ভালো_লাগে_ভালোবাসতে #পর্ব-৫,০৬

0
1097

#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-৫,০৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
০৫

“কাজী অফিস”
নামটা শুনলেই কেমন একটা পালিয়ে বিয়ে করা ব্যাপারটা মাথায় আসে।নিদ্র ভাইয়া আমাকে কাজী অফিসে যেতে বলছে কেনো?সে আবার পালিয়ে বিয়ে করছে না তো!নাকি সেই মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে?কোনটা?আর যাই হোক,আমাকে যেতে বলছে কেনো?সাক্ষী দিতে?
এসব ঝামেলার ব্যাপার আমার একদম পছন্দ না।কিছু হলে তো শেষে মেয়ের পরিবার আমাকে এসে ধরবে।আমি তো সাফাকে আগেই বলে দিয়েছি আর যাই করুক না কেনো লুকিয়ে প্রেম,পালিয়ে বিয়ে এসবে যেনো আমার সাহায্য না চায়।

আমি চিন্তিত গলায় বলে উঠলাম,ভাইয়া আমি গিয়ে কি করবো? ভাইয়া আপনার তো কত বন্ধু বান্ধব আছে তাদের দিয়েই সাক্ষী দিন না।আমাকে এসবে জড়াবেন না।প্লিজ ভাইয়া।
নিদ্র ভাইয়া ধমকের সুরে বলে উঠল,
-‘চুপ।এক নিঃশ্বাসে কয়বার ভাইয়া বলো!মানুষ নিজের আপন ভাইকেও তো মনে হয় এত বার ভাইয়া বলে ডাকে না।আজকে আমার বিয়ে তাই যা বলছি তাড়াতাড়ি করো।পনের মিনিটের মধ্যে যেন তোমাকে এখানে পাই।’

অগত্যা আর কি করার এই ছেলেকে আমি যথেষ্ট ভয় পাই।তার মুখের উপর এর থেকে বেশি বলার ক্ষমতা আমার নেই।কোনোমতে হাত মুখ ধুয়ে হলুদ কামিজের সাথে লাল উড়না মাথায় দিয়ে সিএনজি করে কাজী অফিসে চলে এলাম।
ভেতরে গিয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়া একটি খয়েরী রঙের সুতি পান্জাবী পড়ে সোফায় বসে তার বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছে।তানিয়া আপু সহ তাদের আরো কয়েকটা মেয়ে বান্ধবীও আছে।
আমি চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলাম কোন মেয়েটা হতে পারে।নিদ্র ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম,
-‘আপনার অনেক ফ্রেন্ডরাই তো এসেছে তবুও আমাকে ডেকেছেন কেনো?’
আমার কথায় সে আমার দিকে হালকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করায় মনোযোগ দিল।রক্ত মাংসে গড়া গোটা একটি মানুষ যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তা যেন সে টেরই পাচ্ছে না।আমি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলাম।
আমাকে অপমান অনুভব করার আর সুযোগ না দিয়ে কাজী সাহেব বলে উঠল,’কই তাড়াতাড়ি চলে আসুন।আমাকে আরো এক জায়গায় গিয়ে বিয়ে দিতে হবে।’
নিদ্র ভাই কাজী সাহেবের চতুর্কোন টেবিলের সামনে রাখা একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।তানিয়া আপু আমাকে টেনে তার পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিল।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।বরের পাশের চেয়ারে সাক্ষী দাতা বসে নাকি!
বিয়ের কার্যক্রম দ্রুতগতিতেই এগোতে লাগলো।কিছু কিছু ব্যাপার যথেষ্ট সন্দেহজনক,মাথায় প্রশ্নের স্তুপ তৈরী হয়ে আছে তবুও পাশে বসা নিদ্র নামের সিনিয়রের ভয়ে মুখ দিয়ে কিছুই বের হতে পারছে না।কিছু ফর্মালিটি পূরণ করে কাজী সাহেব আমাদের দিকে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিল।নিদ্র ভাই সাইন করলে আমিও বিরক্তি নিয়ে সাইন করে দিলাম।এরপর কাজী সাহেব বলল,’বলুন কবুল।’
নিদ্র ভাইয়া এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করে তার বলার সাথে সাথেই তিন কবুল বলে দিল।এরপর কাজী সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’এবার আপনি বলুন।’
তার কথায় আমি অ্যাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।আমতা আমতা করে বললাম,’আমি বলবো?’
কাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল,’তাহলে আর কে বলবে!উফ আপনারা দেখি অনেক সময় নষ্ট করছেন।’
এই কাজী সাহেবের দেখছি অনেক তাড়াহুড়া।পারলে মুখ থেকে কথা টেনে বের করে আনে!
কিছু মানুষ আছে যাদের জন্মই হয় শুধু বিরক্ত হওয়ার জন্য।তারা সব ব্যাপারেই বিরক্ত হয়।এমনকি তাদের সামনে যদি আপনি তার প্রশংসা করেন এতেও সে মহাবিরক্ত।যেনো শুধু শুধু তার কান দিয়ে কতগুলো কথা শুনতে হলো।
আমাদের সামনে বসা খাটো করে বয়স্ক পান খাওয়া কাজী সাহেবটাও বুঝি তাদের মধ্যে একজন।

