ভালোবেসেছি_তোরই_মতো পর্বঃ১৯,২০

0
2729

ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ১৯,২০
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ১৯

রাত বাড়ছে। গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন সবাই। রাতের সাথে তাল মিলিয়ে বাইরে বৃষ্টির বেগও বাড়ছে যেন। নোরিনের দৃষ্টি জানালা ভেদ করে বাইরে নিবন্ধ। দৃষ্টি সেদিকে থাকলেও মন অন্য অভিসারীতে। চোখেও বর্ষণের ছোঁয়া। সবকিছু ছেড়ে ছোড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার৷ ফর্সা গালে লাল আভা সৃষ্টি হয়েছে। কান্নার তোড়ে গলার খাদে গর্ত সৃষ্টি হয়ে আবার পরিপূর্ণ। চোখের বড় বড় পাপড়ি পানির ছোঁয়াতে একজোট হয়ে হয়ে যেন বলছে, ‘কান্না থামাও নোরিন। কান্নাতে তোমায় না। ভুলে যাও তাকে। ছুঁড়ে ফেলে দাও। অতীত নিয়ে বাঁচতে গেলে সামনে এগুতে পারবে না। তোমার লক্ষ্য যে অনেক দূরে। প্রেম-ভালোবাসা সবার জন্য আসেনি। ‘
নোরিন নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। খুব কি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে নিবিড়ের সাথে আজ? খুব বেশি বলে ফেলেছে? নোরিনের মস্তিষ্ক আন্দোলন করলো,
—- না! তুমি কোনো ভুল করোনি। হয়তো আজও তোমাকে কোনো না কোনোভাবে কষ্ট দিতো। হয়তো আবার তোমাকে ছোট করতো। তুমি নিজের মনোবল হারাতে পারতে৷ নিবিড় শুধুই তোমার অতীত৷ তুমি এতো স্বস্তা নও। তোমার ভালোবাসাকে যদি সে তোমার দুর্বলতা ভেবে থাকে, তাহলে তাকে বুঝিয়ে দাও তুমি কি পারো আর কি পারো না। ‘

নোরিন চোখ বন্ধ করে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে কাতর হয়ে আপনমনে বলতে লাগলো,
—- এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? এতোদিন পর সে কি আশা করে এখানে এসেছে? তাকে দেখলেই আমার অতীত মনে পড়ে যায়, নিজের মন ভাঙার গল্পটা মনে পড়ে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। কেনো আমি এমন? আমি তাকে ভুলতে পারিনি। কি করবো আমি? আমি কোনো মায়া রাখতে চাইনা। না পারছি তাকে সহ্য করতে…..

আলতো ছোঁয়ায় চোখের চাওয়ায়
পাওয়া না পাওয়া কি যে নেশা
সেই স্মৃতিটা আজো হাতড়াই,
হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা।

পরদিন,
সকালে পুরো এলাকা জগিং করে এসে নোরিন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরলো। তার চোহারা নির্লিপ্ত। গতরাতে সে যে প্রাণ উজাড় করে কেঁদেছে, চেহারায় তার কোনো ছাপ নেই। খুব সুন্দর হেসে গার্ডেনের ফুলে পানি দিলো, গাছের অতিরিক্ত অংশ কাটিং করলো ফুরফুরে মেজাজে। বাগানের মালির সাথে কিছুক্ষণ কথাও বললো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে নোরিনকে। ভীষণ সুন্দর এক অপরুপ রুপসী শহুরেকন্যা যেন বাগানে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।

একটুপর ঘরে ঢুকতেই, ডাইনিংয়ে তার বাবাকে বসে থাকতে দেখা গেলো। নোরিন ভালো করে তাকালোও না, দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতো উঠতে বললো,
—- বাবা জাস্ট পাঁচ মিনিট। আমি ছোটখাটো একটা শাওয়ার নিয়ে আসছি। তুমি খাওয়া শুরু করো।

আজমল সাহেব হালকা হাসলেন,
—- আমি একা কোথায়! নিবিড়কে দাওয়াত করেছি। আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।

নোরিন হাঁটা থামিয়ে অবাক হয়ে টেবিলে ভালো করে তাকালো। বাবার অপর প্রান্তের চেয়ারে নিবিড় চুপচাপ বসে আছে। নোরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের চলে গেলো সে। শাওয়ার না নিয়েই সে টেলিফোনে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। তাদের বাংলোটা পুরোনো ধাঁচের। টেলিফোন ছাড়াও অারো অনেক পুরোনো আমলের জিনিস রয়েছে। আজমল সাহেব রিসিভ করেই বললেন,
— কি ব্যাপার? ডাইনিং থেকে তোমার রুমের দুরত্ব কি খুব বেশি দূরে?

