ভালো_লাগে_ভালোবাসতে #পর্ব-১৩,১৪

0
994

#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৩,১৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
১৩

“বোকা,চরম বোকা,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা মেয়ের প্রেমে আমি পরেছি।তাকে যদি আমি এখন সামনে গিয়েও বলি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ তবুও সে তার চোখগুলো গোল গোল করে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবে,’আপনার কি হ্যালুসিনেশনের সমস্যা হচ্ছে?আমার ভেতর ঐ মেয়েকে দেখতে পাচ্ছেন?
‘তাই অন্য কথা তো আর বাদই দিলাম।শুনেছি মেয়েরা নাকি সহজেই বুঝতে পারে কে তাকে পছন্দ আর কে তাকে ঘৃণা করে,তাহলে এতকিছুর পরেও এই ঘুমকন্যা বুঝতে পারে না কেনো!
তাকে দেখেছি…!নাহ্ দেখেছি না, অনুভব করেছি,ঠিকমতো দেখার আগে আমি অনুভব করেছি তারে, আমার হৃদ মাঝারে।অনুভব করেছি তার হৃদস্পন্দনের মাঝে মিলিয়ে যাওয়া আমার হৃদস্পন্দনকে।প্রথম আলিঙ্গনে সিক্ত হয়ে পাওয়া প্রথম স্পর্শে আমার সর্বাঙ্গেই যেন এক অস্থিরতার স্বস্তিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।সমস্ত শরীর যেনো তৎপর হয়ে সংকেত পেয়ে যাচ্ছিলো তার অপূর্ণ অংশকে খুঁজে পাওয়ার।তার প্রথম স্পর্শেই আমার মনে হল এই তো আমার বাম পাঁজরের হাড়।আমার অপূর্ণ অংশের সম্পূরক।এবার যেনো আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলাম।এ এক কেমন আকর্ষণ,বোঝানো যে বড্ড দায়!

আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে তাকে আমি দেখতে লাগলাম খুবব খুঁটিয়ে।রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকা তার পাতলা ঠোঁটগুলো,কপালের কার্ণিশে লেগে থাকা এক ছিটেফোটা কাঁদা,যেখানে মৃদু বাতাসে ঈষৎ কোঁকড়া চুলগুলো বারবার উড়ে এসে বারি খাচ্ছে।গাঢ় কাজলে ঢাকা পিটপিট করা তার চোখের চাহনি।নাহ্! ওটা কে কাজল বলবো না,সেটা তো ছিল এক মায়া,কোনো এক মেঘেদের দেশ থেকে চুরি করে আনা এক চিমটি মায়া।নির্বাক দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আমি শুধু ভাবতে লাগলাম যার চেহারায় আগে থেকেই রয়েছে উপচে পড়া মায়া তাকে শুধু শুধু আরেকটু মায়া চুরি করতে হলো কেনো!এক গভীর সম্মোহনী শক্তিতে যেনো সেই শ্যামবর্ণের ঘুমকন্যা আমায় নিঃশেষ করার প্রয়াসে প্রস্তুত হয়ে এসেছে!যেই গভীরতায় আমি নিজেই এখন ইচ্চকৃতভাবে নিঃশেষ হতে চাইছি।
খুব বিরক্ত হলাম,খুব।বিরক্ত আর রাগে আমার মাথা গরম হয়ে উঠলো যখন সে আমায় তাকে খুঁটিয়ে দেখার মাঝপথে থাপ্পড় মেরে বাঁধা প্রদান করলো।সবার সামনে থাপ্পড় মারার কারণ সেই রাগের কতটুকু অংশ ছিল জানি না তবে বিরক্ত করার কারণটাই ছিল প্রধান।
তাকে এক মুহুর্তের জন্যও যে দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ তাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখি।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে শুধু দেখতে থাকি।তার ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করা ভয়ার্ত চাহনি,অবাক চোখে গোলগোল করে তাকিয়ে থাকা,ঈষৎ রাগমাখানো চোখে ঠোঁট ফুলিয়ে থাকা,সবকিছু….সবকিছু আমাকে বড্ড অস্থির করে রাখে।তার অবাক চোখের চাহনি আমার সবথেকে বেশি প্রিয়।কিছু বুঝতে না পেরে সে যখন তার চোখদুটো গোল গোল করে অবাক হয়ে মুখপানে তাকিয়ে থাকে….ইশ! ইচ্ছে করে সহস্র জনম শুধু তাকিয়েই থাকি।এক জনম যেনো কুলোবে না তাকে দেখায়।তাই তো হয়তো একটু বেশিই স্বার্থপরতা করে ফেলি!তার সেই অবাক চাহনির লোভে তাকে বারবার অবাক করে দেই।
তাকে দেখেছি এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে,বেখায়লি আনমনে অবিরাম বারি ধারায় মত্ত হয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে।কিন্তু হায়!আমার তৃষ্ণা কিভাবে নিবারণ হবে!এই তৃষ্ণা যে কখনো মিটবার নয়।এ যে ভালোবাসার তৃষ্ণা,ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণা।
প্রাপ্তিতে হয় দ্বিগুণ।যতই মিলবে ততই বৃদ্ধি পাবে।যেদিন তাকে প্রথম দেখলাম কচুপাতা রঙের শাড়িতে,সে কি জানে কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিলো এই বুকে!বারবার উড়ে এসে কপালে পড়া তার খোলা চুল সে যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে তুলছিলো।এক চিনচিনে ব্যাথায় ঘায়েল করে রাখছিলো খুব সন্তর্পণে।নিজেকে ঘায়েল হওয়া থেকে বাঁচাতেই তাকে বলেছিলাম বেঁধে ফেলতে সেই চুল যাকে খোলা দেখতেই আমার ভালো লাগে।করে ফেলেছিলাম তো বিরাট ভুল!
বাঁধা খোপায় বেলি ফুলের ছোঁয়ায় তাকে দেখতে যে আরো অনিন্দ্য সুন্দর লাগছিলো।যন্ত্রণা হ্রাসের সূত্র যে বিপরীতে গিয়ে ঠেকবে তাকি আমি জানতাম!
সেদিন বুঝলাম,এই ঘুমকন্যা গোপন ষড়যন্ত্রে আমার হৃদয়কে দগ্ধ করতেই এসেছে।এর থেকে আমার আর রক্ষে নেই…..কোনোভাবেই নেই।এই যন্ত্রণার ওষুধও সেই যে এই যন্ত্রণার পেছনের কারণ।তাকে আমার চাই….বৈধভাবেই চাই।তাকে দেখলেই যে শুধু পাগলামো করতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে কোনো এক পাগলামোর সাগরে তাকে নিয়ে ডুব দিতে।কোনো ভুল হোক তার আগেই তাকে বৈধ করে নিলাম।বড্ড অসহায় লাগে সে যখন ঠোঁট টিপে হাসে।নিজেকে সংযত রাখা যে তখন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।তাকে যে সেই মুহুর্তে কি সুন্দর লাগে তা কি সে বোঝে!বোঝে না,নাকি আমি জ্বালাতেই সে বারবার সেই হাসি দেয়!
সে যে আমাকে একদন্ডও স্থির থাকতে দেয় না।
ঘুমপুত্রের রাজ্যে হানা দিয়ে সেই ঘুমকন্যা নিষ্ঠুর হৃদয় নিয়ে তার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল।হৃদয়ের এক কোণাও ছাড় দিল না,সমস্তটুকু দখল করে নিজের রাজ্য বিস্তার করে যাচ্ছে।ঘুমপুত্রের ঘুমকেই কেড়ে নিল।ইচ্ছে করে সবসময় তাকে একদম বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখি,একদম নিশ্চুপ করে।কক্ষনো বের হতে না দেই।কিন্তু সে তো সুস্থির থাকে না শুধু ছটফট করে।আমাকে যন্ত্রণার অতল সাগরে ডুবিয়ে নিজে কি সুন্দর অবুঝ সেজে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।আর এদিকে আমার অবস্থা যে বেগতিক।মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে একটা চরম শাস্তি দেই।আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে এই হৃদ কারাগারে তাকে বন্দি করে রাখি।একটা ধমক দিয়ে বলি ‘এই এত ছটফট করছো কেনো?চুপচাপ এই বুকে ঘুপটি মেরে বসে থাকো তো!’
সে কি শুনবে?সে কি বুঝবে?কবে আসবে সেই দিন?সে তো আবার নিজের অনুভূতিও বুঝতে পারে না।তার চোখে আমি স্পষ্ট দেখেছি আমাকে নিয়ে তার ভালো লাগা,হয়তো ভালোবাসাও।আমি চাই সে নিজে বুঝুক তার মনকে,তার অনুভূতিকে।
ততদিন না হয় আমি থাকবো আমার ঘুমহীন রাজ্যে ঘুমকন্যার খোঁজে।কিন্তু হ্যাঁ,বেশিদিন এই যন্ত্রণায় রাখলে কিন্তু সত্যি সত্যিই তাকে সেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে দেব!
সে কি কম বড় অপরাধ করেছে!আমার সমস্ত ভালো লাগাকে গ্রাস করে ফেলেছে।আমার যে এখন শুধু তাকেই ভালো লাগে,সেই নিদ্রর সুপ্তিকে।আমরা যে একই অর্থে,একই সূত্রে,একই আত্মায় গাঁথা।
তাকে যে আমার খুব খুব খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে,ভিন্ন ভাবে, একইরকমে,সব উপায়েই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।তাকে ভালোবাসতে আমার ভালো লাগে।’

-‘সুপ্তি,তুমি কখন এলে?’
পেছন থেকে তার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পেছনে হাতের আড়ালে ডায়েরি লুকিয়ে তার দিকে ফিরে চাইলাম চোখে মুখে এক লাজুক হাসি নিয়ে।সে তার ভ্রুযুগোল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আমার নির্বাক অবস্থা দেখে।

-‘রিপোর্ট দিতে কি দেরি হবে?’

আমি মাথা নিচু করে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলাম।
সে তার ভাঁজরত ভ্রু আরেকটু ভাঁজ করে বলল,
-‘কি হয়েছে তুমি এমন মিটিমিটি হাসছো কেনো?’

