ভালোবেসেছি_তোরই_মতো পর্বঃ১০,১১

0
2070

ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ১০,১১
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ১০

নোরিনের ঘরে ফেরার ঠিক দুদিন পরের কথা। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ নিবিড় এসে হাজির। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো, কপালের চুলগুলো অবহেলিত, উষ্কখুষ্ক।
নিবিড়কে হলরুমের সোফায় বসতে বলে বাড়ির কাজের লোক লাইলা নোরিনকে ডাকতে গেলো। দোতলায় নোরিন গুণগুণ করে পড়ছিলো তখন। গায়ের লাল টকটকে শাল জড়িয়ে, মাথায় একটা মানকি টুপি , লাল টকটকে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে পড়ছিলো। তার বাবা এখনো তাকে মানকি টুপি পরায়। কানে বাতাস ঢুকবে না। শীতকালে কখন ঠান্ডা লেগে যায় তার ঠিক নেই। তারউপর নোরিনের একবার সর্দি-কাশি হলে সহজে ছাড়তে চায়না। মাফলার কখন না কখন জায়গা থেকে সরে যায়! সুতরাং, মানকি টুপিই উত্তম। লাইলার মুখে কোন অপরিচিত ছেলে এসেছে শুনে, নোরিন মুখ নাড়ানো বন্ধ করলো। বাবা অফিসে। এই অসময়ে কে আসতে পারে? লাইলা এসেই তাকে বলতে লাগলো,
—- আফা, নিচে কোন বেডা আইছে জানি না। এমন সুন্দর কি কইতাম! সাদা একখান শার্ট পরছে, রাজপুত্তুরের মতোন লাগতাছে। এমন লম্বা, খালি চোখ উপরে তুলে কথা কওন লাগে। চুলগুলা মাইয়াগো মতো…….

—– কি সমস্যা লাইলা? এতো ডিটেইলস কে জানতে চেয়েছে। যেই হোক বলো বাবা বাড়িতে নেই। আমাকে যদি খুঁজে, আমিও নেই বলবে। তুমিও আমার সামনে আসবে তো দূরে থাক, দোতলার সিঁড়িতেও পা রাখবে না। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত এবং বিরক্ত। চলে যাও…..

নোরিনের কথায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো লাইলার। হাতে থাকা ঘর মোছার কাপড়টা থপ করে পরে গেলো হাত থেকে। এমন ভাবে তো তার স্যারও বলে না। তার ইচ্ছে হলো, হাত পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে। এই বাড়িতে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নোরিন আর সবচেয়ে বেশি ধমক দেয়ও নোরিন।
লাইলা চলে যাওয়ার পর নোরিন আবার মনোযোগী ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করলো। বিয়ের ঝামেলায় একেবারেই পড়া হয়নি কয়েকদিন। পুরনো পড়া আর নতুন পড়া সবকিছু একসাথে কভার করতে হচ্ছে। মহা ঝামেলা!

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। লাইলাকে চলে যেতে বলেছিলাম। এতো সাহস, মানা করার পরও আসে! নোরিন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। মুহূর্তেই হাতের বইটা মাটিতে পড়ে গেলো। হাঁটাহাটি থামিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব? উনার তো এখন নানুবাড়িতে থাকার কথা। এটা উনি হতেই পারে না। নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন হচ্ছে।
নোরিনের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। একি! হ্যালুসিনেশন তো এতোক্ষণ স্থায়ী থাকে না। উনি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন না কেন? তারমানে নিবিড় সত্যি সত্যি আমার বাড়িতে! আমার রুমে! না না, না এটা কি করে হয়! এটা নিবিড় হতেই পারে না।

নিবিড় এক কদম সামনে এগিয়ে আসতেই, নোরিন দু’কদম পিছিয়ে গেলো। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গলা শুঁকিয়ে গেছে। এক্ষুনি পানি খাওয়া দরকার। আমার চোখ ঘুরঘুর করছে, বুকে অসম্ভব রকমের ব্যাথা করছে। আমার মন বারবার আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছে, সামনে থাকা ব্যক্তিটা কোনোভাবেই নিবিড় হতে পারে না। উনি এখানে আসতেই পারেন না।

— বুড়ি আমাকে সালাম কর!

নোরিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওমাই গড! নিবিড়ের ভূতটা তো কথাও বলছে দেখছি। নোরিন যেন নিজের মধ্যে নেই। তার দুনিয়া আবার লন্ডভন্ড হয়ে গেছে প্রতিবারের মতো। নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটা বারবার তাকে এলোমেলো করে দেয়।
নোরিন আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো নিবিড়ের সামনে।
—- নিবিড় ভাইয়া, আপনি আমাকে একটু ছুঁইয়ে দিনতো!

