ভালোবেসে ছিলাম তারে পর্ব -১২,১৩

0
313

ভালোবেসে ছিলাম তারে
পর্ব -১২,১৩
মাসুরা খাতুন
১২

“হারিয়ে গেছ অন্ধকারে – পাইনি খুঁজে আর,
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!”

সকাল দশটা,নিশিতা ক্লাসে স্টুডেন্টদের নজরুল ইসলামের “চৈতী হাওয়া “পড়াচ্ছিল। প্রতিটা লাইন যেন নিশিতা কে উদ্দেশ্য করে কবি নিজ হাতে লিখেছেন। প্রত্যেকটা লাইন নিশিতার জীবনের সাথে মিলে যায়।আজকাল নিশিতা ক্লাস নেওয়ার সময় প্রত্যেকটা উপন্যাসের, প্রত্যেকটা কবিতার নায়িকা ভাবে নিজেকে, যেখানে পুরোটায় বিরহে মোড়ানো। কখনো সুরবালা,কখনো ডাহুকের সেই বিরহী ডাহুক, আবার কখনো চৈতী হাওয়ার ব্যর্থ প্রেমিক মন। খুব অদ্ভুত লাগে নিশিতার।জীবনে যার কোন স্থান নেয় সেই মানুষটায় মনের একটা ছোট্ট কোণ দখল করে রাজ করে।সত্যিই কি শত সংসারের চাপে,জীবনে নতুন মানুষের আগমনে, হাজার ও ব্যস্ততায় ও ভোলা যায়, সেই অতীতে ফেলে মানুষটি কে? তার স্মৃতি গুলোকে? তার সুক্ষ্ম অনুভূতি গুলোকে? মনে হয় যায়না। মুখে আমরা যতই বলি ভুলে গেছি, মনে রাখিনি, সবটা ছেড়ে এসেছি। কিন্তু না,বাস্তবে সবটা ছেড়ে আসা যায় না, স্মৃতি গুলো কখনো মোছা যায় না,তা শত চেষ্টা করলেও।হ্যাঁ হয়তো সংসারের ব্যস্ত সময়ে, জীবনে নতুন নতুন মানুষের আগমনে, সেই মানুষটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, খেয়ালের বাইরে চলে যায়।কিন্তু কোন একদিন হটাৎ মাঝরাস্তায় আবারও দেখা হয়ে গেলে কি বুকের ভেতর ধক করে ওঠে না? অজান্তেই দু জোড়া চোখ আটকায় না একসাথে? যে বলবে আটকায় নি সে কোনদিন ভালোই বাসেনি,যে বলবে বুকে ধক করে ওঠে নি, তার মনে আসলে কোনদিন অনুভূতি জন্মই নেয়নি সেই মানুষটির জন্য।
নিশিতা গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে ক্লাসে মনোনিবেশ করে। মনটা কেনন করছে ওর,খুব অস্থির অস্থির লাগছে।খুব প্রিয় কোন জিনিস হারানোর আশংকা পাচ্ছে নিশিতা।অস্থিরতায় কোন রকমে ক্লাস টা সম্পুর্ন করলো নিশিতা।

রাতে নানারকম ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল সোহান বুঝতেই পারে নি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখে নিশান আর নিশিতা দুজনেই বেরিয়ে গেছে। আজ নিশিতার সাড়ে আটটায় ক্লাস ছিলো, তায়তো আজ নিশান কে স্কুলে নিশিতারই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।আর সোহান একটু দেরি করে অফিস গেলেও আজ সমস্যা নেয়।তায়তো সোহান কে ডাকেনি নিশিতা।সোহান ঘড়ি দেখলো নয়টা বেজে গেছে। ও তাড়াহুড়ো করে ওঠে। দশটায় আরাফাতের সাথে দেখা করার কথা আছে ওর।সোহান ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হালকা কিছু খেয়ে নেয়।সকালের খাবার টা ও খুব সামান্যই খায়। তারপর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে আরাফাতের উদ্দেশ্যে।

