ভালোবেসে তোমায়,পর্ব:৮

0
3545

ভালোবেসে তোমায়,পর্ব:৮
Writer: Jannat

হাসপাতাল ,সংসার আর বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ব্যাস্ত আছে তিশা ।
শায়নের সংসারে কোনো তারা নেই আর নেই কোনো ব্যাস্ততা । জীবনটা বোর হয়ে উঠছে আর মন-মানসিকতা সে তো অবশ্যই ।সারাক্ষন ছটপট করে কাটাচ্ছে হেনা ।
__হেনা,এই হেনা
__কি হইছে, আসছি তো
__চোখ বুঝে, হাত বাড়াও
__উফফ । আচ্ছা…
শায়ন ২টা টিকেট বের করে হেনার হাতে দিল
__এবার চোখ খোল…
__টিকেট(অবাক হয়ে)
__হ্যা অফিস থেকে ৭দিনের ছুটি নিয়েছি । আর পুরো ছুটিটা কক্সবাজারে কাটাবো ।
হেনা আনন্দে শায়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । অনাবরত কেঁদেই চলছে । কাঁদবেই না কেন “এই ৪বছর ৪মাস” পর শায়ন তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে ।
এই কয়েকটা বছর নরকের যন্ত্রনার মত কাটিয়েছে । শায়ন নিজেকে সামলে নিয়েছে ।
জোর করে আর যাই হোক ভাগ্যকে বদলানো যায় না তাই যে কয়েকদিন বেঁচে থাকবে স্বাভাবিক ভাবেই বেঁচে থাকবে ।
কিন্তু আজও তিশাকে খুঁজে বেরাচ্ছে তবেই বিফলই হচ্ছে ।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে হেনা লাকেজ গুছাচ্ছে আর শায়ন হেল্প করতেছে ।
তিশা তার রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে নিয়ে ছাদে বসে গল্প করতেছে ।
দিনের বেলা একদমই সময় দিতে পারে না ডিউটির জন্য । আর মাঝে মাঝে রাতেও জুরুরি ডিউটি পড়ে যায় । সেদিন তাদের কি যে অভিমান ।রাতে তাদের মামুনিকে কাছে চাই চাই । তাই তিশা রাতে খুব কম ডিউটিই করে । নানা ভাই আর নানুনের সাথে তাদের ভীষন ভাব । তারাও খুব ভালোবাসে এই মাটির পুতুল ২টোকে।
__মামুনি
__জী,বাবাই
__সবার বাবা আছে ,আমাদের বাবা কোথায় ?
ছেলের প্রশ্ন শুনে আচমকা চমকে উঠল তিশা ।
.
প্রথম যখন কথা বলতে শিখছে
সেই সময় একদিন , ডিউটি শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে ,মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাদের নিয়ে রুমে আসল তিশা ।
সারাদিনের ক্লান্ত ক্লান্ত শরীরটা আর মনটা নিয়ে যখন বাসায় ফিরে নিজেকে খুব অবশ মনে হয় । কিন্তু বাসায় এসে এই মায়াময় মুখ ২টোর দিকে তাকালে অনাবিল শান্তি বয়ে যায় । বুকের সাথে জড়িয়ে নিলে ক্লান্ত বুকটা শান্ত হয়ে যায় । সারা শরীরে আদরের পরশ দিলে ক্লান্ত দেহটা সতেজ হয়ে উঠে ।
মাত্র মুখ থেকে আআআ বুলি বের হচ্ছে ,ওদের অস্পষ্ঠ শব্দগুলো তিশাকে পাগল করে দিচ্ছে ।
তিশা বারবার মামুনি বলানোর চেষ্টা করতেছে ,কিন্তু তিশিন আর তিশান একদমই নারাজ । তারা তাদের মত কথা বলতেছে ।
তিশা যখন ব্যার্থ হয়ে বালিশে নিজেকে হেলিয়ে দিল ঠিক তখনই ২জনই আধো আধো কন্ঠে বাবা ডেকে উঠল ।
সেদিনও তিশা চমকে গিয়েছিল । বাবার স্পর্শতো দূরের কথা যেখানে বাবার দেখাটাও আজও মিলে নাই সেখানে এদের মুখের প্রথম ভাষা বাবা শুনে আতকে উঠারই ।
এতদিনে ভুলেই গিয়েছিল যে এরা তিশার একার সন্তান না ,হ্যাঁ এদের বাবা আছে । এই সন্তান যখন বড় হয়ে বাবাকে জানতে চাইবে তখন এদের কি জবাব দিবে ।
তার সন্তানের বেড়ে ওঠার পথে এই একটা প্রশ্নই প্রভাব ফেলতে যথেষ্ঠ ।
.