এদিকে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমি তো শুনেছি বর কনে কেই তিনবার কবুল বলতে হয়।যারা সাক্ষী দেয় তাদেরকেও কি কবুল বলতে হয় নাকি!
বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সবসময় বউর কাছেই বসে থাকায় বিয়ে পড়ানোর সময় ঠিক কি কি করা হয় তা আমি কখনো দেখিনি।শুধু দেখি বউ সেজেগুজে একটি রুমে বসে থাকে তারপর একজন দাড়িওয়ালা পান্জাবী টুপি পড়া লোক এসে কনের মুখ থেকে তিনবার কবুল শুনে তার সিগনেচার নিয়ে চলে যায়।তার একটুপর শালী বান্ধবীরা নেচে নেচে গিয়ে বরকে দুষ্টামি করে টানতে টানতে নিয়ে এসে কনের পাশে বসিয়ে দেয়।আর অযথা রাজ্যের সব হাসাহাসি শুরু করে দেয়।
এখন এর অগোচরেও আরো কিছু করা হয় কিনা তাতো জানি না।একটু ইতস্তত করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।যেনো আমার মুখের জবাবের অপেক্ষায় সব বুদ হয়ে আছে।আমিও একটু আমতা আমতা করে কবুল বলেই দিলাম।
আমার মুখ থেকে কবুল শুনে সবাই একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
কাজী সাহেব আবারো ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
-‘নিন বিয়ে হয়ে গেলো।এবার মালা বদলটা তাড়াতাড়ি করে ফেলুন।’
নিদ্র ভাইয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটু ভাব নিয়ে কলারটা ঠিক করে মালা হাতে নিয়ে দাঁড়াল।
তানিয়া আপু আমাকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে আমার হাতেও ফুলের একটি মালা ধরিয়ে দিল।
কাজী সাহেব আবারো তাড়া দিতে লাগল।ঘড়ি দেখে আমাকে বলল,’তাড়াতাড়ি করুন।’
আমি শুধু চমকের উপর চমক হচ্ছি।বিয়ে হয়ে গেলো অথচ কনের কোনো কাজ দেখলাম না।এ আবার কেমন বিয়ে!আর আমি কেনো মালা পড়াবো?অদ্ভুত তো!
তাই আমি চোখ গোলগোল করে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি কেনো মালা পড়াবো?’
কাজী সাহেব আমার কথায় চরম বিরক্ত হয়ে বলল,’আপনি দেখছি ভালো বোকা।আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে তা আপনি মালা পড়াবেন না তাহলে কি অন্য কেউ এসে মালা পড়াবে!’

কাজী সাহেবের কথায় আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ল।আমি হা করে বাংলা সিনেমার স্টাইলে হাত আলগা করে মালাটা ছেড়ে দেওয়ার আগেই নিদ্র ভাইয়া তার মাথাটা নিচু করে মালার ভেতর ঢুকিয়ে নিল।আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দুষ্ট হাসি দিয়ে আমার গলায় ও মালা পড়িয়ে দিল।সবাই হাত তালি দিয়ে উঠল।আর একে একে কনগ্রেচুলেশন বলে বিদায় নিতে লাগল।আমি এতটাই চমৎকৃত হয়েছি যে কতক্ষণ যাবৎ আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোলো না।
সবাই চলে গেলে নিদ্র ভাই বলল,’এবার অন্তত মুখটা বন্ধ করো নাহলে সব মাছি ঢুকে যাবে।’
আমি অস্থির ভঙ্গিতে বললাম,’এটা কি হল?’
সে আমার সামনে থেকে সরে সোফায় থাকা ব্যাগটি ঠিক করতে করতে বলল,’কি হল আবার, বিয়ে হল।’
আমি তার পেছন পেছন গিয়ে বলতে লাগলাম,
-‘আমাকে না সাক্ষী দেওয়ার জন্য এনেছেন তাহলে বিয়ে কিভাবে হলো?’
-‘আমি তোমাকে একবারো বলেছি যে তোমাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য আসতে হবে?’
আমি বোকার মতো মাথা নাড়িয়ে না বলে পরমুহূর্তেই ক্ষেপে গিয়ে বললাম,
‘আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করলেন।আপনার পছন্দের মেয়েকে বাদ দিয়ে?’
-‘এত অস্থির হওয়া লাগবে না।তোমার জন্যই সব করতে হয়েছে।’
-‘আমি আবার কি করলাম।’
-‘তুমি যে আমাকে ভার্সিটির প্রথম দিন চড় মেরেছো তার জন্য জানো আমার রেপুটেশন কতটা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন আমার সেই পছন্দের বালিকা তো আমার প্রপোজাল একসেপ্ট করছে না।’
-‘তার জন্য আমাকে কেনো বিয়ে করলেন?’
-‘সেদিন বললাম না আমি একটি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম সেই মেয়েতো আমার জন্য পুরো পাগল হয়ে গেছে।কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।এখন এই ম্যারিজ সার্টিফিকেট নিয়ে আমি বলব আমার বিয়ে হয়ে গেছে তারপর সে আমার পিছু ছেড়ে দেবে।আর আমি আমার পছন্দের মেয়েকে পটানোর জন্যও সময় পাবো।ততদিন তোমাকে আমার সাথে ঝুলে থাকতে হবে।’
তার কথার আমি কিছুই বুঝি না।সেদিন পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগে সেই মেয়ে তাকে পছন্দ করবে কিনা এই নিয়ে এমন ভাব করছিলো যেন সেই মেয়ে পছন্দ না করলে তার আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন থাকবে না।আর আজ কিনা ঐ মেয়ের থেকে বাঁচতেই আমাকে বিয়ে করেছে!

