ভালোবেসে তোমায়,পর্ব: ৬

0
2858

ভালোবেসে তোমায়,পর্ব: ৬
Writer: Jannat
.
তিশার যখন বিয়ে হয় তখন সবেমাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী । বিয়ের পর আর পড়া হয়ে উঠেনি বা নিজেই তেমন আগ্রহ দেখায়নি । এত বেশি ভালোবাসার ভরপুর ছিল যে লেখাপড়া তার নিচে চাপা পড়ে গেছে ।
তবে এখন খুব বেশি আফসোস হচ্ছে ,লেখাপড়াটা চালিয়ে গেলে এতদিনে কম্পিলিট হয়ে যেত । জেনারেল লাইনে পড়ার ইচ্ছা নেই ।
সামনে নার্সিং এর ভর্তির ডেট পড়েছে ,যদি সরকারিভাবে চান্স হয়ে যায় তাহলে আর জেনারেল লাইনে পড়বে না ।
কোসিং এর ভর্তির টাইম যেহেতু শেষ ,সো বাসায় বসেই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছে । রাতদিন এক করে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে যদি আল্লাহ সহায় হয় ।
এই ১মাস ১২দিনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে হেনা আর শায়ন । জোর করে কোনো কিছু অর্জন করার মত বৃথা চেষ্টা আর নেই । আল্লাহ বলেছেন
“ধৈর্য্য ধর “।
নিশ্চই আল্লাহ ধৈর্য্যকারীর সাথেই আছেন ”
ধৈর্য্যর পরীক্ষায় আমি বিফল হইছি ,তাই আল্লাহ এত বড় শাস্তি দিল ।
হয়ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক, শান্ত হয়ে আসছে কিন্তু মনের ভিতরে যে অশান্তির আগুন জ্বলতেছে তা নিভাবে কি করে ।
অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে তিশার সাথে ,যার শাস্তি ইহকাল,পরকাল ২কালেই পেতে হবে ।
তিশা তার বাচ্চা আর লেখাপড়া নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত যে ভুলেও পিছু ফিরার অবকাশ পায় না ।
তিশা আদৌ কখনো
শায়ন বা হেনা কাউকেই অভিশাপ দেয় নি ।
কিন্তু তিশার বুকের ভিতর যে মেঘ সৃষ্টি করে দিয়েছে শায়ন , দিনের শেষে বৃষ্টির ন্যায় অভিশাপসরূপ ঝড়ে পড়ে চোখের জল ।
চোখের জলের চেয়ে বড় অভিশাপ ২য় কিছু আর হয়না ।
দুনিয়াতে সেই বড় অপরাধী যার দেওয়া কষ্টের কথা মনে করে জায়নামাযে/মোনাজাতে ২ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে ।
.
বাচ্চাদের খাইয়ে মায়ের কাছে দিয়ে রুমে এসে বই নিয়ে বসল তিশা । কাল এক্সাম আজকে আর কোনো রকম বিরতি দেওয়া যাবেনা । ফজরের নামায পড়ে ৮টার এলার্ম দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল । এখন একটু না ঘুমালে পরীক্ষার হলে ঘুমাতে হবে ।
সকালে এলার্ম বাজার আগেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ঝটপট উঠে বসল তিশা ।
দৌড়ে মায়ের রুমে গেল ,ওর আম্মু গরুর দুধ চামচ দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেছে ।