—- বাবা, নিবিড় ভাইয়াকে তুমি দাওয়াত করেছো কেন?

—- লাইলা বললো নিবিড় গতকাল এসেছিলো। আমি দেখা করতে পারিনি। ভাবলাম আজকের লাঞ্চ একসাথে করি। তাড়াতাড়ি নিচে এসো। আমরা অপেক্ষা করছি।

নোরিন গলার আওয়াজ খানিকটা খাদে নামিয়ে বললো,
—- আমি আসতে পারবো না।

—- কেনো কোনো সমস্যা?

—উফফ বাবা! তুমি বুঝবে না…
নোরিন বিরক্তি নিয়ে একটা,দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ভাবগম্ভীর মুখে শাওয়ার নিয়ে নিচে নামলো। নিবিড়ের দিকে না তাকিয়ে, আজমল সাহেবের পাশে বসে খেতে লাগলো। পুরো টেবিলময় নীরবতার ছায়া৷ কেউই বাড়তি কোনো কথা বলছে না। আজমল সাহেব দু-একবার ভাব জমানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু দু’পক্ষের কোনো সাড়া পেয়ে, তিনিও চুপ করে গেলেন৷ একপ্রকার গুমোট পরিস্থিতিতে সকালের নাস্তা শেষ করলো তারা।

বেলা তখন বারোটার ঘরে। নোরিন নিজের রুমে বসে মোবাইলে স্ক্রল করছিলো। তখনি আজমল সাহেব খবর পাঠালেন, নোরিনকে নিচে নামতে। নোরিনের প্রচন্ড রাগ লাগছে। ঐ নিবিড়ের সামনে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে আসাই ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। মোবাইলটা বেডে ছুঁড়ে, সে নিচে নামলো। জোরপূর্বক হাসলো সে। বাবাকে কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
—- বাবা ডাকছিলে?

—- হ্যাঁ। আমি বাজারে যাচ্ছি আজ। জেলেপাড়ার কয়েকজনকে ইলিশ মাছের কথা বলে রেখেছিলাম৷ ছেলেটা এতোদিন পর এলো! তুমি নিবিড়ের সাথে থাকো। গল্প করো৷ আমি ড্রাইভারকে নিয়ে যাচ্ছি।

নোরিন বাঁধা দিতে চাইলো,
— বাবা এতো গরমে তুমি যেওনা। আমি যাই?

—- না, অনেকদিন বাজারে যাওয়া হয়না। আজ নিবিড়ও এলো। জম্পেশ খাওয়া হবে। তুমি খেয়াল রেখো, ওর যাতে একা না লাগে।

আজমল সাহেব চলে গেলেন৷ নোরিনের নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। বিরক্তি নিয়ে একটা সোফায় ধপ করে বসে আড়চোখে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় একমনে রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। ভাবমতি এমন যেন, নোরিনকে সে চেনেই না। নোরিনও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো।

অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো। নোরিনের সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন টিভির দিকে। একটা নিউজ চ্যানেলের হেডলাইনে মনোযোগ ঢেলে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ অনুভব করলো, পাশের সোফায় কেউ বসেছে। নোরিন সতর্ক হয়ে পাশে তাকালো।
—- এতো জায়গা থাকতে আমার পাশে কেন বসেছেন? চোখে দেখেন না?

নিবিড় ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
— চোখ আছে বলেই, এতো জায়গায় মধ্যে, আমার ইচ্ছে মতো একটা জায়গা সিলেক্ট করলাম।

নোরিন মুখ কুঁচকে আবার টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো। অস্বস্তি হচ্ছে তার৷ কারণ নোরিনের মনে হচ্ছে, নিবিড় তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড় টিভি অফ করে দিলো। নোরিন তবুও কাঠ হয়ে বসে, টিভির দিকেই তাকিয়ে আছে। বুকে অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে। পারলে এক্ষুনি খুন করতো তাকে।

—- নোরিন আমার দিকে তাকা।

নোরিন সামনে তাকিয়েই জবাব দিলো,
— কি হয়েছে?