ড্রাইভ করতে করতে ভাবে সোহান,একটা মানুষ বুকের ভেতর কতোটা কষ্ট জমিয়ে রেখেও নিত্যদিন সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে পারে, মুখে অমায়িক হাসি ধরে রাখতে পারে তা আরাফাত কে না দেখলে বোঝা যায় না। যার ভেতর টা প্রতিটা পরতে পরতে কষ্টে ভরা।
সেদিন আরাফাতের কথায় সোহান নিজেও অনেক কষ্ট পেয়েছিল। আরাফাত নিজের জীবন সম্পর্কে সবটায় বলেছিলো সোহানকে। আরাফাত আতংকে ছিলো,যদি আর সময় না পায়।

আরাফাত নিজের অসুখের কথা সবার কাছ থেকে গোপন রাখে।বাবা অসুস্থ মানুষ, প্রেসার এমনিতেই কনট্রোলে থাকে না, তার ওপর বাবাকে নিজের এতোবড় অসুখের কথা বলাটা ঠিক হবেনা বলে মনে করে আরাফাত। আর বড়ভাই আহানাফ প্রচন্ড ভালোবাসে আরাফাত কে।দুই ভাই একে অপরের ছায়া।তায় ভাই কে বললে সেও ভেঙে পড়বে।আর যেখানে অসুখ টার পরিনতিই মৃ ত্যু সেখানে সবাই কে এতো তাড়াতাড়ি বলে কষ্ট দেওয়ার নায় মনে করে আরাফাত। কিন্তু ভাবি একদিন ঠিকই বুঝতে পারে আরাফাতের কিছু একটা হয়েছে, যেই ছেলে সারাদিন বন্ধুবান্ধব,আড্ডা ছাড়া থাকতোনা, এতো টা প্রাণোচ্ছল ছেলে কি করে এমন হয়ে যেতে পারে? তার ওপর নিশিতার সাথে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে এসে আরাফাত প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। ঘর থেকে বের হওয়া বাদ দিয়ে দেয়। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা যে কুড়ে কুড়ে খায় প্রেমিক মন গুলোকে তা শুধু সেইসব প্রেমিকযুগলরাই জানে।শেষ পর্যন্ত ভাবিকে বলতে বাধ্য হয় আরাফাত, সবকিছু খুলে বলে।ভাইয়ের মতো দেবরটার এমন কষ্টের কথা শুনে ওর ভাবি ও ভেঙে পড়ে। ওর ভাই কে বলতে চায়লে আরাফাত নিষেধ করে।আরাফাত অনেক অনুরোধ করে কাউকে না বলতে।কিন্তু ওর ভাবির জোরাজোরিতে নিয়মিত ডক্টর দেখাতে হয় আরাফাত কে।এরই মধ্যে একদিন খবর পায় নিশিতার বিয়ে হয়ে গেছে, আবার আহত হয় আরাফাত। চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষ কে অন্য কারো হতে দেখে, কিন্তু ওর কিছুই করার নেই।
ওর ভাবি একদিন খবর দেয় সে মা হতে চলেছে। আরাফাতের কষ্টের জীবনে একটু সুখের খবর শুনতে পায়,সুপ্তির জন্মের পর সবাই বলে সুপ্তি দেখতে ঠিক ওর মতো হয়েছে। আরাফাতের ভাবি মজা করে বলে,
“কিরে আরাফাত, মেয়েটাকি তোরই নাকি রে? দেখতে যে একদম তোরই মতো হয়েছে। ”

আহানাফ মুখ ফুলিয়ে বলে,
“না না একদম ঐ বিদেশি বান্দরের মতো হয়নি,যা তা বলবে না,ও দেখতে ঠিক আমার মতো সুন্দর হয়েছে, ”
“ভাবি তুমি ওই ভদ্রলোক টাকে বলে দাও মেয়েটা একদম ঐ ভদ্রলোক টার মতো হাঁদারাম হয়নি,ও দেখতে ওর চাচ্চু আহমেদ আরাফাতের মতোই হয়েছে। ”

সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।
ওর ভাবির কথায় ঠিক,সুপ্তি দেখতে আরাফাতের মতোই হয়েছে। হয়তো ওর পরবর্তী পরিচয় ওর চাচ্চু আরাফাতই হবে বলে মেয়েটাও একদম আরাফাতের কপি তৈরি হয়েছে। ওই চোখ, ওই নাক,সেই হাসি সবটায় লেগে আছে সুপ্তির মুখে।

