ভালোবেসেছি_তোরই_মতো পর্বঃ১২,১৩

0
1981

ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
পর্বঃ১২,১৩
লেখিকাঃ শাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ১২

জীবনের একটা দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তখন বুঝবে অন্য আরেকটি দরজা তোমার জন্য আপনাআপনিই খুলে গেছে। আজ অনেক মাস কেটে গেলো। নোরিন প্রায় বেরিয়ে এসেছে নিবিড়ের ট্রমা থেকে। তবে মাঝেমধ্যে সেই আগের দিনগুলো মনে আসলে, ও শুধু থমকে যায়। তখন ওর মন শুধু একটাই প্রার্থনা করে, “হে বিধাতা! তুমি আমাকে নিবিড়ের সামনে কোনোদিন দাঁড় করিও না। তুমি জানোই আমি তাকে ভুলতে চাই। ”
নোরিন অসংখ্যবার এই প্রার্থনা করে। কিন্তু সে ভুলতে পারে না। উপর থেকে তার দোয়া কবুল হয়না। যতবার ভাবে ভুলে যাবে, তার চেয়েও বেশিবার মনে পড়ে যায়।
এই এতোগুলো মাসে নোরিন কিংবা নিবিড় কেউই কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। নোরিন সম্পূর্ণরুপে নানুবাড়ির সকলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। জেরু কয়েকবার আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নোরিন সরাসরি তাকে আসতে মানা করে দেয়। পড়াশোনায় এখন উন্নতির শেখরে নোরিন। কেমেস্ট্রির সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়টা তার সবথেকে প্রিয়। সে একটানা বসে পুরো একটা খাতা লিখতে লিখতে শেষ করতে পারে কোনো বিরক্তি ছাড়াই। বাংলা বইয়ে সবার কাছে বিরক্তিকর পদ্যটা নোরিন খুন মনোযোগ দিয়ে পড়ে। খুব ব্যাথিত মনে সে পড়াটা শেষ করে। একদিন তার ক্লাসের ঝর্ণা মিস তাকে অসম্ভব আদুরে গলায় ডেকে বললো,
—- ইউ আর ডুয়িং ভ্যারি ওয়েল মাই বেবি। তুমি দিনদিন সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছো। আমার মনে হয়, তুমি এবারে হাইয়েস্ট মার্ক নিয়ে রেঙ্ক করবে। তোমার পারফরমেন্স আগের চেয়ে ভালো। ক্যারি অন। আ’ম অলওয়েজ উইথ ইউ।
নোরিন কিছুই বললো না। তার মন তখন ম্যামকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসলো,
—- আচ্ছা মিস? আমরা যে এতো এতো ফরমোলা ইউজ করে এতো কঠিন ম্যাথগুলোকে সল্ভ করি, আচ্ছা কোনো সায়িনটিস্ট কি সুখী হওয়ার ফরমোলা ডিসকাভার করেননি? অথবা ভুলে যাওয়ার দাওয়াই?
বছর ঘুরতেই নোরিন ইয়ার চেঞ্জ এক্সামে সবচেয়ে ভালো রেসাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। কলেজে এর আগে এতো ভালো রেঙ্ক কেউ করতে পারেনি৷ তাও সব বিষয়ে! ঝর্ণা মিস নোরিনকে মন ভরে দোয়া করে দিলেন। নোরিন আবার মনে মনে প্রশ্ন করলো, ” মিস এখন কি আমি সুখী হতে পারবো? মন খুলে হাসতে পারবো?”

আজমল আলী সেরনিয়াবাত মেয়েকে সময় পেলেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। নোরিন আগে চুপচাপ থাকলেও সে মানসিক ভাবে সুস্থ ছিলো৷ এখন নোরিন যেন আরো দ্বিগুণ গম্ভীর হয়ে গেছে৷ অথচ সে সব কাজই নিয়মমতো করে। যেমন, সকালের চা করে দেওয়া, বিকেলে একসাথে টিভিতে নিউজ দেখা, আলোচনা করা, রাতে একসাথে খাবার খাওয়া, ঠাট্টা করা, ইউকেন্ডে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা সবই ঠিক আছে কিন্তু তবুও কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে। আজমল আলী মেয়েকে হাসানোর চেষ্টা করেন। আজ সকালে নোরিনকে বললেন,
—- লিয়াকতকে বলেছিলাম কয়েক কেজি ইলিশ মাছ আনতে। তোমার তো ফেবারিট! কাল জিজ্ঞেস করতেই বললো, মাছ পাইনি। এই মৌসুমে ইলিশ মাছ পাইনি! কি শাস্তি দেওয়া যায়?

