#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-৭,০৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
০৭
সকালে আমার ঘুম ভাঙলো খুব বেলা করে।বলা বাহুল্য গতকাল রাতে খুব মজা করেছি।আমাদের ফিরে আসা হয়েছে অনেক রাতে।শরীরটা এখন অসাঢ় হয়ে এসেছে।বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে খুব কষ্ট করে বিয়ে বাড়িতে এক কাপ কফি জোগাড় করলাম।ঘাড়ে এক হাত রেখে আড়মোড়া ভেঙ্গে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।মাথাটা ঝিম মেরে রয়েছে।
আমার পাশে একটি চেয়ার টেনে সাফা বসে পড়লো।ফোন আমার মুখের সামনে ধরে বলল,’সুপ্তি দেখ দেখ,কালকের হলুদের অনুষ্ঠানে খুব সুন্দর পিক উঠেছে।’
আমি বিরক্তি নিয়ে ওর হাত ঠেলে সরিয়ে দিলাম।আর বললাম,’সকাল সকাল কি শুরু করলি?’
-‘আরে ভালো ভালো ছবিগুলো বেছে রাখতে হবে না।ফেসবুকে আপলোড করবো তো।’
আমি কফির কাপে একটা চুমুক দিতে না দিতেই সাফা আবারো ফোনটা এনে বলল,’দেখ তোর আর নিদ্র ভাইয়ার ছবি।’
আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই আমাদের দুজনের একসাথে একটি ছবি।আমি সামনে মুখ করে মুখের সামনে হালকা হাত এনে খিল খিল করে হেসে আছি আর নিদ্র ভাইয়া একটু পাশ থেকে তার ঘন কালো ভ্রু অদ্ভুত ভাবে কুঁচকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই হয়তো কেউ ছবিটা তুলে নিয়েছে।
ছবিটা দেখতে অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে।
সাফা ওর কাঁধ দিয়ে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,’সুন্দর হয়েছে না?ফেসবুকে ছেড়ে দেই কি বলস?’
আমি ফোন থেকে চোখ তুলে ওর দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত টেনে ওর গালে একটা চড় মারলাম।
আর বললাম,’হুম ফেসবুকে ছেড়ে দেই!যাতে সবাই জেনে যায় আমাদের ব্যাপারে?’
সাফা এতক্ষণ মুখ ফুলিয়ে ছিল।আমার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল,’তোদের ব্যাপারে কি জানবে?তোদের ভেতর হয়েছে কি?’
নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যাওয়াতে আমার হেচকি উঠে গেল।কি বলব না বলব ভাবতে ভাবতে তোতলিয়ে বলে দিলাম,’আমরা দুজন যে এক হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছি এটা জেনে যাবে না!’
-‘এটা জানলেই কি?’
-‘ঘোড়ার আন্ডা!তুই তো দেখি আমাকে পুলিশের মত জেরা করা শুরু করলি।’
কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।
কখন কি বলে ফেলি তার ঠিক নেই।কিছুতেই কাউকে জানতে দেয়া যাবে না।
একটা কথা আছে না,আগে গেলে বাঘে খায়।আমরাও তেমনি সবার আগে এসে বসেও সবার পিছনে এসে পড়েছি।প্রথম সিট থেকে উঠতে উঠতে আমরা বাসের পুরো শেষের সিটে গিয়ে পৌঁছালাম।মুরুব্বিদের জন্য সিট ছাড়তে ছাড়তে আমাদের এই দশা।সাফার বাবা সারাজীবন ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে থাকলেও প্রচুর কিপ্টা।বিয়েতে কোনো গাড়ি রিজার্ভ করেনি।একটি বড় বাস ভাড়া করেছে মেয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য।আঙ্কেলের মতে যাওয়াটাই বড় ব্যাপার,কি দিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা না।
বাসের সবথেকে পিছনের সিটে আমি,সাফা,সোমা আপু গাদাগাদি করে বসে আছি।সাফা তো পারলে কেঁদেই ফেলে।গরমে বাসে ওর সব মেকাপ না উঠে যায় সেই চিন্তায়।কিন্তু বেচারা কাঁদতেও পারছে না।প্রথমত,চোখের কাজল লেপ্টে যাবে আর দ্বিতীয়ত আমাদের দুই সিট সামনেই আঙ্কেল বসেছে।
দ্বিতীয় কারণটার জন্য বেশি বিরক্ত হচ্ছে ছেলেরা।আমরা মেয়েরা সব পেছনে বসেছি বলে ছেলেরাও সব পেছনের দিকেই বসেছে কিন্তু তার মাঝে আবার আঙ্কেল এসে বসেছে সাজেদ ভাইয়ার পাশে।এর জন্য ছেলেরা কোনো মজাই করতে পারছে না।সাজেদ ভাইও মুখ ভার করে বসে আছে।আঙ্কেলের মন মেজাজও ভীষণ খারাপ।যে পরিমাণ লোক হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।অনেক বয়স্করা আবার সাথে করে নাতি নাতনিও নিয়ে এসেছে।বাসে জায়গা হচ্ছে না।
ছেলেরা অসহায় মুখ করে বারবার এদিকওদিক দেখছে।আঙ্কেলের জন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে না পারায় সবথেকে বেশি বিরক্ত মামুন ভাই।একটু পরপরই সে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করছে।খানিকক্ষণ পর সে উঠে বাসের মিউজিক প্লেয়ারে বাদশাহর গান ‘আভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যা’ ছেড়ে দিল কিন্তু তাতেও আঙ্কেল গিয়ে সেই গান চেন্জ করে একটা বাউল সঙ্গিত ‘খাঁচা ছাইড়া পাখি ফাঁকি দিয়ে উইড়া যাইবো রে’ গান ছাড়লো,এতে তো মামুন ভাইসহ বাস ভর্তি সকল ইয়াংরা মিলে বিরক্তিতে ত্যানা ত্যানা হয়ে গেল।