আমি মুখটা ভার করে বললাম,’আপনার তো আরো অনেক বান্ধবী ছিল তাদেরই বিয়ে করতেন।’
-‘সমস্যা শুরু তো তুমি করেছো থাপ্পড় মেরে।আমি তো আগেই বলেছিলাম এর ভরপুর তোমাকে করতে হবে।আর এত সিরিয়াস হচ্ছো কেনো?টেক ইট ইজি।এটা তো এমনিই বিয়ে।’

এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা করছে তার মাথার চুলগুলো টেনে ধরি।নাহ!তার মাথার চুল না,ধরা উচিত আমার মাথার চুল।চার মাস আগে একটা থাপ্পড়ের জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।আর এই ছেলে এমন ভাব করছে যেনো কিছুই হয়নি,নরমাল একটা ব্যাপার।কি সুন্দর মুখ দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়িতে গিয়ে উঠছে।আমাকে বিয়ে করে নিয়েছে আর বলছে টেক ইট ইজি।
পেটের ভেতর কথা কিলবিল করছে তাকে বলার জন্য।কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না।
হায় আল্লাহ!আমাকে আর কতদিন এসব পোহাতে হবে?

টেনশনে যেখানে মানুষের খাওয়া দাওয়া লোপ পায় সেখানে টেনশনে পড়লে আমার ক্ষিধে বহু গুনে বেড়ে যায়।বিছানার উপর পা তুলে বসে রাত ১টা বাজে বসে বসে চামচ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছি আর টেনশন করছি।আমার বিয়ে হয়ে গেলো?কি সাংঘাতিক ব্যাপার!এত সহজে বিয়ে হয়ে যায়!কেউ যদি জেনে যায় তাহলে কি হবে!
আর কতদিন তার সাথে এভাবে ঝুলে থাকতে হবে?সেটা তো পরিষ্কার করে কিছু বলল না।

আজ আবার ভরা জ্যোৎস্না।চাঁদের আলো উপচে এসে পড়ছে রুমে।অন্ধকার রুমকে মায়াবী আলোতে আলোকিত করে রেখেছে।তার মধ্যে পুরো রুমে আমি একা একা বসে আছি।সোমা আপু আজকে তার অন্য ব্যাচম্যাটের রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছে।ব্যাপারটা কি আমিও বুঝিনি।মিটিমিটি করে হেসে বলল আজকে নাকি তার এই রুমে কিছুতেই ঘুম আসবে না।আমিও বেশি জোর করিনি।এমনিতেই টেনশনে আছি পাছে সে আবার না বুঝে যায়!
বেলকনি থেকে টুক করে কিছু পড়ার অদ্ভুত আওয়াজ আসায় আমি চামচ মুখে ঢুকিয়েই ভ্রু কুঁচকে সেই বরাবর তাকালাম।আবারও কেমন আওয়াজ আসছে।তাই এবার বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে খালি পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।এই হোস্টেলের বেলকনিগুলো খোলা,কোনো গ্রীল দেওয়া নেই।
আমি সেখান দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম।হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কিছু একটা আছে।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো।
তখনই ফ্লোরে আমার পাশে আরো একটি ছায়ার মতো দেখতে পেয়ে আমি কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার দিতে গেলাম,’ভূ…ভূ..উত।’
তার আগেই এক জোড়া হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিল।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আধো আলো আঁধারে দেখতে পেলাম সেই সুন্দর ঘন কালো ভ্রু।
সাদা টি শার্টের উপরে বোতাম না লাগিয়ে আকাশি রঙের শার্ট পড়ে সে ঠোঁটের কোনায় একটি হালকা হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
সে ফিসফিস করে বলল,’পাগলী আস্তে।এখানে ভূত আসবে কোনদিক থেকে!’
আমি তাকে ইশারায় চোখ দিয়ে আমার মুখ থেকে হাত সরাতে বললাম।সে ওহ্ বলে সাথে সাথে ছেড়ে দিল।আমি বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
নিদ্র ভাইয়া হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে রুমের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
এতক্ষণে আমার হুঁশ হল সে এখানে কি করছে!
আমি পিছন থেকে গিয়ে চিন্তিত স্বরে বললাম,’আপনি এখানে এসেছেন কেনো?’
-‘আজকে না আমাদের বাসর রাত।বাসর রাতে স্বামী স্ত্রী কে আলাদা থাকতে হয় না জানো না?’

তার কথা শুনে আমি চরম পর্যায়ের অবাক হয়ে গেলাম।বললাম,’বাসর রাত মানে!আপনি না বলেছেন এটা এমনি এমনিই বিয়ে।তাহলে আবার এসব কি?’
-‘আরে আমাদের জন্য এটা এমনি এমনিই কিন্তু বিয়েটা তো সত্যি সত্যিই হয়েছে।এখন বাসর রাতে যদি আমরা আলাদা থাকি তাহলে তো অমঙ্গল হতে পারে।এখন তুমি কি চাও আমার অমঙ্গল হোক?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।আমি চাই না তার কোনো অমঙ্গল হোক।কেনো চাই না তা জানি না,তবে একটুও চাই না।
আমি আবারো বললাম,’আপনি দোতলায় উঠে আসলেন কিভাবে?’
-‘কিভাবে আবার,মই বেঁয়ে।রাফি আর তামিম ধরে রেখেছিল।’
-‘যদি কেউ দেখে ফেলতো?’
-‘তোমার কি মনে হয় আমি এতো কাঁচা প্লেয়ার!’

