#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-২,০৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
০২
আশ্চর্য পরিমাপের যদি কোনো থার্মোমিটার থাকতো তবে আমার ক্ষেত্রে পারদের মাত্রা সর্বোচ্চ ঘর ছাপিয়ে উপরে উঠে যেত।আমি চরম আশ্চর্য হলাম যখন জানতে পারলাম নিদ্র ভাইয়ের এই সাজাকে সবাই মজা বলছে।ভার্সিটির সবচাইতে হ্যান্ডসাম ছেলের সর্বদা সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বড় ভাগ্য নাকি আর কিছুই হতে পারে না।তাকে দেখলেই এখন ভয়ে আমার হাত পা কাঁপতে থাকে আর তার সাথে সাথেই থাকতে হবে শুনে যেখানে আমার অবস্থা খারাপ সেখানে কিছু মেয়ে আফসোসে শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা কেনো এই পানিশম্যান্ট পেলো না।
চিন্তার অথৈ সাগরে ডুবে একাকার হয়ে আমি বিছানায় বসে ওড়নার প্রান্ত কুট কুট করে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছি।
আর এদিকে সোমা আপু হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে।
-‘আপু তুমি হাসছো।আমি তোমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র রুমমেট।আর তার দুঃসময়ে তোমার হাসি পাচ্ছে!’
-‘তো আর কি করব সুপ্তি?শেষমেষ তুই কিনা নিদ্র ভাইয়ার সাথে ফেঁসে গেলি।তোদের দুজনকে দেখলে আমার সিংহ ইঁদুরের ঐ গল্পটা মনে পড়ে যায়।তোর অবস্থা এখন সেই ধরা পড়া ইঁদুরের মত লাগছে।’
-‘আচ্ছা তোমাদের ঐ নিদ্র ভাইয়া কোন ইয়ারে পড়ে?’
-‘মাস্টার্সে।কেনো?’
-‘তার মানে তাকে আমার পুরো একবছর সহ্য করতে হবে!হায় আল্লাহ আর একবছর এদিকসেদিক হলেই তো হত!আজকেই আমি বাবাকে ফোন করে বলব আর একবছর পর বিয়ে করলে তাদের কি এমন হয়ে যেত।বরং আমি বেঁচে যেতাম ঐ ধলা লম্বুশ ডেভিলটার হাত থেকে।’
-‘চুপ থাক নটাঙ্কি, নিদ্র ভাইয়া মোটেও ডেভিল নয়।আমি ভাইয়ার দুই বছরের জুনিয়র।কত দিন ধরে তাকে দেখছি,হি ইজ এ রিয়েল জেন্টেলম্যান।কত জুনিয়রদের পড়ার খরচ দিয়ে সে সাহায্য করেছে।সব মেয়েরা তার জন্য পাগল অথচ সে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না।তুই জানিস নিদ্র ভাইয়ার জন্যই এই ভার্সিটির মেয়েদের কোনো ছেলে টিজ করতে পারে না।এই ভার্সিটি সবথেকে পপুলার হলে কি হবে এর রেগিং ইতিহাস খুব খারাপ ছিল।নিদ্র ভাই এসে এসব বন্ধ করিয়েছে।রেগিং তো বলতে গেলে হয়ই না,তুই তো ভাইয়াকে থাপ্পড় মেরে ক্ষ্যাপিয়ে তুললি।ভাইয়া এমন কিই বা তোকে করতে বলেছে!কত মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে তার সাথে একটু কথা বলার জন্য।আর তুই তো বাম্পার অফার পেয়ে গেছিস!’
-‘যারা আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরই করতে বলো।আমার জায়গায় থাকলে না বুঝতা।’
-‘হুম, এখন এসব বাদ দিয়ে খেতে চল।সাড়ে নয়টার পর কিন্তু আর খাবার পাবি না।’
হোস্টেলের এই একটি নিয়ম আমার অসহ্য লাগে।এখন আমার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।কোথায় বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি করে নিজের শোক পালন করব!কিন্তু না!এখানে এখনই খেতে হবে মানে এখনই খেতে হবে।নো হেরফের।এদের কি মন বলতে কিছু নেই।ধূর!
বাংলা ব্যাকরণের মত বিরক্তিকর ক্লাসে আমি শত চেষ্টা করেও মনোযোগ বসাতে পারছি না।গালে হাত দিয়ে শুধু হাম দিয়ে যাচ্ছি।মধ্যবয়স্কের প্রফেসরটি নাকের ডগায় রাখা চশমার ফাঁকে তীক্ষ্ণ চোখে বারবার আমায় দেখে যাচ্ছে।এই বুঝি ধমক দিল বলেই!
কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।কালকের ঘন্টাটা আমার আনুকূল্যে না হলেও আজকের ঘন্টায় আমার সুবিধা হওয়ায় আমি খুশিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম।ঠিক তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসল।
-‘হ্যালো কে বলছেন?’