নোরিন কৌতুক ভরা চোখে তাকিয়ে বললো,
—- বাবা তুমি লিয়াকতকে পদ্মা নদীতে ফেলে দেবে। প্রতিটা ডুবে একটা করে ইলিশ তুলে আনবে। না পারলেই শাস্তি। কঠিন শাস্তি।

—- ওই কুমড়োপটাশটা আনবে মাছ? পরে দেখা যাবে ও’র তরমুজ পেট নিয়ে ভেসে উঠেছে।

নোরিন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে বললো,
—- বাবা! তুমি বরং ওর ভুঁড়িটাকে ফুটবল বানিয়ে খেলো। খেলতে খেলতে দেখবে তোমার নিজের ভুঁড়িটাই আর নেই। ভালো না?

— হা হা হা মামণি! তা তুমি যে ছেলেটার কথা বলেছিলে রাশেদ৷ বাজে মেসেজ পাঠায়৷ সে কি আর তোমার পিছু নিয়েছে আর? ওর নাম্বারটা পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়েছিলাম৷ এখন কোনো অসুবিধা হচ্ছে?

—- না বাবা। এভ্রিথিং ইজ অলরাইট নাও। বাবা কি হয়েছে জানো? কাল একটা ছেলে ড্রাইভারকে ফুলের বুকে দিয়ে বলে, সিলমোহর সাইনে যেতে। খানিকটা ভাবও দেখালো৷

—- হা হা হা মামণি! এনজয় দিস। কিন্তু ভুলেও কোনো ছেলেকে মন দেবে না। এসবে এখন জড়ালে নিজের লাইফ ক্যারিয়ার সব শেষ। নিজেকে নিজের হাতে খুন করা৷ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ছেলেটার হাতে তোমার হাতে তুলে দেবো।

আজমল আলী মেয়েকে হাসাতে গিয়ে নিজেই ঘর কাঁপিয়ে হাসেন৷ কিন্তু নোরিন হাসে না৷ ঠোঁটটা একটু প্রশস্ত করে রাখে। সে মনে মনে বলে, বাবা মন দেওয়া তো হয়ে গেছে কিন্তু আর ফেরত নিতে পারিনি। পৃথিবীর সেরা ছেলেটাকে আমি চাইনা। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছেলেটাকে বেছে নিয়েছে তোমার মেয়ে। তার হাতে সহস্রবার খুন হয়েছে। সে ভেতরের আমিটাকে শেষ করলেও একটা লাভ হয়েছে। বাবা সে একদিন আমার জন্য আফসোস করবে। আই এশিওর ইউ। তোমার মেয়ে কখনো হারতে শেখেনি। শেষ হাসিটা একদিন আমি, নোরিন সেরনিয়াবাত’ই হাসবে।

নিজের প্রতি এতো অবহেলার পরও নোরিনের রুপ যেন দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছে না। যতই তার বয়সের সংখ্যাটা যুবতী বয়সকে গ্রহণ করতে যাচ্ছে, ততই তার সৌন্দর্য যেন আশেপাশে ছড়িয়ে পরছে। প্রায় সকালে ঘুম ভাঙলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, তার চোয়ালের নিখুঁত গড়ন, তার নিটোল ঠোঁট। ঘাড় সমান খাঁজকাটা পেঁয়াজি রঙা চুল। হাতে- পায়ের যেখানে মাংসের অভাবে তাকে রোগা দেখায়,সেসব জায়গায় হালকা ফোলাভাব দেখা দিয়ে একটা আশ্চর্য সুন্দর গড়নে রুপ নিয়েছে। তার হাতে সামান্য চাপ লাগলেই রক্তিম লাল আভা সৃষ্টি হয়, একটু সর্দি হলেই নাক লাল হয়ে যায়। তার গাম্ভীর্যতা, নিস্তব্ধ-নীরবতা যেন নিজের আভিজাত্যকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাইরের মানুষের কাছে সে খুব সুখী, হাসিখুশি এবং অহংকার নিমজ্জিত একটা মেয়ে কিন্তু একমাত্র সেই জানে, নোরিন কীভাবে নিজেকে পুরো পৃথিবী থেকে আড়াল করে রেখেছে। ভেতরে সে একেবারেই প্রাণহীন একটা ফুল যেটা, বহুদিন পানির অভাবে মারা যাচ্ছে। একটু পানি ছুঁয়ালেই এক্ষুনি বাঁচতে পারে। কিন্তু পানি গ্রহণ করতে সে নারাজ। দরকার পরলে মরে যাক তবুও সে পানি ছুঁয়াবে না।

?
?

