ভালোবেসেছি_তোরই_মতো পর্বঃ০৪,০৫

0
1808

ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ০৪,০৫
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ০৪

—আপনি সবসময় আমার পানি খেয়ে ফেলেন কেন?

নিবিড় নিঃশব্দে গ্লাসটা রেখেই ঠাস করে আবার আরেকটা চাটি মারলো নোরিনের মাথায়। চাটির বারিতে নোরিনের কোমল নমনীয় চুল আটকানোর কাঁটাটা আলগা হয়ে এলো। কয়েক গাছি ছোট ছোট চুল সামনে এসে চামচিকার মতো ঝুলে পরলো। নোরিন কাঠ হয়ে বসে আছে। চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর নেই। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় অসাবধানে তার বাম হাতটা তরকারির বাটির ভেতরে ঢুকে গেছে। নোরিন হাতটাও তুললো না। একইভাবে বসে রইলো। চুলের অবস্থা শোচনীয়। নিবিড় যেন নোরিনের অবস্থা দেখে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে গেলো।
—– কীরে বুড়ি! তোর হাত তো বাটির মধ্যে ঢুকে গেছে। তাও বাম হাত ছিহ্!! এই কেউ ওই বাটি থেকে খাস না আবার। তোর বাদর চুলগুলোর দেখছি অবস্থা খারাপ। এইভাবে কেউ খেতে পারে? তোকে দেখে আমার বমি পাচ্ছে। ওয়াক…..

ছোট-বড় সব কাজিনদের মধ্যে একটা হাসির রোল লেগে গেলো। নোরিন ধীরগতিতে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর ইচ্ছেমতো কাঁদল। ফাঁকা ঘরে কেঁদে কেঁদে ইচ্ছেমতো লাফালো। বিলাপও করলো।
—– আমার সাথে আপনার কোন জন্মের শত্রুতা আছে বলুন তো নিবিড় ভাইয়া? জানেন ওরা সবাই আমাকে কতটা রেসপেক্ট করে? আমি তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু? আর আপনি সবার সামনে আমাকে এভাবে মারতে পারলেন!! আপনি এই ফাঁকা ঘরে আমাকে একশোটা মারলেও কিছু বলতাম না। টু শব্দও করতাম না। সবাই হাসছিলো। সবার সামনে আমাকে কেনো হাসির পাত্র বানালেন নিবিড় ভাইয়া?

নোরিন যা নয় তাই বলে বিলাপ করতে লাগলো। আধঘন্টা পর চোখে-মুখে পানি ঝাপটিয়ে শান্তভাবে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো। গাল আর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে খুব৷ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।

নোরিন নিজের রুম হতে বের হলো বেলা এগারোটায়। বের হয়ে কাউকে খুঁজলো না। সোজা নানুমণির রুমে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। নোরিনের নানুবাড়িটা ছোটখাটো একটা সমতল পাহাড়ের উপর বানানো। দোতলা কাঠের বড় বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা মাঝারি সাইজের উঠোন। তারপর ঢালু হয়ে পাহাড়টা নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। কয়েকশো রকমের গাছ দিয়ে পুরো পাহাড়টাকে দূর থেকে জঙ্গলের মতো মনে হয়। নিচে শান বাঁধানো একটা পুকুর আছে। শীতকালে এখন গোলাপী শাপলায় পুরো পুকুরটা ছেয়ে আছে। পানি পর্যন্ত তোলা যায়না, এতোটুকু কোণা পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। নোরিনের নানাভাই চেয়ারম্যান থাকাকালীন এই বাড়িটা করেছিলেন। বড় বউয়ের সাথে বাবা মা ধরে বেধে বিয়ে দিলেও, নোরিনের নানুমণিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বড় বউকেও একটা বাড়ি করে দিয়েছেন। এখান থেকে দশমিনিট রাস্তা হাঁটলেই ওই বাড়িতে যাওয়া যাবে। দুই বউয়ের মধ্যে যাতে কোনোপ্রকার ঝামেলা না হয় তাই এই ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। দুই বউ তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে দুই বাড়িতে থাকতো। সে অনেক বছর আগের কথা। এসব কথা এখানকার মানুষের মুখে মুখে। চেয়ারম্যানবাড়ি নিয়ে কার না আগ্রহ থাকে!!!
নোরিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে গ্রামবাংলার বিস্তর জনপদের দিকে। নানুমনি খাটে বসে সবসময়ের মতো পান চিবুচ্ছেন। তিনি নোরিনকে ডাকলেন।
— কী গো সুন্দরী বানু! মন খারাপ নাকি?

