ভালো বেসেছিলাম তারে পর্ব -১০,১১

0
224

ভালো বেসেছিলাম তারে
পর্ব -১০,১১
মাসুরা খাতুন
১০

নিস্তব্ধ পদ্মা পাড়।বিষন্ন বিকেল,চারদিকে মানুষের পদ্মা ভ্রমনের আনন্দ বিরাজ করছে।কাছেই একজোড়া প্রেমিক যুগলের মাঝে মান অভিমান হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে অনেকক্ষণ যাবত মানানোর চেষ্টা করছে। তারপরও মেয়েটি একেরপর এক অভিযোগ করেই যাচ্ছে। ছেলেটির দোষ সে আসাট সময় মেয়েটির নামে একগুচ্ছ ফুল আনেনি।এই দোষের জন্যই বেচারা ছেলেটা একের পর এক সরি বলেই যাচ্ছে। মেয়েটিকে শপিংয়ে নিয়ে যাবে বললেও মেয়েটি ক্ষমা করছে না।তার অভিযোগ ফুল আনলোনা কেন? আসলেই মেয়েদের মন বোঝা বড় দায়।এদের কাছে হাজার হাজার টাকার শপিংয়ের থেকে অনেক সময় কয়েকটাকার ফুলই বেশি দামী হয়ে যায়।ছোট্ট একটা ফুল না আনার জন্য প্রিয় মানুষটির বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগের ঝুলি খোলে।
পদ্মা পাড়ের বট গাছটার নিচে একটা ব্রেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্পের নায়ক নায়িকা। দুজনের মুখেই কোন কথা নেয়। ওদের সব কথায় যেন রূপকথার রাজ্যের গল্পের মতো নাম হীন ফিকে হয়ে গেছে। কে কোথা থেকে শুরু করবে তার উপায় নেই। অনেক জড়তা ঠেলে নিশিতা প্রশ্ন করলো,

“তোমার কি হয়েছে আরাফাত। ”

“মুখে প্রাপ্তির হাসি নিয়ে আরাফাত ফিরে দেখলো নিশিতাকে। নিশিতা আজ ওর কতো কাছে, কিন্তু সম্পূর্ন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতো এতো ভালোবাসার মানুষ টা,যেই মেয়েটা রোজ ওর বুকে মাথা পেতে ওর বুকের ধুকধুকানি শব্দ টা শুনতো,সেই মেয়েটাকে ও আজ সামান্য ছুঁয়ে দিতেও পারবেনা।একটু খানি গালে হাত দিয়ে ও বলতে পারবে না “”আমি ভালো নেই নিশিতা, একটুও ভালো নেই, তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারিনা নিশু।তোমার প্রতিটা স্মৃতি আমাকে রোজ নিয়ম করে শাস্তি দেয়।” কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না।সে অধিকার ওর নেয়।

“আমি ভালো আছি নিশু”আরাফাতের উত্তর।

নিশিতা চেয়ে থাকে পাশে বসা পুরুষটির দিকে। তার ফোলা ফোলা দুটি চোখ বহুদিনের না ঘুমানোর সাক্ষী দেয়।চেহারার আগের সেই জৌলুশ নেয়।কেমন যেন শুকিয়ে গেছে সুন্দর মুখটা।চোখ দুটোর নিচে শত বৎসরের দুশ্চিন্তার কালির প্রলেপ পড়ে গেছে। সেই মুখ আজ কেমন যেন অচেনা লাগছে নিশিতার কাছে।আজ আর আরাফাতের হাসিটাকে আগের মতো প্রাণবন্ত লাগছে না বরং মরুভূমি তে দেখা পানির মতোই শুকনো নিষ্পাপ আর ধোঁকা মনে হচ্ছে,যেন আরাফাত ইচ্ছে করেই না চাইতেও জোর করে মুখে ঝুলিয়ে রেখেছে।

“সত্যি করে বলো আরাফাত, আমি মিথ্যে কখনো পছন্দ করি না তা তুমি জানো, কি হয়েছে তোমার আরাফাত। আমি গতকাল নিশান কে নিয়ে স্কুল গেছিলাম, ওখানে সুপ্তি আমাকে বলল তুমি নাকি হসপিটালে এডমিটেড।প্লিজ আরাফাত বলো আমাকে কি হয়েছে তোমার? “নিশিতার ব্যাকুল আবেদন।