বিশাল চাঁদ এখন মাঝ আকাশে উঠে এসেছে।নিদ্র ভাইয়া আমার বিছানার কাছে গিয়ে পকেট থেকে দুটি তাজা গোলাপ ফুল বের করে বিছানার সাথে ঘেষানো ছোট্ট টেবিলটিতে রেখে বলল,বাসর রাতে একটু ফুলের ছিটেফোঁটা না থাকলে মোটেও ভালো লাগবে না।’
এই বলে সে শুয়ে পড়ল আমার বিছানায়।কিছু মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘুমিয়ে পড়ল।আমি সোমা আপুর বিছানায় শুয়ে বারবার এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম।টেনশনে কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না।আর উনি কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।
খোলা জানালা থেকে ভেসে উঠছে পূর্ণিমার
স্নিগ্ধ মায়াবী চাঁদ।জানালার পর্দা দুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া।হঠাৎ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল।জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় তার ঘুমন্ত মুখ চাঁদের থেকেও বেশি মায়াবী লাগছে।অদ্ভুত হলেও সেই দুটো গোলাপ থেকে মনে হল মিষ্টি সুভাস ছড়াচ্ছে।টকটকে লাল গোলাপ দুটি যেন পলক না ফেলে আমাকেই দেখে যাচ্ছে।যেমনটি আমি দেখে যাচ্ছি নিদ্র ভাইয়াকে।টেনশন যেন সব কোথায় উড়ে গেল।কোন এক অজানা জগৎ থেকে ভেসে এলো এক অচেনা সুর।সেই মায়াবী আলোয় মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে একটি অদ্ভুত ইচ্ছা আমার মনে জাগলো,তার ঘুমন্ত মুখটিকে একটু ছুঁয়ে দিতে।
ইচ্ছে টা যেন ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছে।
অদ্ভুত তো!

চলবে,,

#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব ৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

বিয়ে বাড়ি মানেই একরাশ হৈ হুল্লোড়,অযথা হাসাহাসি আর বাচ্চাদের ছোটাছুটি।কোনো কাজ ছাড়াই যদি বসে বসে এসবকিছু উপভোগ করা যায় তবে বিয়ে বাড়ি ব্যাপারটা মন্দ না।আমিও এখন এমনি একটি বিয়ে বাড়িতে বসে বসে মুড়ি মাখানো খাচ্ছি।শুধু পেয়াজকুঁচি,কাঁচা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে বানানো।গাঁদা খানেক বানানোর জন্য সেই উপাদানগুলোও খুবই কম মাত্রার।কিছু করার নেই বলেই জানালার পাশে বসে ঘাসের মতো এগুলো চিবিয়ে যাচ্ছি।আমার খানিক দূরে সাফা বড় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একটি লেহেঙ্গার নিচের পার্ট কোমড়ে ধরে রেখে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখে যাচ্ছে।
সাফা আমার কুট্টি কালের ফ্রেন্ড।ওদের মূল বাড়ি ঢাকাতেই হওয়ায় ওর আমার মতো হোস্টেলে থেকে পড়তে হয় না।সাফার বাবা যখন গাজীপুরে পোস্টিং এ ছিল তখন থেকেই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়।সাফার বড় ভাই সাজেদ ভাইয়ার বিয়ে।সেই সুবাদেই অ্যান্টি মানে সাফার মা আমাকে এক সপ্তাহ আগেই এখানে এনে রেখেছে।
সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর নিদ্র ভাইয়ার সামনে বেশি পড়িনি।যেভাবে ছল করে আমাকে বিয়ে করে নিল সেকারণে তার প্রতি মনে এখন আরো দ্বিগুণ ভয় চেঁপে বসেছে।আবার আমাকে দিয়ে কখন না কি করায়!নিদ্র ভাইয়াও এখন খুব ব্যস্ত থাকে।হবারই কথা তাদের এখন পড়ালেখা জীবনের লাস্ট ইয়ার চলছে।তাই দেখা খুব কমই হয়।
কিন্তু মাঝে মাঝেই হুটহাট করে গভীর রাতে ফোন দিয়ে বলবে,’ফোনটা তোমার কানের কাছে পাঁচ মিনিট ধরে রাখো তো।আমি পড়তে পড়তে টায়ার্ড,আমার এখন একজন কথা বলার মানুষ দরকার।’
বেশিরভাগ সময়ই পাঁচ মিনিট হবার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু সকালে উঠে দেখি কল এখনো চলছে।আমি উঠে হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হয়।
মানুষটা কি রোবট না কি বুঝি না।এত্ত পড়ে কিভাবে!

