ভাড়াটিয়া-১৭,১৮,১৯

0
578

ভাড়াটিয়া-১৭,১৮,১৯
নাবিল মুহমুদ
১৭

শাহিন সাহেব বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার আছে। তার মন খুব ভালো। ওনার পুলিশের আইজি বন্ধু মিলন খন্দকার কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছে। রাশেদা বেগম নামের মহিলাটি ধরা পড়েছে।

সুইটি নামের মেয়েটির খোঁজ বের করা হয়েছে। সব খবর শুনে ওনার একটু খারাপও লাগছে! সুইটির আসল পরিচয় জানা গেছে।

শাহিন সাহেব অবশ্য সুইটি কে গেরেফতার করতে মানা করেছেন। উনি নিজে সুইটির মুখোমুখি হতে চান। সুইটির ওপরে নজর রাখা হচ্ছে। ও মনে হয় এখনো আঁচ করতে পারেনি। নিজের মতো ছদ্মবেশ নিয়ে চলাফেরা করছে।

আনোয়ারা কে এখন এ সব বিষয়ে জানান হয়নি। দেখা যাক কী হয়? পরে সবাইকে জানান যাবে।

আনোয়ারা বেগম এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। শাহিন সাহেব আনোয়ার দিকে তাকালেন। আনোয়ারা অনেকটা শুকিয়ে গেছে! চেহারায় কেমন একটা চিন্তার ছাপ পড়েছে! মনে হয় এ কয়দিনে বয়সটা বেড়ে গেছে!

শাহিন সাহেবের খুব মায়া লাগছে! সুইটি মেয়েটার কথা বলে দিতে ইচ্ছে করছে। না থাক আনোয়ারা কে এখন বলাটা ঠিক হবে না।

আনোয়ার মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ” কী ব্যাপার বলো তো?”

শাহিন সাহেব নিজেকে সামলালেন। এ এক সমস্যা! আনোয়ারা কী করে যেন শাহিন সাহেবের মনের কথা বুঝে ফেলে! কী করে বুঝে কে জানে?

“কোনো ব্যাপার নাই তো!”

আনোয়ারা ইজি চেয়ারের হাতলের ওপরে বসল। “আজ তোমাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে? ”

“না তেমন কিছু না।”

“তা আজ অফিসে যাবে না? দশটা বেজে গেছে এখনো তুমি রিলাক্স মুডে বসে আছ!”

“না আজ আর অফিসে যাব না। অবশ্য একটু পরে বের হতে হবে। অন্য একটা কাজ আছে।”

“অফিস কামাই দিয়ে অন্য কাজ করার মানুষ তো তুমি না!”

“অন্য কাজ বলতে মিলনের সাথে একটু দেখা করতে যাব আরকি।”

“ও তাই বলো।”

“রায়হান কই?”

ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ল আনোয়ারা! “আছে ঘরে। ছেলেটা আমার কেমন হয়ে গেছে!”

ছোটো একটা গভীর শ্বাস শাহিন সাহেবও ছাড়লেন। একটা কষ্ট ওনার বুকেও বিঁধল!

সুইটি সাতদিনে ঘর থেকে বের হয়নি। এ কয়দিন ঘরেইছিল। এক সপ্তাহের বাজার করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। মায়ের একবার দেখা করে এসেছে। ভেবেছিল এ কাজটা করে পুরো টাকাটা হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি! অবশ্য গয়নাগুলো বিক্রি করলে হয়ে যাবে।

এখন গয়না বিক্রি করা যাবে না। তাই আপাতত কিছুই করার নাই। ঘর থেকে বের হলে ধরা পড়ার একটা সম্ভব থাকে।

মায়ের সাথে দেখ করতে ইচ্ছে করছে। আজ একবার মায়ের কাছে যেতে হবে। একটু অন্যরকম সাজে বের হতে হবে। এমন সাজ দেখলে মা প্রশ্ন করতে পারে।
মা কে বুঝানটা খুব কষ্টের! মা মনে হয় কিছু সন্দেহ করছে! কাছে গেলেই কেমন করে তাকায় কিছু অবশ্য বলে না! না-কি বলতে পারে না?

