেসে সারতাজকে পাশ কাটিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো, সারতাজ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। নোরিন তার হাতের বোতলটা ছুঁড়ে সারতাজকে এগিয়ে দেয়। একপাশে ঠোঁট প্রসারিত বললো,
— ওকে। উই আর ফ্রেন্ডস ফ্রম টুডে।
নোরিন কথাটা বলে চলে গেলে সারতাজের মুখে হাসি ফুটলো। অস্ফুটে বললো,
—- অদ্ভুত মেয়ে! অদ্ভুত তার বলার ভঙ্গি!
দিন যায়, মাস আসে, বছর ঘোরে। সময় পাল্টালো। একমাসের ছুটিতে নোরিন কয়েকদিন পরেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
বাড়ি পৌঁছানোর আগের রাতে সবাই বেশ হুলস্থুল কান্ড করে বসলো। বাইরে বন ফায়ারের আয়োজন করে নাচ,গান হৈ-হুল্লোড়ে মাতে সবাই। নোরিন একটা বই নিয়ে চেয়ারে বসে আছে। সামনে সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। স্যার আজ সবাইকে ছাড় দিয়েছেন তবে, কোনো উশৃংখল আচরণ করা যাবে না এই শর্তে।
আগুনের জ্বলজ্বল করা আলো খানিকটা দূরে অবস্থান করা নোরিনকে মুখে পড়ছে। লাল আভায় তার মুখ অন্য ধরনের দীপ্তি এনে দিয়েছে। বাতাসের দোলে তার হেয়ার ব্যান দিয়ে আটকানো চুলগুলো একবার এক কাঁধে তো আরেকবার অন্য কাঁধে বারি খাচ্ছে। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়েও নির্বিকার পড়তে লাগলো নোরিন। বইয়ে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
— সারতাজ কিছু বলবে?
সারতাজ উসখুস করছে। নোরিন আচমকা বলে বসলো,
— তুমি আমাকে পছন্দ করো। এম আই রাইট?
সারতাজ অবাকের শেষ প্রান্তে গিয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবাকতার রেশ কাটিয়ে বললো,
— হ্যাঁ, তুমি আমাকে পছন্দ করো না?
নোরিন বইয়ে দৃষ্টি রেখে ছোট করে বললো,
—- না।
সারতাজের বিস্ময় আরো প্রশস্ত হলো। তার সাথে কথা বলার জন্য মেয়েরা মুখিয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে সে ভবিষ্যতে ক্যাডেট অফিসার হবে। ডিসেন্ট, কুল, হ্যান্ডসাম। একটু আগেও একজন মেয়েকে রিজেক্ট করে এলো আর এখন? অবশ্য নোরিনও কম না। মেডিক্যাল অফিসার, ক্যাপ্টেন, প্রশিক্ষকরা পর্যন্ত নোরিনকে আড় চোখে দেখে। একজন নাকি নোরিনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব অব্ধি পাঠিয়েছে নোরিনের অগোচরে। তবুও সারতাজের ধারণা ছিলো, নোরিন তাকে পছন্দ করে। কারণ, কারো সাথেই নোরিন তোমন একটা কথা বলে না। সারতাজ কষ্ট পেলেও মুখ স্বাভাবিক করে কথা চালিয়ে গেলো। বন্ধুত্ব নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না।
—- কেউ মনে আছে নাকি?
নোরিন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
— তোমার কি মনে হয়?
—- আমার মনে হয় কেউ নেই৷
নোরিন হালকা হেসে বললো,
—- ছিলো।
নোরিনের কাছে এমন উত্তর আশা করেনি সারতাজ। বুকে যেন কেউ ছুরিঘাত করেছে। মনটা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে।
—- এখন নেই?