আমি আরেকটু মাথা নিচু করে রইলাম।এই লাজুক হাসিকে যে কিছুতেই সংযত করা যাচ্ছে না।নিচ থেকে মা নিদ্রর নাম ধরে ডাক দিলে উনি একবার বাইরে তাকিয়ে আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলেন।আর আমি দ্রুত ডায়েরিটা মুখের কাছে চেপে ধরে খুশিতে আপ্লুত হয়ে গেলাম।নিজের নামের সাথে বোকার সর্বোচ্চ ডিগ্রী ধার্য করা এই ডায়েরিকে একশবার চুমুতে ভরিয়ে দিলাম।আমার যে ইচ্ছে করছে এখন নাচতে,লাফালাফি করতে,গান গাইতে।আমার খুশির যে আজ বাঁধ ভেঙেছে।

আজ যেনো আমি তার সাথে চোখই মেলাতে পারছি না।লজ্জারা যেনো সব ডানা মেলে আমাকে ঘিরে ধরেছে।আর উনি কৌতুহলী হলেও তার অভিমান ভেঙে আমাকে পরিষ্কার করে জিজ্ঞাসাও করতে পারছেন না।শুধু আমার মিটিমিটি হাসির পরিবর্তে ভ্রু কুঁচকে বারবার তাকিয়ে দেখছে।চোখ মেলাতে পারছি না অথচ শুধু ইচ্ছে করছে তার সাথে ঘেঁষে থাকি।তার কোলে গিয়ে বসে থাকি,তার গলায় ঝুলে থাকি।
তার হৃদ কারাগারে বন্দী হতে যে এবার আমার মনও ব্যাকুল।
রাতে যখন সে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল অভিমানী মুখে আমি একটু হেসে তাকে শক্ত করে জাপ্টে ধরলাম।উনি অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন,’একি কি হয়েছে সুপ্তি?এমন শক্ত করে ধরে রেখছো কেনো,ছাড়ো?’
আমি মনে মনে বললাম,’ইশ!এখন রাগ করে ন্যাকামো করা হচ্ছে।আমি ঘুমিয়ে পড়লে তো ঠিকই জড়িয়ে ধরে আর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে,আমি ডায়েরি তে সব পড়েছি।
-‘কি হলো ছাড়ো!’
আমি চোখ বন্ধ করে আদুরে গলায় বললাম,’আমার ভয় লাগছে।’
তিনি আবারো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু আমি গভীর ঘুমের ভাণ ধরে পড়ে রইলাম।