সুইটি এ সব কার জন্য করছে? ও পারত আট দশটা মেয়ের মতো সাধারণ একটা জীবন বেছে নিতে। ইচ্ছে যে করে না তা না। রায়হান ছেলেটা কে ওর ভালোই লেগেছিল!

আসলাম সাথে কথা হয় না। বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। গতকাল সুইটি কল দিয়েছিল নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। নতুন নাম্বার নিলো কি? নাম্বার চেঞ্জ করলে তো সুইটি জানিয়ে দেয়। এবার দিতে ভুলে গেছে মনে হয়। কয়দিন পরে ঠিকই কল দিবে।

সুইটি রাশিদার নাম্বারে কল দিলো। নাম্বারটা খুলা কিন্তু কেউ কল ধরল না। ব্যস্ত আছে মনে হয়। ফ্রি হলে কল ব্যাক করবে। বোনের বাড়িতে ভালোই সময় কাটাচ্ছে!

একটা সাদা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরে সুইটি বের হলো। চুল ছোটো করে ছাঁটা। দেখলে মনে হয় খুব সুন্দর একটা ছেলে।

সুইটি বাসা থেকে বের হয়ে বড়ো রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল। কেমন জানি লাগছে! মনে হচ্ছে কেউ পিছন থেকে তাকিয়ে আছে। সুইটি মনের অস্বস্তিটা কে দূর করার চেষ্টা করছে কিন্তু যাচ্ছে না।

সুইটি ভাবল দূর কে আমাকে চিনবে? মা ও হুট করে দেখলে চিনতে পারবে না। এটা সুইটি। আর তো দূরের মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে বড়ো রাস্তায় চলে আসল সুইটি।

এখন সকাল এগোরটা বাজে। এ সময় রিকশা পাওয়াটা একটু কঠিন হয়ে যায়। অফিস সময় সবাই অফিসে ছুটছে। পাঠাও কে কল দিলে হয়। অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে। পাঠাও থাক। একটা রিকশা নিলেই হবে। একটু অপেক্ষা করলেই হয়ত রিকশা পাওয়া যাবে।

একটা রিকশা আসতে দেখা যাচ্ছে। সুইটি রিকশাটাকে ইশারায় থামতে বলল।

রিকশাওয়ালা কিছুটা সময় ধরে সুইটির দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সুন্দর ছেলে আগে কখনো দেখেনি মনে হয়।

“কই যাবেন ভাই?”

সুইটির ভালো লাগল! যাক মানুষজন ওকে ছেলে ভাবছে। আলগা হেসে বলল, “ঢাকা মেডিকেল যাবেন।”

“হুঁ, যামু।”

ভাড়ার কথা সুইটি কিছুই জিজ্ঞেস করল না। রিকশাওয়ালা কে ওর খুব ভালো লেগেছে! মালিবাগ থেকে ঢাকা মেডিকেল কত আর ভাড়া নিবে? একশো টাকা দিলে কি রিকশাওয়ালা খুশি হবে না?

সুইটি রিকশায় চড়ে বসল। রিকশা চলছে অনেকটা দ্রুত গতিতে।

চলবে–

ভাড়াটিয়া-১৮

সুইটি অনেকটা সময় ধরে বসে আছে একটা চেম্বারে। ছোটো খাটো একটা ঘর। প্রাইভেট চেম্বারের মতো সাজানো গুছানো না।

ঘরটা বেশ পরিস্কার বলা যায়। সরকারি চেম্বারে আসবাবপত্র খুব একটা থাকার কথা না। একটা বড়ো ধরনের টেবিল আর গুটিকয়েক চেয়ার আছে। অন্য ডাক্তারের চেম্বারে একটা বেড থাকে। এখানে কোনো বেড নাই! ডাক্তার মনে হয় এ ঘরে রোগী টুগী দেখেন না।

একটা লম্বা সময় কাটিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন মুখলেছুর রহমান। সুইটি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

ডাক্তার ঘরে ঢুকেছেন সুইটি টের পায়নি। ডাক্তার ঢুকে নিজের চেয়ারে বসলেন। সুইটি তখন বাইরে তাকিয়ে আছে।

“কী খবর সুইটি?”