-‘তোমার নামের অর্থের মিতা।’
এমনি সময় হলে এমন প্যাচানো কথার আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না।কিন্তু আজ তার গাম্ভীর্য্য গলার আওয়াজেই বুঝে গেলাম কে।একটি ঢোক গিলে বললাম,
-‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
একটু হেসে বলল,’আরিয়ান ইসলাম নিদ্র সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাও নেই।এখন চট করে ক্যান্টিনে চলে আসো তো।বাদাম খাবো।’
খুব নরম স্বরেই বললাম,’ভাইয়া আপনি বাদাম খাবেন আমি কি করব?’
-‘আমার বাদাম খেতে ইচ্ছে করছে খোসা ছাড়াতে নয়।তুমি খোসা ছাড়িয়ে দিবে আমি খাবো।’
সে ফোন কেটে দিলে আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম।এর থেকে তো সেই স্যারের বোরিং ক্লাসটাও ভালো ছিল।আমার এই অবস্থা আর আমার নেমকহারামী বান্ধবী সাফা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে।সত্যি বিপদে পড়লে সব পর হয়ে যায় এখন তার প্রমাণ হাতে নাতে পেলাম।
ক্যান্টিনের মাঝারি ধরণের গোলাকার টেবিলের এক প্রান্তে নিদ্র ভাইয়া এক হাত টেবিলে উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে আর তার বিপরীত প্রান্তে আমি খুব মনোযোগ সহকারে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি।দুই আঙ্গুলের মাঝে বাদাম রেখে মৃদু চাপ দিতেই খোসা ছুটে যাচ্ছে।তার মধ্যে থেকে বাদাম বের করে এনে তার উপরের খয়েরি রঙের আবরণটা দু হাতের মাঝখানে রেখে একটু পিষে দিতেই সব আলগা হয়ে যায়।মুখ দিয়ে ফু দিয়ে সেই আলগা আবরণ ফেলে দেওয়ার কাজটা আমার কাছে যথেষ্ট মজার লাগে।অনেকক্ষণ ধরেই মাথা নিচু করে নিজের মত করে যাচ্ছি।অনেকগুলো একসাথে জমা হওয়ার পর মাথা উঁচু করে তার হাতে বাদামগুলো দিতে গিয়েই দেখলাম সে আমাকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে।আমার সাথে চোখে চোখ পড়তেই একটু ইতস্তত বোধ করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আমার দেওয়া বাদাম একটি একটি করে মুখে পুরে খেতে লাগল।বাদামের মতই আজ সে বাদামি রঙের শার্ট পড়ে এসেছে।
আমি বললাম,’ভাইয়া এখন যাই।আমার ক্লাস আছে।’
-‘এখন তো তোমার অফ পিরিয়ড।আরো চল্লিশ মিনিট থাকতে পারবে।’
আমি মনে মনে রেগে বললাম,’আমার একেবারে সবকিছু জেনে বসে আছে।অসহ্য!’
একটি বারো তেরো বছরের ছেলে এসে বলল,
-‘ভাই আপনার কফি।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’ছোটকু তুই স্কুলে যাস নাই?’
-‘যাই তো ভাই,আইজ ইশকুল বন্ধ।আপনের টেকা দিয়া বই কিনছি,জামা কিনছি ভাই।নতুন বইয়ের গন্ধ খুব ভালা লাগে।’
নিদ্র ভাইয়া পিঠ চাপড়ে বলল,’টাকা লাগলে আবার বলবি,বুঝলি!আমাকে যেনো জিজ্ঞেস করতে না হয়।’
ছোটকু বত্রিশটি দাঁত বের করে হেসে বলল,’আইচ্ছা।’
আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছিলাম তাদের দুজনকে।এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ছেঁয়ে গেল।
গরম গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ মুখের কাছে নিয়ে সে নিচের ঠোঁট আলতো করে চেঁপে ধরে তার ঘন কালো ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে ঘ্রাণ নিতে লাগল।
আহা! কি সুন্দর দৃশ্য।যেনো এই সুদর্শন যুবকের ঘ্রাণ নেওয়ার এই অপূর্ব মুখভঙ্গির জন্যই কফির সৃষ্টি।কফিও তার জন্মের সার্থকতা লাভ করতে পেরে প্রথম আলতো চুমুকেই তার ঠোঁটের কোণে লেগে রইল।
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চোখ দিয়ে ইশারা করল কি!
আমি তাকে ইশারায় ঠোঁট দেখিয়ে বললাম।
সে শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,’ধরো তো একটু।’
মনে মনে বললাম,’এখন এটাও আমায় করতে হবে।’
সবাই নতুন ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে দেখছে আর আড্ডা দিচ্ছে আর আমি কিনা এখানে বসে ফুট ফরমায়েশ খাটছি।
আমি মুখ ফুলিয়ে সানগ্লাস ধরে রাখলাম আর সে সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সে বলল,’এভাবে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?