— সেটা বলা যাবেনা।
সারতাজ আবারো হতাশ হলো। কি অদ্ভুত! এতোদিনের বন্ধুত্বেও টের পেলো না কিছুই। নোরিন কত নিখুঁতভাবে নিজের ব্যাপারে সবকিছু গোপন করে গেছে৷ নোরিন মলিন হেসে সারতাজকে ডাকলো,
—- সারতাজ! ভালোবাসা এক অদ্ভুত মায়া। যেখানে নারী এক পুরুষকে অন্য পুরুষ হতে আলাদা করে রাখে আর পুরুষ তার নারীকে৷ আমিও অন্য কাউকে ভাবতে পারিনি।
নোরিনের মুখে ভালোবাসার কথা শোনে সারতাজকে আবারো অবাক হতে হলো৷ আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
— সে তোমাকে ভালোবাসে না?
নোরিন শক্ত কণ্ঠে বললো,
— না। আজ এতোগুলো বছরের পরও আমি তাকে ভুলতে পারিনি। ঐযে বললাম, ভালোবাসা এক মায়া। আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না সারতাজ!
সারতাজের সামনে নোরিন এবার কাঁদতে শুরু করলো৷ নাক টানতে টানতে বললো,
—- আমি তাকে অসংখ্যভাবে ভালোবেসেছি সারতাজ,অসংখ্যবার ভালোবেসেছি, এক জীবনের পর অন্য জীবনেও ভালোবাসবো, বছরের পর বছর, সর্বদা,সবসময়।
সারতাজের চোখও ভিজে এলো। চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে কাঁদতে দেখে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। নোরিনকে এমন ব্যাকুল হয়ে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি সে। অবশ্যই নোরিনকে রিজেক্ট করার ক্ষমতা কারো নেই। কারণ নোরিনের খুঁত ধরার মতো কিছুই নেই। কাজেকর্মে, গুণাবলিতে সে পারদর্শী। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বলতে গেলে, নোরিন অপরুপ। সারতাজের এই মুহূর্তে সেই মহামানবকে স্বচক্ষে দেখার তুমুল ইচ্ছা জাগলো।
—- আমি তার সাথে দেখা করতে চাই নোরিন। আমি তাকে বুঝিয়ে….
নোরিন যেন গর্জে উঠলো,
—- কক্ষনও না! তোমাকে আমি শুট করবো। জেনে রেখো, যদি তুমি কোনোদিন বলো, সেদিনই আমাদের বন্ধুত্বের শেষদিন।
সারতাজ ভয় পেয়ে গেলো। পরক্ষণেই শান্ত কণ্ঠে বললো,
— তুমি তোমার এই জীবন নিয়ে হতাশ নও?
নোরিন ব্যঙ্গাত্বক হাসলো। নিজেকে সামলে নেওয়ার অপূর্ব দক্ষতা নিয়ে সে শান্ত স্বাভাবিক মুখে আকাশে চোখ রাখলো,
— আমি আমার জীবন নিয়ে কখনোই হতাশ হয়নি সারতাজ। কে বলতে পারে, হয়তো আমার মতো জীবন পাওয়া অনেকের কাছে স্বপ্ন? আমি নিজেকে নিয়ে খুব কমবারই আফসোস করেছি৷ ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে, প্রত্যেকটা সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছি আমি। আজকের যে কাজগুলো করতে তুমি ভয় পেয়ে ছেড়ে দিলে, একদিন পেছন ফিরে দেখবে এবং বুঝবে, যে সুযোগগুলো হাতছাড়া করেছো, তা নিয়েই অনুতপ্ত হচ্ছো বেশি।
———————-
নোরিন বাড়ি ফিরেছে আর দুদিন হলো। নিবিড় হাজির একদিন। নোরিন বাবা অফিসে। নোরিন গার্ডেনের পানি দিচ্ছিলো আপন মনে৷ নিবিড় পেছন থেকে নোরিনের ঝুটি টেনে ধরলো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে পেছন ফিরলো নোরিন। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তার৷
চলবে…..