আজ নোরিনের কলেজে এনুয়্যাল ফাংশান। নোরিন গান করবে। সকালে কলেজে এসে একবার অফিসে একবার ক্লাসে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে তাকে। অনুষ্ঠান হিসেবে বিশেষভাবে সাজাইনি সে নিজেকে। একটা হুডিওয়ালা জ্যাকেট পড়ে জিপ খোলা রেখেছে, ভেতরের কালো স্ট্রাইপ গেঞ্জি, কুচকুচে কালো রঙে গায়ের সাথে লাগানো টিপটপ জিন্স। কালো বুট জুতা। পার্লারে গিয়ে স্পেশাল করে শুধু চোখজোড়াকে সাজিয়েছে। গাড় কাজল এবং অন্যান্য উপাদানে সজ্জিত চোখজোড়ার দিকে তাকালে যে কেউ গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাবে এমন অবস্থা। কাঁধে গিটার তুলে যখন সে হাঁটছে উপস্থিত ছেলের মধ্যে যেন এক চাপা উচ্ছাস, উত্তেজনা। কি মোহময়ী!আবেদনময়ী অধরা নোরিন! ছেলেদের আকৃষ্ট করার মতো সব গুণ নিয়ে জন্মেছে সে তবুও নিজের ব্যাপারে বরাবরই অনীহা তার। নিজের জন্যই গাফিলতি। গায়ের মাতাল করা সুগন্ধি যেন তারা কয়েক মিটার দুরত্বে থেকেও উপভোগ করতে পারছে।

নোরিন অডিটোরিয়ামে নিজের গান পরিবেশন করলো। কিছু কিছু গান আছে যা অনুভূতি ছাড়া প্রকাশ করা যায় না। অনুভূতি ছাড়া গান অসম্পূর্ণ মনে হয়। গান গেয়ে যদি কষ্ট কমানো যায়, চোখ ভিজে আসে, কিছু স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসে তাতেই গায়কের স্বার্থকতা। নোরিন গিটারের হাত দিলো।

“এলোমেলো ইচ্ছে যত,
ভালোবেসেছি তোরই মতো।
ডুবে আছি আজও তোরই প্রেমে
জীবন সঁপেছি তোরই নামে!
এ’কি সাথে পথ চলা
কত কথা ছিল বলার….
সব যেন আজ শুধু স্মৃতি হলো
জানি না এ কোন রাত এলো!”

নোরিন ঝাপসা ভেজা চোখে সামনে তাকালো। তার ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি দৌড়ে পালায়। আচমকা নোরিনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এ-কি! এ কাকে দেখছে সে? নিবিড়! নিবিড় এই সময় এখানে কি করছে?

চলবে

#ভালোবেসেছি_তোরই_মতো
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন

আচমকা নোরিনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এ-কি! এ কাকে দেখছে সে? নিবিড়! নিবিড় এই সময় এখানে কি করছে?
নোরিনের হঠাৎ কি হলো সে জানে না। সে গানটা কোনোমতে গাওয়া শেষ করলো। আনন্দে তার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। নিবিড় নিশ্চয় তার সাথে দেখা করতে এসেছে! নিশ্চয়ই তাকে না দেখে এতোদিন থাকতে পারছিলো না। নোরিন যেন নিজের মাঝে নেই৷ ডিপ ব্লু শার্টে নিবিড়কে মারাত্মক লাগছে। নোরিনের মস্তিষ্ক বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘তুই যাস না। আবার তোকে অপমান করবে। নোরিন নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখ। ‘
নোরিন মস্তিষ্কের কথা শুনলো না। এতোদিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত মান-অভিমান, জেদ-ঘৃণাকে তুচ্ছ করে নিজেকে নিবিড়ের সামনে দাঁড় করালো। নোরিন আকুতিভরা খুশী খুশী চোখে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। আর নিবিড়? সে তো ভ্রু কুঁচকে নোরিনকে দেখেই চলেছে।
—- নিবিড় তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছো তাইনা?