— নাহ্ নানু। এমনিই। বাবাকে মিস করছি।

— চার পাঁচদিনের লাইগা আসলা। আজমলরে তো কইছিলাম। হের তো অফিসে কাজ আছে বললো।

নোরিন মনে মনে নানুকে উত্তর দিলো, নানুমনি তুমি ভুল ভাবছো। বাবা ইচ্ছে করেই আসেনি। মা’র স্মৃতি যে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। আমারও আসতে ইচ্ছে করেনা জানো? মায়ের সাথে এই বাড়িতে, পুরো গ্রামে কত ঘুরেছি। মা সবসময় বলতো, আমরা দুজন বেস্টফ্রেন্ড।

—— আম্মা আসবো?
নোরিন দরজায় তাকালো। এক প্রাপ্তবয়স্ক দম্পতি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে একজন ছেলে। ছেলেটাকে সে চেনে। নিবিড়ের বড় ভাই। দুইভাই দেখতে একরকম। পার্থক্য হলো বড় ভাইয়ের রং একটু চাপা আর একটু মোটা। হালকা ভুড়ি বেরিয়ে আছে। অন্যদিকে নিবিড় উজ্জ্বল ফর্সা আর স্বাস্থ্যবান। মুখের গড়নটার মিল দুভাইয়ের। হতে পারে এই দম্পতি নিবিড় ভাইয়ার মা-বাবা। নোরিন এবার আরো তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। ভদ্রমহিলা তার মামী হবেন। শহুরে ভাব। নোরিন বুঝলো তার মামী গয়নার ক্ষেত্রে বেশ চুজেবল এবং বেশ আধুনিক। নানুমনি তাদের ভেতরে আসতে বললেন।
— আসো আসো আয়েশা। ভিতরে আসো। আরে আমার নাতিও আইছে দেখছি। বহো বহো…

—- আম্মা ভালো আছি। আপনার শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক তো?

— তোমরা আইছো আমার এখন সব ঠিক।

নানুর সাথে তারা কথা চালিয়ে যেতে লাগলো। কথার পিঠে জানতে পারলো, নিবিড়ের বড় ভাই শিমুলও একজন ইন্জিনিয়ার। কুয়েটের ছাত্র। নোরিনের মা প্রয়াত দিলারাকে নিয়েও কথা চললো খানিকক্ষণ। আয়েশা নোরিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই বললো,
— এমন একটা মেয়েই আমার ছেলের জন্য খুঁজছি আম্মা। গ্রামে নোরিনের মতো কোনো মেয়ে পেলে আমাকে বলবেন।
নোরিনের বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা। বিষম খেতে খেতে তার কচুরিপানার পানিতে ঝাপ দিতে ইচ্ছে হলো। এতো দুঃখ সে কোথায় রাখে!