ছুটির দিনের বিকেলে যদি এক ছুট ক্রিকেট খেলা যায় তবে ব্যাপারটা মন্দ হয় না।আইডিয়াটা আমিই দিলাম,স্নিগ্ধ শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।নিদ্র কোনো ভাবাবেগ না দেখিয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে জানিয়ে দিল সে খেলতে ইচ্ছুক নয়।আমিও পেছনে লেগে পড়ে তার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলাম।উনি কিছুক্ষণ হাতের দিকে আবার কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’তুমি আজকাল একটু বেশিই ধরাধরি করছো না?’
আমি গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,’স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে,বাচ্চাদের সামনে এসব কি বলছেন।’
তিনি বিরক্তিসূচক শব্দ করে আমার টানাটানিতে আর থাকতে না পেরে ল্যাপটপ নামিয়ে খেলতে উঠলেন।বারান্দার কাছে আসতেই আমার মতিগতির পরিবর্তন শুরু হয়ে গেল।ইচ্ছে করছে তার কোলে চোড়ে বহুদূর যাই।এখন বহুদূর যেতে পারবো না তাতে কি!বারান্দা থেকে বাগানে তো যেতে পারব!
ইচ্ছে করেই নিজেকে এলিয়ে দিলাম তার গায়ের উপর।সে আমাকে ধরতে ধরতে বলল,’কি হল সুপ্তি!’
-‘পায়ে মোচ খেয়েছি।’
সে আমাকে ঠিকমতো দাঁড় করানোর চেষ্টায় চলতে থেকে বলল,’পায়ে মোচ খেলে কেউ এভাবে গায়ের উপর ঢেলে পরে নাকি!’
আমি টলতে টলতেই আবার তার উপর পরে দুঃখী গলায় জবাব দিলাম,’এখন আমার পায়ে মোচ পড়েছে সেটা নিয়েও আপনার এত সমস্যা?এখানেও দোষ খোঁজা শুরু করেছেন!’
-‘ঠিকাছে পায়ে মোচ পড়েছে এখন খেলা বাদ।’
-‘আমি উদ্বিগ্ন গলায় বললাম,’আরে খেলা বাদ হবে কেন?’
-‘তোমার পায়ে ব্যাথা তুমি খেলবে কিভাবে?’
-‘আপনারা খেলবেন আমি দেখবো।আমি না হয় আম্পায়ারই হব।’
উনি জেরার মত প্রশ্ন করতে লাগলেন,
-‘আচ্ছা!আর নিচে নামবে কিভাবে?’
আমি মুখ টিপে হেসে নরম গলায় বললাম,’আপনি কোলে করে নিয়ে যান না!’
আমার কথায় স্নিগ্ধ ওর হাতের খোলা গাড়ির পার্টস থেকে মুখ তুলে চাইলো।আমি আড়চোখে দেখে ওর মাথার ক্যাপটা নিচে নামিয়ে দিয়ে বললাম,’তুই তোর মেকানিকে মন দে।’
নিদ্র কপাল ঈষৎ ভাঁজ করে টন্ট মেরে বলল,’এখন বাচ্চাদের সামনে কোলে উঠবে কিভাবে!’
আমি তার দুই হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরে বারবার প্লিজ প্লিজ করতে লাগলাম।সে একটি বিরক্তিচাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হলুদ শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে আমাকে ঝট করে কোলে তুলে নিল।আমিও খুশিতে ঝলমল করে তারে গলা জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে।সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একবার তার গলা আরেকবার আমার মুচকি হাসির মুখপানে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
খেলার সময় আমি টেনেটুনে স্নিগ্ধর হাত থেকে গাড়ির পার্টস নিয়ে বল ধরিয়ে দিলাম।স্নিগ্ধ বোলিং করছে আর আমার নিদ্র ব্যাটিং।আমি নামের অ্যাম্পায়ার হয়ে নিদ্রর সামনে বাম পাশের একটু সাইডে দাঁড়িয়ে তাকে খেলতে দেখতে লাগলাম।হলুদ শার্টে নিচের ঠোঁট হালকা কামড়ে ধরে মনোযোগ দিয়ে সামনে তাকিয়ে সে বলের অপেক্ষা করছে।দৃশ্যটি দেখতে কি সুন্দর লাগছে!
আর এই ছেলেটি নাকি আমায় ভালোবাসে!ভাবতেই মনের ভেতর কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
একবার শুধু সে আমাকে এমন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
-‘এভাবে এত সামনে জগতের কোন অ্যাম্পায়ার দাঁড়ায় একটু বল তো,বল লাগলে তো সোজা আকাশে উড়ে যাবে।’
-‘উড়লে উড়লাম।এই সুযোগে আপনার সাথে তো একটু আকাশে উড়া হবে।’
-‘কি?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম,’কিছু না।’
প্রথম বল এই সে একটা ছক্কা মেরে দিল।আমি খুশিতে বাচ্চাদের মত কাছে গিয়ে তার গলা ধরে লাফাতে লাগলাম।সে সাংঘাতিক ভাবে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর বলল,’এই,তুমি ঠিক আছো তো?কোনো অসুখ টসুখ হয়নি তো!’
আমি মনে মনে বলতে লাগলাম,’হ্যাঁ আমার অসুখ হয়েছে,সাংঘাতিক অসুখ।আপনাকে ভালোবাসার কোনো দিন সুস্থ না হওয়া এক দীর্ঘ অসুখ।যেই অসুখে এতদিন আপনি আক্রান্ত ছিলেন সেই অসুখ এখন ছোঁয়াচের ন্যায় আমাকেও আক্রান্ত করে দিয়েছে।
নিদ্র নিচের ঠোঁট আলতো কামড়ে ধরে ভ্রু কুঁচকে আনমনে সামনের দিকে তাকালো।তার ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে।ইচ্ছে করছে এখানে একটু ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে দেই।মনকে সবসময় অত দমিয়ে রাখতে হয় না।মাঝে মধ্যে মনের চাওয়াগুলোকেও স্বীকৃতি দিতে হয়।নয়তো একসময় মন অসুস্থ হয়ে যায়।
হাতের বাঁধনটা আরেকটু শক্ত করে পায়ের গোড়ালিতে ভর করে একপ্রকার লাফ দিয়েই আমি টুপ করে তার গালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম।তারপর লাজুক মুখ নিয়ে এক ছুটে দৌড় দিলাম।আমার কান্ডে স্নিগ্ধ মুখ হা করে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে হাত থেকে বল মাটিতে পড়ে গেল।আর উনার প্রতিক্রিয়া কি সেটা দেখার জন্য আমি আর পিছনে ফিরতে পারলাম না।আমি যে আজ শুধু উড়ছি।আমাকে আজ পায় কে!

চলবে,,

#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৪
#Writer:ইশরাত_জাহান_সুপ্তি

“মৃত্যু” শব্দটাই কত বিভীষিকাময়,তাই না?জীবনের শেষ নিষ্ঠুর পরিণতি।একদিন সবার তীরেই পারি জমাবে সেই নিষ্করুণ মৃত্যু নামের ভেলা।দেহটাকে কাগজের ন্যায় ছুঁড়ে ফেলে আত্মাকে গুটিয়ে নিয়ে টেনে দিয়ে যাবে জীবনের ইতি।হাজার হাজার স্বপ্ন,আকাঙ্খা,স্মৃতি সব চাপা পড়ে থাকবে এক ধূলিমাখাময় নিষ্প্রভ দীর্ঘশ্বাসের
তলে।নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম তো সে তখন হয়ে উঠে যখন একজনকে প্রাণহীন করে সাথে আরেকজনকেও জীবন্ত লাশ বানিয়ে রাখে।জীবনের এই শেষ পরিণতির স্বীকার তো হতে হয় সবাইকেই তবুও কিছু কিছু মানুষকে জীবনের দীর্ঘতম সময় জুড়ে ভোগ করতে হয় সেই নিদারুণ মৃত্যুর যন্ত্রণা।ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে থাকার কষ্ট যে মৃত্যুকেও হার মানায়।একজন তো জীবনের ভীড়ে হারিয়ে যায় আর আরেকজন! তাকে তো থাকতে হয় একবুক হাহাকার,চিরদিনের নিস্তব্ধতা,হারানোর তীব্র ব্যাথায় মর্মাহত ক্ষত হৃদয় নিয়ে।স্মৃতিগুলো যে হিংস্র পশুর ন্যায় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।একজনের হয় মৃত শরীর আর আরেকজনের হয় মৃত মন।হয়তো তাই মৃত মানুষটির চেয়েও তার জন্য হাহাকার করা রক্তাক্ত হৃদয়ের মানুষটির বেদনাই আমাকে বেশি কষ্ট দেয়।কতটা কষ্ট তার!কি করে কাটাবে সে তার বাকি জীবন!নিঃসঙ্গ,সঙ্গীহীন,নিষ্প্রাণ…এই তো!