নিবিড়ের দীর্ঘশ্বাস নোরিনের কানে এলো।
—- ভালোবাসিস কাউকে?

নোরিন স্পষ্ট গলায় বললো,
—- আমি কাউকে ভালোবাসিনি নিবিড় ভাইয়া। ভালোবাসবো না কাউকে। ভবিষ্যতেও না।

নিবিড় সোফার পেছনে মাথা এলিয়ে বসানো গলায় বললো,
—- তুই তাহলে চিঠিটা পড়িসনি? আমিতো ভেবেছিলাম….

— কি ভেবেছিলেন? আমাকে আবার অপমানিত করা যায় কি-না? আমাকে কীভাবে ছোট করা যায় তাইনা?
নোরিন সরাসরি নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় আজ একটা ধূসররঙা শার্ট পরে এসেছে। মুখের শেইপ অনেকটা ধারালো, তারউপর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখগুলো এমন যেন সবসময় হাসছে, গায়ের রঙ ছেলে হিসেবে ভীষণ সাদা। ভ্রুতে একটা নিখুঁত কাটা দাগ খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা দুটো সোফার সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে। নোরিনের মনে হলো, এমন লম্বা ছেলে পুরো সেনানিবাস এলাকা ঘুরলেও একটা পাওয়া যাবে না। নোরিন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে আবার সামনে চোখ রাখলো।

—- আমি জানতাম তুই কাউকে ভালোবাসিস। এখন বাসিস না? হঠাৎ এতো পরিবর্তন। কিন্তু কেন?

নোরিন নিজেকে সামলাতে চাইলো। গলা বেয়ে উঠে আসা কান্নার দলাকে সে কঠোর রুপে দমন করলো,
—- বাসতাম নিবিড় ভাইয়া, এখন না। যে আমার শরীরে কলংকের দাগ খুঁজে বেড়ায় তাকে কীভাবে ভালোবাসা যায়? তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। বেহায়া হয়ে গিয়েছিলাম আমি, বারবার তাকে বুঝাতে, তার দোয়ারে হাজির হয়েছিলাম কিন্তু সে বারবার আমাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিল।অন্য করো ভুলের কারণে আমাকে দূরে ঠেলে দেয়, নীরব প্রত্যখ্যান করে বারবার। আমি বুঝতাম তবুও মন সায় দেইনি। সে যে আমার প্রথম এবং শেষ আবেগ ছিলো। যে আমার কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগকে দূরে ঠেলে দেয়, তার সামনে কেন নিজেকে ছোট করবো? যাকে ঘিরে সাজিয়েছিলাম আমার অন্য এক পৃথিবী; হাজারটা রাত সাক্ষী, আমার চোখ সাক্ষী; কীভাবে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমি ঘুমাতে পারতাম না নিবিড় ভাইয়া! আমার সময় এক জায়গায় থমকে ছিলো। কথায় আছে না, কারো সময় কাটে না আর কারো সময় থাকে না। আমি কাউকে বলতে পারিনি সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা, ভেতরে শত-শতবার মরে গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আমার স্বপ্নই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো। আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলো। আর আমি আজকের নোরিন আলী সেরনিয়াবাত। আমি এখন কিশোরী বয়স পার করে এসেছি। বুঝতে শিখেছি, নিজেকে সামলে নিয়েছি। কোথাও হয়তো আজোও দুর্বল। তবে, নিজের দুর্বলতা কীভাবে লুকাতে হয় তাও রপ্ত করেছি। এতোকিছুর পর সে আমার কাছে কি আশা করে?

—- নোরিন…..

নিবিড়ের স্বরেও নোরিন ফিরলো না। আচমকা নোরিন ঘুরে বসলো। সরাসরি চোখ রেখে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড়ও একমনে তাকিয়ে আছে। নোরিন গলা নামিয়ে বললো,
—- নিবিড় ভাইয়া আমার একটা কথা রাখবেন?

নিবিড় মিশ্র কণ্ঠে বললো,
— তুই যা বলবি তাই করবো…

—- প্লিজ আপনি চলে যান। অনেকদূরে চলে যান যাতে আপনি-আমি চাইলেও একে অপরের মুখ দেখতে না পারি। আমার কথাটা রাখবেন?