তারপর আবারও আসে আরাফাতের জীবনে দ্বিতীয় কালো অধ্যায়।সুপ্তির বয়স তখন ছয়মাস।আহমেদ মিলস এ একটা বড় ডিল সাইন হওয়ার কথা।বিদেশ থেকেও অনেক ক্লাইন্ট আসার কথা,তায়তো আহমেদ ফ্যামেলির সবাই ওখানে উপস্থিত থাকা জরুরি।
আরাফাত কে বারবার বললেও আরাফাত যেতে নারাজ ওসব অফিসিয়াল মিটিংয়ে। তায়তো সুপ্তিকে আরাফাতের কাছে রেখে ওর ভাইয়া ভাবি, বাবা সবাই মিটিংয়ে যায়।বাসায় আরাফাত সুপ্তিকে দেখে রাখে।সন্ধায় আরাফাতের কাছে একটা ফোন আসে,কে যেন ওর ভাইয়ের নাম্বার থেকে ফোন করে, ওকে তাড়াতাড়ি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলে।আরাফাত সুপ্তিকে আমেনা খালার কাছে রেখে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় আরাফাত। গিয়ে যা দেখে তাতে আরাফাত একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবা ও ভাবি ওর সাথে দুটো কথা বলার পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। খুব খুব অভিমান নিয়ে চলে গেছে বাবা,বেয়াড়া ছেলেটাকে কোনদিন অফিসে বসাবার না পারার অভিযোগে চিরকালের মতো অভিমান করেছে বাবা।আর ভাবির এতো ভালোবাসার সংসার টা ছেড়ে ভাবি ও সার্থপরের মতো বিদায় নিয়েছে। আরাফাত যখন যায় একমাত্র ভাইটায় অপেক্ষা করছিল ওর জন্য।ওকে শত শত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে।কিছু কথা বলেছিল ভাইয়া।সুপ্তিকে আজীবনের জন্য দিয়ে গেছিল ওকে।তারপর ভাইয়াও ভাবি আর বাবার মতো চির সুখের ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে।যে ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে আরাফাত শত পার্থনা করতো সৃষ্টিকর্তার কাছে, এতো দিন ধরে শুধু মোনাজাতে বলে গেছে ওমন একটা ঘুমের আর্জি, আজ বিনা আর্জিতে ভাইয়া, ভাবি, বাবা পেয়ে গেল ওমন সুখের ঘুম।কিন্তু ওদের তো এতো তাড়াতাড়ি এ ঘুমের দরকার ছিলো না, কতো সুন্দর ছিলো এই তিনটি মানুষের জীবন, যত যাতনা ছিলো এই মানুষটার বুকে,কিন্তু যে যেটা চায় সে বোধ হয় তা পায় না, পৃথিবীর সবাই পেলেও সে শুধু সেই জিনিস টা থেকে বঞ্চিত থাকে।

গাড়ি করে ফিরছিলো ওরা।হটাৎ গাড়িটা ব্রেক ফেইল করে, গাড়িটা একদম কনট্রোলের বাইরে চলে যায়, একেবারে গিয়ে পড়ে একটা খাদে ওখানেই চলে যায় বাবা আর ভাবি। আহানাফের ও অবস্থা খুব খারাপ ছিলো।হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যায় সেও

তিনটি র ক্তা ক্ত দেহের কাছে বসে আছে আরাফাত। ও কাঁদছে,খুব কাঁদছে। কেউ নেয় ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার। আরাফাত পুরোপুরি বিদ্ধ স্ত। নিয়তি ওকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে।ওর খুব রাগ ভাবির ওপর।অনেক রাগ।
আরাফাত কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে ভাবিকে বলে,

“ভাবি,তুমি আমার সাথে এতোবড় শত্রুতা করতে পারলে! তুমি খুব খারাপ, ভাবি তুমি খুব খারাপ। বাবা,ভাইয়া না জানুক, তুৃমি তো জানতে আমি সুস্থ নই,আমি এ পৃথিবীতে কিছুদিনের অথিতি মাত্র। যেকোনো সময় আমার বড় ধরনের কিছু হয়ে যেতে পারে। তাও কেন এমন করলে ভাবি।কেন তোমরা সবাই আমাকে ছেড়ে গেলে।এখন আমি কি করবো বলোতো? কি করে সুপ্তিকে সামলাবো? সব দোষ আমার,আমি কাছের মানুষদের ধরে রাখতে পারিনা।কি করে সুপ্তিকে ধরে রাখবো।ওই তো আমাদের বংশের একমাত্র চিহ্ন। ”