-‘এই সুপ্তি দেখতো লেহেঙ্গাটা দেখতে কি ভালো লাগছে?’
-‘হুম।’
সাফা মুখ ফুলিয়ে বলল,’কিসের হুম?লেহেঙ্গাটা তো ফিটই হয় নি!ঐ দর্জি ব্যাটাকে মন চাচ্ছে পঁচা পানিতে ধরে চুবাই।এখন আমি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এই ঢুলা ঢুলা এইটা কিভাবে পড়ে যাবো?’
-‘হুম।’
-‘আবারো হুম!তুই আমার কথা শুনছিস?’
-‘আরে একটুই তো ঢিলা।এতটুকুতে কি হয়?’
-‘এতটুকুতে কি হয় মানে!অনেক কিছু হয়।তোর তো এসব নিয়ে কিছুই যায় আসে না।তুই কি পরবি কিছু ঠিক করেছিস?আজকে কিন্তু মেয়ে বাড়িতে তুই একটা চমক পাবি।’
আমি আবারো হুম বলে বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।সাফা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার কাঁথার কোণা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।আমিও আমার শেষ অবলম্বনের মত কাঁথাকে শক্ত করে ধরে রাখলাম।
সাফা বলতে লাগলো,’এই সুপ্তি তুই কি এখন ঘুমাবি নাকি!সন্ধ্যা বেলা ঐ বাড়ি যাবো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আর এখন তুই ঘুমাবি।চল না পার্লারে যাই।’.
অবশেষে আমার ঘুমের কাছে ব্যর্থ হয়ে সাফা হাল ছেড়ে দিল।এখন জেগে থাকলে এই মেয়ে জামা,জুয়েলারি নিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিবে।আর আমার ঘুমও পাচ্ছে বেশ।তাই যখন যাবো সেটা তখন এর উপর ছেড়ে দিয়ে আমি পাড়ি দিলাম ঘুমের রাজ্যে।

আমার ঘুম ভাঙলো শেষ বিকেলের একটু আগে।
ঘুম ঘুম চোখ হাত দিয়ে কঁচলে রুমের বাইরে গিয়ে দেখলাম সবাই সাজগোঁজে ব্যস্ত।আঙ্কেল মানে সাফার বাবা রাগে গজগজ করছে।ফুলের ঝুরিটা কার ধাক্কা লেগে যেন সব ফুল মাটিতে পড়ে গেছে সেটা নিয়েই সে চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।
আমি আঙ্কেলের সামনে পড়তেই সে মুখে হাসি এনে বলল,’মামণি তুমি এখনো রেডি হওনি কেনো?তাড়াতাড়ি করো যাও।ভালো করে সাজগোজ করতে হবে না!’
আমার জায়গায় এখন অন্য কেউ হলে আঙ্কেল ধমক দিয়ে তার কান বয়রা বানিয়ে ফেলতো।সে খুব বদমেজাজী।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আঙ্কেল আমাকে খুব স্নেহ করেন।সবসময় হাসি মুখে কথা বলে।
আমি গিয়ে রেডি হওয়া শুরু করলাম।সাফা সেই কখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার চুল খুলছে আবার বাঁধছে।দেরিতে আসলেও আমি ওর আগেই রেডি হয়ে গেলাম।আমি আজকে পড়েছি সোনালী রঙের মোটা পাড় দেওয়া হলুদ রঙের লেহেঙ্গা।উপড়ের জামাটাও পুরো সোনালী।
দুই হাত মুঠ করে গোল্ডেন কালার স্টোনের চুড়ি আর কানে পড়েছি গোল্ডেন কালারের স্টোনের মাঝারী সাইজের দুল।চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে খোলা রেখেছি।সোনালী লেজ দিয়ে ঘেরা হলুদ ওড়নাটা ডান পাশে মেলে রেখে বাম দিকে অর্ধেক চুল সামনে এনে ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক আর চোখে হালকা কাজল।ব্যাস,আমার সাজ কমপ্লিট।

সাফাকে বিরক্ত হয়ে বললাম,’তোর এখনো হয়নি?শুরু তো করেছিস আমার আগে!’
-‘দেখ না সুপ্তি,গোলাপী লিপস্টিক একদম ম্যাচ করছে না।লাল টা দিবো?’
-‘আমি যদি না ও বলি তবুও তো তুই দিবি।তাহলে এখনই দিয়ে ফেল।’
এরই মাঝে আঙ্কেল এসে সাফাকে দিল এক ধমক।বলল,’আজকে কি তোর বিয়ে দিতে যাচ্ছি যে সাজতে এতক্ষণ লাগে!দুই মিনিটের ভেতর নিচে না আসলে তোকে রেখেই কিন্তু চলে যাবো।’