তোমার নিজের জন্যই এখন এখানে বসে থাকতে হচ্ছে।’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘সেদিন যে হিরোইন স্টাইলে আমার গায়ের উপর পড়ে গেলে আর শার্টের বারোটা বাজিয়ে দিলে তার জন্য জানো আমি কত ইম্পর্টেন্ট একটা কাজ মিস করে ফেলেছি।সেই কাজ কভার করে প্লাস একরাতের মধ্যে অ্যাসাইমেন্ট কমপ্লিট করতে আমার কত খাটতে হয়েছে।এখন রিল্যাক্স এর জন্য আমার এতটুকু প্রয়োজন।’
আমার পেটের ভেতর কথা সুড়সুড় করছে।বলতে ইচ্ছে করছে তাহলে আপনি কেনো আমাকে কাঁদা পানিতে ভিজিয়ে দিলেন?সেখান থেকেই তো সব শুরু।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।শুধু মুখ ভার করে বললাম,’হ্যাঁ এখন তো চাঁদ মামা দিনে কেনো উঠে না তাতেও আমার দোষ!’
আমার কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি হেসে দিলেন।
আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।এই প্রথম তাকে হাসতে দেখলাম।একটা মানুষের হাসিতে কতটা সৌন্দর্য্য লুকিয়ে থাকে তা হয়তো তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।এই বুঝি সেই হাসি যে হাসিতে পুরো পৃথিবী বিক্রি করে ফেলা যায়।সে যে কম হাসে তাই ঠিক করে,নাহলে সে তো হাসি দিয়ে খুনও করে ফেলতে পারে।হৃদয়ের খুন। অতিরিক্ত সৌন্দর্য্য মানুষের হজম হয় না।একধরণের বিষন্নতা এনে দেয়।
বিষন্নতা ছাপিয়ে যাওয়ার আগেই সেখানে নিদ্র ভাইয়ার পুরো গ্যাং উপস্থিত।তামিম ভাইয়া বলল,
-‘কি খবর স্লিপিং কুইন আমাদের স্লিপিং কিং কে ভালো মতো সেবা করছো তো?তা তোমার সেই সাফা আফা কই?’
সবাই হো হো করে হেসে দিল।সাফা এখানে উপস্থিত থাকলে তার নামের বারতি যোগ করা অংশটুকু শুনে নিশ্চিত কেঁদে দিত।
তাদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল,
-‘এই সেই মেয়ে?বাহ্! দেখতে তো দারুন মিষ্টি।’
আরেকটি ছেলে বলল,’তানিয়া রে!নিদ্রর মত সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেয়ে এই সুবিধাজনক লাভ আমারো পেতে ইচ্ছে করছে।’
তানিয়া আপু হেসে বলল,’সোহেল,সুন্দরী মেয়েদের থাপ্পড় খেতেও না যোগ্যতা লাগে।তোর মতো বান্দরের তা নেই।’
-‘তাই নাকি!নাঈম শালা এখনো আসছে না কেনো?তোর হাতে তো ও ভালোই মাইর খায়।তাকে জিজ্ঞাসা করতাম পেত্নীদের হাতের থাপ্পড় খেতেও কি যোগ্যতা লাগে নাকি!’
-‘তবে রে!’
