ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ২১ অন্তিমপর্ব
লেখিকাঃ শাদিয়া_চৌধুরী_নোন
কোনো এক শীতের বিকেল। গ্রামের অলিগলির ফাঁকফোকরে, গ্রাম্য খানিকটা আধুনিক মসজিদ। মসজিদ বারান্দার পাশে এক প্রকান্ড বটগাছ। সামনে একটা বিরাট পুকুর। নামাজীরা গোসল করে, ওজু করে। এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। মসজিদে মানত করে অনেকে অনেককিছু দান করে। এইতো একটু আগেই একজন হিন্দু মহিলা এসে একজোড়া মোরগ দিয়ে গেলো। ছেলের গায়ে ধুম জ্বর, যদি সেরে যায়!
চারপাশে অনাবিল প্রশান্তির ঢেউ। অনেক দূর আকাশ থেকে ধেয়ে আসা ধানি বাতাস, নিস্তব্ধতার শান্তিপ্রিয় মানুষের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, প্রাণোচ্ছল বাতাসের স্মিত স্রোতে ধাক্কা খাওয়া জলরাশি। নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ধাক্কা খেয়ে পুনরায় নিজেদের অবস্থানে ফিরে এসেছে। শীতের হালকা কুয়াশা। পুকুরের একপাশে প্রবেশপথ, অন্যপাশে গোরস্থান। এপার-ওপার স্পষ্ট দেখা যায় না।
গোরস্থানের কোনো এক জায়গা থেকে প্রকট বকুল ফুলের গন্ধ আসছে। মসজিদ ছাড়িয়ে আশপাশের কয়েকটা ঘরেও ঐ গন্ধের পদচারণা। এই কয়েক বছরে গাছটা আরো মোটা হয়েছে, উচ্চতায়ও অনেক দূর। এই গল্পের লেখিকা শাদিয়া চৌধুরী নোন। প্রতি সকালে শেকড়ের পাশের দু’টো কবরে বকুলে ছেয়ে থাকে। সাদা-সাদা, ভেতরের কুড়িটা খানিকটা লাল, অপূর্ব তার ঘ্রাণ। সহজে মোহিত হবে যে কেউ।
এতো শান্তির মাঝেও কেমন যেন গা ছমছম করা পরিবেশ। এখানেই যে কত মানুষের জীবনচক্র সাঙ্গ হয়। সুতরাং, নীরবতা পালনই শ্রেয়।
এক যুবক। পরণে তার বকুলরঙা শুভ্র শার্ট। গায়ে ভাজভাঙা চাদর। পুরো গালময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বড় বড় চুল। তার হাসিহাসি চোখজোড়া এখন আর আগের মতো নেই৷ সে আজ বহুবছর হাসে না। তার চোখে আজ উদাসীনতার মায়া৷ খানিকটা কান্না, খানিকটা কষ্ট, বিশাল জড়তা, সংকোচতার এক মিশ্র অনুভূতি। জড়তার কারণ, সে বারবার নিজের ওয়াদা ভুলে তার অধরা প্রেয়সীর সামনে হাজির হয়। লোকে তাকে বলে পাগল। সে তো ভুল দেখে না! এই গোরস্তানের সে তার প্রেয়সীকে দেখতে পায়। কথা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিবারের ন্যায় আজও এসে যুবক তার প্রেয়সীর সামনে বসলো। অতঃপর সে শুরু করলো।
—– নোরিন! আজ পৌষের তেইশ। তোর সাথে আমার দেখা হয় এমনই এক পৌষের বিকেলে। এই একই গ্রামে। কে জানতো আজ এতোকাল পরে আমাকে আসতে হবে তোর সাথে দেখা করতে! সে কতকাল আগের কথা! আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন এক অপরুপ সুন্দরী রুপসী বারবার আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। ছোট্ট একটা মেয়ে তখন সে৷ গম্ভীর মুখ, বড়দের মতো কাজকারবার। নিজেকে বড় প্রমাণ করতে তার যত চেষ্টা। দায়িত্বজ্ঞান ছিলো প্রচুর। আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করছিলাম, সে বারবার জড়তা নিয়ে তাকাচ্ছিল, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে। হতে পারে নিজের অনিচ্ছায়। তার রাগ ছিল সবকিছুর উর্দ্ধে। ক্ষমতা থাকলে সে নিজের তেজে দুনিয়া ধ্বংস করে দিতো। ”
চোখের গড়িয়ে পড়া অশ্রুকে পাত্তা না দিয়ে যুবক বলতে লাগলো,
—– এখনো সেসব স্মৃতি কতটা জীবন্ত তাইনা? আজ আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো নোরিন। আমি সত্যি তোকে শেষবার দেখতে পারিনি। ইউএসএ তে তখন ভিসা পাওয়া ছিল খুব জটিল। এদিকে এম্বেসিতে যোগাযোগ করে তোকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। আমি মরে যাচ্ছিলাম নোরিন! তুই সত্যি আমার সাথে দেখা করতে চাসনি হয়তো। সারতাজ ছেলেটা আসলেই খুব ভালো। কয়েকদিন আগে বউ নিয়ে নাকি তোর সাথে দেখা করে গেছে? বেচারা খুব কাঁদছিল। তুই নাকি বলেছিলি, সারতাজকে বিয়ে করে নিতে। তোর আবদার সে রেখেছে নোরিন। বিয়ে করে নিয়েছে সারতাজ। আংকেল এখন আর আগের মতো হাসেন না৷ কাউকে হুট করে গালি দেননা৷ শরীর ভেঙে গেছে। সবকিছু চুপচাপ। তুই যাওয়ার পর, সেদিন থেকে সবকিছু থমকে যায় নোরিন! আমরা কেউই ভালো নেই। এই পৃথিবীতে তুই নেই, আমি মানতে পারি না। এই পৃথিবীর বুকে আজ বহুবছর তোর পদচারণা নেই। আমার বাঁচতে ইচ্ছে হয়না। এই পৃথিবীতে সত্যিই আমার নোরিন শ্বাস নেয়না, কাউকে ডাকে না, তার স্বভাবসুলভ আচরণ দিয়ে আর কাউকে মুগ্ধ করেনা!