“ওও সুপ্তি তোমাকে এসব বলেছে? হাহা,,,,,,,কেমন বোকা মেয়েটা। একটু ড্রিংক বেশি করে ফেলায় জ্ঞান হারিয়েছিলাম।আর তায়তো বোকা মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আসলে আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেয় তো তায় একটু বেশিই চিন্তা করে। তুমি এসব নিয়ে ভেবোনা। আমার কিচ্ছু হয়নি। ” হেসে বলল আরাফাত।

আরাফাত তুমি কি এখনো বকুল ফুল পছন্দ করো? আনমনেই বলে ফেললো নিশিতা।

“বকুল ফুল আমার সেদিন থেকেই অপছন্দ হয়ে গেছে যেদিন থেকে আমার ফুলের সুবাস হারিয়ে গেছে। আমার সুবাস দিয়ে আজ অন্য কেউ সুবাসিত নিশিতা।বকুল ফুল আমার জীবনের সব রং কেড়ে নিয়েছে নিশু,বিনিময়ে দিয়ে গেছে বকুলেরই মতো সাদা শুভ্র বিষাদময় জীবন। ” উদাস হয়ে বলল আরাফাত।

“আরাফাত! তুমি এসব বলছো কেন? আমি তোমার কোন কথার মানেই বুঝতে পারছি না, তুমি নিজে আমায় প্রত্যাক্ষান করেছিলে,! আমি তোমায় ছেড়ে যায়নি। আমি সেদিন যেতে বাধ্য হয়েছিলাম,তুমি আমায় বাধ্য করেছিলে।”উৎকণ্ঠা হয়ে বলল নিশিতা।

“আরে ধুর! আমার যে কি হয়েছে, আজগুবি সব কথা বলি।এমনি বললাম, বাদ দাওতো তুমি ওসব।আচ্ছা বলো কি খাবে? তোমার প্রিয় ঝালমুড়ি টা এখনো ঐ দোকানে হয়,শুধু গফুর চাচার বদলে গফুর চাচার ছেলে বসে দোকানে। এটায় তো নিয়ম। কারো জন্য কোনকিছু থেমে থাকে না। এই ধরো,আমি আজ আছি , ভবিষ্যতে যে থাকবো তাতো না।হুট করেই একদিন শোনা গেলো আহমেদ আরাফাত আর বেঁচে নেই। “নিশিতার থেকে চোখ সরিয়ে বলল আরাফাত।

“আরাফাত প্লিজ এসব কথা বলবে না, আমার ভালো লাগছে না। মানুষের অসুখ হলেই মরে যায় না।তোমার ও কিচ্ছু হবে না। তোমার যে কিছু একটা হয়েছে তা আমি জানি, কিন্তু হয়েছে টা কি প্লিজ বলো।তুমি না বললে বুঝবো কেমন করে? সুপ্তি বাচ্চা, ও তো কিছুই বলতে পারছে না। তুমি শুধু বলো,আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

“প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য এতোটা ব্যাকুলতা মানায় না নিশু।আর আমার ও কিচ্ছু হয়নি।ঐ হালকা শরীর খারাপ আর কি।তুমি তো জানোই,ডাক্তাররা হালকা শরীর খারাপেও কতোটা নিয়ম, বাধানিষেধ চাপিয়ে দেয়।”মুচকি হেসে বলল আরাফাত।

“সত্যি বলছো তো? “বলে নিশিতা।

“একদম সত্যি নিশু মনি।এখন বলতো কি খাবে? নাহলে পরে বলবে আরাফাত কিপ্টে হয়ে গেছে। ”
রসিকতা করে বলল আরাফাত।

“না আমি কিছু খাবো না।সোহান অফিসে আছে,সুপ্তিদের স্কুলে আজ গিয়েছিলাম, গিয়ে সুপ্তির কাছে শুনলাম তুমি নাকি খুব অসুস্থ , খুব মনমরা হয়ে ছিলো মেয়েটা।তায়তো সোহানকে ফোন করে বলি আমি তোমার সাথে দেখা করতে যেতে চায়,বরাবরের মতোই ও সম্মতি দিলো,আর আমি আসলাম।আর এখন দেখো তুমি কিছুই বলছো না।”গুছিয়ে কথা গুলো বলল নিশিতা।

