ভালো বেসেছিলাম তারে পর্ব -১

0
1207

ভালো বেসেছিলাম তারে
পর্ব -১
মাসুরা খাতুন

ড্রয়িং রুমে আমার ছয় বছরের ছেলের বন্ধুর বাবা হিসেবে নিজের প্রাক্তন কে দেখে ভয়ানক অবাক হলাম আমি।আমার ছেলে নিশান প্রথম শ্রেণীতে পড়ে, ওরই প্রিয় বন্ধু সুপ্তি ও সুপ্তির বাবাই আজ আমাদের বাসায় আসবে বলে অনেক আয়োজন করে আমি নানা পদের রান্না করছি,কিন্তু সুপ্তির বাবাই যে আর কেউ নই বরং আমার সাত বছর আগে ফেলে আসা অতীত তা আমি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম না।
আমার দু পা যেন জমে গেছে একটুও সামনে এগোতে পারছিনা।

আমি নিশিতা রহমান, নিশানের মা।বর্তমানে রাজশাহী মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের লেকচারার। মূলত নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যই চাকরিটা করা।নিশানের বাবা সোহানুর রহমান একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় আজ বাসায় থাকতে পারে নি।

নিশান ড্রয়িংরুম থেকে আমাকে ডেকেই যাচ্ছে, এদিকে আমার চোখে হাজার অশ্রুকণা ভির করেছে। কোনরকমে চোখ দুটিকে মোছার চেষ্টা করছি কিন্তু না,অবাধ্য চোখ গুলো কথা শুনলে তো! আড়াল থেকে একবার ড্রয়িং রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম, না মানুষটা আগের মতোই আছে সেই চোখ, সেই হাসি।বাচ্চাদের সাথে কত্তো সুন্দর মেশতে পারে ছেলেটা, আগেও যখন পার্কে আড্ডা দেওয়া হতো তখনও পার্কে খেলতে আসা ছোট ছোট বাচ্চা গুলোর সঙ্গে ও খুব মিশে যেতো।

” মাম্মাম কখন থেকে ডাকছি তোমাকে, আঙ্কেল কখন থেকে বসে আছে বলো তো? তুমি আসছো না কেন? এসো,”

” হ্যাঁ আসছি বাবা,এইতো,তুমি চলো।

শেষে পা বাড়ালাম ড্রয়িং রুমের দিকে। বুকের ভেতর কেমন একটা কম্পন হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারি,আজ এতোদিন পরে আবারও সেই মানুষটার মুখোমুখি। আমি যথেষ্ট গোছানো হয়েই ছিলাম কিন্তু এই মুহুর্তে আমাকে একদম অগোছালো মনে হচ্ছে, খুব খুব জড়তা এঁটে ধরেছে আমাকে।

” আঙ্কেল এইতো আমার মাম্মাম

” আস আালামু,,,অর্ধেক টা বলে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো আহমেদ আরাফাত, বাকিটুকু মুখেই রয়ে গেলো।দু জোড়া চোখ শুধু অপলক তাকিয়ে আছে, কারো মুখেই কোন কথা নেই দুচোখের ভাষা ওরা দুজন ছাড়া হয়তো আর কেউ জানেনা।মুহুর্তের পর মুহূর্ত থেমে যায় ওই চোখের দৃষ্টি বিনিময়ে
নিরবতা কাটিয়ে উঠলো নিশিতা আগেই। নিজেকে ধাতস্থ করে খুব শান্ত গলায় বললো, বসুন।

এতোক্ষণে আরাফাত নিজেও নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে,কিন্তু এতোদিন পর সাক্ষাৎ পাওয়া বহুদিনের পুরনো একান্ত নিজের মানুষটাকে দেখে সে নিজেই অনেকটা শকড।অনেকটা তোতলিয়ে আরাফাত বললো,

” নিশু! মা মানে নিশিতা তু তুমি? কেমন আছো? ”

” ভালো, যেমন টা রেখে গিয়েছিলেন তার থেকেও অনেক অনেকটা ভালো, তারপর? আপনি কেমন আছেন? আপনার স্ত্রী কে দেখছিনা যে”

” ওমা বাবাই তোমরা দেখছি আগে থেকেই চেনো,ভালোই তো! আর বারে আন্টি তুমি বুঝি জানোনা,আমার মাম্মাম তো চাঁদ হয়ে গেছে আকাশের, বাবাই তো রোজরাতে ছাদে গিয়ে মাম্মামের সাথে কথা বলে।”