এক মুহুর্তের জন্য অজ্ঞাত মেয়েটির জায়গায় নিজেকে অনুভব করতেই আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল।হসপিটাল জায়গাটা আমার এমনিতেই অপছন্দ,আর তার উপর এভাবে আজ এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তা কে জানতো!
আজকেই এমনটা হতে হলো!
রিপোর্ট দিতে একটু দেরি হওয়ায় জেনারেল ওয়ার্ডের সামনে বসেছিলাম।হঠাৎ সেখানে এক শোকে মর্মাহত পরিবার এসে উপস্থিত হয়।তাদেরকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো তারা তাদের কোনো এক আপনজনকে হারিয়েছে।তাদের সামনে স্ট্রেচারে করে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া একলোককে নিয়ে আসে।মৃত মানুষটিকে আনার সাথে সাথেই একটি ছিপছিপে গঠনের সুন্দর মেয়ে লাশটির হাত ধরে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ল।সবাই এখন মেয়েটিকে সামলাতে ব্যস্ত।তার কান্নার আতর্নাদ বারবার আমার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে তুলছে।মেয়েটি কিভাবে সহ্য করবে তার স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু।কতই বা বয়স তার।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা নবদম্পতি।সেখান থেকেই শুনতে পেলাম তাদের বিয়ের দেড়বছর হয়েছে মাত্র,পাঁচ বছরের প্রেমের বিয়ে ছিল।কিন্তু আজ সব শেষ!কোন দোষের এত বড় শাস্তি সৃষ্টিকর্তা এই মেয়েটিকে দিল।মেয়েটার কান্না আজ আকাশকেও কাঁপিয়ে তুলবে।তার রক্তাক্ত হৃদয়ের মর্মযন্ত্রণা এক বিভৎস কান্নার প্রতিমূর্তি হয়ে বেড়িয়ে আসছে।না চাইতেও যা ছোঁয়াচের ন্যায় আমাকে ছাপিয়ে তুলছে।একটি কান্না আমার গলার কাছে এসে আটকে রয়েছে।চোখের পাতা ভারী করার তার কি দীর্ঘ প্রয়াস।একে বের করতে পারলেও যেনো আমি শান্তি পেতাম।অথচ সে স্তব্ধ মনের বহিঃপ্রকাশে কুন্ডলী পাকিয়ে আমার শ্বাসরোধের চেষ্টায় মগ্ন।চাইছি না সেখানে দেখতে তবুও আড়চোখে দৃষ্টি বারংবার সেখানেই চলে যাচ্ছে।আজ আমার জন্য একটি বিশেষ দিন।আজকের দিনে আমি আমার মনকে এই বিষাদমাখা উদাসীনতায় নিমগ্ন রাখতে চাই না।আমাকে এড়িয়ে যেতে হবে এসবকিছু,মনকে নিক্ষিপ্ত করতে হবে অন্য কোনো স্মৃতির দাঁড়ে।

-‘হি হি হি!সুপ্তি,এতদিনে তোর বুদ্ধির দুয়ার খুললো তবে।নিদ্র ভাই কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে,এবার তার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে দে।বেচারাকে কিন্তু তুই ভালো যন্ত্রণা দিয়েছিস।তার জন্য তার শাস্তিস্বরূপ রোমান্টিক অত্যাচারের জন্য তৈরি থাক।’

সোমা আপুর কথায় আমি লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে রাখলাম।তারা দুজন যেন আজ আমাকে লজ্জায় খুন করতে পারলেই ক্ষান্ত হবে।সেই কখন থেকেই সোমা আপু আর সাফা আমাকে নিয়ে ক্ষ্যাপানো শুরু করেছে।আর আমি লজ্জয়া মাটিতে মিশে যাওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজে যাচ্ছি।সাফা হঠাৎ মুখ থমথম করে বলল,

-‘নিদ্র ভাই তোকে সেই ফাস্ট ডে থেকে পছন্দ করে তার সূত্রেই সে তোকে ছল করে বিয়ে করেছে আর এই কথা আমাকে তামিম এখনো জানায়নি।আমাকে জানালেও তো আমি তোকে জানাতে পারতাম।আজকেই ওর সাথে গিয়ে আমি ব্রেকআপ করবো!’