নিবিড় পাথর হয়ে গেলো যেন। থমথমে গলায় জবাব দিলো,
—- আচ্ছা, চলে যাবো। কালই ইউএসএ চলে যাবো।

—- সত্যি নিবিড় ভাইয়া?

—- কছম চলে যাবো। তোকে আমার মুখ আর দেখতে হবে না। তোকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি।

নিবিড় নোরিনের মাথা ছুঁয়ে, ড্রয়িংরুম পেরুলো, তারপর সদর দরজা পেরিয়ে গমগমে পায়ে চলে গেলো। নোরিনের মুখে তখন হাসি থাকলেও, এখন কান্নার বাঁধ ভেঙে পড়লো। চোখভর্তি জল নিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেলো। সে আজও বুঝলো না তাকে….

চলবে

#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ২০
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন

নিবিড়ের চলে যাওয়ার অনেকদিন হয়ে গেছে।কয়েকটা হেমন্ত পেরিয়ে গেছে, শীত ছাড়িয়ে বসন্তও পালা করে চলে গেছে। সময়ের সাথে সবকিছুকেই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কারো জন্য, কারো জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকেনি কখনো।
নোরিনের জীবনকে সে থেমে থাকতে দেয়নি। তার অসাধারণ কৃতিত্বের জোরে অনেকআগেই সে, সর্বোচ্চ রেঙ্ক নিয়ে তার দীর্ঘমেয়াদী কোর্স সম্পন্ন করেছে। কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পরও তার সফলতা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন মিশনে নেতৃত্বদান, দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ দমনে অভিযান, নিজ দেশের প্রতিনিধি হয়ে নারী অফিসার হিসেবে বেশ কয়েকটি দেশেও ইতিমধ্যে নিজের সাফল্যের ছাপ রেখেছে সে। বেশ কয়েকবার পদোন্নতি হয়েছে হয়েছে তার। জীবনের অনেকগুলো বছর সে এভাবেই কাটিয়ে দিলো। পরিস্থিতিকে সে মানিয়ে নিয়েছে।
নোরিন এখন এক পরিপূর্ণ যুবতী। অপরুপ সৌন্দর্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহারণ। এতো কসরত, খাটনিতে তার সৌন্দর্যে এতটুকুও ভাটা পড়েনি। সবার কাছে সে নির্মল, স্বচ্ছ, সাহসী এবং সকলের কাঙ্ক্ষিত। তার অকুতোভয় সাহসে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করে, “ম্যাম, আপনার কি একটুও ভয় নেই? প্রায় সব মিশনে আপনাকে দেখা যায় সবার আগে আওয়াজ তুলতে, এগিয়ে আসতে বিশেষ করে আপনার শুটার স্কিল; যা সত্যি অসাধারণ। আপনার সমসাময়িক অনেক অফিসারেরই আপনার জায়গায় আসতে পুরো জীবন লেগে গেছে। কিন্তু আপনি? ”
নোরিন তখন মুখ উঁচু করে বলে, “তারাই পিছিয়ে পড়ে, যাদের পিছুটান আছে। যা আমার নেই। অনেক ত্যাগের পর এই জায়গায় আসতে পেরেছি।”

সারতাজ আর নোরিনের বন্ধুত্ব এখনো আগের মতোই আছে। তবে দুজনের দেখা খুব কম হয়। কোনো এক অজানা কারণে সারতাজের জীবনে এখনো পর্যন্ত কোনো নারীর আগমন ঘটেনি। নোরিনও এই ব্যাপারে কোনো কথা বলেনা। এড়িয়ে যায় সবসময়। একদিন সারতাজ নোরিনের পাশে বসে প্রায় কেঁদে ফেললো। নোরিন তখন পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে শুধু বললো,
—– সারতাজ তোমার বিয়ে করা প্রয়োজন। বিয়ে করে ফেলো। কারো অপেক্ষায় বসে থেকোনা, যার জন্য অপেক্ষা করছো, হয়তো সেও এভাবেই কারো জন্য অপেক্ষা করে।

সারতাজ অবাক না হয়ে পারেনা। সেই শুরু থেকে এই মেয়েটা শুধু তাকে অবাক করেই গেছে। অদ্ভুত তার সঙ্গ। তার যেটা মনে হবে, হুট করে সেটাই বলে বসবে। সবই বুঝে তবু, বুঝতে চাইবে না৷