“তুমি খুব সুখে আছো তায়না নিশিতা? জানো মাঝে মাঝে আমার সোহান কে দেখলে হিংসে হয়।দেখো উজাড় করে ভালোবেসেও আমি শুন্য হয়ে বসে আছি,আর সোহানকে দেখো,সবকিছু কড়ায় গন্ডায় উপরআলার কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে, যেখানে কোন খামতি নেই,ওপরআলা সব কিছু ঢেলে দিয়েছে ওকে।কেন সেই ভাগ্য টা আমার হয়নি বলোতো নিশু? আমি কি খুবই অপরাধী? “নিজেকে যথাসাধ্য শাসন করার পরও মুখ ফসকে বলে আরাফাত।

আরাফাতের প্রত্যেকটা কথা নিশিতার বক্ষপিঞ্জরে থাকা হৃদযন্ত্র টাকে কাঁপিয়ে তুলছে।কি বলছে আজ আরাফাত।এতোটা আবেগ, এতোটা কষ্ট নিয়ে এই ছেলেটা থাকে কি করে? আর ও যদি নিশিতাকে এতোটায় ভালোবাসে তাহলে কেন সেদিন নিশিতাকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলো? আর সুপ্তির মায়ের সাথে সংসারই বা করলো কি করে এতোদিন?
নানা রকম প্রশ্ন উঁকি দেয় নিশিতার মনে। প্রশ্ন গুলোকে দমিয়ে রেখে নিশিতা আরাফাত কে প্রশ্ন করে,

“সুপ্তির মাম্মামের কি হয়েছিল আরাফাত? কেন মারা গেছে সুপ্তির মাম্মাম?”

“এক্সিডেন্ট, কার এক্সিডেন্ট হয়েছিল, ওখানেই স্পর্ট ডেড হয়ে যায় । “অন্য দিকে তাকিয়ে বলে আরাফাত।

“ওহ সরি,,আচ্ছা সুপ্তি তখন কতটুকু? ”

“সুপ্তি তখন দেড় বৎসরের। বর্তমানে আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেয়। ”
হটাৎ করেই আরাফাতের যেন কি হয়ে যায় জোড়হাত করে বলে,
“আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তুমি সুপ্তিকে দেখবে তো নিশু? সোহান সাহেব কি একটু মানবে ওকে? সোহান তো অনেক ভালো মনের মানুষ, অনেক দয়ালু, একটু দয়া কি করবেন উনি? প্লিজ নিশু,প্লিজ। আমার সুপ্তি টার যে এই পৃথিবীতে কেউ নেই, এমনি আমি অসুস্থ হওয়ায় মেয়েটা অনেক মনমরা হয়ে থাকে। ”
কঠিন শক্ত মনের আরাফাত যে কিনা মুখের ওপরে প্রিয় মানুষটিকে প্রত্যাক্ষান করেছিলো,সেই আরাফাত আজ কাঁদছে, অনেক অনেক অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে।

আরাফাতের এমন ভেঙে পড়ায় নিজেকে ও ধরে রাখতে পারে না নিশিতা। তায়তো এতোদিনের গড়ে তোলা রাগী, কঠোর আচরণ কে বিসর্জন দিয়ে নিজেও অশ্রু ঝড়াতে কার্পণ্য করলো না।

“তুমি এসব কি বলছো আরাফাত, সামান্য অসুখে কেউ ওমন করে ভেঙে পড়ে? তাহলে সুপ্তির কি হবে।অতোটুকু বাচ্চা নিজেকে সামলাবে কি করে? “কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল নিশিতা।

“আমি সত্যিই সুপ্তির সাথে অন্যায় করেছি নিশু,আমি বড় অন্যায় করেছি।আমি নিজের কষ্ট গুলো কে মুছতে গিয়ে সুপ্তির কষ্টের কারণ হয়েছি।আমি সুপ্তির ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি । শুধু নিজের কষ্টদায়ক অতীত ভেবেই নিজেকে পুড়িয়েছি। ”

“আরাফাত তোমার কি হয়েছে বলো না,প্লিজ, দরকার হয় দেশে ভালো চিকিৎসা না হলে আমরা বিদেশে যাবো, যেখানে গেলে ভালো হবে সেখানেই যাবো।তুমি বলো প্লিজ। ”

মনে মনে হাসে আরাফাত।ওর যেই অসুখ টা হয়েছে তা কি আদৌও ভালো হবে? না হবে না, শুধু শুধু নিশিতা কে বলে ওকেও কষ্ট দেবে কেন?