বিকেল বেলা……
বিয়ে বাড়ি মানেই ব্যস্ততা। হাজার রকমের কাজ। হাজার রকম মানুষের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, মিলেমিশে কাজ করা। বাড়িতে সবাই কাজ করছে। আজ বাদে কাল বিয়ে। আর মাত্র কয়েকঘণ্টা বাকি। বড়নানু-ছোটনানুর দুই পরিবারের মানুষ, পুরো গ্রামের মানুষ একসাথে কাজ করেও, কোনো কুল-কিনারা হচ্ছে না। তার উপর ছোট ছোট বাচ্চাদের ভোঁ – ভোঁ, চোঁ-চোঁ লেগেই আছে।
নোরিনের অবস্থা কাহিল। সে বইটাকে বুকের উপর রেখে চোখ বড় বড় করে, হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হবে, সে এইমাত্র স্ট্রোক করেছে। আসল কথা হচ্ছে গিয়ে, নোরিনের মনে হচ্ছে, পুরো বাড়ির এই বাচ্চাদের কান্না, হৈচৈকে একটা ট্রেনে পুরে; উড়ন্ত ট্রেনটা তার কানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সাধারণত, ট্রেনের আওয়াজ হচ্ছে ঝক..ঝক..ঝক টাইপের। কিন্তু এই চিল্লানিমিশ্রিত ট্রেন আওয়াজ করছে,
— ব্যা-ব্যা-ব্যা-চে-চে-ক্যা-ক্যা-হু-হু-আআআআাা….

নোরিনের মনে হলো ট্রেনটা মাত্রই তার পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। তাই সে হাত দিয়ে ট্রেনটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। হতাশ হলো সে।

বাচ্চাপার্টির চ্যানচ্যানানি আর উঠতি বাচ্চাদের ট্যানট্যানানি এবং এর বড়দের ফ্যারফ্যারানি থেকে বাঁচতে বাড়ির বড়রা ঠিক করলো সবাইকে ঘুরতে পাঠিয়ে দেবে।

চলবে

#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ০৫
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন

বাচ্চাপার্টির চ্যানচ্যানানি আর উঠতি বাচ্চাদের ট্যানট্যানানি এবং এর বড়দের ফ্যারফ্যারানি থেকে বাঁচতে বাড়ির বড়রা ঠিক করলো সবাইকে ঘুরতে পাঠিয়ে দেবে। শুধুমাত্র দুধের বাচ্চাদের ছাড়া সর্বনিম্ন সাত-আট বয়সী থেকে যত উপরে উঠা যায় বাচ্চারা মিলে ঘুরতে বের হলো। সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো মকবুল আর ছকিনার উপর। ছকিনা মকবুলের বোন। ওদের পূর্বপুরুষও এই বাড়িতে কাজ করে এসেছে।
নিবিড় সকল বাচ্চাপার্টির কাছে আগ্রহের বস্তু। নিবিড় ভাইয়া বললেই একপায়ে খাড়া সবাই। কি এমন জাদু করেছে কে জানে! খেতে বসলে নিবিড় ভাইয়ার সাথে খাবো, কোথাও গেলে নিবিড় ভাইয়ার সাথে যাবো, হাসলেও নিবিড় ভাইয়ার সাথে হাসবো। নিবিড় কয়েকজনকে কয়েকটা টুক্কি টাক্কা মানে আলতো চড়ও মেরেছে তবুও, তার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। বরং যাকে মেরেছে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর তার দেখাদেখি অন্যরাও বলে, নিবিড় ভাইয়া ও’কে আদর করেছো আমাদের আদর করবে না? ঘুরতে যাওয়ার কথা শোনে তারা প্রথমে রাজি না হলেও, নিবিড় যাওয়ার কথা শুনে ঠিকই রাজি হলো।

অন্যদিকে, এই চিল্লানিযুক্ত ট্রেন থেকে বাঁচতে নোরিনও রাজি হলো। সে একটা কালো জিন্স আর ওয়ান পিস পড়ে যখন বাইরে বেরিয়ে এলো, তখন দেখা গেলো একমাত্র সে’ই বাকি ছিলো। বাকি সবাই রেডি হয়ে অলসপায়ে উঠানে পায়চারি করছে। নিবিড় মুখ কুঁচকে বললো,
—- এতো সেজেগুজে এসে কি হলো? সেই-তো পেঁচার মতো দেখতে লাগছে তোকে। শুধু শুধু সময় নষ্ট।