মামুন ভাইয়ের হয়তো আজকে বিরক্ত হবারই দিন,সে কারণেই একটু পর এক বয়স্ক লোক কোমর ব্যাথার কথা বলে কিছুক্ষণের নাম করে তার কোলে একটি সাত আট বছরের বাচ্চা ছেলেকে বসিয়ে দিল।
বিরক্ত আমরাও কম হচ্ছি না।পেছনের সিটের সবার মাঝখানে বসেছি আমি।আমার বাম পাশে সোমা আপু আর ডান পাশে সাফা।সাফার পাশে আবার সব মেয়েদের ভেতর এসে বসেছে এক পান্জাবী পড়া দাড়ি গোঁফআলা বয়স্ক লোক।সেই চাচার মুখে আবার মুখ ভর্তি জর্দা দেওয়া পান।একটু পরপরই সে বাসের জানালা খুলে পানের পিক ফেলছে।জর্দার কড়া গন্ধে আমাদের সবার বমি আসার মত অবস্থা।সেই চাচা আবার পান চাবাচ্ছে আমাদের দিকে তাকিয়েই।
সাফা তো আমার দিকে মুখটা কাঁদো কাঁদো করেই রেখেছে।বেচারা ভুগছে যে সবথেকে বেশি।
বাস চলছে নিজস্ব গতিতেই।একসময় সবকিছু আমাদের সয়ে গেল।এখন আর অতো বিরক্ত লাগছে না।জীবনের প্রথম বাসে করে বরপক্ষ হয়ে বিয়েতে যেতে ভালোই লাগছে।
হঠাৎ করে মামুন ভাইয়ার সিট থেকে উৎকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো।মামুন ভাই চরম বিরক্তি নিয়ে তার কোল থেকে ছোট ছেলেটিকে নামিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বলল,’যাহ শালা এত সুন্দর বডি স্প্রে লাগিয়ে এসেছিলাম।আর এ পাদ দিয়ে সব দিল..!’
পুরো বাসে হাসির রোল পরে গেল।এই কর্মের জন্য দায়ী বাচ্চা ছেলেটি তার আগের সিটে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল।যেনো এই কাজ করতে পেরে সে গর্বিত।
আমরা নাকে আঁচল চেপে হাসতে লাগলাম।এভাবে একটু মজা একটু বিরক্ত একটু গল্পে জমে আমরা একসময় বিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
গায়ে হলুদ কমিউনিটি সেন্টারে হলেও বিয়ের আয়োজন বাড়িতেই করা হয়েছে।এসব আঙ্কেলের জন্যই।অবশ্য আঙ্কেল ঠিকই বলেছে,নিজ বাড়ির উঠোনে বিয়ের অনুষ্ঠানে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা কমিউনিটি সেন্টারে কোথায়!
সেখানে তো সব শুধু পটের বিবি সেজে বসে বসে ছবি তোলো।বিয়ের কাজে হাত না দিলে কি বিয়ের মজা উপভোগ করা যায়?
তামিম ভাইয়াদের বাড়ি ঢাকার শেষ প্রান্তে হওয়ায়
তাদের বাড়ির চারপাশে কিছুটা হলেও খোলা জায়গা আছে।সেখানেই প্যান্ডেল খাটিয়ে সব আয়োজন করা হয়েছে।
আজ আমরা মেয়েরা সবাই একরকম মিষ্টি রঙের শাড়ি পড়েছি।আমরা বাস থেকে নেমে বিয়ের জন্য বানানো রঙবেরঙের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাজেদ ভাইয়ায় শালীরা এসে ফিতা দিয়ে গেট আটকে রাখল।আগে টাকা তারপর ভেতরে ঢোকা।
অনেকক্ষণ দরকষাকষি চলার পর অবশেষে আমরা ভেতরে ঢুকতে পারলাম।ভেতরে ঢুকতেই গতকালের মত চোখে পড়ল নিদ্র ভাই আর তাদের গ্রুপের উপর।নিদ্র ভাইরা আজ সবাই হালকা আকাশী রঙের শেরোয়ানী টাইপ ড্রেস পড়েছে।আমাদের মত তারাও কি সব পরিকল্পনা করে একরঙের জামা পড়ল নাকি।
আমরা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমি একটু মজা করে ভাব নিয়ে বললাম,’এখানে আমরা কারো জুনিয়র না,আমরা ছেলেপক্ষ।তাই আমাদের যেনো ভালোভাবে আপ্যায়ন করা হয়।’
নিদ্র ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,’অবশ্যই।কিরে তামিম বিয়াইনদের কি কষ্ট করে হাঁটিয়ে নিব নাকি!আমরা আছি কি করতে!ধর।’
এই বলে নিদ্র ভাই আর তার বন্ধুরা সত্যি সত্যিই হাত বাড়িয়ে কাছে আসতে নিল কোলে নিতে।
আমরা এক ছিটকে সরে এসে দিলাম দৌড়।
বিয়ে বাড়িতে আমার নিদ্র ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকায় আরো কয়েকজন আমাদের ভাই বোন ভাবল।নিদ্র ভাই তো কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আমি ঢোক গিলে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
বিয়ের কাজ শেষ হলে সাজেদ ভাইয়াকে দিয়া ভাবীর পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো।এটাই তো সবথেকে মজার সময়।তাদের হাতে ধরিয়ে দিল ফুলের মালা।কেউ কাউকে মালা পড়াতে দিচ্ছে না।এপাশ থেকে একদল আবার ওপাশ থেকে একদল ধরে টানাটানি করছে।অবশেষে সব হাঁপিয়ে উঠলে মালা পড়ানো হলো।তাদের মালা পড়ানো দেখে আমার মনে পরে গেল সেই দৃশ্য,কিভাবে নিদ্র ভাইয়া আমার হাত থেকে ফট মালা পড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ আমাকে পড়িয়ে দিয়েছিল।আমি তো অবাক চোখে হা হয়ে ছিলাম আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছিল।