নিবিড় শুধু নোরিনকে ছুঁলেনই না, আস্তে করে নোরিনের ছোট ছোট চুলগুলো টেনেও ধরলেন।
—- সবসময় এতো ছেলে ছেলে ভাব কেনো? তুই কি ছেলে নাকি! ঘাড় অব্দি চুল নিয়ে, জিন্স-শার্ট পড়ে, ছেলেদের মতো মোড নিয়ে তুই কি বাই এনি চান্স নিজেকে ছেলে প্রমাণ করতে চাস? মেয়েদের এতো ভাব মানায় না।

নোরিন হতাশ হলো। সে এখন নিশ্চিত হয়েছে এটা আসলেই নিবিড়। নিবিড় ছাড়া কেউ হতেই পারে না! আসলেই চরম উন্মাদ এবং বজ্জাত ছেলে।
— ভাইয়া আপনি কেনো এসেছেন?

— কিছু দিতে এসেছি।

কিছু দিতে এসেছি মানে কি বুঝাতে চাইলেন নিবিড়? উনি কি সেই দুই লাইনের চিঠিটা হাতে পেয়েছেন? সেটাই কি দিতে এসেছেন? নোরিন বুক ব্যাথা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। মুখে খেলে গেলো লজ্জার হাসি। এই মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারলে বেশ হতো। চারপাশে এতো লজ্জায় ভরপুর কেন?
— কি জিনিস ভাইয়া?

নিবিড় নোরিনের আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে বললো,
— তুই একটা শার্ট ফেলে এসেছিলি,সেটাই দিতে এসেছি। দেখ!
নিবিড় সত্যিই নোরিনের একটা শার্ট বের করে দেখালো, যেটা সে নানুবাড়িতে ফেলে এসেছিলো। রাগে নোরিনের মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। এতো মাইল পাড়ি দিয়ে, বৌভাতের অনুষ্ঠান ফেলে উনি শুধুমাত্র এই একটা শার্ট দিতে, এই ভর সন্ধ্যাবেলা এখানে এসেছেন? রাগে দুঃখে নোরিনের রীতিমতো কাঁদতে ইচ্ছে হলো। মানুষটা এতো খারাপ কেনো? তারমানে নিবিড় ঐ লিখাটা পড়েননি? এটা কী করে হয়! কাগজটা এমন জায়গায় সে রেখেছিলো যে, নিবিড় ব্যাগের চেইন খুললেই ওটা দেখতে পাবে।

—- তোদের বাড়ির সামনে একটা চমৎকার গার্ডেন দেখলাম। আমাকেও একটু ঘুরে দেখা!

ব্যাটা ভদ্র শয়তান! তোকে আমি গার্ডেনের “গ” তেও নিয়ে যেতে পারবো না। তোর সাথে আমি রাগ করেছি।
—- জ্বি ভাইয়া কেনো নয়! কেনো নয়! চলুন না!
নোরিন মুখে ম্যাকি হাসি ঝুলিয়ে নিবিড়কে নিয়ে দোতলায় বেয়ে নিচে নামলো। তারপর বাড়ির সামনে গার্ডেনে গেলো।

নিবিড় গার্ডেনের চেয়ারে বসে আশেপাশে তাকালো।
—- আবাসিক এলাকা, সরকারি বাংলো, বিরাট জায়গা নিয়ে বাউন্ডারি বাহ্! তোর বাবা তো দেখছি ভালোই কামায়। আসার সময় তো দারোয়ান ঢুকতেই দিচ্ছিলো না। পরে তোর সাথে একটা সেলফি দেখিয়ে, আত্মীয় টাত্মীয়, অনেক বলেকয়ে ভেতরে আসলাম৷ তোর কপাল তো সোনায় সোহাগা! দুবেলা বসবি, খাবি, ঘুমাবি আর বাপের টাকা উড়াবি।

নোরিন জবাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। নিজেকে আপ্রাণ শান্ত রাখতে চেষ্টা করলো। এই অসভ্যটার সামনে কিছুতেই নিজের ব্যক্তিত্বে আঘাত হানতে দেবে না নোরিন। পরে দেখা যাবে, এই অশান্ত ছেলেটা তাকে তার কথা দিয়েই নাচাচ্ছে। জাস্ট ইম্পসিবল!