বলে তানিয়া আপু সোহেল ভাইয়াকে মারতে লাগল।
আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো তানিয়া আপুর মত এত সুন্দরী মেয়ে নাকি আমাকে সুন্দর বলছে।আমি তো বেশি ফর্সাও না।
এই ফাঁকে রাফি ভাইয়া নিদ্র ভাইয়ার হাত থেকে খোসা ছাড়া বাদাম নিতে ধরলেই নিদ্র ভাই চট করে হাত সরিয়ে বলে,
-‘একদম না।খেতে হলে ওখান থেকে খোসা ছাড়িয়ে খা।এর ভেতর একদম স্পর্শ করবি না।’
-‘হায় রে দোস্ত!দে না একটা।খোসা ছাড়াতে ইচ্ছে করছে না।’
নিদ্র ভাইয়া নিজে খোসা ছাড়িয়ে রাফি ভাইকে দিতে লাগল তবুও আমার দেওয়া বাদামগুলো দিল না।এটা দেখে সবাই একে অপরের সাথে চোখাচোখি করে মুচকি হেসে মুখ দিয়ে হুম করে অদ্ভুত সাউন্ড করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে নাঈম ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে তানিয়ে আপুকে বলল,’স্যরি জানু।এখন তুমি মুখ ভার করে থাকলেও তোমার রাগ ভাঙাতে পারবো না।’
তারপর নিদ্র ভাইয়াকে ডেকে বলল,’নিদ্র তোকে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছে,মে বি নবীন বরণ নিয়ে কথা বলবে।’
তারা সবাই একসাথে চলে গেল।নিদ্র ভাইয়া দু কদম যেয়ে আবার পিছিয়ে এসে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল,’ডোন্ট ওয়ারি,দশ মিনিট পরে কভার করে নিব।’
তারপর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে একটু মুচকি হেঁসে চলে গেল।
এমন ভাব করলো যেনো দশ মিনিট আগে যাওয়ার আফসোসে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আমার বয়েই গেছে তার জন্য আফসোস করার।আমি তো আরো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
চলবে,
#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-৩
#Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
এই মুহূর্তে আমার নিজের চোখকে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না।কিন্তু তবুও করতে হচ্ছে।কয়েকদিনের পরিচয়ের হলেও আমি যতদূর জানি সোমা আপুর সাথে আমার যথেষ্ট সখ্যতা গড়ে উঠেছে।এতবড় কথা আমার থেকে লুকানোর কোনো মানেই হয় না।আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফোনের স্কিনে আই লাভ ইউ সোমা উঠে রয়েছে।যেই মেসেজটা কিনা রাফি ভাইয়ার নামে সেভ করা নাম্বার থেকে এসেছে।
সোমা আপু রুমে ফিরে আসতেই আমি তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে মুখ ভার করে বললাম,’যার তার হাতে ফোন দিয়ে দিওনা।তোমাদের পারসোনাল মেসেজ দেখে ফেলতে পারে।’
সোমা আপু অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে বলল,’তুই দেখে ফেলেছিস।বিশ্বাস কর আমি তোকে আজ না হয় কাল ঠিক বলতাম।তুই তো তাদের কথা উঠালেই নিদ্র ভাইয়ার নামে এত গালি দিতে থাকিস বলে কিছু বলতে পারি না।’
-‘হ্যাঁ নিদ্র ভাইয়া!তুমি যদি বলতে রাফি ভাই তোমার বয়ফ্রেন্ড তাহলে আমিও একটু তাকে দিয়ে নিদ্র ভাইয়ার কাছে সুপারিশ করে রেহাই পেতাম।জানো ঐ নিদ্র আমাকে কতটা জ্বালাচ্ছে!উঠতে বসতে সবকিছুতেই এসে ডেকে পাঠায়।’
সোমা আপু হেসে বলল,’তোর কি মনে হয় রাফি বললেই নিদ্র ভাইয়া তোকে মুক্তি দিবে!ভাইয়ার যেটা একবার মাথায় আসে তা থেকে কেউ তাকে বের করতে পারে না।তবে একটা আশ্চর্যের কথাই!এতদিন হয়ে গেল ভাইয়া তোকে এখনও মাফ করছে না,এতটা রুড তো ভাইয়া না!নিদ্র ভাইয়ার হয়েছে টা কি?’
আমি কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বললাম,’হ্যাঁ আমার যে কপালটাই খারাপ তাই আমার ক্ষেত্রেই সবকিছু বেশি বেশি।’
নিদ্র ভাইয়াকে আমার এখন কাঁঠালের আঠার মত লাগছে।যতই আমি তাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে ততই জড়িয়ে রাখছে।
নবীন বরণের অনুষ্ঠানে সকল নিউ স্টুডেন্টদের কোনো না কোনো ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।সাফাকে সিলেক্ট করা হল নাচের জন্য।তা নিয়ে বেচারা ন্যাকাতে ন্যাকাতেই শেষ।আমিও পূর্ব প্রতিশোধের সূত্র ধরে খুব করে হেসে মজা উড়ালাম।
কিন্তু সময়টা তো খারাপ যাচ্ছে আমার।হাসি আর দীর্ঘক্ষণ টিকলো না।আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে ফাংশন অর্গানাইজ করায় হেল্পের জন্য।আর এই পুরো ফাংশনের দায়িত্ব যে কার উপর পড়েছে তা তো ভালো করেই জানি।নিদ্র ভাইয়ার সাথে সবকিছুতে যে কেন এভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি!