তার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম এখনো আমার দিকে তাকিয়ে সেভাবে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
সে কি বুঝতে পারছে আমি ঐ ঘটনা মনে করছি।
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিলাম।
বর কনেকে এখন আয়না দেখানো হবে।খুব সুন্দর কারুকার্য খচিত গোল আয়নায় তাদেরকে একত্রে দুজন দুজনের চেহারা দেখানো হলো।ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ রোমান্টিক লাগে।
আমি যখন সত্যি সত্যি বিয়ে করব তখন আমিও সব থেকে সুন্দর আয়নার আমার ভালোবাসার মানুষের মুখ দেখব আর সে দেখবে আমার মুখ।
তাদের আয়না দেখানো শেষ হলে আয়নাটা আমার হাতে দিয়ে বলা হল সাইড টেবিলে রেখে দিতে।আমি রাখতে যাচ্ছিলাম,হঠাৎ করে আয়নাটা আমার হাত থেকে ফসকে পড়ে যেতে নিল।কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া কোথা থেকে এসে আয়নার তল পিঠে হাত রেখে ধরে ফেলল।আয়নাটি এখন আমার আর তার দুজনের হাতেই আছে।আর সেখানে স্পষ্ট হয়ে আছে আমাদের দুজনের চেহারা।ব্যাপারটায় আমি হকচকিয়ে গেলাম।আয়না থেকে মুখ তুলে তার দিকে একপলক তাকিয়ে আয়না তার হাতে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।
পথে মামুন ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম।সে আমাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল,’সুপ্তি চলো একটা সেলফি তুলি।’
আমি বিরক্তি লুকিয়ে বললাম,’মামুন ভাই আপনি একাই তুলুন আমার ভালো লাগছে না।’
কিন্তু সে প্যান প্যান করতেই থাকল।ফোন উপরে তুলে আমাকে ইনসিস্ট করতে লাগল।এর মাঝে হঠাৎ নিদ্র ভাই এসে ইচ্ছে করে তার সাথে ধাক্কা লাগিয়ে তার হাত থেকে ফোন ফেলে দিল।মামুন ভাই হায় হায় করতে করতে তার ফোন উঠাতে ব্যস্ত আর এদিকে নিদ্র ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বলল,’তোমার কাজ টাজ নেই?শুধু ঘোরাফেরা কর,যাও এখান থেকে!
আমি রাগে মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।সবসময় শুধু ধমক দেয় কেনো!
সাফার কাছে গিয়ে দেখলাম সাফা একটি টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে কোল্ড ড্রিংক পান করছে।আমি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও বলল,’সুপ্তি দেখ নিদ্র ভাইয়া কত ভালো,ঐ রাফি ভাইরা আমার হাতে কোল্ড ড্রিংকের নাম করে পানি ভরা বোতল ধরিয়ে দিয়েছিল।আমি তো চুমুক দিয়ে বোকা বনে গেলাম আর তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।তারপর নিদ্র ভাইয়া তাদেরকে থামিয়ে আমার জন্য কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এলো।’
আমিও একটি কোল্ড ড্রিংকের বোতল হাতে নিয়ে বললাম,’তোর নিদ্র ভাই ছাই ভালো।সবসময় তো শুধু আমার পেছনেই লেগে থাকে তুই বুঝবি কিভাবে।’
-‘সর,নিদ্র ভাইয়া অবশ্যই ভালো।’
আমি কোল্ড ড্রিংকে একটা চুমুক দিয়ে বললাম,’আরেকবার যদি ভালো বলেছিস তাহলে এই ড্রিংক তোর মাথায় ঢেলে দিব।’
এর মধ্যে নিদ্র ভাইয়া এসে আমার হাত থেকে কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,’হাই গার্লস,কি নিয়ে কথা বলছো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি আমারটা নিলেন কেনো?’
-‘ও,খুব তেষ্টা পেয়েছিল।এই নাও।’
আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া বোতল না নিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,’আমি কারো ঝুটা খাইনা।’
-‘একদিন খাবে।’
এই বলে সে মুচকি হেসে চলে গেল।এদিকে সাফাও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।আমি ওঁকে ধমক দিয়ে বললাম,’তুই হাসিস কেনো?’
শাড়ি ছেড়ে নরমাল ড্রেসআপে ফ্রেশ হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি।
এদিকে সাফা পাশের সোফায় বসে বসে ব্লাশ করছে।আমি ওঁকে দেখে বললাম,’তোর আবার কি হয়েছে?’
আমার কথায় ও থতমত খেয়ে বলল,’কিছু না।’
তারপর আমার পাশে এসে বলল,’তোকে আর নিদ্র ভাইকে দেখলে না আমার খুব ভালো লাগে।আমার মনে হয় কি নিদ্র ভাই তোকে পছন্দ করে।’
আমি ঝারি দিয়ে বললাম,
-‘ছাই করে!ধমক ছাড়া তো কোনো কথাই বলে না।
আর সে অন্য একটি মেয়েকে পছন্দ করে কিন্তু সেই মেয়েটি এখনো মানছে না।সে নিজে আমাকে বলেছে।’
-‘বাব্বাহ!তোর সাথে এতকিছু শেয়ার করে!ব্যাপার কি?’
-‘ব্যাপার তোর মাথা!যা এখান থেকে!