খুব কাঁদে আরাফাত।একে একে নালিশ জানায় বাবাকে,

“বাবা,ওবাবা।এতো অভিমান তোমার? এতো অভিমান এই অপদার্থ ছেলেটার ওপর?আমি কি করতাম বলো তো বাবা? তুমি বলতে বিয়ে করতে,তুমি বলতে অফিসে বসতে,কিন্তু আমি যে কোন টায় পারবো না বাবা।বাবা,তোমার এই ছেলেটাও যে খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের কাছে চলে যাবে।আমার ওপর রাগ করে থেকো না বাবা।”

“ভাইয়া,তুই এতো হিংসুক! সেদিন ভাবি সুপ্তিকে আমার মেয়ে বলেছিলো বলে তুই সত্যি সত্যি রাগ করে সুপ্তিকে ছেড়ে গেলি? আমার ওপর তোর এতো রাগ! কি করে আমি এতোবড়ো দায়িত্ব পালন করবো ভাইয়া।এতোদিন নিজের মরন কামনা করে আসতাম।কিন্তু এখন আমার কিছু হলে সুপ্তির কি হবে ভাইয়া বল?আমি কতোদিন সুপ্তির কাছে থাকতে পারবো তাও জানিনা।”

একসাথে তিনটি লা শ দাফন করেছিল আরাফাত সেদিন। কেউ পাশে ছিলো না,কেউ সান্ত্বনা দেয়নি।তখন থেকেই বুঝতে পারে ওর বেঁচে থাকতে হবে।সুপ্তির জন্য হলেও ওর বেঁচে থাকতে হবে। তায়তো ঠিক মতো চিকিৎসা নিতে থাকে। অন্তত যতোদিন বেঁচে থাকা যায়।কিন্তু ওর সব কিছু আবার এলোমেলো হয়ে যায় হটাৎ আবার নিশিতাকে দেখে।সেদিন নিশিতার বাসা থেকে এসে খুব ড্রি ং ক করে আরাফাত। পুরনো দহন জ্বালাতে থাকে ওকে।তারপর থেকে প্রতিদিনই নিজেকে পোড়ায় আরাফাত। কিন্তু এখন যখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে গেছে তখন সুপ্তির ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় ভোগে।সুপ্তির একটা নির্ভর যোগ্য ভবিষ্যৎ করে দিয়ে না গেলে ওপারে গিয়ে কি জবাব দেবে ভাইয়া ভাবির কাছে।তায়তো সেদিন ছুটে যায় সোহানের কাছে।জরিয়ে ধরে সোহানের হাত।আরাফাতের জীবন কাহিনী শুনে এমনিতে ও সোহান অত্যান্ত ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিল, তাতে আরাফাতের এ দাবি ফেলতে পারে নি সোহান । সেও কথা দেয় সুপ্তিকে ও নিজের কাছে রাখবে।কোনদিন ও কোন কষ্ট পেতে দেবেনা।

গাড়ি এসে থামে শহরের এক রেস্টুরেন্টে। গাড়ি থেকেই দেখতে পায় সোহান ভেতরে এক অসহায় ভদ্রলোক বসে আছে একটি ছয় বছরের ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে। বুকের সব আদর ঢেলে দিচ্ছে মেয়েটিকে।আজই যে ওদের বাবা মেয়ের শেষ দেখা। অসুস্থ, ভগ্ন শরীরের লোকটি তায় শেষ আদর করে দিচ্ছে ওর এতোদিনের আগলে রাখা সুপ্তিকে। একদম ভাঙা চেহারা, নেয় কোন জৌলুশ, না আছে সৌন্দর্য। কে বলবে এই ব্যক্তিটি একদিন সুদর্শন এক যুবক ছিলো, যার একটু খানি হাসিতেই পাগল হয়েছিল এক সবে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে,,,,,,,,