মেয়ে বাড়িতে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু পরেই।আমরা যেমন সবাই হলুদ রঙের পড়েছি তেমন এখানে সবাই পড়েছে টিয়া রঙ।
ডেকোরেশনও হালকা হলুদ আর টিয়া মিক্স করে করা হয়েছে।বাহারী রঙের লাইটের আলোয় চারপাশ খুব সুন্দর লাগছে।আমাদের সবাইকে বরণ করার জন্য দাঁড় করানো হলো প্রধান ফটকে।সাজেদ ভাইয়াকে তার শালা শালীরা বরণ করে নিচ্ছে।এই ফাঁকে সাফাও একটু আয়না দেখে ঠিকঠাক হতে লাগলো।আমি ওকে হাতে বারি দিয়ে থামালাম।সাফা বলল,
-‘আরে দোস্ত দাঁড়া একটু ঠিক হয়ে নেই।ভেতরে বেয়াইরা আছে না!তুই ও একটু ঠিকঠাক হয়ে নে,বলেছিলাম না তোর জন্য চমক আছে।’
আমি ওকে দাঁত ভেটকিয়ে একটা হাসি দিয়ে চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর বরণ শেষ হলে ভেতরে যাওয়ার পথে দেখলাম নিদ্র ভাই,তামিম ভাই,রাফি ভাইসহ আরো অনেকে ছেলেপক্ষের লোকের উপর ফুল আর গোলাপ জল ছিটাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়াকে দেখে আমি একটুও চমকালাম না।যেনো তার এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক।আমার সব চমক হওয়ার ক্ষমতা সে ভেঙে ফেলেছে।তার দ্বারা সবই সম্ভব।এই অচেনা বিয়ে বাড়িতে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটানোও সম্ভব।
সাফা আমাকে পাশ থেকে খোঁচা দিয়ে বলল,’কি চমকে গেলি না!আরে নিদ্র ভাই আর তোর খুনসুটি ছাড়া কিছু জমে নাকি?ইশ!তোরা যদি সবসময় এভাবেই লেগে থাকতি।’
আমি সাফাকে চোখ গরম করে বললাম,’তার মানে তোর দোয়াতেই এসব হয়েছে,আমাকে এমন ঝামেলায় পেঁচাতে হলো।তোর খবর তো আমি পড়ে নিচ্ছি।আগে বল এরা এখানে কি করছে?’
সাফা লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল,’তামিম ভাইয়ার ছোটো বোনই তো আমার ভাবী।’
-‘এই খবর আমাকে বললি না কেনো?’
-‘ঐ যে তোকে চমকে দিতে চাইছিলাম।’
তামিম ভাই সাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’বেয়াইন,আপনাদের ঘরে তো মনে হয় কেউ রুটি খেতে পারে না তাই না?’
-‘পারবে না কেনো?’
-‘কারণ আপনাকে তো দেখে মনে হয় ঘরের সব আটা ময়দা আপনিই মুখে মাখেন।’
সব ছেলেরা হাসাহাসি শুরু করে দিল।সাফাকে আর পায় কে!মুখ ফুলিয়ে চলে গেল।
তামিম ভাইও চলে গেল ওর পিছু পিছু।আমার চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়ার উপর।সে আজ টিয়া রঙের পান্জাবীর উপড়ে হলুদ রঙের কোটি পড়েছে।পান্জাবীর হাতা ফোল্ড করে রাখা আর হাতে দামী ব্রান্ডের ঘড়ি।সবসময়ের মতই তাকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।দেখলাম নিদ্র ভাইয়া কেমন শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ফুল ছিটিয়ে যাচ্ছে।
তার দৃষ্টি শান্ত হলেও আমি বুঝে গেলাম সে আমার উপর রেগে আছে।আমি ভাবতে লাগলাম আমি এমন কি করেছি।ভাবনার কোনো কুল না পেয়ে সেখান থেকে কেটে পড়াটাই শ্রেয় মনে করলাম।আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছি কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া আমার সামনে এসে বলল,’তোমার যে একটা ফোন নামের কিছু আছে সেটা কি মাথায় আছে?’
আমি একটি ঢোক গিলে বললাম,’থাকবে না কেনো?’
-‘তাহলে কেউ ফোন করলে যে কষ্ট করে সেটা রিসিভও করতে হয় এটা কি ভুলে গেছো?’
আমি পার্স থেকে ফোনটা বের করে দেখলাম নিদ্র ভাইয়ার অনেকগুলো মিসডকল।
আমি বললাম,’স্যরি ভাইয়া।আমি আসলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।’
-‘হ্যাঁ তোমারই তো ঘুমের সময়।আমার ঘুমের তো বারোটা বেজে গেছে।’
-‘ভাইয়া…..
এর মাঝেই সাফার একটা কাজিন এসে আমাকে বলল,’সুপ্তি তোমরা কি রিলেটিভ।’
তার কথা শুনে তো আমার আত্মা শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা।বুঝে ফেললো না তো যে আমাদের বিয়ে হয়েছে!
আমি বললাম,’কেন বলুন তো?’
-‘নাহ্ মানে তুমি ভাই ভাই করছো তাই আমি ভাবলাম হয়তো তোমরা ভাই বোন।’
এটা বলে সে চলে গেল।আমি তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।বিয়ে হয়েছে জানার থেকে ভাই বোন জানাটাও বেটার।
নিদ্র ভাইয়া থমথম গলায় আমাকে বলল,’তুমি আমাকে এখনও ভাইয়া বলে ডাকো কেনো?আমাদের না বিয়ে হয়েছে!’
আমি চোখ গোল গোল করে বললাম,’আপনিই তো বলেছিলেন এটা এমনিই বিয়ে।’
-‘এমনি বিয়ে হলে কি বিয়ে তো!তোমার ভাইয়া ডাকের জন্য যে আমাদের সবাই ভাই বোন ভাবছে।’
-‘আমাদের যে বিয়ে হয়েছে এটা জানার থেকে তো ভাই বোন ভাবাও ভালো।’
-‘কেনো আমাদের বিয়ে হয়েছে এটা জানলে কি হবে?’
তার কথা শুনে মনে মনে বললাম,’হ্যাঁ জানলে কি হবে!তুমি তো তোমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আরামছে ফুটে যাবে আর মাঝখান থেকে আমার জীবনে আর ভালোবাসার মানুষ আসবে না।’
আমি তো যে করেই হোক কাউকে বুঝতে দিব না এই বিয়ের কথা।