হঠাৎ ছাদ থেকে হাসাহাসির শব্দ কানে এলো।আমি আর সাফা দুজনেই অবাক হয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম।ছাদে গিয়ে দেখি নিদ্র ভাইয়া আর তাদের দল,সাজেদ ভাইয়ার বন্ধু আর কাজিনরাও আছে।সবাই এখন নরমাল গেট আপে আছে।আমাদের দেখে রাফি ভাই বলল,’আরে বেয়াইনরা যে!বসেন বসেন।’
আমরা তাদের থেকে একটু দূরত্বে চেয়ার টেনে বসলাম।
আমিই প্রথম বললাম,’আপনারা কখন এলেন?’
রাফি ভাই বলল,’আমরা তো দিয়ার সাথে এসেছি।কনের সাথে তার বাবার বাড়ির পক্ষ থেকে কিছু লোক আসার নিয়ম আছে না!’
-‘আপনারা এসেছেন টের পেলাম না তো?’
এতক্ষণে নিদ্র ভাইয়া মুখ খুলল।কিন্তু সে মুখ খুলেই আমাকে পঁচানোর জন্য।বলল,
-‘বাসের মধ্যে ভেড়ার মত বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে থাকলে টের পাবে কিভাবে!’
সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিল।মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে তার চুলগুলো গিয়ে খামছে ধরি।
তামিম ভাই উঠে গিয়ে নিচের থেকে কোল্ড ড্রিংক আনতে গেল।সোহেল ভাই বলে উঠল,’জামাই বউকে কি বাসর ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছে?’
সাফা বলল,’না,কেনো?’
-‘আরে গিয়ে কান পাততে হবে না!আমরা তো ফুল প্লান করে ফেলেছি।বিছানার নিচে পাপড় ভাজা রেখে দেওয়া হয়েছে।তারা গিয়ে বসলেই পাপড় ভাঙতে শুরু করবে।দুজনে হকচকিয়ে যাবে।তারপর করা হবে লোডশেডিং অপারেশন।একটু পরপর লাইট অন হবে অফ হবে।বেচারারা চমকাতে চমকাতেই শেষ হয়ে যাবে।’
আমরা তো থ মেরে রয়েছি তাদের কথা শুনে।
নিদ্র ভাইয়া বলে উঠল,’সোহেল,বেচারাদের এত জ্বালাস না।শেষমেষ কিন্তু বাসর না করতে পারলে তোদের সারাজীবন অভিশাপ দিয়ে যাবে।’
সোহেল ভাই বলল,’মামা তুমি আমাদের অভিশাপের ভয় দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না।
তোর বাসর ঘরে তো আমরা সারারাত জ্বালামু।’
-‘আচ্ছা!এই নিদ্র করতে দিলে তো!’
ইশ কি কথার ছিরি!আমি সাফাকে চোখ ঘুরিয়ে দেখালাম ‘দেখ তোর ভালো ভাইয়ার গুণ।’
বর কনেকে বাসর ঘরে নেওয়া হয়েছে শুনে সবাই উঠে চলে গেল।বাকি রইলাম আমি,সাফা,তামিম ভাই আর নিদ্র ভাই।হঠাৎ তামিম ভাই বলে উঠল সে বাথরুমে যাবে।আর সাফাও লাফ দিয়ে বলে উঠল সে দেখিয়ে দিতে যাবে।আমি সাফাকে ফিসফিস করে বললাম,’তোর যাওয়ার কি দরকার।?’
কিন্তু ও একটু আসছি একটু আসছি বলে চলে গেল।আমিও ওর পিছু পিছু যাওয়া ধরলে নিদ্র ভাইয়া আমার হাত টেনে ধরে বলল,’কি করছো?দুজনের নতুন নতুন প্রেম শুরু হয়েছে,একটু একলা সময় দাও।’
আমি চরম অবাক হয়ে বললাম,’প্রেম শুরু হয়েছে মানে!কবে থেকে?’
-‘দুজনের মনে মনে তো আগের থেকেই ছিল,এপ্রুভাল আজকে পেল।’
-‘তারা দুজন তো শুধু লেগেই থাকে।প্রেম ছিল কিভাবে?’
-‘ঐ লেগে থাকার ভেতরেই তো প্রেম।’
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম,’এত কিছু হয়ে গেল আর আমি বুঝালাম না কিভাবে?’
সে একটু পিছনে সরে গিয়ে এক হাতে কোল্ড ড্রিংক ধরে আরেক হাত পকেটে ঢুকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
-‘তার জন্য না ঘিলু থাকা লাগে।’
আমি মুখ ফুলিয়ে রইলাম।সে আবার আমাকে পচাঁনো শুরু করছে!
চলবে,,
#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
মাঝে মাঝে স্ব-ইচ্ছায় আমি আলসেমিকে নিজের উপর চড়াও হতে দেই।পৃথিবীর যাবতীয় সংস্পর্শ থেকে মুক্ত হয়ে আলসেমির পুকুরে ডুব দেওয়াটা মন্দ লাগে না।দুই দিন যাবৎ ভার্সিটি যাই না।গভীর ঘুমের রাজ্যে এখন আমার যোগাযোগ।ফোনের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।আলসেমি ভেঙে সেটা ঠিক করারও ভেতর থেকে কোনো তাড়া আসছে না।সোমা আপু গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ায় কিছু বলার মতও কেউ নেই।
তৃতীয় দিনের দিন যেতে হলো,কারণ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার আজ লাস্ট ডেট।
কিন্তু যাওয়ার পর যা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
ভার্সিটি যাওয়ার পর নিদ্র ভাইয়া আমাদের ক্লাসে যাদের যাদের অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয় নি তাদেরগুলো আমার হাতে দিয়ে দিল।আমার অপরাধ দু দিন সে ফোন দিয়ে,ভার্সিটি এসে আমাকে পায়নি।প্রথমে উদ্বিগ্ন মুখে আমার আলসেমির গল্প শুনে রাগে গজগজ করে আমার মাথার উপর এই শাস্তি তুলে দিল।
নিজের ত্যানা ত্যানা জীবন নিয়ে আক্ষেপ করতে করতে লাইব্রেরীতে বসে বসে একগাঁদা কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম।নিজেরটা করেছি দুই তিনদিন ধরে আর এতগুলো আধো আধো করে রাখা অ্যাসাইনমেন্ট আমি কিভাবে ভার্সিটি আওয়ার শেষ হওয়ার আগে কমপ্লিট করব?
আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগলাম,’ঐ নিদ্র আর কতদিন এই ভার্সিটিতে থাকবে!সময় যেন শেষও হচ্ছে না।আমি তার খপ্পর থেকে রেহাই পাবো কিভাবে?আল্লাহ্ একটু দয়া করো।
মাথা চুলকে,চোখ কঁচলে,কলম কামড়ে শুধু পাগলই হতে লাগলাম,অ্যাসাইনমেন্ট আর আগাচ্ছে না।
ঠিক সেই সময় নিদ্র ভাইয়া এসে চেয়ার টেনে আমার বাম সাইডের কর্ণারে বসে পড়ল।বই খাতা টেনে ভ্রু কুঁচকে নিচের ঠোঁট আলতো কামড়ে ধরে নিজে নিজে করে দিতে লাগলো।আমি তো শকড হয়ে তাকিয়ে রইলাম।যে শাস্তি দিয়েছে সেই আবার পূরণ করছে।যাক!আমার রাগটাও এখন পরে গেছে।
অনেকক্ষণ পর সব কমপ্লিট করা হলে সে বই থেকে মুখ তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার ফোন দাও।’
আমিও চুপচাপ বের করে দিলাম।সে পুরাতন ব্যাটারী চেন্জ করে একটি নতুন ব্যাটারী লাগিয়ে দিল।
আমি খাতাগুলো চেক করে বললাম,’আপনি ফিজিক্স এর স্টুডেন্ট হয়েও আমাদের সেকশনের অ্যাসাইনমেন্ট কিভাবে করলেন?’
-‘না পাড়ার কি হল!অবশ্য সেম সেকশনের হলে আরো তাড়াতাড়ি হয়ে যেত।’
-‘অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট তো আপনিই করলেন।তাহলে শুধু শুধু আমাকে এই পানিশম্যান্ট দিলেন কেনো?’
-‘তুমি যে পারবে না এটা তো আমি আগেই জানি।তোমাকে যে এগুলো নিয়ে টেনশন করে করে মরতে হল এটাই তোমার পানিশম্যান্ট।
আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললাম,’কিন্তু মেইন কষ্ট তো শেষমেষ আপনাকেই করতে হলো!’
কথাটি বলে আমি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।সে কিছুক্ষণ অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভির মুখে বলল,’তোমাকে না বলেছি আমার সামনে এভাবে হাসবে না।’
তার কথা শুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।আমি মুখ টিপে হাসলেই সে সব সময় এই কথা বলে কেনো?আমাকে এভাবে হাসলে কি এত খারাপ লাগে?
তার পরেরদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে তামিম ভাইয়ার সাথে দেখা।সে আমার হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে বলল ভার্সিটি গিয়ে নিদ্র ভাইয়ার কাছে দিয়ে দিতে।আমি রিকশা থেকে নামতেই চোখ পড়ল নিদ্র ভাইয়া আমার একটু সামনে দিয়েই ভার্সিটির গেটের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে।
হাতের মাঝে বই রেখে আমি তার পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে নিদ্র ভাইয়া নিদ্র ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলাম।আমি তার কাছে পৌঁছাতেই এক অচেনা অ্যান্টি নিদ্র ভাইয়াকে থামিয়ে বলল,’তোমার বোন তোমাকে ডাকছে কতক্ষণ ধরে।’
ততক্ষণে আমিও তার নাগালে পৌঁছে গেছি।
অ্যান্টি তো বলেই পগারপার।আর নিদ্র ভাইয়া যে
দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো মনে হচ্ছে আজকে আমাকে নির্ঘাত গিলে ফেলবে।আমি মুখটা কাচুমাচু করে রাখলাম।সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,’তোমার এই ভাইয়া ডাকের জন্য আর কেউ যদি আমাদের ভাই বোন ভাবে তাহলে আই স্যয়ার, তোমাকে আমি জাস্ট শেষ করে ফেলব।’
আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম,’তাহলে আর কি বলে ডাকব?সিনিয়রকে তো মানুষ ভাইয়া বলেই ডাকে!’
-‘আমার মাথা বলে ডেকো!এই তোমার বয়স কি সত্যিই ১৮+?আমার তো একদমই মনে হয় না।ভার্সিটিতে পড়ো বিয়ে হয়ে গেছে তবুও মাথায় এতটুকু বুদ্ধি বলতে নেই।’
‘সুপ্তির বিয়ে হয়ে গেছে?’
আমি চমকে উঠে পাশে তাকালাম দেখলাম আমারই এক ক্লাসমেট তিশা।ওর প্রশ্ন শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল।বুঝে ফেলল না তো আমার আর নিদ্র ভাইয়ার ব্যাপারে!