চলবে,,,,,

ভালো বেসেছিলাম তারে
পর্ব -১৩
মাসুরা খাতুন

সুপ্তিকে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে আরাফাত। ভিষণ দূর্বল শরীর,তারপর ও সুপ্তিকে কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করছে না। হয়তো আজই শেষ দিন ওর আদরের সুপ্তির সাথে। আরাফাতের অবস্থা খুবই খারাপ। ডক্টররা কিছুতেই বাইরে আসতে দিতে চায়নি,যেকোনো সময় খারাপ কিছু হয়ে যাবে।এমনিতেই এইডস,তার ওপর কিছু দিন ধরে নিয়মিত ড্রি ংক করায় সবকিছু ডক্টরদের হাতের বাইরে চলে গেছে। দীর্ঘ এগারো বছর ধরে ভাইরাস টাকে সাথে নিয়ে ঘুরছে আরাফাত। টেস্ট করে বুঝতে পারে সাত বছর আগে, কিন্তু এর সুত্রপাত তো সেই বিদেশে ছাত্র জীবনে।
আরাফাতের শরীর টা কিছুতেই যেন আর সায় দিচ্ছে না।সাথে এক বন্ধু কে এনেছে, যে ওকে আবারও হসপিটাল পৌঁছে দেবে।আমেনা খালাকে ও বিদায় জানিয়েছে আরাফাত। ভাবি থাকা সময় থেকে আমেনা খালা ওদের বাড়িতে থাকেন।মধ্য বয়স্ক মানুষটার ও পৃথিবীতে কেউ না থাকায় আরাফাতের বাড়িই হয়েছিল আমেনা খালার আশ্রয়। সুপ্তিকে উনিই দেখা শোনা করতেন। আরাফাতের অসুখ সম্পর্কে ও জানতো আমেনা খালা।তায়তো আরাফাত এই শেষ বয়সে মানুষ টাকে রাস্তায় ছাড়ে নি।আরাফাত আহমেদ ভিলাসহ সকল প্রপার্টি সুপ্তির নামে করে দিয়েছে। ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সহ সবকিছু সুপ্তির কাছে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। কিন্তু আহমেদ ভিলা টা আমেনা খালার দায়িত্বে রেখেছে।আমেনা খালাকে নির্দেশ দিয়েছে বাড়িটা ভাড়া দিতে,আর কিছু জায়গায় আমেনা খালা থাকতে।শেষ বয়সে যেন আর কোথাও কাজ করতে যেতে না হয় তায় ভাড়া পাওয়া টাকা গুলো আমেনা খালা কেই নিতে বলেছে,যতোদিন উনি বেঁচে থাকবেন।তারপর সুপ্তি যা চায়বে তায় হবে।অনেক অনেক কৃতজ্ঞ হয়ে আমেনা খালা ও প্রতিদিন আরাফাতের কাছে আসে হসপিটালে।বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। সুপ্তিকে একায় সামলায়।তায়তো আরাফাত বুঝতে পারে এবার ওর সুপ্তি কে ওর নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া উচিত। টাকা পয়সা যা আছে তাতে সুপ্তির সারাজীবন কোন সমস্যা হবেনা, কিন্তু? একটা ভালো পরিবার সুপ্তি কোথায় পাবে? তা শুধু নিশিতা সোহানের কাছেই পেতে পারে সুপ্তি। নিশিতাকে মা হিসেবে পাওয়া,অর্থাৎ নিশিতার সহচর্যে বড় হওয়া কম কথা নয়।একমাত্র নিশিতার কাছেই সুপ্তিকে নিশ্চিন্তে রেখে যেতে পারবে আরাফাত। তায়তো সোহানে কাছে আজ সুপ্তি কে দিতে এসেছে আরাফাত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হয় সোহান। খুব সুন্দর ভাবে কুশল বিনিময় হয় দুজনার।আরাফাতের অবস্থা দেখে আঁত কে ওঠে সোহান। প্রতিদিন যেন আলাদা চেহারা হচ্ছে আরাফাতের।জিম করা সুঠাম দেহের অবশিষ্ট ও নেয় বর্তমানে। একদম ভাঙা, রোগাক্রান্ত অসহায় মানুষ হয়ে গেছে আরাফাত।সেই সুন্দর হাসি যেন আজ বেমানান লাগছে ঐ গাল ভাঙা মুখে। দু-চোখে অশ্রু জমা হয় সোহানের। একটা মানুষ সারা জীবন ভালোবাসতে বাসতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সারাজীবন শুধু কষ্ট পেয়ে পেয়ে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। না ভালোবাসাকে,না পরিবারকে,আর না শেষ সম্বল প্রিয় মেয়ে কে? কাউকেই ধরে রাখতে পারলো না মানুষ টা।যার ইতিহাসে পুরোটায় কষ্ট লেখা।
নিজেকে মাঝে মাঝে অপরাধী মনে হয় সোহানের। দুজন মানুষ কতো যন্ত্রণায় ভোগে ভালোবাসা হারানোর তা ও নিজে চোখে দেখেছে।একজন মনের ভেতর হাজারো যন্ত্রণা চাপা দিয়ে রেখে ভালো থাকার অভিনয় করে যায়,আরেক জন সেই ভালোবাসার আগুনে পু ড়ে একদম নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু সোহানের কি কিছু করার ছিলো? ও কি তখন জানতো যে কেন আরাফাত সেদিন সেই নাটকটা করেছিল? কি সত্যতা ছিলো এর পেছনে? না।ও জানতো না।তায়তো নিশিতা কে তখন সঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক করায় ছিলো একমাত্র উদ্দেশ্য। সোহান নয়,আসলে ভাগ্য ওদের এক হতে দেয় নি।