নোরিনের সমস্ত বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়ে নিবিড় বললো,
—- প্রশ্নই আসে না! তুই এই কলেজের স্টুডেন্ট আমি জানতামই না। আমি তো এসেছি একটা জরীপ করতে। আমাদের ভার্সিটি থেকে একটা প্রজেক্ট নিয়ে পুরো বাংলাদেশের ভালো ভালো কলেজ বাছাই নিয়ে জরীপে নেমেছি। তোকে পেলাম ভালোই হলো। আমাদের একটু সাহায্য কর বোন! তোকে তো পপ সিঙ্গারের মতো লাগছে৷ চোখে এসব কালি-টালি কি দিয়েছিস?

নোরিনের মাথা ঘুরে গেলো নিবিড়ের কথা শোনে। কথার খেই হারিয়ে ফেললো মুহূর্তেই। মুখে ভর করলো আকাশের কালো মেঘ। দাঁতে দাঁত চেপে কোনোরকম কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। এতোগুলো মাস পর নিবিড়ের সামনে উপস্থিত হলো এই কথা শুনতে? এতো খারাপ কেনো নিবিড়? আর কতো নিজেকে ছোট বানাবে নিজেকে নোরিন? আর কতো কষ্ট পাবে!

নিবিড়কে এড়িয়ে নোরিন চোখ মুখ খিচে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। এই বাজে লোকটার সামনে আর আসবে না ও। কয়েক কদম এগুতেই জ্যাকেটের হুডিতে টান পরলো যেন। নোরিন পেছনে ফিরলো। শয়তান পাজিটা এখন তার জ্যাকেট ধরে টানাটানি করছে৷ কি ভয়ানক অসভ্য! নিবিড় মুচকি হাসি হাসতেই, নোরিনের সমস্ত রাগ যেন কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো। বুকের বা পাশ দিয়ে যেন আস্ত একটা বোঝা নেমে হালকা হলো।

—- কোথায় যাচ্ছিস? একটু আপ্যায়ন-টাপ্পায়ন কর! এরা আমার ফ্রেন্ড।

নোরিন চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো। এতোক্ষণ তো খেয়ালই করেনি। প্রায় ডজনখানেক ছেলে নিয়ে এসেছে নিবিড়। প্রত্যেকেই উজবুকের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। নোরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের মতিগতি বুঝতে পারলো। জ্যাকেটের জিপ টেনে নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের কক্ষ চিনিয়ে দিতেই সবাই রুমের ভেতর চলে গেলো। ম্যাম ভীষণ ব্যস্ত হয়ে কাগজ-পত্র ঘেটে কি যেন করছে। চোখে-মুখে উদ্দীপনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এতোগুলো ব্রাইট স্টুডেন্ট তার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকেই দেশের সম্পদ, ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তিনি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
নোরিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ নিবিড় নামক অশান্ত ছেলেটা যতক্ষণ না সে আসছে, এখানে অপেক্ষা করতে বলেছে। নোরিনের একটা গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো। নিজেকে আবার ছোট করেছে সে৷ জীবনটা যে চোখের পলকেই কীভাবে এতো এলোমেলো হয়ে গেলো বুঝে আসে না তার৷ নিবিড় এমনভাবে কথা বলেছে যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। ঐ চিঠির কথা, সেদিনে গার্ডেনে বলা কথাগুলো সবকিছু এড়িয়ে গেছে। মুখে তার ছাপটুকু পর্যন্ত নেই৷ নোরিনের দৃষ্টি ছলছল করছে। তাহলে কি নিবিড় সেইসব কথা ভুলে গেছে৷ জীবনের প্রথম নিজের অপ্রকাশিত ভাবনা বলে বেড়ানোর প্রমাণ কি সে ভুলে গেলো? কই নোরিন তো ভুলে যেতে পারেনি৷ প্রতি রাতে সে ধুঁকে ধুঁকে মরে। নোরিনের চোখ আবার ভিজে আসছে। এতোদিন পরেও নিজেকে শক্ত রাখতে পারেনি সে৷ ঠিকই যেচে চলে গেছে নিবিড়ের সামনে৷ আর নিবিড়, সে তো যেন কিছুই জানে না। সত্যি কি আপনি কিছু জানেন না? জানেন নিবিড় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট কোনটি? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো একতরফা ভালোবাসা। আর তারচেয়ে বড় কষ্ট হলো আমি আপনাকে ভালোবাসি সেটা আপনি জানতেন, কিন্তু এখনো যে ভালোবাসি তা জানেন না। প্রথম প্রেমের যন্ত্রণা আপনি বুঝবেন না নিবিড়। প্রথম প্রেমের যন্ত্রণাটা মৃত্যুর মতোই ভয়ানক, যন্ত্রনাদায়ক। সবকিছুকে তো নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছিলাম এতোদিন। আবার কেনো এলেন আপনি? আপনাকে এতো করে চাইলাম, কই আপনি তো ধরা দেননি। তবুও কেনো আসলেন?