বলেই নিবিড় ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলো। নোরিন পানসে মুখ করে অন্যদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বুঝলো, তাকে মোটেও খারাপ লাগছে না। বজ্জাত একটা! আপনাকে একদিন আমি সত্যি সত্যিই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে বসাবো, আগাগোড়া পরীক্ষা করবো। নোরিন দোয়া পড়ে ফো দিলো।
প্রথমেই তারা পুকুর পাড়ে গেলো। পুকুরভরা শাপলাফুল। মকবুল নোরিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নোরিন তার মোবাইল নিয়ে চারপাশে ভিডিও করছে, বাবাকে দেখাবে বলে। জেরু,রাইদা,মিমহা, গালিব ভাইয়া, ইশরাক, ইশমাম, তাশরিক ভাইয়া সহ ছোট বড় সব কাজিনরা পেয়ারা পেড়ে খাচ্ছে। মকবুল আস্তে করে নোরিনকে ডাকলো তার তুতলানো স্বর দিয়ে,
— আা-আফা…

নোরিন মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে জবাব দিলো,
—- হুম, বলো!

মকবুল এবার নিজের কথার পসরা সাজালো।
— জা-জানেন আফা কি হইছে? একদিন সকালে আমি পানি তুলতে আইছিলাম এইহানে। দেখি, দুইটা সাপ গড়াগড়ি খাইতাছে। একে অপরের সাথে পেঁচাইয়া সিঁড়ির পাড়ে উল্টাউল্টি করতাছে। তারপর দেখি, আরো পাঁচ-ছয়টা সাপ। একটা সাপ পেয়ারা গাছের সাথে ঝুলছে। আ-আফা একটা সাপের না দুইটা করে মাথা। আল্লাহর কসম কইতাছি! আমারে দেইখা লাল সাপটা এমন দৌড়ানি দিছে….! আমি আর এইদিকে একা আসি নাই।

ভয়ে নোরিনের আত্মা শুকিয়ে গেলো। মোবাইলটা এবার মকবুলের উপর তাক করে বললো,
—- সত্যি? আপনি দেখেছিলেন?

— হ আফা… আপনি নিজের চোক্কে না দ-দ-দেখলে বিশ্বাস করতেন না।

—- এই মকবুল!!!! সর ওখান থেকে। সর বলছি…
নিবিড়ের ডাকে মকবুল ভয়ে দূরে সরে গেলো। নিবিড় নোরিনের পাশে দাঁড়ালো।

—- সকালে আমিও কয়েকটা সাপকে দেখেছি। পেয়ারা গাছটাতে বসে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বাড়িও দেখে এসেছি। চল তোকে নিয়ে যায়।

নোরিন চোখ বড় বড় করে বললো,
— সত্যি নিবিড় ভাইয়া?

—সত্যি কি মিথ্যা তুই নিজেই যাচাই করিস!

নোরিন ভয়ে ভয়ে দূরে সরে এলো। এসব প্রাণীতে তার ভীষণ ভয়। একদিন প্র্যাকটিক্যাল করার সময়, ব্যাঙ কাটতে গিয়ে সে নিজেই বেহুঁশ হয়ে পরেছিলো। আরেকদিন হাতে কেঁচো লেগেছিলো বলে, তিনদিন পর্যন্ত হাত দিয়ে ভাত খায়নি। কিভাবে কিলবিল করছিলো ইয়া লম্বা কেঁচোটা ভাবলে এখনো গা গোলায় তার।

এতো বড় বাহিনী দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। রাস্তায় মানুষ হাঁটার জায়গা পাবে না। মানুষ ভাববে সবাই হরতাল করতে বেরিয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা করে নিবিড় ঘোষণা করল, এই বাচ্চা বাহিনী মকবুল আর ছকিনার অধীনে থাকবে। আর ইয়াংস্টার’রা থাকবে নিবিড়ের অধীনে। দুঃখে কষ্টে মকবুলের মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো।