“কেমন আছেন আরাফাত? আমি কি বেশি দেরি করে ফেললাম? খুব কষ্ট দিলাম আপনাকে?
আরাফাতের কাঁধে হাত রেখে বলল সোহান।

আরাফাতের কথা বলতে অনেক টা সমস্যা হচ্ছে, গলায় টান অনুভব করছে খুব।কিন্তু আজ তো ওকে কথা বলতেই হবে,অনেক দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে আজ।
শ্বাস টেনে টেনে উত্তর দেয় আরাফাত,

“এইতো আছি,আমার আর ভালো থাকা সোহান।না না আপনার দেরি হয়নি,আমরা ও একটু আগে আসলাম। ”

আবারও কথা শুরু করলো আরাফাত,
“আমার সুপ্তিটাকে দেখে রাখবেন প্লিজ। নিশিতাকে বলবেন, আমার শেষ চাওয়া ওর কাছে, আমার মেয়েটাকে একটু ভালো রাখা।হয়তো আমি আর বেশি ক্ষণ নেই, যাওয়ার আগে প্লিজ সোহান কথা দিন আমার এই মেয়ে টাকে সারাজীবন দেখে রাখবেন? আপনি সারাজীবন আমাকে দিয়েই এসেছেন সোহান,সাত বছর আগে আমার সব থেকে প্রিয়, ভালোবাসার মানুষটাকে আপনি সামলিয়েছেন,ওকে নতুন জীবন দিয়ে আমার চাওয়া পূর্ণ করেছেন, আমার সাথে নিশিতার সম্পর্কের কথা জানার পরও নিশিতা কে সাপোর্ট করেছেন, আজ,আজ আবার ও চির ঋনী হয়ে যাচ্ছি আমি আপনার কাছে। ”
এতোটুকু বলতেই সোহান আরাফাত কে থামায়,

“ওসব কথা এখন বাদ দিন প্লিজ, আমার এতোটুকুও রাগ,ক্ষোভ কোনটায় আপনার প্রতি নায়।আমি কখনোই চায়না আপনার খারাপ কিছু হোক,আমি মন থেকে চায় আল্লাহ আপনাকে আবারও সুস্থ করে দিক,একটা মানুষ কে এভাবে সারাজীবন কষ্ট পাওয়া দেখতে আমি কিছুতেই পারি না।”

“আজ আমায় বলতে দিন সোহান। আমার ওপারের ডাক এসে গেছে, আর কোন সুযোগ নেই ফিরে আসার।”

এর মাঝেই সুপ্তি বলে উঠলো,

“বাবাই,কোথায় যাবে তুমি? কি কথা বলছো তোমরা? ”
না বুঝা ছোট্ট সুপ্তির প্রশ্ন।

“সুপ্তি, মা আমার।আমার না অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য বিদেশে যেতে হবে, মামুনি,লক্ষি মেয়ে আমার,তুমি আজ থেকে তোমার সোহান আংকেলের বাসায় নিশিতা আন্টি, নিশানের সাথে থাকবে।”
সুপ্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে সোহান।

“কিন্তু বাবাই তুমি ফিরবে কবে? আমার তোমাকে না দেখতে পেলে ভালো লাগে না। ”
মুখ ভার করে বলল সুপ্তি।

সোহান, আরাফাত দুজনেরই দু- চোখে টলমল পানি।

“ওমন কথা বলে না মামুনি,ওখানে নিশিতা আন্টি আছে তো! নিশিতা আন্টি তোমাকে খুব আদর করবে।নিশানের সাথে খেলবে তুমি, স্কুল যাবে। ”

“তা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি ফিরবে কবে বাবাই?”