__আরে রে কি করছ । ইশ আমার কলিজাগুলোকে কষ্ট দিচ্ছ ক্যান ?
__কাল রাতে খাইয়েছিস ,এইটুকু বাচ্চার গলা শুকিয়ে যাবে তো ।
__তুমি আমাকে ডাকনি ক্যান
__তুই তো ঘুমাচ্ছিলি তাই । আর তাছাড়া না ঘুমালে এক্সামের টেবিলে ঘুমিয়ে পড়বি
__সব কিছুর উর্ধ্বে আমার বাবুরা । অন্যসব গোল্লায় যাক ।
তিশার আম্মু মেয়ের এমন পাগলামী দেখে হাসতেছে । তার সেই পিচ্চি রাজকন্যাটাও আজকে কত্ত বড় হয়ে গেছে । তার বাচ্চাটাও আজকে বাচ্চা সামলাচ্ছে ।
সবকিছু কতটা দ্রুত পাড় হয়ে যাচ্ছে । তিশা রেডি হয়ে ২বাচ্চাকে বুকে কিছুক্ষন জড়িয়ে রাখল , চোখে-মুখে আদর দিয়ে বাবার সাথে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল ।
বিসমিল্লাহ বলে প্রশ্নপত্র হাতে নিল তিশা । ধীরে ধীরে প্রশ্নের আন্সার দিচ্ছে । অধিকাংশ প্রশ্নই তার জানা । নির্ধারিত সময়ের আগেই সকল প্রশ্নের উত্তর করা শেষ ।
তবুও বারবার উত্তর সীটে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে । ঘন্টা বাজার পর পরীক্ষার হল ত্যাগ করল । মনে মনে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে গেছে , তার মন বলতেছে সরাকারি ভাবে চান্স হয়ে যাবে ।
বাসায় গিয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরল মাকে । মেয়ের মুখ দেখেই বুঝে গেছেন খুব ভালো হয়েছে এক্সাম ।
সেই ছোটবেলার মত এক্সাম ভালো হলে বাসায় এসেই জড়িয়ে ধরত আর যদি কখনো সামান্য পরিমান খারাপ হত রুম লক করে কান্না করত ।
.
বাচ্চাদের নিয়ে দুষ্টমিতে লেগে গেছে , নিখুঁতভাবে বাচ্চাদের পর্যবেক্ষন করতেছে । নাহ,ভাবছিল শায়নের মত হবে বাট একদম ওর নিজের কার্বন কপি মনে হচ্ছে ।
আর হবেই না ক্যান পেটে আসার পর থেকে তো মা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল ।
কখনো বাবার সংস্পর্শ তো দূরের কথা দেখাই মিলে নাই ।
মামুনির উপর রাগ করিস না সোনারা । বাবার থেকে আলাদা বলে কষ্ট পাসনে । তোদের মামুনি ২জনের ভালোবাসা একাই পোষাইয়া দিবে ।
বাচ্চাদের সাথে অনাবরত কথা বলেই যাচ্ছে । আর বাচ্চা ২দুটো ছোট ছোট হাত পা নড়াচড়া করে মামুনিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে । কিছুক্ষনপর ঘুমিয়ে গেল ,তিশা মন খারাপ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে ।
এই কয়েকদিনে মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখেনি তিশার মা ।
আজকে হঠাৎ এভাবে দেখে চমকে উঠলেন ,তিনি চান না তার মেয়ে আর বিন্দু পরিমান কষ্ট পাক ।
__কিরে মা ,কি হল তোর ? এভাবে বসে আছিস ক্যান ?
(মা-বাবা ২জনেই তিশার রুমে প্রবেশ করল)
__দেখ না মা । আমি কতটা ফিলিংস নিয়ে ওদের সাথে কথা বলতেছি আর ওরা কিনা আমাকে ইগনোর করে ঘুমিয়ে পড়ল । আমার ফিলিংস এর কোনো দাম নেই ।
.
মেয়ের এমন কথা শুনে ২জনেই হেসে উঠল । কে বলবে এই বাচ্চাটাও ২টো ছোট্র সোনার মামুনি । এই বাচ্চাদের সাথেও কেউ অভিমান করে । ওর বাবা-মায়ের হাসি দেখে তিশা আরো গাল ফুলিয়ে ফেলছে । তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেছে ,পাগলি মেয়ে এই জন্য কেউ এভাবে অভিমান করে । ওরা এখনো ফিলিংস বুঝতে শিখে নি । ওদের কাছে আগুন পানি ২টোই সমান । তুই যদি সারাদিনও এভাবে অভিমান করে থাকিস তবুও কি ওদের আদৌ তোর অভিমান ভাঙানো সম্ভব ।
তাই তো ,এতক্ষন তো ভেবেই দেখে নাই । ইশ আমার বাবুরা না আমাকে বোকা ভাবা শুরু করবে । ফিক করে হেসে দিল তিশা । সাথে ওর বাবা-মা যোগ দিল ।