সোমা আপু সাফার মাথায় চাটি দিয়ে বলল,’ও আমার ব্রেকআপ রাণী!একজন এখানে ভালোবাসার মিলনের ধ্যানে আছে আর আরেকজন পৃথকের!’

-‘তো!ও আমাকে কিছু জানালো না কেনো?তোমাকে তো রাফি ভাই ঠিকই জানিয়েছে।তাহলে বলো এখন ওঁকে কি বলা দরকার।’

আমি সোমা আপুর দিকে তাকিয়ে অভিমানসুরে বললাম,’সোমা আপু,তুমি আমাকে এত বড় কথা বললে না কেনো বলো তো?তাহলেই তো আমি আরো আগে জেনে যেতাম।’

সোমা আপু বলল,
-‘নিদ্র ভাইয়ার কঠিন নিষেধ ছিল কেউ যেনো তোকে এই কথা না জানায়।নিদ্র ভাই চেয়েছে তুই যেনো তোর অনুভূতিগুলো নিজে থেকে বুঝতে পারিস।আর তার ভালোবাসায় ধরা দিস।আর সাফা তোকেও এই কারণেই জানানো হয়নি,তোর যেই পেট পাতলা!হয়তো তামিম ভাই তোকে বলতে দেরি করতো কিন্তু তুই আর সুপ্তিকে জানাতে দেরি করতি না।’

সাফা আমার কাঁধে থুতনি রেখে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল,’সুপ্তি,ভাইয়াকে তাহলে কবে জানাবি বলে ঠিক করলি?’

আমি মৃদু হেসে মাথা নিচু করে বললাম,’আজকে রাতেই।’

আজকের রাত!কতটা বিশেষ আমার জন্য,আমাদের জন্য।আজ রাতেই আমি নিদ্রকে বলবো আমার মনের কথা।ব্যক্ত করবে হৃদয়ের সব ভালোবাসার সুর।অথচ আজ মনটা কতটা বিমর্ষ হয়ে উঠেছে।মাত্র একটা ক্লাস করেই আজ ভার্সিটি থেকে সোজা হসপিটালে চলে আসি।নিদ্র বলেছিল রিপোর্ট সে আনতে যাবে কিন্তু সে বিগত দুইদিন ধরে খুব ব্যস্ত।অফিসেই কাটাতে হয় বেশিরভাগ সময়।তাই আমি আর তাকে জানাইনি।না বলেই চলে এসেছি একা একা রিপোর্ট কালেক্ট করতে।কিন্তু এখানে এসে যে এমন পরিস্থিতিতে পড়বো তা জানলে কখনই একা আসতাম না।মেয়েটির কান্না বড্ড বারি খাচ্ছে আমার কানে।হাতগুলো কেমন যেন ঈষৎ কাঁপছে।মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বুঝি ঐ আবার শুরু হলো।না এভাবে আজকের দিনে নিজের মনকে উদাসীনতায় গ্রাস হতে দেওয়া যাবে না।এর রেশ আমায় কাটাতে হবে।ভাবতো হবে অন্যকিছু,আরো অন্য ভালোকিছু।কোনো সুখ স্মৃতি।

-‘সুপ্তি,তোমাকে থার্ড ফ্লোরে নিদ্র ভাইয়া ডাকছে।’

অফ পিরিয়ডে বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝে এমন তার হুটহাট ডাকে চরম বিরক্তিতে আমার কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেল।এখন ভয়ানক বিরক্ত হলেও আমাকে তো যেতেই হবে।তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার মতো দুঃসাহস আমার থাকলে তো কথাই ছিল না!
বিরক্তি আর ঈষৎ ভয় মাখানো অনুভূতি নিয়েই আমি উঠে পড়লাম তার খোঁজে।থার্ড ফ্লোরে এসে দেখি সবকয়টা ক্লাসই খালি।এখানে ক্লাস খুব কম হয়।এক একটা ফাঁকা ক্লাস ঘুরে ঘুরে আমি তাকে খুঁজতে লাগলাম।তার সামনে আসতে আগে থেকেই আমার ভয় ভয় লাগতো আর এখন বিয়ের পর সেই ভয়টা বেড়ে আরো দ্বিগুণ হয়ে গেছে।ভয়ের সাথে এখন এক প্রকার চাপা অস্বস্তিও মিশে থাকে,কেউ যদি আমাদের দেখে বুঝে যায় যে আমাদের বিয়ে হয়েছে তবে!
এই ভয় আর অস্বস্তির বশবর্তী হয়েই তার সাথে এখন আমি একটু কম থাকতে চাই কিন্তু সে এসব কিছুই বুঝে না।এমন ফাঁকা ফাঁকা ক্লাসে যে ডেকে পাঠায় কেউ দেখলে কি ভাববে!
গুটি গুটি পায়ে প্রায় সবগুলো ক্লাসরুম চেক করে একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠে আরো একটি ফাঁকা ক্লাসরুমকে ক্রস করেতই হঠাৎ আমার হাত ধরে হ্যাচকা টানে কেউ আমাকে একটি বড় ফাঁকা ক্লাসরুমের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে নিল।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে গিয়ে চিৎকার দিতে উদ্যত হলে একটি বলিষ্ঠ হাত দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে আমার মুখ চেঁপে ধরল।আকস্মিকতার ঘোর কাটলে চোখ বড় বড় করে আমি বুঝতে পারলাম ইহা আর কেউ নয় স্বয়ং নিদ্রই।তার সুদৃশ্য ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে নিচের আলতো চেপে ধরা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে দাঁড়িয়ে আমার ভয়ার্ত অভিব্যক্তির মজা নিচ্ছে।একসময় সে আমার মুখ থেকে হাত সরালে আমি হালকা শ্বাস টেনে বললাম,’এমন ভাবে কেউ ধরে,আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!’
সে বাম হাত আমার মাথার ডান পার্শ্বের দেয়ালে রেখে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’ভীতুরা অলওয়েজ ভয় পাবে এতে আর নতুন কি?’