এই খবরে সব থেকে খুশি হল সাফা।যেন ঈদ বোনাস হাতে পেয়েছে।নিজের ন্যাকামো ভুলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে লাগলো।
করিডোরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখছিলাম।কোথা থেকে আমাদেরই এক ব্যাচম্যাট রাশেদ এসে গল্প জুড়ে দিল।একথায় সেকথায় তাকে আমার উপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি অসন্তুষ্টর কথা জানিয়ে দিলাম।সে পরামর্শ দিল অন্য কোন এক্টিভিটিতে যোগ দিতে তাহলে হয়ত প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে আগেরটা বাদ দেওয়া যাবে।বিরক্তিকর সমস্যার হঠাৎ পাওয়া সমাধানের কথা শুনে ব্যাপক খুশি হলাম।খুব মিষ্টি করে হেসে রাশেদকে ধন্যবাদ বললাম।এতেই সে বেশ খুশি।ইদানিং আমার সাথে একটু বেশিই ভাব করতে চাইছে।
আড়চোখে পাশ ফিরে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া পাশ দিয়ে যাচ্ছে।আমার দিকে একটু রাগী চোখে তাকিয়েই দ্রুত সামনে দৃষ্টি দিল।সব এক্টিভিটির প্রধান দায়িত্বে যেহেতু সেই আছে তাই তার পিছনে দৌড়ানোই আমি শ্রেয় মনে করলাম।
পিছন থেকে ডাকলেও কোনো সাড়া না দিয়ে সে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।অবশেষে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
আমি বললাম,’ভাইয়া আমাকে অন্য কোনো এক্টিভিটি দিন।আমি এটা করতে পারবো না।’
-‘সব কিছুই সিলেক্ট হয়ে গেছে এখন কোনো চেন্জ আনা যাবে না।’
-‘তাহলে আমার নাম ওখান থেকেও কেটে দিন কোন বেকুব না গাধা আমার নাম দিয়ে বসে আছে!আমি এসব করতে পারব না।’
কথাটা বলে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আস্ত গিলে খাবে।বিপদ সংকেতের পূর্ব মুহূর্তে অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগলো নামটা সেই দেয় নি তো!’
সে এক পা এক পা করে সামনে আগাতে থেকে বলতে লাগল,’আমি বেকুব?গাধা?ভালো লাগুক আর না লাগুক তোমাকে তোমার পানিশম্যান্ট কমপ্লিট করতেই হবে।নিদ্রর গালে চড় মেরেছো তুমি।এত সহজে ছাড়া পাবে!’
পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমি ভয়ে একটা ঢোক গিললাম।জীবনে এই মানুষটিকেই আমি সবথেকে বেশি ভয় পাই।নিজের হাতটাকে কেটে কুচি কুচি করে এখন বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।এই থাপ্পড়ই আমার কাল।আর কত কি যে পোহাবো এর জন্য!
কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে মাঠের দিকে আসতেই দেখলাম সোমা আপু,তানিয়া আপু আর রাফি ভাইয়া একসাথে দাঁড়িয়ে আছে আর কোনো বিষয় নিয়ে খুব হাসছে।
আমাকে দেখে সোমা আপু বলল,
-‘সুপ্তি দাঁড়া।আমিও এখনই যাবো।ও…স্যরি তোকে তো এখন নাম ধরে ডাকা যাবে না।ডাকতে হবে ভা….
এতটুকু বলেই রাফি ভাইয়ের চোখের ইশারাতে সে চুপ হয়ে গেল কিন্তু হাসিটুকু আর থামলো না।
তাদের এই অহেতুক হাসির কোনো কারণ ধরতে না পেরে আমি মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না।
পথে ধাক্কা খেলাম মিথি আপুর সাথে।সে কিছু না বলে চোখ গরম করে চলে গেল।আমার কেন যেন মনে হয় এই আপুটা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না।
ভাবনার মাঝেই সেখানে সাফা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে উপস্থিত।ওকে দেখে আমার নিজের কাঁদো ভাব চলে গেল।সাফা বলতে লাগল,
-‘সুপ্তি নিদ্র ভাইয়ার ঐ বন্ধু রাফি ভাই এত খারাপ কেনো বলতো!আমি প্রাকটিস করতে গিয়েছিলাম আর আমাকে দেখে কি বলে জানিস।’সাফা আফা
ডান্স কোনো আফার কাজ না।আপনি এখান থেকে ফুটুন।’
সাফার কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না।সাফা বলল,’তুই হাসছিস!নিদ্র ভাইয়া কত ভালো।তার বন্ধুটা এত ফাজিল কেনো?’
নিদ্র ভাইয়ার প্রশংসা শুনে রাগ চেপে বসল মাথায়।আমি বললাম,’শোন ঐ নিদ্র না আরো ফাজিল।আমি জানি তাই আমাকে বোঝাতে আসিস না।পলিটিক্যাল লিডার সব আতরা ফাতরা ছেলেরাই হয়।’
-‘নিদ্র ভাইয়া কিন্তু টপারও,ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।এটা ভুলে যাস না।’
সাফার এই কথায় আমতা আমতা করে আর কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না।সত্যিই!সে কিভাবে যে রাজনীতি করে আবার পড়ালেখাও এত ভালো সামলায়।
সদ্য কাঁচা ঘুমটা ফোনের রিংটোনে ভেঙে যাওয়ায় ইচ্ছে করছে মোবাইল নামক পদার্থটাই পৃথিবী থেকে গায়েব করে দেই।বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই স্কিনে ভেসে উঠা নামটা দেখে সব ঘুম পালিয়ে গেল।নিদ্র ভাইয়া রাত বারোটা বাজে আমায় ফোন করছে কেনো?