প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি আবারো করা হলে বুঝতে পারলাম ও শুধু নিদ্র ভাইয়ার শেষের কথাটিই শুনেছে।তিশার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এবার নিদ্র ভাইয়ার দিকে।নিদ্র ভাইয়ার চেহারায় রাগ উড়ে গিয়ে শয়তানী হাসি ভেসে উঠেছে।আমি ঘাড় নাড়িয়ে প্রবল বেগে নিদ্র ভাইয়াকে না বলতে বললাম।
নিদ্র ভাই বলল,’হ্যাঁ,সুপ্তির তো বিয়ে হয়ে গেছে।’
তিশা বলল,’সত্যি সুপ্তি।’
আমি তো না বলতেই যাবো কিন্তু তার আগেই নিদ্র ভাইয়া আমার পেছনে এসে ফিসফিস করে দুষ্টমি ভঙ্গিতে বলল,’তোমার হাতে কিন্তু বই।বই ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয় না!’
আমি নিশ্চুপ হয়ে মুখ ফুলিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।আর তিশা মুখ টিপে হাসি দিয়ে চলে গেল।কি বুঝলো কে জানে!
নিদ্র ভাইয়াও মুচকি হেসে পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে গুন গুন করতে করতে গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আমার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে নিদ্র ভাইকে খুন করে ফেলি।সে এটা কেনো করলো?
এখন যদি সব জানজানি হয়ে যায় তবে আমার জীবনে আর ভালোবাসার মানুষ কচু আসবে!’
ভার্সিটি আওয়ার শেষ হতে না হতেই দেখলাম এই খবর সবাই জেনে গেছে।একটু পরপর প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে আমার কাছে একেকজন উপস্থিত হচ্ছে।সাফা চোখ কপালে তুলে আমার কাছে এসে বলল,’তোর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই আমাকেই জানালি না।কার সাথে হয়েছে?’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে চলে আসলাম।প্রচন্ড রাগ লাগছে নিদ্র ভাইয়ার উপর।সেদিন সারারাত রাগে আমি ঘুমাতেও পারলাম না।
শেষে ঠিক করলাম আর না!ঐ নিদ্র ফিদ্র আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে।আর আমিও চুপচাপ সহ্য করেছি।এবার আমি তাকে জব্দ করবো।
একটি বিশাল সাদা দালান বিশিষ্ট বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।বাড়িটির সামনে একটি নীল মাছের মূর্তির পানির ফোয়ারা।মাছের মুখ থেকে জল ছিটকে আশেপাশে পড়ছে।কাঠের মেইন দরজার সম্মুখ থেকে একটি প্রশস্ত রাস্তা ফোয়ারার চারিদিক বৃত্তাকার ন্যায় ঘুরে সামনের লোহার গেটের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে।রাস্তার দুপাশেই বাহারী রঙের ফুলের বাগান।বাগানের মাঝে হলুদ রঙের কিছু নাম না জানা ফুল নজর কেড়ে রেখেছে।
কঠোর আত্ম সংকল্প নিয়ে এলেও এখন আমার রীতিমত ঘাম ছুটে যাচ্ছে।নিদ্র ভাইয়ার মা যদি আমার গালে থাপ্পড় টাপ্পর মেরে বসে।নাহ!ভয় পাওয়া যাবে না,মারলে মারুক।নিদ্র ভাইয়ার অবস্থাও তো খারাপ হবে।তার বড়লোক বাবা মা নিশ্চয়ই মেনে নিবে না ছেলের এমন হুটহাট গোপন বিয়ে।তারপর নিশ্চয়ই আলাদা করার জন্য তারাই মরিয়া হয়ে উঠবে।আর আমিও রেহাই পাবো।সিনেমাতে তো তাই হয়।আমি যদি একটা থাপ্পড় খাইও নিদ্র ভাইয়া খাবে পাঁচটা।
এই ভেবে মনটাকে একটু শান্ত করলাম।প্রশস্ত কাঠের দরজাটি খুলে গিয়ে গোলগাল মুখের একজন অতি সুন্দরী মহিলা হাসিমুখে আমাকে জিজ্ঞাসা করল,’কাকে চাই?’
তার মায়া মায়া মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জেনো মনে হল ইনিই নিদ্র ভাইয়ার মা।আমি একটু ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলাম,’আপনার ছেলে আমাকে গোপনে বিয়ে করেছে।’
কথাটি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে মাথা উঠিয়ে দেখলাম সেই মহিলাটি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে আছে।
আমি ভাবলাম কাজ হয়েছে।
কিন্তু তখনই সে আমার হাত টেনে ভেতরে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে কাজের লোকদের বলতে লাগল,’কইরে তোরা দেখ,তোদের নিদ্র ভাই বিয়ে করে ফেলেছে।নিদ্রর বউ এসেছে।’
নিদ্র ভাইয়ার মাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তিনি এই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মহিলা।আমাকে সোফায় বসিয়ে বাচ্চাদের মত খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘হ্যাঁ রে মা,তোরা কিভাবে বিয়ে করেছিস আমাকে সব বলতো।আমার অনেক ইচ্ছা ছিল আমিও পালিয়ে বিয়ে করবো,কিন্তু তোমার শ্বশুর একদম ভীতু,প্রেম করা সত্ত্বেও আমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে তারপর বিয়ে করলো।আমি তো নিদ্রকে বলেই রেখেছিলাম পালিয়ে বিয়ে করতে।ও তো দেখি সত্যিই করে ফেলেছে।’
আমি তো শুধু বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখে যাচ্ছি।প্রথম আলাপেই সে আমাকে কত কথা বলে দিচ্ছে।আমি কি ভেবেছিলাম আর কি হচ্ছে।
এবার এক অন্য ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে।
এরই মাঝে নিদ্র ভাইয়া দোতলা সিড়ির মুখে এসে দাড়ালো।তার পড়নে এখন একটি অরেঞ্জ টি শার্ট আর ব্লাক থ্রি কোয়ার্টারের প্যান্ট।সে আমাকে দেখে একটুও চমকালো না।যেনো আমার এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক।
নিদ্র ভাইয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে তার মা তার কান ধরে বলল,’কিরে বিয়ে করেছিস আর এখনও আমাকে জানাতে পারলি না।’
নিদ্র ভাইয়া মৃদু হাসি দিয়ে কান ছাড়িয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো।
অ্যান্টি হেসে বলল,’যাহ!মাফ করে দিলাম।এত মিষ্টি মেয়েকে আমার বৌমা বানানোর জন্য।’
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।নিজের করা গর্তে নিজেই পড়ে গেলাম না তো!