আমি মুখ ফুলিয়ে তাকে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আমার সামনে থেকে সরিয়ে বললাম,’তাহলে সবসময় ভীতু মেয়েকেই কেনো ডেকে পাঠান?একটা সাহসী মেয়েকে ডাকলেই তো হয়!আপনি একটা ভূত এনে সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলেও হি হি হি করে হাসবে।’
আমার কথায় হেসে দিলেন উনি।পেছনে সরে হাইবেঞ্চে উঠে বসলেন আর বললেন,
-‘আমি তো জানতাম সিনিয়রকে থাপ্পড় মারা মেয়ে অনেক সাহসী হয়।সেই হিসেবে আমি তো কোনো ভুল করিনি।’

তার কথায় একটি মুখ ভেংচি দিয়ে সামনে অগ্রসর হতেই কাঠের বেঞ্চের সাথে বাম পায়ে হোঁচট খেলাম।নিদ্র তড়িৎবেগে বেঞ্চ থেকে নেমে আমাকে একটি বেঞ্চে বসিয়ে পায়ে হাত দিল।আমি চমকে উঠে পা সরিয়ে নিলাম।সে এবার তার মাটিতে ভাঁজরত হাঁটুর উপর আমার পা আলতো করে রেখে দেখতে লাগলো।আমি ইতস্তত করে বলতে লাগলাম,’ভাইয়া আমি ব্যাথা পাইনি।আপনি আমার পায়ে…হাত..দি..চ্ছে ন
তার গরম চোখের চাহনিতে আর বাকি কথাটুকু বলতে পারলাম না।সে হাত বুলিয়ে আমার পায়ের গোড়ালি দেখে যাচ্ছেন।তার ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত শিহরণ হতে লাগলো আর সাথে অস্বস্তিও।কেউ যদি এভাবে আমাদের দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে।তাছাড়াও অত ব্যাথা তো পাইনি।
বারবার দরজার দিকে নজর রাখতে লাগলাম কেউ যেন এসে না পরে।

-‘ভয় নেই,ফর্টি ফাইভ মিনিটের আগে এখানে কেউ আসবে না।’
তার কথায় আমি চমকে উঠে বললাম,’কেনো?’
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’থাক আর বোঝা লাগবে না।পা এখন ঠিক আছে?’
আমি পা নামিয়ে বললাম,’পা তো সেই কখন থেকেই ঠিক আছে।একটু হোঁচট খেলেই কি আর ব্যাথা পায়!’
-‘তুমি নিজেরটা পাও না অথচ আমি কেন এতো ব্যাথা পাই বলো তো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’মানে?’
-‘কিছু না।’
-‘তাহলে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেনো বললেন না তো?’
কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাত উঠিয়ে তার কালো রঙের শার্টের হাতায় মুছে বলল,’মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে,তার জন্য একজন মানুষ দরকার।তাই ডেকেছি,সুপ্তি আমার কপালের উপর একটু তোমার হাত রাখো তো।’
এতক্ষণে আমি খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই তার মুখটা আংশিক শুকিয়ে রয়েছে।আমি বললাম,’মাথা ব্যাথার মলম লাগাবেন?আমার ব্যাগে আছে।’
একটি শর্ট বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি বললেন,’না লাগাবো না।তোমাকে যা বলছি তাই করো।’
আমি কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে তার মাথা টিপে দিতে লাগলাম।তিনি আমার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বললেন,’টিপে দিতে হবে না।শুধু হাতটা কপালের সাথে ছুঁয়ে রাখো।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’শুধু ছুঁয়ে রাখলে কি হবে?তাতে কি ব্যাথা কমবে নাকি।’
তিনি শুকনো মুখে চোখ খুলে মৃদু হেসে বললেন,
-‘এই শহরের প্রত্যেকটি মানুষের অসুস্থতার এক রহস্যময়ী ওষুধ খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে আছে অন্য আরেকজনের হাতের মাঝে।তোমাকে শুধু সেই হাত খুঁজে নিতে হবে।আমার ওষুধও যে তোমার হাতে।’