#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
নোরিন বাড়ি ফিরেছে আর দুদিন হলো। নিবিড় হাজির একদিন। নোরিনের বাবা অফিসে তখন। নোরিন গার্ডেনের পানি দিচ্ছিলো আপন মনে৷ নিবিড় এসে পেছন থেকে নোরিনের ঝুটি টেনে ধরলো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে পেছন ফিরলো নোরিন। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তার।
কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর নোরিন ডানহাতে নিবিড়ের হাত মচকে ধরলো। আর্মি ট্রেনিংগুলো এতোদিন পর কাজে এসেছে তার। চোখ গরম করে বললো,
—- নেক্সট টাইম এমন করার সাহস দেখাবেন না নিবিড় ভাইয়া। সময় বদলে গেছে। আমি এখন আর আগের মতো নেই।
নোরিনের ইঙ্গিত করা কথাটা খুব সহজে বুঝে ফেললো নিবিড়। হালকা হেসে সর্বশক্তি দিয়ে অপর হাত দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
—- বুঝলাম তুই অনেক কিছু পারিস। কিন্তু নিবিড়ের শক্তির কাছে তোর শক্তি কিছুই না। তুই সেনাবাহিনীতে যা, আর পাতিবাহিনীতে যা, তুই একটা মেয়ে৷ মেয়েদের শক্তি ছেলেদের তিনভাগের এক ভাগ।
কথাটা বলে বেশ আরাম করে নিবিড় পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। নোরিন চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, যেটা একটু আগেই নিবিড় মুচড়ে ধরেছিলো। এর মাথা বরাবর ফোকাস করে ফায়ার করা উচিত। এতো বড় সাহস!!! নোরিন ভ্রু নাচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো,
—- আপনি জানেন? আমি এখন একজন ক্যাডেট। কয়েক বছর পরই অফিসার হয়ে বের হবো। এখন থেকেই আমাদের নিরাপত্তার জন্য বডিগার্ড দেওয়া হয়েছে। ওদের কাঁধে সবসময় বন্দুক ঝুলানো থাকে। নেহাৎ আমি এখন বাড়িতে নাহলে, ওরা এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে, আপনার এই বেয়াদবির জন্য, তাদের মিনিমাম দশ বারোটা চড় আর লাথি আপনার কপালে জুটতোই। আর….
নিবির নোরিনকে আর বলতে না দিয়ে নিজের হাসি আরো প্রশস্ত করে বললো,
—- হ্যাঁ জানি তো, ওদের কাজ কি! এ বলদ বডিগার্ড তোকে পাহারা দেয় সবসময়। তুই বাথরুমে গেলেও বলদ দুটো তোর সাথে থাকে। একজন দরজার ছিটকিনি খিল দেয়, আরেকজন টয়লেট টিস্যু পেপার হাতে…..
নোরিন নিবিড়ের মুখ চেপে ধরলো। কি পরিমাণ অসভ্য হয় মানুষ! কি চরম বেয়াদব হলে মানুষের মুখ এমন লাগামহীন হয়! অপমানে নোরিন গাল লাল করে বললো,
—- আপনি এখান থেকে চলে যান। নোরিন আলী সেরনিয়াবাত এখন এসব ছোটখাটো বিষয়ে সময় নষ্ট করেনা। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
নিবিড়ও এবার রেগে গেলো। নোরিনের দিকে তেড়ে এলো সে,
—– কি বললি তুই? কাজ শেখাস আমাকে? তুই কি করেছিলি তোর মনে নেই? আমি কেন এসেছি তুই জানিস না? এতোবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম তুই ইগনোর করে গেছিস। কমসেকম বিশবার খানেক সেনানিবাসে গিয়েছি। তোর জন্য আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতিপত্র পর্যন্ত দেয়নি ওরা। তুই নাকি নিবিড় নামে কাউকে চিনিসই না! মজা নিস আমার সাথে?