__যাহ ফ্রেস হয়ে আয় তারপর কিছু খেয়ে নে । নিজের অবস্থা কি করেছিস একবার আয়নায় দেখেছিস ..?
মায়ের কথা শুনে চুপ হয়ে গেল তিশা । তাই তো শেষ কবে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাও মনে করা দায় । আগে তো সকাল টু সন্ধ্যা নিজকে পরিপাটি করে রাখত শায়নের জন্য । কিন্তু সেই মানুষটার যখন ফিরে তাকানোর সময় নেই সেদিন থেকে কখনো আয়নার সামনে দাড়ানো হয়নি বা নিজেকে সজ্জিত করেনি ।
মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগা শুরু করে দিয়েছে । কবে যে মেয়েটা সম্পূর্ন স্বাভাবিক হবে ।
__এভাবে হুতুম পেঁচার মত বসে থাকিস না তো ।
.
মায়ের কথায় চমকে উঠল তিশা
__কিক কি বললে তুমি । আমি হুতুম পেঁচা । বাবা ,তুমি কিছু বলবে না ? বের হও রুম থেকে (জোর করে ২জনকেই বের করে দিল )
.
আজকে অনেক টাইম নিয়ে সাওয়ার নিল । টাওয়াল পেঁচিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো । যাক ,এখন কিছুটা হলেও মানুষের মত দেখা যায় । এখন একটা ঘুমের প্রয়োজন তাইলে পুরোপুরি মানুষের রুপটা ফিরে আসবে ।
তার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার ।
খেয়ে এসে ২দুটো কলিজার টুকরোকে ২পাশে রেখে মাঝখানে নিজে সুয়ে পড়ল । ৫টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো ।চোখ মেলে বাবুদেরকে দেখতে পেল না ,মা নিয়ে গেছে ।
উফফ অনেক ঘুমালাম নিজেকে যথেষ্ঠ সুস্থ,স্বাভাবিক আর ফুরফুরে লাগতেছে । চোখে মুখে পানি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো । বাবা আর মা তিশিন ,তিশানকে নিয়ে বাগানে হাটতেছে ।
বারান্দায় আর দাড়িয়ে না থেকে নিজেও বাহিরে চলে গেল । অনেকদিন ফটোশেসন করে না । আজকে মনটা ফুরফুরে আর ওয়েদারটাও খুব চমৎকার । অনেকগুলো পিকচার তুলল ।
.
শায়ন সকল সংকোচ পায়ে ঠেলে তিশার নম্বরে ডায়েল করে যাচ্ছে বাট প্রতিবারই বন্ধ । এই পযন্ত অগনিত ফোন দেওয়া হয়েছে ,তবে বিশেষ লাভ হচ্ছে না ।
.
তিশার এক্সামের রেজাল্ট দিছে । সরাকরি ভাবে রাজশাহী নাসিং কলেজে চান্স পেয়েছে ।
সকল খুশির যেন বাধ ভেঙে গেছে আজ । তিশার ইচ্ছা অনুযায়ী এখনকার বাসা বিক্রি করে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি পাড়ি জমালো রাজশাহী ।
.
হেনা এখন সম্পূর্ন সুস্থ । হেনা, শায়ন আর শায়নের বাবা-মা তিশাদের বাড়িতে আসল । কলিং বেল বাজানোর শব্দে এক অপরিচিত মহিলা এসে দরজা খুলে দিল ।
__কাকে চাই ?
__আমরা তিশার শশুড় বাড়ি থেকে এসেছি । ওনারা কি বাসায় আছে ..?
__জী না ,ওনারা এক সপ্তাহ হল এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে ।
__বিক্রি মানে ? তাইলে ওনারা কোথায় থাকে এখন ?
__সরি সেটা তো আমরা জানি না ।
এতবুক আশা নিয়ে এসেছিল কিন্তু ভাগ্য এতই খারাপ যে দেখাটুকুএ কপালে জুটল না ।
ওর সকল আত্মীয়-স্বজন কারো কাছ থেকেই সঠিক কোনো তথ্য বের করতে পারেনি ।
হন্য হয়ে খুঁজতেছে ……
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here