এরপর কিছু ঘটনা ঘটলো অতি দ্রুত।নিদ্র ভাইয়ার বাবাকে ফোন করে অফিস থেকে আনা হলো।তার থেকেও আমার কাঙ্খিত প্রতিক্রিয়া পেলাম না।তাকে দেখেও মনে হচ্ছে তার ছেলের কাজে সে গর্বিত।
বড় বিপত্তিটা তো বাধলো তখন যখন আমি হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার কথা বললাম।আমার কথা শুনে নিদ্র ভাইয়ার বাবা মা এত অবাক হল যেন এমন আজগুবি কথা তারা কখনো শুনে নি।
তাদের মতে তাদের এত বড় বাড়ি থাকতে তাদের ছেলের বউ হোস্টেলে থাকবে এটা হতেই পারে না।আমাকে তারা কিছুতেই যেতে দিল না।ধরে বসিয়ে দিয়ে গেল নিদ্র ভাইয়ার রুমে।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।আমার এখন শুধু কাঁদাটাই বাকি।ঠোঁট ফুলিয়ে আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে মনে মনে কপাল চাপড়াতে লাগলাম।এ আমি কোথায় ফেসে গেলাম!তার বাবা মা তো দেখি তার থেকেও ফাস্ট।তাকে জব্দ করতে এসে নিজেই জব্দ হয়ে রয়েছি।
আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ন্যাকাচ্ছি আর ওদিকে নিদ্র ভাইয়া হাসতে হাসতে শেষ।রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে।হাসির চোটে যেন কথাই বলতে পারছে না।
তার হাসি দেখে আমার গা আরো জ্বলে গেল।
তাকে তো আবার এখন ভাইয়া বলা নিষেধ!তাই কিছু না ডেকেই রাগ করে বললাম,’আপনি এভাবে হাসছেন কেনো?’
সে হাসি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বলল,’তোমার দেখি শ্বশুরবাড়ি আসার বড্ড তাড়া!কিভাবে ম্যানেজ করলে?’
‘আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম,’আমি তো এসেছি আপনাকে ফাসাতে,কে জানতো যে এমন হয়ে যাবে!আপনি গিয়ে আপনার বাবা মাকে বোঝান।আপনার ঐ মেয়ে যদি শুনে এতকিছু তাহলে তো আর জিন্দেগীতেও আপনাকে মেনে নেবে না।’
-‘স্যরি,আমার বাবা মাকে আর থামানোর ক্ষমতা আমার নেই।এবার তো আর আমি কিছু করিনি।’
-‘আর আমার বাবা মা বুঝি নেই?তারা যখন শুনবে তখন আমাকে কি করবে জানেন?’
আমার কথা শেষ হতেই এই বাড়ির এক কাজের মেয়ে এসে মুখ টিপে নিদ্রকে বলল,’ভাই,ভাবীর বাপ মা আসছে।’
এই কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম।তারা আমার এড্রেস জানলো কিভাবে?বাবা মাকে ডেকে এনেছে!
বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।সে দু হাত নাড়িয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বোঝাল এখানে তার কোনো হাত নেই সে কিছু জানে না।
সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দেখলাম আব্বুর সাথে আঙ্কেল কোলাকুলি করে খোশ গল্পে মেতে উঠেছে।দেখে মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে তারা খুঁজে পেয়েছে।নিদ্র আমার পেছন থেকে এসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল।আমিও তার পিছনে পিছনে নিচে গেলাম।নিদ্র আব্বুকে সালাম দিলে আব্বু নিদ্রকে বুকে টেনে নিল।
আমি তখন নিদ্রকে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমার আব্বু আম্মু জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে।
আমার আব্বু আম্মু আমাকে খুব ভালোবাসে।আমি যদি একটি রিকশাওয়ালাকেও বিয়ে করে তাদের সামনে নিয়ে যেতাম তবুও তারা হাসি মুখে মেনে নিত আর এদিকে তো নিদ্রর মত পারফেক্ট ছেলে পেয়ে কোনো কথাই নেই!
এবার আব্বু আমার কাছে এসে আমাকে বুকে টেনে বলল,’আমার সোনা আম্মু মামণিটা এত শুকিয়ে গেছে কেনো!’
তারপর নিদ্রকে বলল,’নিদ্র আমাদের মেয়েকে আমরা খুবই আদর যত্নে বড় করেছি।আমার মেয়েটা অনেক সহজ সরল।ওর মনে যেমন কোনো প্যাচ নেই তেমনই ও কোনো প্যাচ বোঝেও না।ওকে দেখেশুনে রেখো।আমার একটাই মেয়ে।’
নিদ্র ভাইয়া আব্বুর হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলল,’চিন্তা করবেন না বাবা।আপনার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে আমার।আমি ওকে সবসময় আগলে রাখবো।’
শুধু শুধু নিদ্রর নাটক করে এত কথা বলার কি দরকার আমি বুঝি না।চুপ করে থাকলেই তো হয়।
এই দুই পরিবারের এত সখ্যতার কারণ শেষমেষ জানতে পারলাম।নিদ্র আর আমার বাবা হাইস্কুল ফ্রেন্ড ছিল।এত দিন যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল।আমার ঠিকানা বের করে নিদ্রর বাবা গাজীপুর থেকে আমার বাবা মাকে আনিয়ে দেখতে পেল তার ছেলে আর অন্য কাউকে নয় তারই পুরোনো বন্ধুর মেয়েকেই বিয়ে করেছে।
গল্পে আনন্দে দুই পরিবার পুরো মেতে উঠল।এতকিছুর মাঝে শুধু আমি একাই অস্থিরতায় ভুগছি।এতো পুরো দেখি সত্যি সত্যি বিয়ের বাঁধনে রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে।এরপর কি হবে?