প্রথম যখন বাচ্চা পেটে আসে কতই না স্বপ্নের বীজ বুনছিল । তখন মনে হয়েছিল সুখরা যখন আসে দল বেঁধেই আসে । একদিন বাচ্চাদের প্রথম ডাক কি হবে তা নিয়ে সে কি খুনসুটি । শায়ন অফিস থেকে এসেই পেটের কাপড়টা সরিয়ে অনেকগুলো আদর দিল ,হাত বুলিয়ে দিল তারপর পেটের উপর মাথা রেখে ভিতরটাকে অনুভব করতে চেষ্টা করতেছে ।
__এই কি করছো ?
__হুস,আমার সোনামনিদের সাথে জরুরি মিটিং করতেছি ,ডিস্টার্ব কর না তো
__তুমি সত্যিই পাগল
__তিশু
__হুম
__এই তিশুপাখি
__কিহহ ,কানে শুনতে পাও না__রেগে যাচ্ছ ক্যান ময়নাটা ।
জানো ,
বাবাইটা কি বলছে
__ভ্রুকুচকে কি জানতে চাইলো
__বলছে ।বাবা জানো ,,,
আমি যখন কথা বলতে শিখব তখন তোমাকেই ডাকব প্রথম
__নাহহ ,একদমই না ওর মামুনিকে ডাকবে
__দূর আমাকেই ডাকবে বলেছে । আচ্ছা তিশু পাখি ,আধো আধো কন্ঠে যখন বাবা বলে ডাকবে । তখন অনুভূতিটা কেমন হবে বলতে পার ?
ইশ আমার তো ওর মুখে আধো ভাষায় বাবা শুনতে আর তর সইছে না ।
__এই গন্ডার ,হনুমান ,কুত্তা । আমার বাবাই সোনাটা আমার ভিতর বেড়ে উঠতেছে তাই ওর মামুনিকে ডাকবে ।
__তুমি দেখ ,বাবাকেই ডাকবে ।
হ্যাঁ গো তোমার ধারনাই সঠিক । আমার কলিজার টুকরোগুলো বাবাকেই ডাকল । বাট ওদের ডাক শুনে পাগল হয়ে যাওয়া বাবাটা যে ওদের নেই ।
আজ এই বাবা শব্দটাই ওদের চলার পথে বাঁধা হয়ে যাচ্ছে ।
.
__ও মামুনি কি হল বলছ না কেন ?
আমাদের বাবা কোথায় ?
মেয়ের ডাকে হুস ফিরে পেল তিশার । বলতে শেখার পর থেকে কয়েকশত বার এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে । বারবারই এড়িয়ে যাচ্ছে ।
__আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্রটা দেখতে পারতেছ না ,ওখানেই তোমার বাবা থাকে ।
__আমাদের কাছে আসবে না ,মামুনি ?
ক্লাশে সবাই বাবার গল্প করে ,তখন খুব মন পড়ে বাবাকে।
ম্যাম যখন বাবা/মা নিয়ে রচনা লিখতে বলে সেই প্রথম থেকে শুধু মাকে নিয়ে লিখছি ।
জানো মামুনি ,,,
খুব ইচ্ছা করে বাবাকে নিয়ে কখনো লিখতে ।
বাচ্চাদের কথা শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারতেছে না তিশা ।
ওদের কথাগুলো বুকে প্রচন্ড আঘাত করতেছে ।
__বাবাকে খুব প্রয়োজন তোমাদের ?
__ভীষন মিস করি ।
যখন সবার বাবা তার ছেলে-মেয়েকে আদর করে আমাদেরও খুব ইচ্ছা হয় বাবার কোলে চড়তে ।
__বেশ ,তাহলে আমি ওই দূর আকাশে তারা হয়ে যাই ।
আর তোমাদের বাবাকে পাঠিয়ে দেই ।(কেঁদে কেঁদে)
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে । বাবার মত মাকে হারানোর ভয়ে ২বাচ্চাই মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে রইল
__নাহ মামুনি একথা বল না । তোমাকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না ।
__তাহলে আর বাবার কথা জানতে চাইবে না তো ?
__প্রমিস, আর কখনো না ।
প্লীজ মামুনি তুমি কেঁদ না তাইলে বড্ড কষ্ট হয় ।
__অনেক রাত হয়েছে ,এখন ঘুমাবে নয়ত ক্লাশ মিস করবে ।
.