নিবিড় চেয়ারের পেছনে হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে আরো আরাম করে বসলো। দৃষ্টি আকাশপানে। নোরিন শান্ত দৃষ্টিতে নিবিড়ের মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাতে নোরিন যেন ভস্ম হয়ে গেলো! বুকটা মৃদু আওয়াজে ঢিপঢিপ করছে। মহাজ্বালা!

— জানিস বুড়ি! আমি এক বন্ধু অনিক। আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম স্কুল লেভেল থেকে। সবাই বলতো, আমাদের দুজনের মধ্যে যদি কোনো একজন মেয়ে হতো, তাহলে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতো। এমন কোনো বিষয় ছিলো না, যা আমরা একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করিনি৷ যত রকম কষ্ট থাকুক না কেন অনিক আমার সাথে সব শেয়ার করতো৷ যেখানেই যেতাম ওকে সাথে নিয়ে যেতাম৷ আমার কথায় অনিক কখনো রাগ করতো না। যত অপমানই করি, পরদিন আমার দরজার সামনে এসে বলবে, ” দোস্ত কেমন আছিস?” এভাবেই চলছিলো৷ একসময় আমি ডিইউ’তে টিকে গেলেও, অনিকের নাম আসলো না। একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতেই খেয়াল করলাম, অনিক আর আগের মতো নেই। সেই প্রাণোচ্ছল ভাবটা আর নেই। আমাকে দেখলেই লুকাতে চাইতো। নিজেকে একরকম আড়ালে নিয়ে গেলো৷ আমি চেষ্টা করতাম, কিন্তু ও কিছুতেই জানাতে চায়নি।সেবার ছুটি শেষে আমি ক্যাম্পাসে ফিরে গেলাম৷ এর মাঝে একদিন শুনি অনিক আর নেই। মারা গেছে। বুড়ি তুই ভাবতে পারছিস? আমার বন্ধু আর নেই। হুট করে চলে গেলো আমাকে না জানিয়ে। আমি অনেক কিছু ম্যানেজ করে বাড়ি ফিরলাম। অনেকদিন পর জানতে পারি, অনিক একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। এতোটাই ভালোবাসতো যে, আমাকেও কোনোদিন জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি৷ মেয়েটা ওর ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। ওকে ঠকিয়ে চলে গেলো। আর আমার বোকা অনিকটা অভিমান করে চলে গেলো। হ্যাঁ আসলেই অনিক বোকা ছিলো। নাহলে একটা মেয়ের জন্য জীবন দেয়! আরেকটা ঘটনা কি হলো জানিস? আমার ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই। তুখোড় মেধাবী। ব্রাইট ফিউচার। বড় বড় চাকরিও তার কাছে কিছু নয়! সেই হাসিখুশি বড় ভাই একদিন হুট করে ত্রিশটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় পড়লো। ভাই এখন কি করে জানতে চাস? সে এখন একটা মানসিক হসপিটালের রোগী। কোথায় চাকরি! কোথায় ভবিষ্যতে! সব শেষ। তার কারণ হলো ঐযে সো কল্ড ভালোবাসা! একটা মেয়ে হাজারটা ছেলেকে ঠকিয়ে জাস্ট টাকার জন্য নিজের জ্বালে ফাসায়। আরো কত মেয়ে দেখলাম, সবাই একই! আরো এমন হাজারো ঘটনা আছে তুই কি শুনতে চাস নোরিন? বলবো? না থাক। জানিস নোরিন? মেয়েরা না চাইলে সব ঠিক করতে পারে৷ ওরা আসলে প্রত্যকেই বিশ্বাসঘাতক। ওরা ঠকবাজ, লোভী! আমি ঘৃণা করি তাদের। নোরিন তোকে আমি বোঝাতে পারবো না হাউ মাচ আই হেট দ্যাম!

নিবিড় টেবিলে একটা বারি মারলো। চোখ টকটকে লাল আকার ধারণ করেছে।
—- আমি কোনো বিশ্বাসঘাতককে আমার লাইফে আসতে দেবো না। আমি কাউকে সেই সুযোগ দেবো না। সব মেয়েই খারাপ! সবাই!

চলবে
#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
______________________________
নিবিড় টেবিলে একটা বারি মারলো। চোখ টকটকে লাল আকার ধারণ করেছে।
—- আমি কোনো বিশ্বাসঘাতককে আমার লাইফে আসতে দেবো না। সব মেয়েই খারাপ! সবাই!