শব্দ শুনে প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল সুইটি। অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল ডাক্তারের দিকে। হালকা একটু হাসি দিয়ে বলল, “ভালো। ” ভালো বললেও সুইটি অবশ্য ভালো নেই! “আপনি?”

“আছি ভালোই। তোমার কোনো খবর নেই কেন?”

“কয়েকদিন আগে তো একবার এসেছিলাম স্যার।”

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”

“টাকাটা আমি জোগাড় করে ফেলেছি স্যার।”

“এখন তো আর টাকার দরকার নেই সুইটি।”

ডাক্তারের কথায় সুইটির বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তবে কি? মা আর নেই! চোখে কেমন ঝাপসা দেখতে লাগল সুইটি! ডাক্তারটা খুব ভালো মানুষ। সুইটির জন্য অনেক কিছু করেছে। অনেক করে বলেছিল টাকাটা দ্রুত জোগাড় করতে। সুইটি টাকাটা জোগাড় করেছে। এখন সব শেষ হয়ে গেল!

সুইটির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন,” ঘাবড়ানোর কিছু নেই! তোমার মায়ের অপারেশন হয়ে গেছে। তাই টাকার আর প্রয়োজন নেই।”

সুইটি কিছুটা সময় কথাই বলতে পারল না। কত কী করে ও টাকা জোগাড় করল।
“কী করে জোগাড় হলো?”

“তুমি জানো না! তোমার বাবাই তো টাকাটা জমা করে দিয়েছেন। তোমার মায়ের অপারেশন হয়ে গেছে সুইটি। এখন উনি ভালোই আছেন।”

সুইটি অবকা হয়ে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। বাবা টাকা জমা দিয়েছে! যে বাবা কোনোদিন ওদের খবর নেয়নি! ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। সেই বাবা ওর মায়ের অপারেশনের জন্য ত্রিশ লাখ টাকা দিয়েছে। এটা বিশ্বাস করা যায়। সুইটিদের খবরই বা জানল কী করে? ওনার সাথে তো বহুবছর ধরে কোনো যোগাযোগ হয়নি। সুইটি ঠিক হিসাব মিলাতে পারছে না! বাবার কথা ওর খুব একটা মনে নেই। মা যখন ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তখন সুইটির বয়স কত হবে? পাঁচ ছয় বছর। এতটা বছরে একবারও যে বাবা খবর নেয়নি! সেই বাবা কোথা থেকে এসে এত টাকা দিলো?

সুমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে গেল। মা কে দেখতে হবে। কাঁচেঘেরা একটা ঘরে মা কে রাখা হয়েছে। সারা মাথা ব্যান্ডেজ করা। মায়ের কাছে যাওয়া যাবে না।

অনেকটা সময় কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে রইল সুইটি। মায়ের এই অপারেশনটা করানোর জন্য কত কী করল সুইটি! শেষমেশ কি না টাকাটা এমনি এসে গেল!

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল সুইটি। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে। বাবার কথা। বাবা কি ভালো হয়ে গেল? অমন মানুষ কখনো ভালো হয়!

মানুষের টাকা দিয়ে এখন সুইটি কী করবে? মায়ের জন্যই তো সে টাকা জোগাড় করেছে। মায়ের যেহেতু টাকাটা লাগল না। এখন কী টাকাটা ফেরত দিবে? সব টাকা অবশ্য নেই। বেশ কিছু খরচ হয়ে গেছে। ওরা দুইজনও তো টাকা নিয়েছে। ওর কাছে থাকা টাকাটা ফেরত দেয়া যায়।

মিলন খন্দকার বসে আছেন শাহিন সাহেবের সামনে। ওনার মুখে একটা বিরক্তির ছাপ। শাহিন সাহেব হালকা হেসে বললেন, ” কী খাবা বলো?”