যুবক খানিকটা থামলো। আবার বলতে লাগলো,
—- তোকে সরাসরি না দেখলেও লাইভ টেলিকাস্টে পতাকায় মোড়ানো ফুলেল সজ্জিত কফিনটাকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো সেদিন। রাষ্ট্রীয় সম্মানতায় তোকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার সময় আমি এক বৃদ্ধকে লক্ষ করি। সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার হাত কপাল থেকে নামায়নি। পরে জানতে পারি, সেই বৃদ্ধের কাছ থেকে তুই নাকি একদিন স্যালুট আশা করেছিলি। বৃদ্ধ লোকটা সেদিন খুব কাঁদছিল। এতো চুপচাপ থেকেও তুই আর কতজন মানুষকে মায়ায় ফেলেছিস বলতে পারিস? কিছু মানুষের জন্মই হয়েছে বোধহয় দান করার জন্য। তারা সারাজীবন শুধু দিয়েই যাবে, হুটহাট যে কাউকে নিজের মায়া জড়াবে। তারপর একদিন অসময়ে কাউকে না জানিয়ে, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে।
যুবক আবারো থামলো কিছুক্ষণের জন্য।
—- “নোরিন! অধরা নোরিন! আমার উপর তোর অনেক অভিযোগ তাইনা? আমি সব বুঝেও তোকে কেনো মেনে নেইনি? আসলেই আমি তখন বুঝতে পারিনি বিশ্বাস কর! আমি বুঝতে পারিনি তোর ভালোবাসার প্রখরতা। তুই কেন ঠিকঠাক আমাকে বলিসনি বলতো? সবাইকে বুঝতি, আমার বেলাতেই কেন অবুঝ হতে হলো তোকে? তুই কেনো সেদিন চিঠিটা পড়িসনি? আজ সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো। সেদিন তুই শুধু একবার মুখ ফুটে বলতি নোরিন, আমি কোনো বাধাকে মানতাম না। আমি আজ তোকে তোর মতোই ভালোবাসি নোরিন। তুই যতটা ভালোবাসতিস, আমিও ততটাই ভালোবাসি। সেদিন তোর বাড়িতে তোকে যতগুলো কথা বলেছিলাম, তার একটাও মিথ্যা ছিলো না৷ আজপাশের মিথ্যে ভালোবাসা দেখতে দেখতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম, তোর বয়সের আবেগ, কয়েকদিন পরই কেটে যাবে। কিন্তু না তুই আমাকে নিজের মতো করে মন উজাড় করে ভালোবেসে গেছিস। আমি তখনও বুঝতে পারিনি৷ আমার মা তোকে পছন্দ করতো না। যতবার তোর কাছে যেতে চাইতাম,ততবার মা আমাকে আটকাতো। সে কেনো তোকে অপছন্দ করতো আমি জানি না নোরিন। আমি মায়ের ভক্ত। মায়ের কথা ফেলতে পারিনি। আমার মায়া কাটাতে অনেক সময় খারাপ ব্যবহার করেছি তোর সাথে৷ কিন্তু মন থেকে এমন আচরণ আমার কল্পনাতেও আসতো না বিশ্বাস কর! মায়ের কথা ফেলে, আমি সেদিন তোকে চিঠিটা লিখেছিলাম। এর পরদিন তুই যে কথাগুলো বলেছিলি,আমি সহ্য করতে পারিনি নোরিন৷ দূরে চলে গিয়েছিলাম।তোর কথা রাখতে গিয়ে আজ আমরা কেউই ভালো নেই। তুই আমাকে মেরে ফেল নোরিন। আমি শাস্তি চাই। আমি বাঁচতে চাইনা। আমি মরে যাচ্ছি৷ আমি তোর কাছে আসতে চাই নোরিন৷ তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? আমি তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি। অনেক বেশি…..