“না নিশিতা আমার তেমন কিছু হয়নি।এমনিই এসব চিন্তা হয় মাঝে মাঝে। তায় তোমাকে বললাম। তুমি ভালো থেকো নিশু।খুব ভালো থেকো।আর তোমার জীবনে আরাফাত নামক কালো অধ্যায় টাকে মুছে দিও প্লিজ।আমি তোমাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি, তাইতো আমাকে শুধু শুধু মনে রেখে নিজের সুন্দর জীবনে এর ছাপ ফেলো না প্লিজ। ”
অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে আরাফাত। ওর মুখে বলা প্রতিটি কথায় যে ওর হৃদয়ে কতোটা আঘাত লাগছে তা শুধু ওই জানে।প্রতিবার ওর নিশিতা কে ভুলে যেতে বলায় ওর বুকে যেন কেউ বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করছে।

পড়ন্ত বিকেলের মতোই ওদের গল্প গুলো পেছনে পড়ে রয়।আর সামনে এগিয়ে দুজন দুরাস্তায় হেটে চলে যায় দুটি ভাঙা মন।
পাশের ঝগড়ারত তরুণ তরুণী ও নিজেদের ঝামেলা চুকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

চলবে,,,,,,,

ভালো বেসেছিলাম তারে
পর্ব -১১
মাসুরা খাতুন

ব্যালকোনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সোহান।হাতে কফির মগ। পাশেই নিশিতা একটু একটু করে গরম চায়ের পরশ ছোঁয়াচ্ছে নিজ ঠোঁটে। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে আনমনে। নিরবতা ছেড়ে সোহানই প্রথম প্রশ্ন করলো,
“কেমন দেখলে আরাফাত সাহেব কে? শরীরের অবস্থা কেমন?”

“কি জানি, খুব একটা ভালো বলে মনে হলো না।আমাকে তো কিছুতেই বলছেনা কি হয়েছে। হালকা শরীর খারাপ নাকি। কিন্তু আমার ওর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।মনে হয় কিছু লুকাচ্ছে আমার কাছে। ”

“আরে না না,কিছু হলে তো অবশ্যই বলতো,একা মানুষ, তায় হয়তো একটু ডিপ্রেশনে চলে গেছে। তুমি চিন্তা করো না”
মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা সোহানের।

“জানো কি বলছিলো,ওর যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে আমরা যেন সুপ্তিকে দেখে রাখি,এতোটা ভেঙে পড়েছে আরাফাত। ”
সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল নিশিতা।

“দেখো নিশিতা, তুমি আমাকে চেনো,বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি।আমাদের তো কোন কিছুর কমতি নেই, সুপ্তিও আমাদের মেয়ের মতো,ওকে আমাদের কাছে রাখতে আমার কোন সমস্যা নেই, আর তাছাড়া ও আমাদের তো একটা মেয়েরও দরকার , আর তুমি ও কনসিভ করতে পারবে না আর,ডক্টর বলেছে তোমার জন্য রিস্ক হয়ে যাবে,তো সুপ্তি আমাদের মেয়ে হতেই পারে। ”

“কি বলছো তুমি? এটা কি করে সম্ভব? আমি তোমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়, তুমি মানুষ না কি অন্য কিছু? আরাফাতের মেয়ে সুপ্তি,তুমি কি করে মেনে নিতে পারো?”অবাক হয়ে বলল নিশিতা।

“হ্যাঁ তাতে কি? আরাফাতের এসময় ওর আপনজন বলতে কেউ নেয়, তায়তো আমরা ওর পরিচিত হিসেবে ওর পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ”