মেয়েটি আমার পায়ের কাছে এসে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।আমি উঠে ধরার আগেই তার পরিবারের মানুষরা এসে তাকে ঘিরে ধরল।আর তার প্রায় সাথে সাথেই আমার একেবারে সামনে দিয়ে স্ট্রেচারে করে মেয়েটির স্বামীকে নিয়ে গেল।অ্যাক্সিডেন্টে থেতলে যাওয়া তার বিভৎস রক্তাক্ত মুখ এক পলকে দেখে এক শীতল স্রোত আমার শির দাড়া বেয়ে নেমে আমাকে কাঁপিয়ে তুলল।মাইগ্রেইনের অসহ্য ব্যাথাটা খুব ভালোভাবেই জাঁকিয়ে বসেছে মাথায়।
সেদিন নিদ্রর সেই কথার মানে আমি বুঝিনি।বরাবরের মতোই ড্যাবড্যাব চোখে শুধু তাকিয়ে ছিলাম।কিন্তু আজ তো বুঝি।আমার হাতের স্পর্শে যেমন তার অসুস্থতার ওষুধ আছে তেমনি আমার অসুস্থতার ওষুধও তো তার হাতেই।তাকে আমার এই মুহুর্তে দরকার,খুব দরকার।
কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তাকে কল করার আগেই ডক্টরের কেবিনে আমার ডাক পড়ল।
ডক্টরের প্রাসারিত বড় কেবিনে ঢুকে একটু হলেও মনটা শান্ত হলো।অন্তত সেই বেদনাদায়ক দৃশ্যের হাত থেকে তো রেহাই পেলাম।ডক্টরের টেবিলের উপর হাতের ফোনটি রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলাম।টেবিলে রাখা পরিষ্কার সাদা পিরিচে ঢাকা স্বচ্ছে কাচের গ্লাসে পানি দেখে মুহুর্তের মধ্যেই তৃষ্ণা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল।সামনে বসা সাদা এপ্রোণ গায়ের মধ্য বয়স্কের ডক্টরটি হয়তো বুঝতে পারলো।সাদা পিরিচটি সরিয়ে আমার সামনে গ্লাসটি বাড়িয়ে দিল।আমি এক চুমুকেই ঢকঢক করে সমস্ত পানি পান করে নিলাম।তারপর শুন্য গ্লাসটি টেবিলে রেখে মৃদু হাসি টেনে থ্যাংকস বলতেই ডক্টর বলে উঠল,
-‘আপনার সাথে কেউ আসেনি?’
-‘না।আমি একাই এসেছি।কেনো বলুন তো?’
তিনি কিছু না বলে আমার সামনে রিপোর্ট মেলে ধরে মাথা নিচু করে রইলেন।
আমি কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,’ডক্টর রিপোর্ট কি সব নরমাল?’
তিনি মাথা উঁচু করে বললেন,’আপনার কোনো গার্ডিয়ানকে আপনি নিয়ে আসবেন।’
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম,’আপনি আমার রিপোর্ট আমাকেই বলুন।প্লিজ।’
তিনি চুপ করে রইলেন।
আমি এবার শক্ত হয়ে বললাম,’ডক্টর প্লিজ,আমাকে বলুন সমস্যা কি?’
তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ থেকে ভারী চশমা খুলে বললেন,
-‘আপনার মাথা ব্যাথা কোনো স্বাভাবিক মাইগ্রেইনের ব্যাথা নয়।আপনি ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত।’
ডক্টরের কথাটি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।সারা শরীর যেনো শীতল হয়ে জমে রইল।নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-‘আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে।কি..ভা..বে?’

-‘ব্রেইন টিউমার দুই ধরণের হয়,একটি ম্যালিগন্যান্ট অর্থাৎ ক্যান্সারযুক্ত আরেকটি বিনাইন মানে ক্যান্সারহীন।আপনার হয়েছে ম্যালিগন্যান্ট প্রাইমারী টিউমার।এই টিউমারটির উৎপত্তি মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে।আমাদের শরীরের কোষগুলো ক্রমাগত বিভক্ত হয়ে মরে যায়।যার পরিবর্তেই নতুন কোষগুলো তৈরি হয়।কিন্তু অনেকসময় দেখা যায় নতুন কোষগুলো তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু পুরনো কোষগুলো ঠিক পুরোপুরি ভাবে বিনষ্ট হয় না।তখন কোষগুলো জমাট বেঁধে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।এই কেসের অধিকাংশ মানুষই একে মাইগ্রেইনের নরমাল ব্যাথা মনে করে অবহেলা করে।আর যখন বুঝতে পারে ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে যায়।যদিও এখন এই রোগের চিকিৎসা স্বরুপ বিদেশে বিভিন্ন সার্জারির ব্যবস্থা মোটমুটি আছে….

তার শেষোক্ত আমতা আমতা করে বলা কথাগুলো মাঝ পথে থামিয়ে আমি বললাম,
-‘আমার হাতে আর কতদিন সময় আছে?’

তিনি একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-‘এই বেশি হলে দশ বা এগারো মাস।’

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।শব্দগুলো গলায় আটকে এলো।টেবিলের উপর শুন্য গ্লাসটা পড়ে রয়েছে।অথচ আরেকগ্লাস পানির তেষ্টায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে।কিন্তু না আসছে ভেতর থেকে কোনো শব্দ আর না কোনো শক্তি।সামনে থাকা ফোনটি অনবরত বেজে যাচ্ছে।ফোনের স্ক্রিনে নীলাভ আলো জ্বলে গোটা গোটা অক্ষরে বারবার ভেসে উঠছে সেখানে একটি নাম,”নিদ্র।”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here