ইদানীং বাবা ভীষণ চাপ দেয়। সেদিন নোরিন বাড়িতে গেলো। তিনি মেয়ের সামনে প্রায় একঘণ্টা যাবত হাত ধরে বসে রইলেন। বিয়ে করলে কি কি ফায়দা হয়, ব্যাখ্যা করে শোনালেন,
—- মা, তুই বিয়েটা করে নে। অনেক হয়েছে।

নোরিন আরো মনোযোগের ভঙ্গিতে বলে,
— বাবা আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে, আমি আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পারবো না। আমার আরো অনেকদূর যেতে হবে৷

আজমল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
—- সব তোর বাহানা।

নোরিন কিছু বলেনা। মুচকি হাসে৷ বাবাকে তো বলায় হবে না, সে কোনোদিন বিয়ে করবে না। সুখ তার কপালে নেই। নিবিড়ের সাথে তার কোনোপ্রকার যোগাযোগ নেই। ইউএসএ’তে যাওয়ার পর নিবিড় তার সাথে কখনো যোগাযোগ করেনি। না করেছে নোরিন। তবে, নোরিনের মোবাইলে এক অদ্ভুত নাম্বার থেকে কল আসে, অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে৷ অদ্ভুত নাম্বারটা যতবার কল দেয়, ততবারই নোরিন রিসিভ করে। যেমন, একদিন রাতের তিনটা বাজে কল দিলো, আরেকদিন ভোরে, সময়ে অসময়ে কল দেয়। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো, অদ্ভুত কলকারী সবসময় চুপ থাকেন। কোনো কথা বলেন না। নীরবতা পালন করায় যেন তার ধর্ম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়, কিন্তু সে কল কাটে না, কোনো টু শব্দও করেনা। নোরিন কেন এই অদ্ভুত কলটা রিসিভ করে তাও অজানা৷ তারচেয়েও অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, কলটা আসলেই নোরিনের চোখ ছলছল করে। কিছু শোনার অপেক্ষা করে। কিন্তু কেউই কোনো কথা বলেনা।

________________
একটি শান্তিরক্ষা মিশনে নোরিনকে আফ্রিকা যেতে হবে। কবে দেশে ফিরবে তার ঠিক নেই। সৌভাগ্যক্রমে সাতরাজও আছে সাথে। এই প্রথমবার সাতরাজ আর নোরিন একসাথে কোনো মিশনের কাজে বাইরে যাচ্ছে। দেশের বাইরে অনেকবার যাওয়া হলেও এর আগে একসঙ্গে যাওয়া হয়নি। সাতরাজকে বেশ উদ্দীপিত দেখা গেলো। কিন্তু নোরিন নির্বিকার ভঙ্গিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। কোনো এক অজানা কারণে তার মনে কু ডাকছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। ওখানে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া যাবে না নিরাপত্তার স্বার্থে। বাবার সাথে কথা বলা দরকার।
আজমল সাহেব কল রিসিভ করতেই নোরিন কেঁদে দিলো। এই প্রথমবার মিশনে যাওয়ার আগে নোরিনকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে আজমল সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন৷ ভিডিও কলে নোরিন কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললো,
—- বাবা আমি মরে যাবো। আমার মৃত্যুকে ভয় হচ্ছে বাবা। আমার ভয় করছে। আমার যে অনেককিছু দেখা বাকি বাবা!

নোরিনের এমন অদ্ভুত কথায় আজমলের সাহেব অবাক হলেন। কারণ নোরিনকে কখনো এমন পরিস্থিতিতে মনোবল হারাতে দেখেন নি৷ ওদিকে নোরিন বলেই চলেছে,
—- বাবা, জীবনে আমি অনেককিছুই পায়নি। যা হারিয়েছি তা পাওয়ারও চেষ্টা করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম, জীবন থেকে একবার যা হারিয়ে যায় তার অভাব মেটানো সম্ভব নয়। বাবা তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, আমি জানি। আরো অনেক বেশি ভালোবাসো কারণ আমার মা নেই। জীবনের অনেকগুলো বছর আমি মা ছাড়া কাটিয়েছি। বাবা! আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, তুমি আমাকে মায়ের পাশে কবর দিও। বাবা তোমাকে কখনো বলা হয়নি, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। ”

আজমল সাহেবের চোখ ভিজে এলো,
—- মা তুই এক্ষুনি বাড়ি চলে আয়। তোকে চাকরি করতে হবে না রে মা। তুই চলে আয়।