চুপ করে যায় নিশিতা। আজ আরাফাত এতোটা ভেঙে পড়লো কেন? ও কখনোই চায়নি আরাফাতের খারাপ কিছু হোক।নিশিতা কখনো অভিশাপ দেয়নি আরাফাত কে। তাহলে কেন মানুষ টার জীবনে এতো কষ্ট। সে চলে যেতে চেয়েছে নিশিতা যেতে দিয়েছে, নিশিতা কষ্ট পেয়েছে কিন্তু অভিশাপ দেয় নি,বরং চেয়েছে সে যেন তার মতো ভালো থাকে। আচ্ছা ওই মুখ,ওই হাসি,সেই মানুষটি যে রোজ বকুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করতো নিশিতার জন্য, এতো এতোটা ভালোবাসা সব কোথায় হারিয়ে গেছে? সময় কতোটা সবকিছু বদলে দেয়, একদিন যাকে না দেখলে থাকতে পারতো না সেই মানুষটির আজ কতোটা নির্মম পরিনতি।আচ্ছা সবার জীবনে কি সব আশা পূর্ণ হয়? না হয়না।নিশিতা ও চেয়েছিলো, অনেক স্বপ্ন দেখেছিলো একটি মানুষ কে ঘিরে, পায়নি সেই মানুষটিকে নিজের করে,সেই মানুষ টি আজ মৃতপ্রায় হয়ে কোনরকমে বেঁচে আছে।আর নিশিতা হয়েছে অন্য কারো। নিজের সবটুকু দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে সেই মানুষটির জীবন। আজ আর আরাফাতের প্রতি কোন অভিযোগ নেই নিশিতার।সেদিন আরাফাত ছেড়ে গিয়েছিল বলেই হয়তো এতো ভালো মনের মানুষের সাহচর্য পেয়েছে নিশিতা।

দুজনেই আস্তে আস্তে চুপ হয়ে যায়, নিশিতা প্রতিদিনের মতো নিশানের ঘরে উঁকি দিতে যায় নিশান ঠিক আছে কি না।আর সোহান ভাবে অন্য কিছু,

কিছুদিন আগে আরাফাত এসেছিল সোহানের অফিসে,বোধহয় নিশানের স্কুল থেকে ঠিকানা নিয়েছিল।সোহান একদমই বুঝতে পারে না আরাফাতের এখানে আসার কারণ। সেদিন বাসায় ঐ একবারই আলাপ হয়েছিল আরাফাতের সঙ্গে, এর পর আর সময় হয়ে ওঠে নি।মনে মনে কিছু টা ভীত সোহান। আরাফাত আবার নিশিতাকে চায়তে আসলো না তো।না না তা কেন হবে? একবার ছেড়ে গেছে নিশিতা কে ভেঙে গুড়ো করে দিয়ে আজ এতো বছর পর যখন নিশিতা ওর সন্তানের না তখন আবার নিশিতাকে ফিরিয়ে নিতে চায়লে ও দেবে কেন? খুব কড়া, কঠোর ভাবে কথা বলবে সোহান যা তার আচরন বহির্ভূত । মনে মনে এসবই ভাবছিল সোহান। এমন সময় ওর রুমে প্রবেশ করে আরাফাত। সোহান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে আরাফাত কে।কতো সুন্দর মুখশ্রী মানুষটার,কেমন মায়াবী মায়াবী। এমন মায়াময় মুখশ্রী দেখেই মনে হয় নিশিতা সেদিন সোহানের বন্ধুত্বের মধ্যে কার ভালোবাসা কে বুঝতে পারে নি, জরিয়ে পড়েছিল আরাফাতের মায়ায়।কিন্তু সোহান ভাবে এতো সুন্দর মায়াবী চেহারার মানুষ টা কি সত্যিই কারো সাথে বেইমানি করতে পারে? হয়তো পারে, কারো উপর দেখে তো আর ভেতর টা বিবেচনা করা যায় না।

“হ্যালো সোহান সাহেব, কেমন আছেন আপনি? ”
সোহানের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল আরাফাত।

“হ্যাঁ ভালো,আপনি কেমন আছেন? “অনেকটা বিরক্ত হয়েই বলল সোহান।

“আমি ও আছি ভালোই, আমি এসে আবার আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম না তো?”সুন্দর হাসিটা ঠোঁটে রেখে বলল আরাফাত।

“আরে না না,বিরক্ত হবো কেন,বলুন কি নেবেন,চা? নাকি কফি? “কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল সোহান।

“আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না,আমি কিছুই নেব না।আসছিলাম আপনার সাথে একটু কথা বলতে।”