দুই পরিবার মিলে ঠিক করলো আমাকে আর হোস্টেলে পাঠানো হবে না।আর কয়মাসের মধ্যেই যেহেতু নিদ্রর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাবে আর বিজনেসে যোগ দিবে তাই তার কিছু সময় পরেই বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।ততদিন আমি এখানেই থাকব নিদ্রর সাথে।
আমার হোস্টেলে একা একা থাকা আর সেখানের বিশ্রী খাওয়া নিয়ে আগে থেকেই আমার বাবা মার চরম আপত্তি ছিল।তারা তো এখন আরো নিশ্চিন্ত হতে পারলো।
রাত এখন অনেক।আমার আব্বু আম্মু সন্ধ্যার পরেই গাজীপুরে ফিরে গেছে।অাঙ্কেল অ্যান্টি থাকার জন্য অনেক বলেছিল।
আমার ইচ্ছে করছে নিজের চুলগুলো টেনেটুনে সব ছিড়ে ফেলি।কাল এই সময় হোস্টেলে ছিলাম আর আজ নিজের বোকামীতে ফেঁসে গিয়ে নিদ্রর রুমে বসে আছি।নিদ্রর বিছানার কর্ণার ঘেঁষে বসে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছি।নিদ্রর বাবা মা তো দেখি তার থেকেও বেশি ফাস্ট।আমাকে একবারের জন্যও হোস্টেলে ফিরে যেতে দিল না।নিদ্রকে দিয়ে আমার জিনিসপত্র আনিয়ে নিল।আর ঐ পলিটিক্যাল লিডারের কাছে তো এসব কোনো ব্যাপারই না।
এখন আমি তার সাথে একরুমে থাকব কিভাবে।ভাবতেই তো কেমন যেন লাগছে!
বাথরুমের দরজা ফাঁক করে নিদ্র একটি হোয়াইট টি শার্ট আর ব্লাক ট্রাউজার পড়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
তার মুখে এখনো সেই স্মিত হাসি।আজকে সারাদিন ধরেই তার ঠোঁটে এই হাসি ঝুলে রয়েছে।
আমার যন্ত্রণাতেই তো তার খুশি!
আমি এখন হালকা গোলাপি রঙের সুতি কামিজ আর সাদা রঙের ধুতি সেলোয়ার পড়ে আছি।সে বিছানার কাছে এসে টাওয়ালটা সোফায় ছুঁড়ে মেরে বিছানায় শুয়ে পড়লো।আমি মুখ ভার করে বললাম,’আমি কোথায় ঘুমাবো?’
সে চোখ বন্ধ করেই বলল,’যেখানে ইচ্ছা।চাইলে আমার পাশেও ঘুমাতে পারো।কিন্তু এই আশা করো না যে আমি এখন ফিল্মের হিরোর মতো তোমায় পুরো বিছানা ছেড়ে দিয়ে নিচে গিয়ে ঘুমাবো।’
আমি মনে মনে তাকে একটা গালি দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে রাগে কষ্টে নিজের পাতলা ওড়নাটাই আষ্টেপিষ্টে গায়ে পেচিয়ে নিচে ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম।
নিদ্রও সাথে সাথে লাইট অফ করে দিল।আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় আছি।হঠাৎ কানে ভেসে এলো কেমন একটা অদ্ভুত মৃদু আওয়াজ।যেমনটা হরর মুভিতে কেমন একটা ভয়ংকর গা ছমছমে সাউন্ড হয়।
আমি চোখ মেলে তাকালাম।পুরো রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাইরে থেকে সোডিয়ামের হালকা আলো যেন অন্ধকারকে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে।আওয়াজটা এখন আর আসছে না।নিস্তব্ধ চারিপাশ।নিঃশ্বাসের শব্দও যেন প্রকট শোনা যাচ্ছে।আমার গা ছমছম করতে লাগল।নিদ্রর দিকে তাকিয়ে মনে হলো পুরো বেঘোরেই ঘুমিয়ে আছে।আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।আবারো সেই আওয়াজ।চোখ খুলে ভয়ে আমি ঢোক গিলতে লাগলাম।একে একে সবগুলো হরর মুভির ভয়ংকর সিন গুলো আমার চোখে ভাসতে লাগলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো ভুতের ছবি দেখবো না।প্রচন্ড ভয় আমার উপর জেঁকে বসেছে।এখন এভাবে নিচে একা একা ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।তার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম আর ভাবলাম তার সাথে তো আমার শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছেই তাহলে এখন এক বিছানায় ঘুমালে তো আর গুনাহ হবে না।দূরত্ব বজায় রাখলেই হবে।
আমি কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে বালিশ হাতে নিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে নিদ্রর পাশে শুয়ে পড়লাম।নিদ্র এক হাত মাথার নিচে দিয়ে চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে।আমিও চোখ বন্ধ করে নিলাম।এবার আবারো সেই সাউন্ড হলো,আরো জোরে।আমি ভয়ে নাক মুখ কুঁচকে নিদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
চলবে,,