বাচ্চাদেরকে রুমে নিয়ে এসে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো । চোখে ঘুম নেই । সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে সন্তানের মুখের পানে চেয়ে ,আজ সেই সন্তানই বারবার অন্ধকার অতীতটাকে সামনে টেনে নিয়ে আসতেছে ।
.
শায়নরা খুব ভোরে উঠেই রওয়ানা দিল । হেনার মনটা খুব ভালো লাগতেছে । এতদিনে কিছুটা হলেও মনের যন্ত্রনাটা হালকা করার সুযোগ পেল ।
শায়নের কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে হেনা । কক্সবাজারে পৌছে হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে বিকেলবেলা সমুদ্র সৈকত দেখতে বের হল ।
প্রতিদিনের মত আজকেও তিশিন আর তিশান তার নানুন আর নানা ভাইয়ের সাথে হাটতে বের হল ।
মেয়েটা একদম তিশার কার্বন কপি ,সমুদ্র বুঝি এর জীবনের একটা পার্ট ।
সমুদ্র দেখলে আর স্থীর থাকতে পারে না ,উত্তল ঢেউ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য ।
তাই তো প্রতিটা বিকাল সকলকে পাগল করে তোলে সমুদ্র দেখার জন্য ।
__তিশিন আস্তে নানুভাই ,পড়ে যাবা তো …..
বলতে না বলতেই ওদের বিপরীত দিক থেকে আসা এক দম্পতির সাথে ধাক্কা লাগে ।
দূভাগ্যবশত ওনাদের হাতে থাকা আইসক্রীম বক্সটা পড়ে যায় । তিশিন একবার ওনাদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ
করে ফেলল ।
আর মায়া জড়িত কন্ঠে ভয়ে ভয়ে সরি বলতেছে ।
শায়ন কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল , বাচ্চাটা বোধহয় শুধু মায়া দিয়েই তৈরি ।
ওর সরি বলা ,ভয় পেয়ে ড্রেস খামচে ধরা বুকের ভিতরটায় ধুকধুক সৃষ্টি করে ফেলছে ।
তিশাকে প্রথম যেদিন দেখে ভার্সিটির নবীনবরন অনুষ্ঠান । শায়ন তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র । তারাহুরা করে গেট দিয়ে ডুকতেছে ঠিক তখনই কারো সাথে ধাক্কা লেগে হাতে থাকা কাগজগুলো পড়ে যায় ।
তিশা পড়ে যাওয়া কাগজগুলো কুঁড়িয়ে হাতের মুঠে নিয়ে শায়নের দিকে বাড়িয়ে দিল । এতক্ষন ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত ছিল , কাগজগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ।
নীল বোরকা ,নীল হিজাব পড়া একটা মায়াবীনি ,ঠোঁটগুলো হালকা গোলাপী ।
ভয়ে চোখগুলো বন্ধ করে আছে আর একহাত দিয়ে কাগজগুলো শায়নের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে বোরকা খামচে ধরে আছে ।
আর ভয়ার্ত মধুমিশ্রিত কন্ঠে সরি বলে যাচ্ছে ।
সেদিন তার এই বহুমিশ্রিত রুপ শায়নকে ঘায়েল করেছিল ।
.
হেনা শক্ত করে শায়নের হাত চেপে ধরায় ,চোখের পলক ফেলল শায়ন । সামনে তাকিয়ে দেখে পরীটা নেই ।হেনা বুঝতে পারল শায়ন বাচ্চাটাকে খুঁজতেছে ।
__বাচ্চাটাকে খুঁজতেছ । এক মুরুব্বী এসে সরি বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল , তোমার তো কোনো খেয়ালই ছিল না ।
তিশার কথায় ডানে-বামে ,সামনে-পিছে খুঁজে দেখতেছে । অনেক দূরে, ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে …….
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here