আরাফাতের কথা শোনার জন্য সোহানের মনেও অনেক জল্পনা কল্পনা হচ্ছিল, যদিও ও খুব ভালো করেই ভেবে রেখেছে উত্তর গুলো,আরাফাত কে খুশি ও কিছুতেই করতে পারবে না।তায়তো একটু বিরক্ত চোখে তাকিয়ে কিছু টা মেপে নিলো আরাফাত কে। তেমন বিরক্ত মুখেই বলল,

“আচ্ছা কি বলবেন বলুন,আমি শুনছি”।

সোহানের বিরক্তমাখা চাহনি যেন আরাফাত বুঝেও বুঝলো না,তায়তো পূর্বের মতোই বিনীত ভাবেই বলল,

“সোহান সাহেব, আমি জানি আপনি আমার সম্পর্কে সবই জানেন।আমি আপনার সেদিনের কথা বার্তায়ই বুঝে গিয়েছিলাম। তায়তো আপনার কাছে বলতে আমার দ্বিধা নাই, প্লিজ যদি আপনি একটু সময় নিয়ে আমার কথা গুলো শোনেন।”

“হ্যাঁ তো কি বলতে চান? আমি তো বলছি আমি শুনবো।”কপালের ভাঁজ টা প্রকট করে বলল সোহান।

“আমার মনে হয় আপনি বিরক্ত হচ্ছেন, বিশ্বাস করুন আমি কিছু ফিরিয়ে নিতে আসিনি আপনার কাছে। যাকে ধরে রাখার সামর্থ্য, অধিকার, ক্ষমতা কোনটায় আমার নাই, তাকে মিছে মায়ায় আটকিয়ে রেখে কি লাভ বলুন? আপনার সময় না হলে আমি বরং আসি।”অসহায় ভাবে বলল আরাফাত।

সোহান এবার বুঝলো সে একটু বেশিই খারাপ আচরণ করে ফেলেছে লোকটির সাথে। তার সাথে তো ওর কোন শত্রুতা নাই,তাহলে কেন আবেগে নিজের মন মতো একটা ধারণা করে একজন মানুষের সাথে ও এমন অসভ্যের মতো আচরণ করবে? ওতো এমন না,তাহলে আজ হটাৎ কি হলো ওর।
এবার কিছু টা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা করলো সোহান, কিছুটা লজ্জিত ও হলো এমন বাচ্চাদের মতো ব্যবহারে।

“না না, কোন ব্যস্ততা নেই, আসলে কিছুক্ষণ আগে একটা মিটিং ছিলো তো তায় একটু বোরিং লাগছিলো।বলুন আপনি কি বলবেন,”

“আমি নিশিতার ব্যাপারে কথা বলতে চায় যদি আপনি শুনতে চান।”

“নিশিতার ব্যাপারে? নিশিতার ব্যাপারে তো কিছু আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চায়না,নিশিতা আগে কার সাথে সম্পর্ক করেছে, কিংবা কার সাথে মিশেছে তার কোনটায় আমার জানার প্রয়োজন পড়ে না,ওর বর্তমান পরিচয়, ও আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের মা।এর বেশি আর কিছু আমি জানতে চায়না।”
একটু কটাক্ষ করেই বলল সোহান।

“দেখুন মিস্টার সোহান, নিশিতাকে অপমান করে আমি কিছুই বলতে চায়না,এতোটা দুঃসাহস আমার নেই, এমনকি নিশিতা এমন একজন মানুষ যাকে অপমান বা ছোট করা যায় না,সে পবিত্র। এমন কি নিশিতার ব্যাপারে কথা বলার অধিকার বা যোগ্যতা কোনটায় আমার নাই। কিন্তু একজন মৃত্যপথযাত্রী ব্যক্তির শেষ আবদার টুকু অন্তত রাখুন,প্লিজ। এই কথা গুলো এখন আমি আপনার কাছে বলে না গেলে মরার পরেও আমি একজনের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো,সারাজীবন কেউ আমায় ঘৃণা ভরে স্মরণ করবে তা আমি চায় না।”আরাফাতের চোখের কোণায় ভির করেছে অশ্রু কণা।

“আরাফাত সাহেব! কি বলছেন এসব! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মৃত্যুপথযাত্রী মানে?”অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সোহান।

“হ্যাঁ মিস্টার সোহান, মৃত্যুপথযাত্রী।আর খুব একটা বেশিদিন সময় হয়তো আমার হাতে নেই, বর্তমানে হসপিটালে এডমিড আছি।”