নোরিন নিবিড়কে পাত্তা না দিয়ে পানির ঝাঁঝরি তুলে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। নিবিড় আবার সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো,
—- আলি সারতাজ কে? ফেইসবুকে দুইজন তো বেশ রঙ মাখামাখি করে ছবি ছাড়ছিস। আবার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস, উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস? তুই আজ আমার উত্তর না দিয়ে যেতে পারবি না নোরিন।
—- আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই। বুঝতে পেরেছেন?
—- সারতাজের সাথে কথা বলবো আমি!
—– আপনাদের মতো জঘন্য মানুষদের সাথে সে কথা বলেনা।
—- তুই এমনভাবে বলছিস যেন আমি রাস্তার কুকুর! কি মনে হয় তোর আমাকে? তুই সেনাবাহিনীতে গিয়ে অনেক বড় কিছু হয়ে গেছিস? আমি কয়েকদিন পর আমেরিকা চলে যাবো এমআইটিতে। কোটি টাকা স্যালারি হবে আমার।
নোরিন এবার টোল পরা হাসি নিয়ে বললো,
— তো? আমি কি করবো? আপনার এই সফলতার গল্প অন্য কাউকে শোনান প্লিজ!
নিবিড়ের চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কপালের রগ টনটন করছে। লাথি মেরে সে বাগানের একটা টব ভেঙে ফেললো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলো।
—- জানতাম কথ বলবি না। ত্যাড়ামো স্বভাব তোর। এখন এটা দয়া করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়।
নোরিন নিতে না চাইলে নিবিড় জোর করে তার হাতে পোরে দেয়। নোরিন হাত মুঠ করে দৌড়ে নিবিড়কে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে, একেবারে নিজের রুম বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। অনেক বড় সাহসের কাজ করে ফেলেছে আজ। হাত মুঠ থেকে কাগজটা ধরে, একেবারে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে কাগজটাকে পুড়িয়ে ফেললো সে। পড়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করলো না। সময় পেরিয়ে গেছে। এসব পড়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না। এতোটাও স্বস্তা নয় সে। নিজেকে আর দুর্বল করবে না কোনো মতেই। ঐশ্বরিক হাসি নিয়ে নোরিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
এদিকে ক্রমাগত দরজায় বারি দিয়ে যাচ্ছে নিবিড়।
— নোরিন পড়েছিস তুই?
— দরজা খোল….নোরিন!!!
— প্লিজ দরজাটা খোল নোরিন! আমি সরি….
দরজা ধাক্কানোটা নোরিনের কাছে একটা টিউনের মতো মনে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি সে ঘুমের অতলে ডুবে গেলো।
নোরিনের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন পুরো রুমে অন্ধকারের রাজত্ব। জানালা খোলা, মশা অনায়াসে নাচতে নাচতে ভেতরে ঢুকছে। নোরিন সবকিছু ঠিকঠাক করে নিচে নামলো। ডিনারের টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। লাইলাকে টেবিলে খাবার সাজাতে দেখা গেলো। বাবা টিভি অন রেখে বই পড়ছে মনোযোগ দিয়ে। বাইরে বজ্রপাত হচ্ছে। একটু পরপর প্রকট আওয়াজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টি নামলো বলে! লাইলার কাছে জানতে পারলো, নিবিড় অনেক আগেই চলে গেছে। যাওয়ার সময় নাকি নিবিড়কে কাঁদতেও দেখেছে। ভীষণ হাসি পেলো নোরিনের। নিবিড় কখনো কাঁদতেই পারে না। লাইলা সবসময় ভুল ভাল দেখে। সেদিন বললো, সে নাকি ভূত দেখেছে। গাছের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো সাদা শাড়ি পরে। এটাও নিশ্চয় তেমনি ভুল ছিলো!
নোরিন আজমল সাহেবকে ডাকতে গেলো,
—- বাবা খাবার রেডি। চলে এসো।
আজমল সাহেব বিনা বাক্য ব্যয়ে ডাইনিংয়ে গেলেন। নোরিন প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললো,
—- অফিস কেমন কাটলো আজ?