“আমি ফিরবো তো মামুনি,ঠিক ফিরবো।অফিসে তো অনেক কাজ! আমি না থাকলে চলবে না যে মা।তোমার বিয়ের দিন ঠিক ফিরবো আমি।আর প্রতিদিন তোমার মাম্মামের মতো চাঁদ হয়ে তোমার সাথে গল্প করবো আমি।একদম আংকেল আন্টিকে বিরক্ত করবে না মামুনি।উনারা যা বলবেন,তায় শুনবে।ঠিক আছে মা?”কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে বলে আরাফাত।

“ঠিক আছে বাবাই, আমি কোন দুষ্টমি করবোনা।তবে তুমি কিন্তু ফিরবে।আর প্রতিদিন আমার সাথে কথা বলবে আকাশে এসে।”

“হ্যাঁ মা,অবশ্যই বলবো,এইবার একটা পাপ্পি দিয়ে দাও বাবাইকে।”

ছোট্ট করে একটা ভালোবাসা একে দিলো আরাফাতের কপালে সুপ্তি।আরাফাত ও বুকে জরিয়ে নিলো ওর ছোট্ট সুপ্তিকে।

“সোহান সাহেব, এই নিন কাগজ পত্র। আমার সব প্রপার্টি দুই ভাগ সুপ্তির নামে আর একভাগ নিশানের নামে করে দিয়েছি।সবগুলো এখন আপনার দায়িত্বে নিন।”

“এটা কি করেছেন আরাফাত, নিশানের নাম কেন দিয়েছেন? এগুলো সব সুপ্তির অধিকার। এখানে আপনি শুধু শুধু নিশানের নামটা কেন দিতে গেছেন। ”
ব্যাকুল হয়ে বলল সোহান।

“প্লিজ সোহান,আপনি না করবেন না। সারাজীবন আমাকে দয়া করেছেন, এবার শেষ অনুরোধ টা রাখুন আমার।প্লিজ। জানি আপনার অনেক কিছু আছে,আমার এই সামান্য উপহার খুব অল্পই,কিন্তু যাওয়ার আগে এই এতোটুকু উপহার দেওয়ার সুযোগ দিন আমায়।”
আরাফাতের আকুল আবেদন।

“কিন্তু,, এটা ঠিক করেননি আপনি আরাফাত। সুপ্তি আমাদের ও মেয়ে। আর ওর অধিকার এভাবে ভাগ বসানো কি ঠিক?”

“আর নিশান? ও বুঝি আমার ও ছেলে না? এই যে,সবকিছু ঠিক থাকলে নিশানের বাবা আজ আমি হতাম,বুঝলেন মিস্টার? তায় আমার ছেলে কে আমি যায় ইচ্ছা দিতে পারি।”
এই ভারি পরিবেশে সোহানের মত ঠিক করতে সামান্য রসিকতা আরাফাতের। কি লাভ? নিজের কষ্টের জন্য সবাই কে পো ড়ানোর।

“আরাফাতের কথায় লজ্জিত হয়ে হেসে ওঠে সোহান। ”
“আপনি সত্যিই অন্য রকম একটা মানুষ আরাফাত সাহেব। যেকোন মানুষ, যে কোন পরিস্থিতিকে অভিভূত করার শক্তি আপনার আছে। এমন মানুষের সাথে আরো আগে পরিচয় হওয়া উচিত ছিলো আমার।খুব আফসোস হয়।”

“তায়তো বেশি দিন থাকতে পারলাম না।”

“এভাবে বলবেন না প্লিজ। শুনুন,আমি একটা কথা ভাবছি,সুপ্তি যেহেতু মেয়ে, তায় একদিন না একদিন ওকে পরের কাছে পাঠাতেই হবে,আর আমি আপনাকে কথা দিয়েছি সারাজীবন ওকে আমাদের কাছে রাখবো,তো ওকে সারাজীবন আমাদের কাছে রাখার একটা উপায় অবশ্য আছে,যদি আপনি অনুমতি দেন তো?”
বলে সোহান।

“আপনি যা বলছেন আমি বুঝতে পেরেছি,এটা যদি সম্ভব হয় তাহলে আমি চিরসুখে যেতে পারবো।আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না।