“কি হয়েছে আপনার? আর এমন বলবেন না প্লিজ, সৃষ্টিকর্তা যেমন সমস্যা তৈরী করেছেন তেমন তার সমাধান ও আছে,আর আপনার কি হয়েছে বলুন,অবশ্যই আল্লাহ চায়লে আপনি ভালো হয়ে যাবেন। ”
উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে সোহান।

“আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না মিস্টার সোহান। আসলে শুরু টা হয়েছে অনেক আগে থেকে, তায় এখন হাতের বাইরে চলে গেছে, আমিHIV পজিটিভ। ”

“হোয়াট? কী বলছেন আপনি? কি করে হলো এইটা? “ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে সোহান।

“তাহলে শুনুন আমার কলঙ্কিত জীবনের গল্প,
পড়াশোনার জন্য আমি কিছু বছর বিদেশ ছিলাম,ওখানে আমার এক পথশিশুকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর অ্যাক* সিডেন্ট হয়।তখন আশেপাশের লোকজন আমাকে ধরে হসপিটালে নিয়ে আসে,খুব জরুরী র* ক্তের প্রয়োজন হলে আমাকে নিয়ে আসা এক ব্যক্তি তড়িঘড়ি র* ক্ত দেয় আমাকে।আসলে সেদিন আমার অবস্থা এতোটায় গুরুতর ছিলো যে ডক্টররা র* ক্তের এইচ আই ভি টেস্ট করার সময় পাননি।সেবারের মতো জীবনের চরম সর্বনাশ করে বেঁচে যাই আমি।কিন্তু সাথে করে নিয়ে আসি আরো এক প্রাণ* ঘা তি কে।বিদেশ থেকে এসে যথারীতি জীবন চলতে থাকে।এর মাঝে পরিচয় হয় নিশিতার সাথে।কিন্তু তখন আমি একটুও জানতাম না যে আমার ভেতরে বাসা বেঁধে আছে এমন এক প্রান ঘা তী রোগ।জানলে কিছুতেই আমার সাথে নিশিতার জীবন জড়াতাম না।আমাদের প্রেমের চার বছর পূর্তি। নিশিতা খুবই আনন্দিত,ও ওর বাবা মাকে আমাদের বিয়ের জন্য বলবে।আর আমার পক্ষ থেকে তো কোন সমস্যাই ছিলো না,ভাবি সবটায় জানতো,ভাইয়া আর বাবা কখোনোই বাঁধা দেবে না।
একদিন আমরা পরিবার সহ গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা হয়।আমি নিশিতাকে বলি দুইদিন থেকেই চলে আসবো,এসেই নিশিতার বাবার সাথে কথা বলবো।কিন্তু গ্রামে যাওয়ার দিনই হটাৎ করে আমার শরীর খুব খারাপ হয়।এমনিতেই আমার কিছুদিন আগে থেকেই বাম ডানার নিচে ব্যথা হতো,আর সর্দি জ্বর ভালো হচ্ছিল না,কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেইনি,যুবক বয়স, শরীরের এই সামান্য বিষয় গুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার সময় কোথায়? অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই গ্রামে যাওয়া নাকচ করে, আমি ওদের সবাই কে বলে পাঠিয়ে দিই,যেহেতু ওখানে একটা অনুষ্ঠানে সবার দাওয়াত ছিলো, তায় এই এতোটুকু সমস্যায় সবার আনন্দ নষ্ট করার মানে হয়না।আমি বলি যে, আজ ডক্টর দেখিয়ে আগামীকাল আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাবো।ডক্টরের কাছে গেলে ডক্টরকে গত দুই এক মাস ধরে হওয়া শরীর খারাপের বিবরণ দিই।সবটা শুনে ডক্টর আমাকে কয়েক টা টেস্ট দেয়।আমি বিদেশে ছিলাম শুনে এইচ আই ভি টেস্ট টাও করাতে বলে।পরদিন রিপোর্টে জানতে পারি আমি এইচ আই ভি পজিটিভ।
আমার সমস্ত আশা আকাংখা ভেঙে যায়। সেই থেকে শুরু হয় আমার জীবন যুদ্ধ। কিছুটা শারীরিক, কিছুটা মানসিক যন্ত্রণায় আমি একাকার হয়ে যায়। কয়েকদিন নিশিতার থেকে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ রাখি,আমি ভাবতে থাকি,কিছুতেই আমি আমার এই অভি* শপ্ত জীবনের ভার নিশিতার ওপর দিতে পারিনা।আমার এই রোগটায় ওকেও জর্জরিত করতে পারিনা।তায় সিদ্ধান্ত নিই নিশিতার সামনে নাটক করার।সেদিন সেই নাটকটায় করেছিলাম নিশিতার সামনে। নিশিতা আমার না হোক, অন্তত অন্য কারো হয়ে হলেও তো এই পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে বাস করবে নিশিতা। আর সত্যটা বললে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতো না নিশিতা। তায়তো এই মিথ্যার আশ্রয় নিই আমি।আর সেদিনের পর থেকে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় প্রতিদিন একটু একটু করে মর* তে থাকি আমি। ”