যুবক ক্রন্দনরত অবস্থায় স্মিত হাসলো,
—- জানিস মাথায় একটা টিউমার ধরা পড়েছে কয়েকদিন আগে৷ যে কোনো সময় ব্লাস্ট করতে পারে ওটা৷ আমি কাউকে বলিনি। আমার না খুব ভালো লাগছে। আমারও সময় এসে গেছে। আমরা একসাথে থাকবো নোরিন৷ আচ্ছা, তোর পাশে তো দিলারা ফুপি শুয়ে আছে। তোর খুব শখ ছিল ওনার সাথে থাকার। তোর কি কথা হয়? বকুলের ফুল না তোর উপরও পড়েছে! কি যে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে! তুই কি শুঁকতে পারছিস? তুই আমার অধরা নোরিন। যাকে ছোঁয়া অসম্ভব। তবুও তোকে একবার ছোঁতে চাই নোরিন৷ প্লিজ একবার দেখা দে!
চোখের পলকে যুবকের সামনে হঠাৎ কোথ থেকে এক নারীর আগমন ঘটলো। সে বসে আছে তার চিরস্থায়ী ঘরের মাচার উপর। পরনে তার বকুলরঙা একখন্ড বস্ত্র। অদ্ভুত মোহনীয়তায় মুচকি হাসি নিয়ে সে যুকবের দিকে তাকিয়ে আছে। যুবক চোখ কচলে তাকালো। চোখের ভুল নাকি? কি জানি! সে অস্ফুটে নোরিন বলে ডাকলো। যুবতী নারী হালকা হাসলো আবার। আহা! কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তার প্রেয়সীকে! খানিকটা প্রেমিকের দৃষ্টিতে তাকাতে চেষ্টা করলো সে। ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই যুবতী কথা বললো,
— উহু! ছোঁবেন না। নাহলে হারিয়ে যাবো।
যুবক ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। ঘোর লেগে এলো। কি সম্মোহনী তার হাসি! তার চাহনি! তার মায়া!
—- তুই জানিস তোকে কত লোকে ভালোবাসে? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কেনো চলে গেলি?
—- ভালোবাসলে কি হবে নিবিড়? যাকে চাইতাম সে-ই তো ভালোবাসেনি। পৃথিবীতে সব ভালোবাসার শুভ পরিণতি হয়না। কিছু অপূর্ণ রয়ে যায়, আর কিছু অপ্রকাশিত!
—- সে এখন তোকে তোর মতোই ভালোবাসে নোরিন। তুই ফিরে আয়।
— সম্ভব না।
যুবতীর মুখের হাসি যেন সরছেই না। যুবক তাকিয়েই রইলো। যুবতী বলতে লাগলো,
——
‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন —
কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো;
এক নক্ষত্রের নিচে তবু
একই আলোপৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি
পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়,
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়;
হয় নাকি? —
বলে সে তাকালো সঙ্গীনীর দিকে
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
যেখানে আকাশের খুব নীরবতা,শান্তি আছে খুব
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে ;
হেমন্ত ফুরায়ে গেছে
ঝরিছে মরিছে সব এইখানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
নারী তার সঙ্গিকে, ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
— জানি আমি; – তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়!
কি নিয়ে থাকিবো বলো; – একদিনের আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা।
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না!
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের – প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয় থেকে। ‘
যুবকের ঘোর কাটলো। একি! নোরিন কোথায়? কেউই তো বসে নেই৷ একটু আগে তো এখানেই ছিলো৷ সে কি আবার ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো? তবে কি ভুল ছিলো? এই অপরাধবোধ কি কমবার নয়?
—– জানি আমি, তোমার দু চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর পরে- ’
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশ্বত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভেতরে।
শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া; – অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু;
বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার মুখে এই নিস্তব্ধ।
কেমন যে – সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে জলে ’ ;
— কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে হাঁটলাম,
চিল উড়ে চলে গেছে– কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দুএকটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে।
লক্ষী পেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার
গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো
যেন লেগে আছে বহতা পাখায়। ‘
যুবক মাথা ঠেকিয়ে তার অধরা প্রেয়সীর মাটিতে মাথা রাখলো৷ মাথাটা ভারভার লাগছে, মাথায় যেন ভিজেভিজে ছাপ৷ কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে চোখ বুজলো সে৷ একটা কথা তার কানে বারংবার বাজতে লাগলো,
“একসময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। জানি একদিন ছাড়াছাড়ি হবে নিবিড়, ভুলে যেও না আমায়। জেগে থেকো, দেখা দিও প্রিয় অঘ্রাণ প্রান্তরে। ”
সমাপ্ত