নিবিড় বাকরুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। নিজের অজান্তেই আচমকা ঝর্ণার বেগে অশ্রুকণা পড়তে লাগলো। আষাঢ়ের কালো মেঘের ন্যায় তার মনেও হুরহুর করে বজ্রপাত হলো। নিজেকে সামলাতে চেয়ে আরো আরো বেসামাল হয়ে পরলো নোরিন। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো।

নিবিড় চলে গেছে। নোরিনের দিকে একবার ফিরেও দেখলো না। ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা? এসব ভালোবাসার কোনো দরকার নেই। ভালোবাসা ছাড়া সবাই থাকতে পারে। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। জীবন নিজের নিয়মে চলবে। সব আবেগ। কয়েকদিন পরে এমনিই কেটে যাবে।

নোরিন আলুথালু পায়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে কাতরাতে লাগলো। মেঝেতে গড়াগড়ি খেলো, ইচ্ছে মতো কাঁদলো। তার হৃদয় পোড়ে ছারখার হয়ে গেলো। কারণ নিবিড়ের ফেরত আনা শার্টের বুকপকেটে তার ঐ দুইলাইনের লিখা কাগজটাও আছে। অবুঝ নয় সে। নিবিড় খুব কৌশলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, বেশ ভালোমতো বুঝতে পারলো। কেনো নিবিড়? আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নই? আমার সমস্ত আবেগ দিয়ে লিখা কাগজটা তুমি কেনো ফেরত দিয়ে দিলে? কেনো আমাকে বুঝোনি? শতশত প্রেমিক পুরুষকে পেছনে ফেলে আমি তোমাকে বাছাই করেছিলাম নিবিড়! তুমি আমার ভালোবাসাকে ফেলনা ভাবতে পারো না। আমি সেই অধিকার তোমাকে দিইনি। নিবিড় তুমি কেনো ভালোবাসো না? তুমি তো না বলে চলে গেলে, আমাকে খুন করলে আমি এখন কি করবো? তুমি যে আমার মনটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে কীভাবে জোড়া লাগাই? নিবিড় তুমি মিলিয়ে নিও, আমার মতো করে কেও তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। একদিন তুমিও আমাকে ভালোবাসবে, ঠিক আমার মতো। কিন্তু হয়তো আমি সেই ডাক আর শুনবো না। যে ভালোবাসাকে আজ তুমি ফেলনা ভেবে ছেড়ে গেলে, সেই ভালোবাসাকেই তুমি কুড়িয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু আমি ফেরত নেবো না। আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসবো না নিবিড় ভাইয়া৷ তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য নও। আমি তোমাকে আর ভালোবাসবো না।

নোরিন ঠিক তেমনটাই কাতরাতে লাগলো, যেমনটা সে মায়ের সামনে করে। নোরিন কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো। তারপর জ্ঞান হারালো। প্রচন্ড মানসিক চাপে, অবহেলায় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

রাতে যখন আজমল আলী সেরনিয়াবাত মেয়ের ঘরে গেলেন, দেখলেন ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তিনি বেশ কয়েকবার ডাকলেন নোরিনকে। জবাব এলো না। বাইরে থেকে মানুষ আনা হলো। দরজা ভাঙা হলো। মেয়ে তার অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পরে আছে। জানালা দিয়ে হুরমুর করে বাতাস ঢুকছে। মেয়ের গায়ে শাল নেই, মানকি টুপিটাও নেই, ঠান্ডা ফ্লোরে পা রাখা দুষ্কর সেখানে নোরিন শুয়ে আছে। সামনের চুলগুলো পুরো মুখ ঢেকে দিয়েছে। আজমল আলী শক্ত পাথরের মতো জমে গেলেন৷ এ কি দশা হয়ে গেলো মেয়ের৷ মেয়েটা হয়েছে ভীষণ চাপা স্বভাবের, কাউকে কিচ্ছু বলবে না। সে নিজেই যেনো সবজান্তা। তিনি নোরিন পর্যন্ত যেতে পারলেন না। লাইলা, রাধুনি মেয়েটাই নোরিনকে দিয়ে তুললো। আজমল আলী বুক অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে। নোরিনকে রাত ন’টায় হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। টানা দুইদিন সে জগতের আলো দেখলো না। দু’দিন পর যখন চোখ খুলে দেখলো, আজমল আলী তার হাত ধরে পাশে বসে আছেন। নোরিনের চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। বুকে সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করলো। সবকিছু অর্থহীন মনে হতে লাগলো, মনের কোথাও যেন বিশাল একটা ফাঁকা জায়গাকে সে আবিষ্কার করলো।

— মা তোকে কে কষ্ট দিয়েছে একবার বল! আমি তার লাইফ হেল করে ছাড়বো। তোকে কে কষ্ট দিয়েছে বল একবার শুধু।