“খাওয়া টাওয়া পরে হবে আগে তোমার প্লান বলো?”

“আগে চা টা খাও। মাথা ঠান্ডা করো। পুলিশের মাথা গরম থাকা ভালো না!”

মিলন খন্দকার আলগা হাসি দিলেন। বুঝতে পারছেন। শাহিন সহজে ছাড়বে না।

শাহিন সাহেব টেবিলের ওপরের বেলটা চাপ দিলেন। সাথে সাথে অফিসের পিয়নটা ছুটে এলো।

শাহিন সাহেব বললেন, “দুই কাপ কফি দাও। আর শোন, নীচের করিমের দোকান থেকে গরম গরম সিঙ্গারা নিয়ে এসো তো।”

পিয়নটা ছুটে গেল।

মিলন খন্দকার বন্ধুর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন,” এখন আবার সিঙ্গারা কেন! এখন এ সব খাওয়া বাদ দাও।”

“আরে খাও, খাও। করিম সিঙ্গারাটা ভালো বানায় বুঝলা। ”

“মেয়েটাকে কী করা যায় সেটা বলো?”

“আঃ! তোমাকে তো বলেছি তোমার ডিপার্টমেন্টের কাজ আপাতত তো বন্ধ রাখ। আমি একটা পরীক্ষা করেনি। তারপর তোমাকে বলব।”

“কী করবা সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। ”

“করার পরে সব বলব। এখন তোমারা শুধু নজরে রাখ ব্যস।”

“সে না হয় রাখলাম। কিন্তু তোমার বউমা কে কিন্তু সহজে ছাড়া যাবে না! সে তো শুধু তোমার সাথেই এমন করেছে তা না। আর কয়েকটা পরিবারের সাথে একই কাজ করেছে!”

“সাজা হলে সে তো সাজা পাবেই। সেখানে আমাদের কী করার আছে। তবে মামুন ছেলেটা কে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। কত দ্রুত এদের বের করে ফেলল।”

“হ্যাঁ, মামুন খুব কাজের ছেলে। ছেলেটা কে আমার খুব পছন্দ। ”

পিয়ন একটা ট্রেতে ছোটো ছোটো সিঙ্গরা এনে টেবিলে রাখল। একটা কাঁচের জগে পানি। আর দুইটা গ্লাস টেবিলে রাখল। “কফি কি এখন দিবো স্যার?”

শাহিন সাহেব বললেন,” একটু পরে দাও।”

কিছু না বলে চলে গেল।

শাহিন সাহেব মিলনের দিকে ইশারা করে বললেন,” নাও।”

শাহিন সাহেব বাসায় ফিরলেন বিকালের দিকে। এমনিতে সন্ধ্যায় ফিরেন আজ একটু আগেই ফিরলেন। শাহিন সাহেব ফাতেমা ডাকলেন।

ফাতেমা ছুটে এসে বলল, “কী খবর বাবা?”

“কী করিস রে মা?”

“কিছু করি না বাবা।”

” তোর পরীক্ষা কেমন হলো রে মা?” উনি চেয়েছিলেন মেয়েটা কে পরীক্ষার সময় নিয়ে যেতে। রায়হান বলল,’ তোমার যাওয়ার দরকার নেই বাবা আমি যাচ্ছি। ‘

“ভালোই হয়েছে বাবা।”

“খুব ভালো। তা রায়হান কোথায়?”

“ঘরে শুয়ে আছে।”

শাহিন সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। সুইটি কে খুঁজে পাওয়ার কথাটা এখনো বাসার কাউকে জানান হয়নি। আনোয়ার কে এখন বলা যায়। ক্ষেপে যাবে কি না কে জানে? আনোয়ারা কি পারবে মেয়েটা কে ক্ষমা করে দিতে?

আনোয়ারা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে হাতে একটা ট্রে। শাহিন সাহেব বললেন, “এখন আবার কি আনলে?”