— না, আমার যেতে হবে। এ যে আমার ভালোবাসার জায়গা৷ একজন সৈন্য কখনোই নিজের জীবনের ভয়ে পিছু হটতে পারে না৷ আমি কাপুরষ নই বাবা৷ রাখি।

নোরিন কল কাটতে না কাটতেই সেই অদ্ভুত নাম্বার থেকে কল এলো। কোনো কিছু না ভেবেই হাজারো অভিমান নিয়ে বললো,
—– নিবিড় ভাইয়া! আপনার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া বাকি। আপনাকে আমি কখনো দেশে ফিরে আসতে বলবো না। আমি মরে গেলেও আপনি আমাকে দেখতে আসবেন না।

অপরপ্রান্তের কোনো কথার অপেক্ষা না করে নোরিন দ্রুত কল কেটে দিলো। মোবাইলটা জমা দিয়ে এসে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পরলো সে। ফ্লাইটের আর বেশি দেরি নেই।

—————————
যুদ্ধের দামামা শুরু হয়ে গেছে। ধাওয়া পাল্টাধাওয়ায় মুখরিত রণক্ষেত্র। নোরিন একটা গাছের পেছনে ছোট গর্ত করে বসে আছে। তার রণকৌশল অসাধারণ। প্রতি দুই সেকেন্ডে চারটা করে গুলি অনায়াসে ছুঁড়তে পারে সে। অনেক দেশের এজেন্ট আছে এখানে। শুত্রুপক্ষ দুর্ধর্ষ, তাদের অস্ত্রের পরিমাণও বিপুল। এতো উন্নতমানের অস্ত্র সংগ্রহ যেনতেন কথা না। নিশ্চয়ই এদের পেছনে বড় কারো হাত আছে। নোরিনদের বেগ পেতে হচ্ছে। পাহাড় জঙ্গলে ভরা এই জায়গায় নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা দিয়েছে। নোরিন সময়জ্ঞান নেই। মনোযোগ দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তার খেয়ালই ছিলো যে, তার আশেপাশে যারা ছিলো, তাদের মধ্যে কেউই নেই এখন৷ ওয়াকিটকির খোঁজ করতে নোরিন অন্ধকারে হাতড়ালো। ওহ শিট! ওয়াকিটকি’টা হারিয়ে গেছে৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছে। অস্ত্রের পরিমাণও শেষের দিকে। নোরিনকে ভীষণ চিন্তিত দেখালো। এই সময়ে মনোবল হারালে চলবে না। নোরিন সতর্কতার সাথে আশেপাশে তাকিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। নিশ্চয়ই তার দলের ধারণা হয়ে গেছে যে, সে আর জীবিত নেই। নাহলে ওকে ফেলে যেতো না।
নোরিন থমতমে মুখে সামনে এগুতে থাকলো। পাহাড়ের বুকে অন্ধকার নেমেছে। শত্রুপক্ষের অবস্থান নিয়ে চিন্তিত নোরিন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে তার মনে হলো কেউ তাকে দূর থেকে ডাকছে। সারতাজের ডাক। নোরিন হাফ ছেড়ে বাচলো। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাতরাজের আসার অপেক্ষা করতে লাগলো সে। সারতাজ এসেই হাপাতে হাপাতে বলতে লাগলো,
— থ্যাংকস গড তুমি বেঁচে আছো৷ সবার ধারণা তুমি মারা গেছো। ওদের আক্রমণ যখন আরো জোরালোভাবে আসছিলো, তখন আমরা পিছু চলে আসি। তুমি গ্রুপ থেকে ছিটকে পরো। আর ওয়াকিটকিতে তোমার সাথে কানেক্ট করার অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিন্তু আমার তোমার উপর পুরো বিশ্বাস ছিলো৷ রুলস ব্রেক করে চলে এসেছি আমি৷ বিশ্বাস করো, ভয়ে বুক কাঁপছিল আমার। এখন চলো।

নোরিন স্মিত হেসে সাতরাজের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। সাতরাজের হাতে ছোট্ট একটা লাইট। নোরিন মনে মনে হাজারবার দোয়া করলো। আজ সাতরাজ না থাকলে হয়তো মরণ নিশ্চিত ছিলো।