নোরিন বাবার হাত ধরে শুধু কেঁদেই গেলো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। আজমল আলী ভাবলেন, এতোদিন পর নানুবাড়িতে ঘুরে এসে নোরিন তার মায়ের জন্য কাঁদছে। মায়ের ভাবনায় তার অসুস্থতার কারণ। সুতরাং ব্যাপারটা ওখানেই চেপে গেলো।

দিন কাটতে লাগলো। নোরিন খুব যত্নে বদলে ফেললো নিজেকে। কে নিবিড়! কোন নিবিড়! সে কাউকে চিনে না। নিবিড় নামক কোনো ছেলেকে নোরিন চেনে না। নিবিড়ের কথা মাথায় আসলেই নোরিনের নিজের প্রতি রাগ হয়। জীবনের প্রথম সে কাউকে মন দিয়েছিলো, সে কিনা রিফিউজ করে দিলো। তাও নোরিনকে? নোরিনের তখন ইচ্ছে হয় নিবিড়কে কুচি কুচি করে কচু গাছের মতো কেটে ফেলতে। কেনো সে নিজেকে প্রকাশ করে ফেললো? নোরিন প্রতিজ্ঞা করে ফেললো, সে নিজেকে কোনোদিন নিবিড়ের সামনে দাঁড় করাবে না।
নোরিন পড়াশোনাই নিজেকে সম্পূর্ণরুপে বিলিয়ে দিলো। নিজের রুপে, গুণে দিনদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। সব ছেলেদের কাছে সে এক স্বপ্ন। নোরিনের মনে একটুখানি জায়গার জন্য তারা কত কিছুই না করে। একদিন এক ছেলে তার সামনে হাত কেটে ফেললো। নোরিনের সামনে বসে হাতজোড় করে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো। পুরো কলেজে হইহই রইরই রব পড়ে গেলো৷ মেয়েরা গভীর চোখে ছেলেটাকে দেখছে৷ এভাবেও কেঁদে কেউ! কিন্তু নোরিনের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। ছেলেটা তাকে বলতে লাগলো,
—- নোরিন কলেজে আসার সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে দেখে আসছি। একটু ভালোবেসে দেখো নোরিন৷ কোনোদিন ঠকাবো না৷ প্লিজ নোরিন আমি আর পারছি না!

নোরিন মনে মনে ছেলেটাকে বললো, ” আমার মতো কখনো ভালোবেসেছো? নিশ্চয়ই বাসোনি।কাউকে গভীর ভাবে চেয়েও, এক সমুদ্র ভালোবেসেও না পাওয়ার কষ্ট, অবহেলা অনুভব করতে পেরেছো? রাতের পর রাত কারো স্মৃতি আকড়ে ধরে বালিশ ভিজিয়েছো? তুমি তাকে ভালোবাসো জেনেও, শুধু তার দেয়া অবহেলাটা পেয়েছো? ভালোবাসার প্রকাশ করার পর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছো? নিশ্চয়ই হওনি।”
বাস্তবে নোরিন যেন খুব মজা পেলো। কাটা হাতটার দিকে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর কৌতুক ভরা বাঁকা হাসি দিয়ে চলে গেলো। কলেজের টিচার’রা পর্যন্ত সেদিকে অবাক চোখে এক নিষ্ঠুর নোরিনকে পর্যবেক্ষন করছিলো।

প্রতিরাতে নোরিন যখন ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে, তার চোখে আপনা আপনি ভেসে উঠে এক অশান্ত ছেলের মুখ। সেই গভীর চোখ যেন সবসময় হাসছে, পাগল করা হাসি, সুন্দর গোছানো চুল, খাঁড়া নাকের সে ছেলেটাকে৷ নোরিনের রাতে ঘুম হয়না৷ অদ্ভুত ব্যাকুল কষ্টে সে যেন দিনকেদিন পাথরে পরিণত হলো। আহা! কি সে কষ্ট। এই কষ্ট প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না, বলা যাবে না। নোরিনের নিজেকে তখন খুব তুচ্ছ মনে হয়। যার কাছে তার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই, তবুও কোনো সে ভাবনাতে আসে? আর কত বেহায়া হতে হবে? সে তো আর ভালোবাসতে চায়না। তবুও কেনো এই গোপন কষ্ট মুছে না? কেনো ভুলতে পারা যায় না?
তোমাকে ভুলতে গিয়ে তাই আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি, তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নিই, যতই তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই ততই মিশে যাই নিশ্বাসে প্রশ্বাসে। আমি তোমাকে সত্যি ভুলতে চাই নিবিড় কিন্তু পারছি না৷ তুমি প্লিজ আমার মন থেকে চলে যাও।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here