মনের ভেতর চলতে থাকা প্রশ্নের ঝুরি বন্ধ করে ফোন রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে ভেসে এলো মিষ্টি ভারী গলা,
-‘হ্যালো, সুপ্তি ঘুমিয়ে গেছো?’
মনে মনে বললাম,হ্যাঁ এখন জাগিয়ে জিজ্ঞেস করো ঘুমিয়েছি কিনা!
কিন্তু চাইলেই তো আর সব বলা যায় না।তাই নরম গলায় বললাম,
-‘ভাইয়া এত রাতে আমায় ফোন করলেন যে।’
-‘ঘুম আসছিল না।সন্ধ্যা থেকে টানা পড়েছি,আই ফিল টায়ার্ড নাউ।’
-‘ভাইয়া তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন।আমি কি করব?’
-‘কিছুই করতে হবে না।শুধু কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখো জাস্ট।’
-‘আপনি এত পড়েন কিভাবে।আমি তো আধা ঘন্টা হলেই যেখানে থাকি সেখানেই ঘুমে চিৎপটাং।’
সে শব্দ করে হেসে দিল।আবার সেই হাসি!ভাগ্যিস সামনে ছিল না!আমি বললাম,
-‘আপনি ঘুমাবেন না?’
-‘জানি না।স্বপ্নেও সে বড্ড জ্বালায়।ঘুম কুমারী যে আমারই ঘুম কেড়ে নিয়ে আমাকে নিদ্র থেকে জাগ্রত করে রাখলো।বলো তো সে কোন অদৃশ্য প্রতিশোধ নিচ্ছে?’
তার কথায় আমি খিলখিল করে হেসে দিলাম।পড়তে পড়তে কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।কি আবোল তাবোল বকছে!
হাসি থামিয়ে বললাম,’কে?আপনার গার্লফ্রেন্ড?’
আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সে গুনগুন করে গেয়ে উঠল,’ফন্দি আটে মন পালাবার,বন্দি আছে কাছে সে তোমার।’
-‘বাহ!আপনি তো খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে গান শোনান না?’
-‘গাধী!’
আমি এমন কি বললাম যে আমাকে গাধী বলল।রাগ করে বললাম,’এখন রাখছি।আমার সকালে ক্লাস আছে,ঘুমাবো।’
সে হঠাৎ একটু রাগী স্বরে বলল,
-‘তুমি আবার ক্লাস করো?খুব তো দেখি ক্লাস বাদ দিয়ে ছেলেদের সাথে হেসে হেসে কথা বলো।’
আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল।একদিন মাত্র ক্লাস বাদ দিয়েছি তার জন্য আমাকে এত কথা বলল।বিড়বিড় করে বললাম,
তোমার জন্য আর অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলতে পারি কই।আমার সব সময় তো তুমিই নিয়ে যাও।আমার ভালোবাসার মানুষও আর খুঁজতে পারলাম না!
অফ পিরিয়ডে সবাই জুটিতে পরিণত হয়ে যায়।যেখানেই তাকাবে সব জোড়া জোড়া।সোমা আপুর কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু সে রাফি ভাইয়ার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।সাফাও ইদানিং হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়।তাই আমার মতো আর সিংগেল মানুষের কি করার!
বসে আছি গার্ডেনে রাখা কাঠের বেঞ্চে আর মুখের সামনে ধরে রেখেছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমের উপন্যাস পরিণীতা।কি সুন্দর ভালোবাসা আর অদৃশ্য অধিকারে শেখর ললিতাকে জড়িয়ে রেখেছে।ললিতা নিজের মনের ভাবকে না বুঝেও অজান্তেই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
ফুলের সুভাসে মুখরিত বাগানের মৃদু হাওয়ার মাঝে আমি আলতো করে এক এক পাতা পাল্টে ডুবে যাচ্ছি সেই অনুভূতিতে।ঠোঁটের কোনায় লেগে রয়েছে এক চিলতে হাসি।বারবার মনে হচ্ছে আমারও যদি একজন শেখর থাকতো!
হঠাৎ সেখানে নিদ্র ভাইয়া এসে ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল।বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে নিতে লাগলো।দেখে মনে হচ্ছে হাঁপিয়ে গেছে।আমি বই থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে আড়চোখে আমার হাতের দিকে দেখল।আমিও উৎসাহিত হয়ে বললালম,
-‘আপনি এই উপন্যাসটা পড়েছেন?খুব রোমান্টিক!