বিপদটা ঘটলো তখনই। একটা বুলেট নোরিন গলার পাশ দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে চলে গেলো। নোরিন যেন চৈতন্যে নেই। চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। গুলির শব্দে সাতরাজ সাথে সাথে পেছনে ফেরলো। ছয় সাত জনের একটা দল গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ সাতরাজ তৎক্ষনাৎ আলো নিভিয়ে নোরিনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো৷ নোরিনের গলার পাশটা চকচক করে করছে রাতের আলোয়। ঢলে পড়ে যাচ্ছে নোরিন৷ সাতরাজের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। সেও উদ্দেশ্যহীন কয়েকটা গুলি ছুঁড়ে নোরিনকে আলগা করে ধরলো। কয়েকমিনিট এগুতেই সাতরাজের হাতে একটা গুলি এসে লাগলো। এই মুহূর্তে তার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। নোরিন পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। সে গলা পাশ চেপে ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো।

খানিকক্ষণ পর সাতরাজ আর নোরিন নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে পাহাড়ের পাশ বেয়ে ছুটে চলা ঝর্ণা বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। ঝরনাটা খাঁড়া নিচে নেমে গেছে৷ নোরিন খেয়াল করলো দূর থেকে কিছু ছোট ছোট ক্ষীণ আলো। নিশ্চিত ওটা একটা গ্রাম। সাতরাজকে বলে গ্রামের উদ্দেশ্য ধরে হাঁটা শুরু করলো দুজন। সাতরাজের হাত পা কাপছে নোরিনের অবস্থা দেখে। যদিও সে নিজেই আহত।
গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দ্বিতীয় বিপত্তি ঘটলো। অনেক দূর থেকে আবার অনর্গল গুলি ছুঁড়ছে কেউ। নোরিন আর সাতরাজ ভেবেছিলো ওরা নিরাপদ। আবার এমন আকস্মিক হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউই। গুরুতর আহত নোরিনকে সামলাতে, সাতরাজ তাড়াতাড়ি নোরিনের পেছনে দাঁড়িয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু যা হওয়ার তা অনেক আগেই হয়ে গেছে৷ নোরিনের পিঠে সোজা পাঁজর বরাবর একটা বুলেট তার শরীরে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে৷ নোরিন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, ক্ষীণ আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। টকটকে লাল রক্তে মাটি ভিজতে লাগলো। সাতরাজ নোরিনের পেট চেপে রক্ত বন্ধের চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তার হাতের ফাঁক বেয়ে রক্তের স্রোত বেয়েই চলেছে। ততক্ষণে গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসলো।
সামরিক পোশাকে সজ্জিত দুজন মানব-মানবীকে দেখে তারা দ্রুত এগিয়ে এলো। সাতরাজ হাঁটু ভেঙে একনাগাড়ে নোরিনকে ডেকেই চলেছে। হাতের ব্যথা তার কিচ্ছু নয়৷ নোরিনের অস্থিরতায় তার বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে।

নোরিন হালকা গোঙাচ্ছে। যতবারই কিছু বলার চেষ্টা করছে ততবারই গলার পাশ বেয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে পড়ছে৷ তার শরীর আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে৷ পাখির পালকের ন্যায়। সে বাবাকে মনে করার চেষ্টা করলো। বাবা এখন কি করছে? সেই কতকাল আগে ভিডিও কলে শেষবার কথা হয়েছে। বাবার মুখে একবার ‘মা’ ডাক শোনার ইচ্ছা জাগলো নোরিনের। মাকে নিয়েও একবার ভাবলো। নানুমণির মুখে “সুন্দরী বানু” কতদিন শোনা হয়নি! নোরিনের একজনের কথা মনে আসতেই পৃথিবী উজাড় করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। নিবিড়! সে এখন কোথায়? নিবিড় আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি। আজ কতবছর আমাদের দেখা হয়নি৷ তুমি আমাকে বুঝতে চাওনি নিবিড়। আমি সত্যি তোমাকে চাইতাম।

ধীরে ধীরে চোখ বুজে এলো নোরিনের। চোখ বন্ধ হলো। নোরিন আঁখি বুজার আগে নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বললো। কারণ তার ধারণা নিবিড় তার কথা শুনতে পাচ্ছে।

— “একসময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। জানি একদিন ছাড়াছাড়ি হবে , ভুলে যেও না আমায়। জেগে থেকো নিবিড়, দেখা দিও অঘ্রাণ প্রান্তরে।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here