” দুঃখিত মামনী, আমি জানতাম না তোমার মাম্মাম চাঁদ হয়ে গেছে ”

আরাফাত এখনো চেয়ে আছে নিশিতার মুখপানে, সে জানে,এ পাপ; বড়ো পাপ,তার পরেও বারবার ভুলটা হয়ে যাচ্ছে, আর হবেওনা বা কেন,এতোদিন দীর্ঘ সাত বছর পর নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসা মানুষটি সামনে আসলে কেই বা নিজের দৃষ্টি কে সংযত রাখতে পারবে,আর আরাফাত ও পারবেনা, ওতো টা সাধুপুরুষ ও নয়।

নিশিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আরাফাতই আবার প্রশ্ন করলো,

” নিশানের বাবাকে দেখছিনা? উনি কোথায়? ”

” নিশানের বাবা বাসায় নেয়, খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আটকে গেছে ”
কাটকাট উত্তর দিলো নিশিতা, সামনে বসে থাকা মানুষটিকে ঘৃণা করতে পারে নি ঠিকই কিন্তু ক্ষোভ যে নেই এমনটি নয়।বরং আছে অনেক ক্ষোভ আছে মানুষটির ওপর, সেই তীব্র ক্ষোভেরই প্রমাণ পাওয়া যায় তার কথার ভেতর।
আজও বাচ্চাদের মতো রাগ দেখে কিঞ্চিত হাসলো আরাফাত, এমন হাসি বুঝি শুধু আরাফাতের ঠোঁটেই শোভা পায়,এমনটায় বলতো নিশিতা আগে। কিন্তু আজ আর সেই হাসি নিশিতা দেখলো কি দেখলো না বোঝা গেল না।

ড্রয়িং রুম থেকে উঠে গিয়ে আরাফাতের জন্য ব্লাককফি আর বাচ্চাদের জন্য কিছু স্ন্যাক্স আনলো নিশিতা সাথে নিজের জন্য রং চা,একদম টংয়ের দোকানে যেমন চা হয় তেমন।

কফির মগটা আরাফাতের দিকে এগিয়ে দিতেই সরাসরি তা নাকচ করলো আরাফাত,

” সরি,আমি কফি খায়না,আমাকে পারলে এককাপ চা দিতে পারো”

” আমি যতোদূর জানি ব্লাক কফি আপনার পছন্দের ”

” হুম ছিলো একটা সময়, বাট এখন আমি আনফরচুনেটলি কফি খায় না”

” কেন জানতে পারি? যদিও অনধিকার চর্চা ”

কপালের ভাঁজে আঙুল দিয়ে একটু নেড়ে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো উত্তর দেয় আরাফাত

” হয়তো কফি বানানোর সেই হাত টা আর আমার একান্ত নেয় বলে”

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হাসলো নিশিতা
তারপর উঠে গিয়ে আরও এককাপ চা করে এনো দিলো আরাফাত কে।সুপ্তি আর নিশান দুজনে ব্যস্ত নিজেদের জন্য বরাদ্দ স্ন্যাক্স খেতে আর কার্টুন দেখতে।
আরাফাতের সামনে কেমন যেন অসস্তি লাগছে নিশিতার।তায়তো আরাফাত কে বাচ্চাদের কাছে রেখে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো নিশিতা। কারন এতোক্ষণ যা রান্না হয়েছে তার বেশির ভাগই বুয়া রহিমা খালা রান্না করেছে, নিশিতা দাড়িয়ে থেকে একটু টুকিটাকি বুঝিয়ে দিয়েছে মাত্র। আর রান্না করা খাবার গুলো কন্টিনেন্টাল ডিস,কিন্তু সুপ্তির বাবা যে ভদ্রলোক ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছেন তার এমন খাবার পছন্দ নয়, তায়তো নিশিতা নিজে হাতে করা ছাদ বাগানে রহিমা খালাকে পাঠালো কিছু লাউয়ের ডগা আনতে,আর নিশিতা পেঁয়াজ রসুন দিয়ে শুটকি মাছের ভর্তা মেখে নেয়, লাউয়ের ডগার তরকারি টা আরাফাতের ভিষণ পছন্দের, সেই সাথে শুটকি মাছের ভর্তা, আরো কিছু সাদামাটা তরকারি রান্না করলো নিশিতা, ভালোবেসে না হোক,অন্তত তার বাড়িতে আসা মেহমান হিসেবে পছন্দের কিছু খাবার রান্না করলো নিশিতা।
সেই সাথে ফোন দিয়ে সোহানকে ও তাড়াতাড়ি আসতে বললো সে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here