কথা বলতে বলতে আরাফাত খেয়াল করে সোহানের চোখে ও পানি,কতো নরম মনের ছেলেটা।যারা অন্যের কষ্ট শুনে কাঁদে তারা অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। আর সোহান সাহেব ও তায়।তায়তো নিশিতা পেরেছে এমন একজন মানুষের সাথে আবার নতুন করে জীবন সাজাতে।আরাফাত সার্থক, সার্থক ওর নাটক।ওতো এটায় চেয়েছিলো ওর মায়াবতী সুখী হোক।

“আরাফাত সাহেব,এতো এতো কষ্ট কি করে আপনি বুকে জমিয়ে রেখেছেন? এতোদিন আমি ও আপনাকে খারাপ মানুষ ভাবতাম,যে কিনা নিশিতার মতো মেয়েকে ঠকিয়েছে।আজ যদি আপনি না বলতেন তাহলে কতোবড় ভুল ধারণা নিয়ে থাকতাম আমি।কতোটা পাপী হয়ে যেতাম।”দুচোখ ভরা অশ্রু নিয়ে বলে সোহান।

মুচকি হাসে আরাফাত। আজ তার অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেছে। আজ সে অনেক টায় হালকা।

“আরে না না,আপনি তো অনেক ভালো মানুষ, আপনি পাপ করতে পারেন না।আমাকে খারাপ বললেও আপনার পাপ হতো না,কারণ আমি সেই পর্দাটা সবার চোখে স্থাপন করেছিলাম।কিন্তু জীবনের এই শেষ সময়ে এসে আপনার কাছে এগুলা বলায় যে আমি কতোটা হালকা হলাম তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না।আমি নিশিতার চোখে আমার প্রতি ঘৃণা সহ্য করতে পারিনা। আমি ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হয়ে যায় নিশিতার চোখে ঘৃণা দেখলে তায়তো আপনাকে বলতে এসেছি,প্লিজ, আমি মা*রা যাওয়ার পর ও যদি নিশিতা আমার কথা অত্যন্ত ঘৃণাভরে উচ্চারণ করে তখন,তখন অন্তত এতোটুকু বলবেন,” ঐ পাগল মানুষ টাকে ঘৃণা করোনা প্লিজ, সে পরিস্থিতির স্বীকার। ”
কারন আমি মা*রা গেলেও আমার আত্মা রোজ আসবে নিশিতাকে একনজর দেখার জন্য, তখন যদি দেখে নিশিতা আমার কথা মনে করে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তাহলে সহ্য করতে পারবে না।প্লিজ সোহান সাহেব, প্লিজ। ”

এবারে আর নিজেকে আটকাতে পারে না আরাফাত। নিজেও হাজার অশ্রু কণা বিসর্জন দিতে থাকে।
সোহান ও পাশে এসে জরিয়ে ধরে আরাফাত কে।

“আমায় ক্ষমা করে দিন আরাফাত সাহেব কতো ভুল ভেবে এসেছি আপনাকে।আমি নিশিতাকে আজই সব বলবো। ”

“না না,,এই ভুলটা করবেন না প্লিজ, নিশিতা সহ্য করতে পারবে না, ও কাদবে,ওর কান্না আমি সহ্য করতে পারবো না। আমার চলে যাওয়াটা আরো কষ্টের হবে তাহলে।”

“কিন্তু আরাফাত সাহেব, তাহলে সুপ্তি কে? ও কি আপনার মেয়ে নয়?”,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here