আজমল সাহেব আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,
—- আজ অফিসে কি হয়েছে শুনলে তোর হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবে।
—- তাই? কি হয়েছে শুনি।
—- দুপুরে তাজউদ্দীনকে বললাম আমার সাথে লাঞ্চ করতে। বেচারা তো ভয়ে শেষ! আমিও জানতাম না সে রোজা আছে। খাওয়ার পর রীতুর কাছে শুনি সে রোজা ছিল, ভয়ে ‘না’ বলতে পারেনি।
— এটা মোটেও কোনো হাস্যকর ব্যাপার না বাবা! খুব খারাপ হয়েছে উনার সাথে।
আজমল সাহেব অপরাধীর সুরে বললেন,
— আমি কি জানতাম! সবাই হাসছিলো। গরুটা আমাকে একবার বললেই পারতো! সারাদিন গাধার মতো ঘুরবে, টু টু করবে, কিছু বললেই লাজুক হাসবে।
নোরিন ফিক করে হেসে দিলো। বাবা মানুষটায় অদ্ভুত।
—- আচ্ছা তোর ট্রেনিংয়ের কথা বল। আমি একটু শুনি।
নোরিন মাথা কাত করে কিছু ভাবার চেষ্টা করলো। বাবাকে কি বলা যায়?
—- নতুন নতুন ওখানে গিয়ে একদিন কি হলো জানো? সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছিলাম। শাস্তি হিসেবে ম্যাম পুরো দু’ঘন্টা কড়া রোদে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। এরপর আমি আর এমন ভুল করিনি। আরেকবার ক্যাম্পিংয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলাম, একজনকে একেক দায়িত্ব দেওয়া হলো। মূলত ওখানে গিয়েছিলাম একটা প্র্যাকটিসে। ‘অনুশীলন লালঘোড়া’ নাম বলে। এটার মানে হলো, সব ক্যাডেটদের শত্রুসীমার ভেতরে থেকে নিজ বাহিনীর সাহায্য ছাড়া কীভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা যায়, তা ব্যবহারিকভাবে শিক্ষা দেওয়া৷ স্যার আমাকে এই দায়িত্বটা দিয়েছিলো বাবা। তুমি ভাবতে পারছো? এতোজন থাকতে তারা আমাকেই লিডার বানালো। আমি অপারেশনটা সাকসেসফুলি কভাব করতে পেরেছিলাম৷ স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ” মিস জেন্টলওম্যান! নোরিন আলী সেরনিয়াবাত ইউ আর দ্যা বেস্ট। ” আমার তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেলো!
নোরিন অনর্গল বলেই যাচ্ছে। বাবার সামনে তার কথার বাঁধ বেঙেছে যেন আজ। তার চোখেমুখে এক অন্য ধরনের দ্যুতি খেলা করছে। আজমল সাহেব ছলছল করে গর্বভরা দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেলো।
—- মা! ভালোবাসিস কাউকে?
নোরিন একটা ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকালো। বুকে যেন কে পাথর বেঁধে রেখেছিলো। কষ্ট কমাতে এতো কথা বলছিলো এতোক্ষণ বাবার সাথে। বাবা কি কিছু বুঝে গেলো নাকি? চামচ নাড়াতে নাড়াতে বললো,
—- না বাবা। আমি কাউকে ভালোবাসিনি।
—- আমি তোমার বাবা। চিনি তোমাকে। একটা কথা মনে রাখবে, পছন্দের জিনিসকে সময় থাকতে নিজের করে নিও। দেরি যেন না হয়… জীবনটা খুব ছোট। তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো। আমি তোমাকে বাঁধা দেবো না।
নোরিন কান্না মুখে বললো,
— তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন বাবা?
— আশ্চর্য! আমার মেয়েকে আমি ভালোবাসবো না?
চলবে