সবাই একে একে বর কনেকে হলুদ লাগাতে লাগল।যারা কাপল তারা হলুদ একসাথে গিয়ে লাগাল।একসময় আমি গেলাম হলুদ লাগাতে।আমি যাওয়ার সাথে সাথেই নিদ্র ভাইয়াও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল হলুদ নিয়ে।আমি ফিসফিস করে বললাম,’আপনি এখানে এখন আসলেন কেনো?’
সে আমার থেকেও বেশি ফিসফিস করে বলল,’চলো তো,এখন সময় নেই।সবাইকে তাড়াতাড়ি হলুদ লাগাতে বলেছে।’
আমি সাজেদ ভাইকে হলুদ লাগিয়ে কনেকে লাগাতে গেলাম।তার নাম দিয়া।দিয়া ভাবী আমার হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল,’তুমিই কি সেই সুপ্তি?’
সে এভাবে বলল যেনো আমি কোন সেলিব্রেটি।
আমি কিছুই বললাম না,শুধু একটা হাসি দিলাম।
দিয়া ভাবী হেসে বলল,’সুপ্তি,এটা কিন্তু ঠিক না আমি আজকে বউ আর আমার থেকে বেশি সুন্দর তোমাকে লাগছে।’
দিয়া ভাবী দুই হাত দিয়ে আমাদের দুজনের গালে একটু হলুদ লাগিয়ে দিল।
নিদ্র ভাইয়া দিয়া ভাবীকে হলুদ লাগিয়ে যেতে নিলে ভাবী তার পান্জাবীর কোনা ধরে বলল,’নিদ্র ভাইয়া আজকে কিন্তু নাচ গান দুটোই করতে হবে।আর তুমি কিন্তু এখনো নিজের মুখে বললে না।’
তারপর আমার দিকে একটু তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাতের আঙ্গুল তুলে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝাল,’দারুণ চয়েজ।’
নিদ্র ভাইয়া মুচকি হেঁসে দিয়া ভাবীর মাথায় একটা টোকা দিয়ে চলে গেল।

সাজেদ ভাইকে ভাবীর পাশ থেকে উঠিয়ে আমরা মেয়েরা সব ভাবীর সাথে ছবি তুলতে লাগলাম।
এর মাঝে হঠাৎ মিউজিক বেঁজে উঠল।আমরা সবাই সেলফি তোলা বাদ দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম নিদ্র ভাইয়া ডান্স ফ্লোরে নেমে এসেছে।
একে একে তার বন্ধুরাও সব যোগ দিল।মিউজিক প্লেয়ারে গান চলছে,
♪♪দো ন্যায়ন সিতারে হে চান্দ সা মুখড়া
কেয়া কেহনা উসকা….আফরিন!
দাওয়াত মে যেইসে হো শাহী টুকরা
উসকে যেসি না ক্যোয়ি নাজনীন
শাহী জোড়া পেহ্যান কে
আয়ী যো বান থান ক্যা
য়োহী তো মেরি সুইটহার্ট হে
শারমায়ী সি বাগাল মে
যো বেঠি হে দুলহান ক্যা
য়োহী তো মেরি সুইটহার্ট হে।♪♪

নিদ্র ভাইয়া খুব সুন্দর ডান্স করল।এতক্ষণে এটাকে একটা প্রকৃত বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।তানিয়া আপু এর মাঝে তাদের সাথে একটু যোগ দিতে গিয়েছিল কিন্তু নাঈম ভাইয়া তার পায়ে পাড়া দিয়েছে।এই নিয়ে তাদের আবার মান অভিমান পর্ব চলছে।
এত এত নাচ গানে হয়তো আমাদের সাজেদ ভাইয়ারও মন উৎসুক হয়ে উঠল।তাই সে একটু ড্যাশিং ভাব নিয়ে স্টেজে যাওয়ার আগেই পা পিছলে আঙ্কেলের উপর পড়ে গেল।আঙ্কেল দাঁত কড়মড় করে বললেন,’অপদার্থ।এখন নাচতে গিয়ে আমার অবশিষ্ট মান সম্মানও খুইয়ে আয়।’
তার ধমকে চুপসে গিয়ে সাজেদ ভাই আর নাচার সাহস করলো না।
সাজেদ ভাইয়ার এক বন্ধু আছে নাম মামুন।নিজেকে মহা হ্যান্ডসাম ভেবে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করাই তার স্বভাব।সে আমাদের সব মেয়েদের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাব দেখাতে লাগল।আমি মামুন ভাইকে বললাম,’কি ব্যাপার ভাইয়া,সবাই তো ডান্স করে স্টেজ কাঁপিয়ে ফেলছে।আপনি একটু ডান্স করছেন না কেনো?’
মামুন ভাই ব্যাপক ভাব নিয়ে বলল,’এটাই তো চিন্তা সুপ্তি,সবাই তো শুধু স্টেজ কাপাচ্ছে আমি গেলে স্টেজ ভেঙে যাবে।’
সোমা আপু বলে উঠল,’হ্যাঁ ডান্স না করে শুধু লাফালাফি করলে তো স্টেজ ভাঙবেই।’
আমরা সবাই হেসে দিলাম।
মামুন ভাই সেভাবে ভাব নিয়েই বলল,’মেয়েদের হাসলেই বেশি সুন্দর লাগে।তার জন্য তারা অর্থহীন জোকস ক্রিয়েট করে হাসতেই পারে,আই লাইক ইট।’
সাফা বলে উঠলে,’মামুন ভাই আপনার স্টেজের চিন্তা করতে হবে না।যান ডান্স না পারলে একটা গান গেয়ে শোনান।’
মামুন ভাই বলল,’ওকে গার্লস।তোমরা যেহেতু আমার পারফরমেন্স দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছো তোমাদের জন্য আমি এতটুকু করতেই পারি।’
মামুন ভাই স্টেজের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে এই রাতের বেলা সানগ্লাস চোখে দিয়ে মাইক হাতে নিয়ে একটি হিপ হপ সং গাইতে লাগল।তার অদ্ভুত ভঙ্গিতে গাওয়া গান শুনে আমরা সব শুধু মুখ টিপে হাসছি।আঙ্কেল স্টেজ বরাবর পিঠ দিয়ে বসে জুস খাচ্ছিলো।মামুন ভাইয়ার গান শুনে না দেখেই ধমক দিয়ে বলে উঠল,’এমন ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছে কে রে!কানটা ঝালাপালা করে দিল।’
সব মেয়েরা হো হো করে হেসে দিল।মামুন ভাই গান থামিয়ে মুখ ভার করে নিচে নেমে আমাদের কাছে এসে বলল,’এই ওল্ড পিপলদের নিয়ে এই সমস্যা!মডার্ণ সংয়ের কিছুই বুঝে না।’
আমরা আবার সবাই হেসে দিলাম।আমার হাসতে হাসতে চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়ার দিকে।সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হসে ভ্রু উঁচা করে ইশারা করছে।আমিও অন্য দিকে তাকিয়ে একটু মুখ ভেঙ্গিয়ে দিলাম।
সবাই নিদ্র ভাইয়ার গান শুনার জন্য নিদ্র নিদ্র করছে।সবার রিকোয়েস্ট রাখতে সে স্টেজে উঠে গেল তার সেই কালো গিটার কাঁধে ঝুলিয়া।
গিটারে এক সুন্দর মিষ্টি সুর তুলে গাইতে
লাগল,
ভাললাগে হাঁটতে তোর হাত ধরে
ভাবনা তোর আসছে দিন রাত ভরে
এলোমেলো মনটাকে কি করে আর রাখে
কেন আমি এত করে তোকে চাই….
পারবো না.. আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না.. আমি ভুলতে তোকে
পারবো না.. ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার…..