সে সোজা হয়ে বসে বলল,’আমি ভালোবাসার গল্প পড়ি না,গল্প তৈরি করি।’
হঠাৎ সেখানে একটি মেয়ে এসে বলল,’ভাইয়া আমি আপনার সাথে নবীন বরণ নিয়ে কিছু বলতে চাই।’
নিদ্র ভাইয়া বলল,’অডিটোরিয়ামের সেকেন্ড ফ্লোরে রাফি আর তামিম আছে,যা জানার ওদের থেকে জেনে নাও।’
তার এই কথায় মেয়েটি নড়লো না,এক দৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।মনে হচ্ছে তার সাথেই মেয়েটির কথা বলতে হবে।নয়তো আর উপায় নেই।
মেয়েটি নড়ছে না দেখে নিদ্র ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো।এতে মেয়েটি চলে গেল।কিন্তু যাবার পথেও বারবার পিছনে ফিরে তাকে দেখে যাচ্ছে।
কেসটা কি আমি পুরোপুরিই বুঝে গেলাম।এই মেয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু তার সামনে হাসতে পারছি না।হাসি চেপে রাখার তুমুল চেষ্টায় ঠোঁট চেঁপে মৃদু হাসছি।নিদ্র ভাই কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি সবসময় এভাবে হাসো কেনো? আমার সামনে আর এভাবে হাসবে না!’
আমি চরম অবাক হয়ে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।এভাবে হাসলে কি হয়।সিরিয়াস মুহূর্তে হেসে ফেলার রোগ আমার আছে।সেই অভ্যাস দূর করার চেষ্টাতেই এই হাসি আমার আয়ত্ত হয়েছে।এখন এটাতেও সমস্যা!
গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে তার কপালে মৃদু মৃদু ঘাম জমে যাচ্ছে।একটি রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সে বলল,’আজকে আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।বলো তো আমাকে মেয়ের পছন্দ হবে তো?’
তার কথা শুনে না অবাক হয়ে পারলাম না।বললাম,
-‘আপনার মত এত সুন্দর ছেলেকে আবার কে অপছন্দ করবে?’
একটু উৎসুক হয়ে সে বলল,’আচ্ছা!আমি যদি মেয়েটাকে বলি মেয়েটা বিয়ে করতে রাজী হবে তো?তোমার মতো করে ভেবে বলো।
আমি সোজা তাকিয়ে বললাম,
-‘আমার মত করে যদি বলতে যাই তবে আমি এত সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করতে কখনোই রাজী হতাম না।সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করা অনেক জ্বালা।দুনিয়া সুদ্ধ মেয়ে তার উপর ক্রাশ খাবে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে।অফিসে গেলে সেখানে মেয়ে কলিগ আবার বাইরে বেরোলে সেখানকার মেয়ে!সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকো আবার বরের মনও নাকি ফসকে যায়।এত ভয় ভয় নিয়ে আমি থাকতে পরবো না।আবার সুন্দর ছেলেরা বউকে অত দামও দেয় না।আমার বর আমাকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিবে।সবসময় আমার দিকেই তার নজর থাকতে হবে।অন্য মেয়েরা তাকে এত দেখবে কেনো?তাই আমি তো বিয়ে করবো আমার থেকে কম সুন্দর ছেলেকেই।’
কথাগুলো বলে পাশে তাকিয়ে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া রাগে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেছে।বলল,-‘এখন সুন্দর হয়েছি তাতেও আমার দোষ!’