“ঠিক আছে,আগে ওরা বড় হোক, তারপর ওদের সম্মতি যদি থাকে তবে অবশ্যই আমরা সে ব্যবস্থা করবো,আপনার অনুমতির দরকার ছিলো ।”

“অনুমতি বলছেন কেন? এ আমার পরম পাওয়া, আমার সুপ্তি সারাজীবনের জন্য আপনাদের মতো মানুষের কাছে থাকতে পারবে।”

দুজনে জরিয়ে ধরলো দুজনকে।দুটি দু প্রান্তের মানুষ এক হয়ে বুক মেলালো এক সাথে, যেখানে কোন হিংসা, বিদ্বেষ নেই।

এরই মাঝে হসপিটাল থেকে ফোন এলো আরাফাতের কাছে। একঘন্টা হয়ে গেছে প্রায়,এর বেশি এ সময় আরাফাতের বাইরে থাকা উচিত নয়।

অবশেষে চলে যাওয়ার সময়।
”সোহান , নিশিতা কে সুখে রাখবেন।একটা অপদার্থ বেইমান কে ভুলে যেতে বলবেন ওকে। আর বাড়ির বাইরে বকুল গাছটাও কেটে ফেলবেন।ঐটা থাকলে ও কখোনো ভুলতে পারবে না আমাকে।আর আমার সুপ্তিকে ভালো রাখবেন প্লিজ । ”
দুচোখ ভরা অশ্রু নিয়ে কথা গুলো বলে আরাফাত।

“আমি চেষ্টা করবো আরাফাত, আমি কথা দিচ্ছি,জীবন দিয়ে আগলে রাখবো আপনার দান করা দুটো অমূল্য রত্নকে।সারাজীবন যত্নে রাখবো ওদের। আপনি ভরসা রাখুন।”
আবারও জরিয়ে ধরে দু জন কে।

“সুপ্তি মা,তুমি কিন্তু সবসময় ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে,কখনো ঝামেলা করবে না আন্টিকে।বাবাইয়ের জন্য কাঁদবে না,তুমি কাঁদলে বাবাই দূর থেকে ও কষ্ট পাবে।”

“ঠিক আছে বাবাই, আমি কাঁদবো না।”
বলেই কেঁদে ফেললো সুপ্তি।

“ছি মা তুমি না গুড গার্ল! গুড গার্লরা কখনো কাঁদে না।”

“তাহলে তুমি ও তো কাঁদছো বাবাই? তুমিও কি পঁচা? কেঁদো না বাবাই,আমি একটু ও দুষ্টমি করবো না।কখনো আংকেল আন্টি কে বিরক্ত করবো না।”
কাঁদতে কাঁদতে বলে সুপ্তি।

জরিয়ে ধরে আরাফাত ওর ছোট্ট সোনামুনি টাকে।যাকে আগলে এতোদিন বেঁচে ছিলো সেই একমাত্র অবলম্বন টাও নিয়ে বাঁচার আর অধিকার নেই ওর।ও পৃথিবীর সবথেকে দুর্ভাগা মানুষ হয়তো।

শেষ বারের মতো আদর করে দিয়ে সোহান কে বলে আরাফাত,

“ওকে নিয়ে যান সোহান।আমার মেয়েটাকেবদেখে রাখবেন প্লিজ।আমার মতোই আরেকটি দুর্ভাগা ও।পৃথিবীতে আপনারা ছাড়া আপন বলতে আর কেউ থাকলো না ওর।”

সোহান ও কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে সবচেয়ে নিষ্ঠুর কাজটি করে সোহান।এক অসহায় বাবার বুক থেকে আরো এক অভাগী কে কোলে তুলে নিয়ে অন্য দিকে রাস্তা ধরে।

সুপ্তিও মনে হয় বুঝতে পেরেছে, আজ ওর বাবাইয়ের সাথে শেষ দিন,তাইতো অনেক অনেক স্নেহ দিয়ে আদর করে দেয় আরাফাত কে।শেষ চুমু দেয় ওর বাবাই কে।
কিন্তু কাঁদে না মেয়ে টা।কান্না থামিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই, হয়তো বুঝতে পেরেছে ওর কান্না দেখে ভিষন কষ্টে জ্ব লে যাচ্ছে একটি অসহায় বাবা,,,,,

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here