ভালো থাকা
লেখকঃ আবির খান।
লেইট নাইট ডিউটি করে বাসায় যাওয়ার জন্য শেষ ট্রিপের শেষ বাসটায়ই উঠলাম। কারণ রাত এখন ১২ টা অতিক্রম করেছে। আমার বাসায় যাওয়ার পথে এটাই শেষ বাস। বাসে উঠে চুপচাপ বসে পড়লাম। তেমন কোন লোকজন নেই বাসে ২/৩ জন ছাড়া। তাই সামনের সিটেই বসেছি। সময়টা এখন শীতকাল। ঢাকার শহরের যানবাহনের কোলাহলে দিনের বেলায় শহরটা গরম থাকলেও রাতের শহরটা শীতের তীব্রতায় হার কাঁপিয়ে দেয়৷ যেমনটা এখন আমি কাঁপছি। গায়ে মোটা শীতের পোশাক থাকলেও শীত যেন মানছে না৷ কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম বাসের কন্টাক্টার দিকে৷ ছোট্ট একটা ছেলে। বয়স আনুমানিক ১৬-১৭ হবে। সে থরথর করে কনকনে শীতের বাতাসে কাঁপছে। ছেলেটার পরনে পাতলা ফুলহাতার একটি গেঞ্জি আর একটা ফুল প্যান্ট মাত্র। আর একটা মাফলারও আছে। তবে সেটা দিয়ে বেচারার কিছু হচ্ছে না৷ আমি ভাবছি, ছেলেটার কি এমন অবস্থা যে একটা মোটা জামা কেনার পর্যন্ত সামর্থ্য নেই! রাস্তা ফাঁকা থাকায় ড্রাইভারকে আর হেল্প করতে হবে না বলে ছেলেটা বাসের ভিতরে এসে আমার সামনের সিটটায় বসলো। আর জোরে জোরে হাত দুটো এক করে ঘষতে লাগলো। বুঝলাম শীতের তীব্রতায় ওর হাত দুটো বরফ হয়ে গিয়েছে। তবে আমার মনে ওকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। তাই নিজেকে আটকে না রেখে ওকে জিজ্ঞেস করি,
– তোর নাম কি?
– রুবেল।
– এত শীতের মধ্যে এই পাতলা গেঞ্জিটা পরে আছিস কেন? মোটা জামা নাই?
ছেলেটা মাথা নিচু করে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,
– আছে স্যার, তবে হেডা বাসায়। ছোট বোনডারে দিয়া আইছি। ওই অনেক অসুস্থ তাই।
ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এইটুকু ছেলের মধ্যে এত বড়ো মানবতা লুকিয়ে আছে! আজকাল ভাই বোনের সম্পর্ক যেন ঠুনকো৷ সামান্য ব্যাপারে সম্পর্ক শেষ। আর এইটুকু ছেলে নিজেকে কষ্ট দিয়ে বোনের কথা ভাবছে। আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
– বোন ছাড়া তোর আর কেউ নাই?
– মায় আছে। তয় সেও অনেক অসুস্থ। বাপে আরেকটা বিয়া কইরা চইলা গেছে।
– সংসার তাইলে তুই ই সামলাস?
– জি স্যার।
– হেল্পারি করে সংসার চলে?
– না। আমি শুধু হেল্পারি করি না আরও অনেক কিছুই করি।
– কি কি করিস বলতো।
– সকাল ৬ টায় উইঠা পত্রিকা বিলাই৷ তারপর দুপুর পর্যন্ত একটা হোটেলে কাজ করি। দুপুরের পর থেইকা রাত ১ টা পর্যন্ত হেল্পারি করি।
– অনেক কাজ করিস রে তুই। তা কত আসে মাসে?
– সব মিলায়া ৪/৫ হাজার টাকা।
– চলে এই অল্প টাকায়?
– স্যার আপনাগো কাছে এটা অল্প হইলেও আমগো কাছে এটা অনেক। কষ্ট হইলেও চালায় নি। আল্লাহর ভালো রাখছে৷
বাসের অল্প আলোতে ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বাস্তবতা যেন ওর কাছে হার মেনেছে। এত কষ্ট করে বেঁচে থেকেও বলে বেড়াচ্ছে ও কত ভালো আছে। আর আমরা ওর চেয়েও বেশী ইনকাম করে ওর চেয়েও ভালো অবস্থায় থেকে বলি, আমি ভালো নাই। আমার আরো সুখ চাই, আমার আরো বিলাসিতা চাই। আমাদের এত চাহিদার জন্যই আমরা ভালো থেকেও আজ ভালো নেই। অথচ এই ছেলেটা এত কষ্টে থেকেও ও কত ভালো আছে। আমিও তাদের দলে ছিলাম যারা ভাবতো আমি ভালো নেই। আমার আরো চাই। আরো বেশী সুখ চাই। কখনো মন থেকে মনেই হয় নি, আরে আমি তো অনেক ভালো আছি। অন্তত এই ছেলেটার থেকে অনেক বেশী ভালো আছি। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। সামান্য কিছু কষ্ট আর পরিবারের চাপ থাকায় মনে হত আমি ভালো নেই। কিন্তু আজ এখন মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই অনেক ভালো আছি। অনেক বেশী ভালো আছি। রুবেলের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো কবেই হেরে যেতাম, হয়তো স্বার্থপর হয়ে বোনকে মোটা শীতের কাপড় না দিয়ে নিজেই পরে কাজ করতাম। কিন্তু এইটুকু ছেলের ভিতর যে মানবতা আছে তা আমার মতো শিক্ষিত সাবলম্বিরা কখনো অর্জন করতে পারবে না। ছেলেটাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
– নেশাপানি করিস?
– স্যার মা আর বোনরে বাঁচাইতে এত ব্যস্ত যে এইসবের কথা কহনো মাথাই আহে নাই। আর এগুলা তো খারাপ।
– তাহলে এই নে ৫০০ টাকা। নিজের জন্য একটা শীতের জামা কিনে নিস। তুই যদি অসুস্থ হয়ে পরিস তাহলে তোর পরিবারকে কে দেখবে বল! কিনবি তো জামা?
ছেলেটা অবাক হয়ে টাকাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
– অনেক দিন পর ৫০০ টাকার নোট দেখলাম স্যার, তাও আবার নিজের। কিনমু স্যার অবশ্যই কিনমু। মায়ের জন্যও একটা কিনমু। অনেক খুশী হইবো মায়। আপনারে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।
ছেলেটা খুব খুশী হলো। ওর চেয়ে বেশী খুশী আমি হলাম। কারণ ছেলেটা এখনো মা আর বোনের কথাই ভাবছে৷ সত্যিই আমরা আসলেই সবাই অনেক ভালো আছি নিজেদের জায়গা থেকে।