—– বুড়ি!

নোরিনের ভাবনার মাঝেই নিবিড় তাকে পেছন থেকে ডাকলো। নোরিন জলদি চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে পেছন ফিরলো। নিবিড় হাত ভাঁজ করে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। নোরিনের মনে পুরনো ক্ষতটা জ্বলজ্বল করে উঠলো যেন৷ হার্টবিট লক্ষ গুনে ছুটতে লাগলো। গলা শুকিয়ে এলো আর অসম্ভব রকমের বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো।

—- বেরিয়ে এলেন যে? বাকিরা আসলো না!

—- ওরা কাজ করছে। আমি ওদের টিম লিডার। ওদের কাজ শেষ হলেই আমার কাজ শুরু।

— ওহ!

তারপর পিনপিতন নীরবতা। দু’পক্ষই চুপচাপ। নোরিন আনমনে সামনে হাঁটতে লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিম ধরে গেছে। নিবিড়ই এবার মুখ খুললো,
— তোহ…. দিনকাল কেমন কাটছে? সব ঠিকঠাক?

— হ্যাঁ… বেঠিক হওয়ার তো কোনো কথা নয়।

— তা বুড়ি প্রেমট্রেম করছিস তো? তোদের বয়সী মেয়েরা তো দশ-বারোটা প্রেম করলেও বলে, আমি জন্মগত চিংগেল! হুহ… তুই কয়টা করছিস বল।

নোরিনের ইচ্ছে হলো এক্ষুণি নিবিড়কে ল্যাবে নিয়ে যায়৷ তারপর শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে পরীক্ষা করবে। এতো বজ্জাত ছেলে এই দুনিয়ায় কেনো! ব্যাটা যেন দুধের বাচ্চা! শোন, তোকে আমি একটুও ভালোবাসিনা বুঝলি? তুই আমার সামনে থেকে দূর হ। তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না। তোকে আমি একটুও ভালোবাসি না। নোরিনের মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আবার। ছোট্ট করে জবাব দিলো,
— প্রেম জীবনে একবারই আসে নিবিড় ভাইয়া। আমার জীবনেও একবার এসেছিলো। সুনামির মতো লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেছে।

নিবিড় ইতস্তত করে খুশ খুশ করতে লাগলো। হালকা ঝেরে কাশলো। চোখ পিটপিট করে যেন নিজেকে শান্ত করতে চাইলো সে। হঠাৎ নোরিনের কানে ফিসফিস করে বললো,
—- শুনেছি, সুন্দরী মেয়েদের গায়ে নাকি কলঙ্ক বেশি। তোর আছে নাকি কলঙ্কের দাগ? কতজনের আছে?

নোরিনের সমস্ত শরীর যেন ঘিনঘিন করে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্য পা আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। নিশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেলো। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো।
—– আপনি ভীষণ খারাপ নিবিড় ভাই। আপনি আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না।
আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না নোরিন। দুনিয়া ভেঙে কান্না আসছে তার। বারবার ভাঙছে সে। মুখ বুজে সহ্য করে আজ সে আবার প্রতিজ্ঞা করলো, সে নিজেই নিবিড়ের সামনে আর আসবে না।

এই ছিলো তাদের দেখা হওয়ার মুহূর্ত। নোরিন আবার নিজেকে ব্যস্ত করে ফেললো। নিবিড় নামক কোনো প্রাণীর যেন কোনো অস্তিত্বই নেই এমনভাবে নিজেকে বদলে ফেললো। সামনে থাকলে হয়তো গলে যাবে এই ভয়ে নোরিন একেবারে নিবিড়ের সামনে আসা পর্যন্ত কমিয়ে দিলো। সময় অতিবাহিত হলো। তিন কি চার মাস পরের কথা,

এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে নোরিন বিছানায় আয়েশ করে পড়ছিলো। লাইলা এসে বলে গেলো, নিচে তার কাজিন গ্যাং এসেছে। নোরিনকে ডাকছে। লাইলা আরো বিশেষভাবে বললো, সেইদিনের সেই সুন্দর, লম্বা জিরাফ ছেলেটাও এসেছে। নোরিন নিচে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো। ভীষণ মনোযোগী হওয়ার ভঙ্গিতে লাইলাকে বললো,
—- আমি ভীষণ ব্যস্ত লাইলা! ভীষণ ব্যস্ত! জগতের পড়া বাকি আছে। দেখো, আস্ত চল্লিশটা মডেল কোইশ্চ্যেন আজ আট ঘণ্টার মধ্যে কমপ্লিট করতে হবে। ইটস আরজেন্ট। তুমি একটা কাজ করো। নিচে গিয়ে বলবে, আমি দেখা করতে পারবো না। আমার পড়া আছে। পড়তে পড়তে নাজেহাল অবস্থা। তুমি ওদের খাইয়ে দাইয়ে বিদেয় করো। থাকতে চাইলে থাকবে। আমি দেখা করছি না।

নোরিন দরজাটা লক করে বুক চেপে বসে পড়লো মেঝেতে৷ আজ আর পড়া হবে না তার। সবই বাহানা৷
সেইদিনের মতো সবাই চলে গেলো। লাইলার কাছে শুনেছে, নিবিড় নাকি বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেছে। কেনো গেছে তা অজানা। নোরিন মুখ বাঁকা করে হাসলো। গেলে যাক, তাতে ওর কি হুহ!

ভীষণ কঠিন হয় সেসব মানুষ, যাদের মনের ভেতরটা বারবার ভেঙেছে। নোরিনও নিজেকে কঠোরে পরিণত করেছে। আরো চারটা মাস কেটে গেলো। নোরিনের মন এখন অনেকটা ফুরফুরে। নিবিড়ের যন্ত্রণা এখন আর আগের মতো পীড়া দেয়না। দেওয়ার কোনো রকম পন্হা সে অবশিষ্ট রাখেনি৷ সবকিছু বন্ধ৷ ভুলেও যোগাযোগ হওয়ার বা সামনে পরার কোনো সুযোগ নেই। একটু একটু সাজিয়ে নিয়েছে নিজের জীবনটাকে।
এরই মাঝে একদিন খবর এলো নিবিড়ের বড় ভাই শীতল ভাইয়ার বিয়ে। নানুমণি, নিবিড়ের মা-বাবা দুজনেই নোরিনের বাবাকে আলাদা আলাদা ফোন করে দাওয়াত দিয়ে রেখেছে। বিয়ে তাদের বাড়িতেই হবে। নোরিনকে আগে পাঠিয়ে দিতে বলেছে৷ কিন্তু নোরিন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো সে কিছুতেই যাবে না। যাবে না মানে, কোনো মতেই যাবে না। অজুহাত হিসেবে রাখলো সামনে পরীক্ষা। পাবলিক এক্সাম৷ এসব বিয়েটিয়েতে যাওয়া মানেই সময় নষ্ট। আজমল সাহেব মেনে নিলেন। মেয়ে তার বরাবরই পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস। তাছাড়া, তিনি হাজারবার বললেও নোরিন যাবে না। ভীষণ একরোখা, জেদী হয়েছে একেবারে মায়ের মতো।

তার ঠিক দিনদুয়েক পরের কথা। নিবিড় এসে হাজির। আজমল সাহেব বললেন, ‘ নোরিন তো যাবে না। তুমি বলে দেখো তোমারই তো বোন৷ ‘ মুখে এসব বললেও আজমল আলী জানেন, নোরিন কারো কথা শুনবে না।

লাইলাকে দিয়ে খবর পাঠাতেই, নোরিন যথারীতি আগের অজুহাত দিয়ে নিশ্চিন্তে পড়তে শুরু করলো৷ হয়তো চলে গেছে এতোক্ষণে। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল করে মিনিট কয়েকের মাঝে নিবিড় স্বয়ং ওর রুমে এসে হাজির। নোরিন ভয়ে চেয়ার ছেড়ে দূরে সিটকে পরলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here