দল বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর নিবিড় সবাইকে নিয়ে ধান ক্ষেতে গেলো। শীতকালের শুরু। বিস্তর প্রান্তর জুড়ে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ধান আর ধান। কাঁচা ধানের গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। কুয়াশার বেড়াজালে অর্ধেক মাঠ দৃষ্টিগোচর হলো না। তাতে যেন সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেলো। নোরিন ধানি জমির আইল ধরে খানিকটা হাটলো। পা ভাজ করে নিচু হয়ে দেখলো ছোট ছোট পুঁটিমাছ ঘুরঘুর করছে। কয়েকটা কচুচিংড়ি মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে নরম মাটির ভেতরে নিজেদের আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো। নোরিন হালকা হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সবেমাত্র বিকেল। হলুদাভাব সূর্যটা যেন নিজের খানিকটা রঙ দিয়ে নোরিনকে সাজাতে চাইলো। ফর্সা মুখে হলুদের আলোয় অন্যরকম মায়া সৃষ্টি করেছে। খোলা চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে উড়ছে। ধানি হাওয়া, মুক্ত প্রান্তর একটা তাজা প্রাণ।
নোরিন আগ্রহবশত কাঁচা ধানের একটা গাছি নিয়ে কামড় দিলো। দাঁতটা খসখস করে উঠল। সে জানতে চায় কাঁচা ধান খেতে কেমন। অমনি একটা চিৎকার ভেসে এলো,
—– আল্লাহ্ আল্লাহ্! এই তোকে কি আমরা ভাত দিইনা? ঘুরতে এসে আস্ত কাঁচা ধান খাচ্ছিস! কার না কার হক! বোন প্লিজ তুই ওই গাছটাকে রেহাই দে… বাড়ি গিয়ে তোকে এক গামলা ভাত দেবো প্রমিস…

নিবিড় কথা শোনে নোরিনের মনে হলো এক্ষুণি কচুচিংড়ি হয়ে মাটির নিচে লুকায় গিয়ে। এতো অপমান! এতো ড্যাশিং একটা মানুষের মুখ দিয়ে এমন কথা কীভাবে বের হয়? আপনার মুখে এসব কথা মানায় না নিবিড় ভাইয়া। ওহে সৎ মামাতো ভাই! আপনি আমাকে বোন ডাকবেন না প্লিজ।
নোরিন নির্বিকার মুখে ধান গাছটাকে ছেড়ে চলে এলো। জেরু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। নোরিন এমন কথা কেনো সহ্য করছে? সে তো এসব কথাকে পশ্রয় দেওয়ার মতো মেয়ে নয়।

সবাই এবার গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এলো। গালিব ভাইয়ার দুষ্টমিতে সবাই কিছুক্ষণ পর পর হাসছে৷ সবাই হাসছে শুধু হাসি নেই নোরিনের মুখে৷ তার চোখ ছলছল করছে। একসময় এই রাস্তা দিয়ে সে আর তার মা নানুভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে আসতো। মা বারবার বলতো, মা মারা গেলে যেন নানুভাইয়ের পাশে কবর দেওয়া হয়। মায়ের শখ পূরণ হয়েছে। এই রাস্তা, এই মসজিদ, নানাভাইয়ের কবর সব আগের মতোই আছে, নেই শুধু মা।
সবাই নানাভাইয়ের কবরের পাশে গেলো জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। নোরিন গেলো না। সে একমনে তাকিয়ে আছে পাশের কবরটাতে। জিয়ারত শেষ হলে, নিবিড় নোরিনের হাত ধরে টান দিলো। জানতে চাইলো, কেনো সে দোয়া করলো না? নোরিন এখনো নড়লো না। নিবিড় এবার জোরে বললো,
— ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?

পাশ থেকে জেরু মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো,
— ওটা ওর মায়ের কবর। ওখানে দিলারা খালামণি ঘুমিয়ে আছেন।

চলবে

Sadiya_Chowdhury_Noon

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here