ভাললাগে চাইলে তুই আড় চোখে
চাইছি তোর অই দু চোখ আর তোকে
এলোমেলো দিস করে,সারাটা দুপুর ধরে
বসে বসে বুনে চলি কল্পনায়…..
পারবো না..আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না..আমি ভুলতে তোকে
পারবো না..ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার….

লাইটিংয়ে পরিষ্কার আলো বন্ধ করে এখন হালকা নীল গোলাপী আলো ছড়াচ্ছে।পরিবেশটাই যেন মুহুর্তের মধ্যে বদলে গেল।তার গান শেষ হলে সবাই করতালিতে চারপাশ মুখরিত করে তুলল।
এমন সময় রাফি ভাইয়া বলে উঠল,
-‘ সব পারফরমেন্স কি শুধু মেয়েপক্ষরাই দিবে।ছেলেপক্ষরা কি কিছু করবে না?নাকি পারে না।’
সব হাসাহাসি শুরু করে দিল।তামিম ভাই বলে উঠল,’এদের জন্য বোলে চুড়িয়া গান ছেড়ে দে।এই গান ছাড়া মনে তো হয় না অন্য কোনো গানে নাচতে পারবে!’
ইশ!দেখে মনে হচ্ছে সবগুলো হাসিতে যেনো লুটিপুটি খাচ্ছে।আমরা যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলাম।
আমি বলে উঠলাম,’সাফা গিয়ে গান ছেড়ে আয়।আমরাও দেখিয়ে দিব আমরা কি পারি আর না পারি।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’
আমরাও উঠে এলাম স্টেজে সাফার কাজিনদের সাথে।
য়ো লাড়কি আখ মারে গানে আমরা নেচে যাচ্ছি।

সবাই হা করে তাকিয়ে আছে।কারণ ডান্স আমরাও খারাপ পারি না।একে একে উপস্থিত সবাই যোগ দিতে লাগল নাচে।আমার ডান্সের মাঝে হঠাৎ হেঁচকা টানে কেউ আমায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।পারফিউমের ঘ্রাণে বুঝে গেলাম নিদ্র ভাই।ঘটনার আকস্মিকতায় আর তার এভাবে জড়িয়ে ধরায় আমি কুঁকড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম।তাকে একটু ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল,’আস্তে,তোমার জামার পেছনে ফিতা খুলে গেছে।’
আমি চোখ বন্ধ করেই রইলাম।সে সেভাবে জড়িয়ে রেখেই পেছনে হাত দিয়ে আমার ফিতা বাঁধতে লাগল।
আমার একটু অস্বস্তিও লাগছিলো কেউ যদি আমাদের এভাবে দেখে ফেলে।সে হয়তো বুঝতে পারছিলো তাই বলল,’চোখ খুলে দেখো।লাইট অফ করাই আছে।’
আমি চোখ মেলে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই ছেলে সব কাজ গুছিয়েই করে।দ্বিতীয়বারের মতো তার সাথে এভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম।প্রথমবারের থেকেও বেশি এইবার যেন হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।আমার আর তারও।ফিতা বাঁধা শেষ হলে সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।আর সাথে সাথে লাইট অন হয়ে গেল।সবাই বিরক্তি থেকে রেহাই পেয়ে স্বস্তি পেল।তার ছোঁয়ায় আমি এখনো কুঁকড়ে আছি।সাফা আমার কাছে এসে বলল,’তোর আবার কি হয়েছে?এমন করে আছিস কেনো?’
আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম,’কিছু না।’

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here