তারপর সেখান থেকে উঠে হনহন করে চলে গেল।
আমি হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলাম,সে এতো রাগ করলো কেনো!আমি কি তাকে কিছু বলেছি,আমি তো শুধু আমার মতটা বললাম।এই ছেলের কিছুই আমি বুঝতে পারি না।অদ্ভুতে পরিপূর্ণ।
আকাশ মেঘলা হয়ে আছে।বাতাসে রাস্তার ধুলো উড়ছে।ঢাকা শহরের রুক্ষ ধূলোমাখা রাস্তাও যেনো খুব করে আজ বৃষ্টি চাইছে।মেঘলা বিকেল,শীতল হাওয়া হুডখোলা রিকশায় ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা এক অন্য ধরণের অনুভূতি।পাশে বসে আছে নিদ্র ভাইয়া।রিকশার ঝাঁকুনিতে একটু পর পর কাঁধে কাঁধে ধাক্কা খাওয়ায় একটু কেমন জেনো লাগছে।
আগামীকালই ভার্সিটির ফাংশন।এ নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত।আমি যাচ্ছি নিদ্র ভাইয়ার সাথে মার্কেটে ফুলের অর্ডার দিতে।
সারা মার্কেট ঘুরেও কোথাও কালকের জন্য তাজা ফুলের অর্ডার দেওয়া গেল না।এত তাড়াতাড়ি এত ফুল কেউ সরবরাহ করতে পারবে না।তাই ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর পর্যন্তই চলে এলাম।বাজারের পেছনেই বস্তি।অবশেষে এক দোকানে অর্ডার দেওয়া গেলো।ফেরার পথে একটি রিকশাও আর খুঁজে না পাওয়ায় আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাজার ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় চলে এলাম।সেখানেই ঝুম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল।নিদ্র ভাইয়া আমার হাত ধরে রাস্তার পাশে শনের বানানো এক ঝুপড়ি ছাউনির নিচে এনে দাঁড়া করালো।
দৌড়ে এসেছি তবুও দুজনেই খানিকটা ভিজে গেছি।তার অ্যাশ কালারের শার্টের উপর খানিকটা ভিজে গেছে।সে হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে লাগলো।আমারও মাথা আংশিক ভিজে গেছে।গায়ের গোলাপি রঙয়ের কামিজ আর জর্জেট উড়নার কিছু কিছু অংশও ভিজেছে।
বৃষ্টি খুব জোড়ে সোড়েই নেমেছে।পড়ন্ত বিকেলের ঝুম বৃষ্টিতে আমার বেশ ভালো লাগছে।হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি নাড়াচাড়া করছিলাম।নিদ্র ভাইয়া ছাউনির বাঁশের খুটিতে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে দাড়িয়ে মুচকি হেসে আমাকে দেখে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সেই ছাউনিতেই ভুট্টা পোড়া বিক্রি করছে।
আমি একটি কিনতে চাইলাম কিন্তু নিদ্র ভাইয়া টাকা দিয়ে দিল।বৃষ্টির মাঝে ভুট্টা পোড়া খাওয়ার মজাই আলাদা।আমার খুব পছন্দের।বৃষ্টি দেখছি আর খুশি হয়ে মজা করে খাচ্ছি নিদ্র ভাইয়া তাকিয়ে হাসছে হাসুক।
এদিকে এখন বাসায় ফিরাও দরকার।একটুপর সন্ধ্যা হয়ে যাবে।নিদ্র ভাইয়া ভুট্টা বিক্রেতার থেকে জানতে পারলো সামনের রাস্তা পেরোলেই মোড়ে অটো স্ট্যান্ড।একটু হেঁটে যেতে হবে।এদিকে বৃষ্টি হালকা কমে এলেও এখনো ভালোই আছে।রাস্তা দিয়ে খালি গায়ে কিছু বাচ্চারা মাথায় খুব বড় বড় কচুপাতা দিয়ে খেলতে খেলতে দৌড়াদৌড়ি করছিলো।নিদ্র ভাইয়া ওদের থেকে একটি কচু পাতা চেয়ে নিলো।
দুজনে এক কচু পাতার নিচে ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি।বৃষ্টির থেকে মাথাটিই রেহাই পাচ্ছে।শরীরে ঠিকই বৃষ্টির ছাট লাগছে।রাস্তা পার হওয়ার সময় বিশাল ছাগলের পাল নিয়ে এক চাচা সামনে এসে পড়ল।আমরা থমকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।ভুট্টা পোড়া খেয়ে পানি না খাওয়ায় এখন বেশ তেষ্টা পেয়েছে।হোস্টেলে ফিরতেও এখন অনেক দেরি।
কি করব কি করব ভেবে কচুপাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই মুখ উঁচু করে একটু একটু করে পান করতে লাগলাম।তৃষ্ণা মিটতে দেরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কাজ হচ্ছে।বৃষ্টির ফোঁটা বেশিরভাগই আমার ঠোঁটের বাইরে গড়িয়ে গলা বেঁয়ে পড়ছে।
কতক্ষণ সেভাবে পানি পান করে ঠিক হয়ে পাশে নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে বললাম,
-‘আপনারও তেষ্টা পেয়েছে?তাহলে আমার মতো করেই পান করুন।’
সে বলল,-‘এখন সম্ভব না।আমাকে তৃষ্ণা মেটাতে অপেক্ষা করতে হবে।’
তার কিছু কথার মানে আমি একদমই বুঝতে পারি না।চোখ গোলগোল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
বৃষ্টি তার বেগ আবারো বাড়িয়ে দিয়েছে।খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা রাস্তায় দুজন তরুণ তরুণী যে শুধুমাত্র একটি কচুপাতার আশ্রয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার কোনো পরোয়া নেই।তাদের মাথার উপরে কচুপাতা ঘিরে এখনও টপটপ করে পানি পড়ছে।চারিপাশে অজস্র বারিধারা। তবুও সেই যুবককে কেনো তার তৃষ্ণা মেটাতে অপেক্ষা করতে হবে তা কি এই প্রকৃতিও বুঝতে পারছে না।নাকি তারা জানে!
চলবে,