আনোয়ারা আলগা হাসি দিলো। শাহিন সাহেবের পছন্দের পিঠা বানান হয়েছে।
পিঠা দেখে শাহিদা সাহেব হালকা হাসি দিলেন। আনোয়ার শাহিন সাহেবের পাশের চেয়ারে বসলেন।

আনোয়ারা বললেন, “সুইটি মেয়েটার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?”

শাহিন সাহেব একটু অবাক হলেন। আজ হঠাৎ আনোয়ারা মেয়েটার কথা জানতে চাইল কেন? আনোয়ারা কিছু জানতে পেরেছে?

এ সময় ফাতেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো বারান্দায়। এসে হাঁপাচ্ছে।

আনোয়ারা জিজ্ঞেস করলেন, ” কী হয়েছে রে? ”

“মা, মা সুইটি মেয়েটা এসেছে! ”

দুইজনই বিস্মিত হয়ে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে রইল।

চলবে–

ভাড়াটিয়া-১৯

সুইটি বসে আছে ড্রয়িংরুমের সোফায়। ঘরে এ মুহূর্তে কেউ নেই। ফাতেমা নামের মেয়েটা দরজা খুলে কিছু সময় ধরে তাকিয়ে ছিলো। তারপর ভিতরে ছুটে গেছে। হয়ত সবাইকে খবর দিতে। সুইটি কী বলবে একটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।

সুইটি ঠিক জানে না। ওনারা কেমন আচরণ করবেন? খুব ভালো আচরণ করবে এমন আশা কী করা যায়? না, যায় না! সুইটি তাদের কী বিপদে না ফেলেছিলো! তা কী কোনো মানুষ ভুলতে পারে?

সুইটি অবশ্য সব ধরনের শাস্তি মেনে নিতে রাজি আছে। ওনারা পুলিশ কে খবর দিতে পারে। তাতে অবশ্য খুব একটা সমস্যা হবে না। মা কে নিয়ে সুইটির এখন আর চিন্তা নেই। মায়ের অপারেশন হয়ে গেছে।

সুইটির খারাপ লাগছে রায়হান ছেলেটার জন্য। ছেলেটা মনে হয় ওকে সত্যি ভালোবেসেছিলো। ভালোবাসা পেয়েও সুইটি নিতে পারল না। সবাই সব কিছু পায় না। বা সবাই ধরে রাখতে পারে না। সুইটিও সেই অভাগাদের দলে যারা পেয়েও হারায়!

আনোয়ারা বেগম বেশ উত্তেজিত হয়ে গেছেন! শাহিন সাহেব তাকে শান্ত করলেন। রায়হান এখন কোথায় আছে কে জানে? বাসায় না থাকলেই ভালো হয়। অবশ্য শাহিন সাহেবের বেশ ভালো লাগছে! তিনি আশা করেননি সুইটি মেয়েটা বাসায় চলে আসবে।

মিলন খন্দকার যখন ওদের সন্ধান পাওয়ার খবরটা জানাল। শাহিন সাহেব জানতে পারলেন। আসলাম আর রাশিদা সুইটির বাবা মা নয়। ও রুবিনার মেয়ে! শুনে খুব খারাপ লেগেছিল! রুবিনার মেয়েটা শেষপর্যন্ত এমন হলো?

কেন জানি ওনার মনে হচ্ছিল কোনো একটা কারণ আছে। না হলে রুবিনার মেয়ে কখনো এমন হওয়ার কথা না। ডিটেইলস জানার পর দেখলেন। রুবিনা হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার জন্য ত্রিশ লাখ টাকা দরকার। ওনার বুঝতে বাকি রইল না আসল ঘটনা কি?

তারপরই মিলন কে বললেন, সুইটি কে না ধরার জন্য। তিনি দেখতে চান মেয়েটা কি নষ্ট হয়ে গেছে না-কি এখনো ভালো আছে।

হাসপাতালে গিয়ে রুবিনার চিকিৎসার খরচটা দিয়ে দিলেন। ডাক্তার কে জানালেন সুইটি তারই মেয়ে। রুবিনার অবশ্য শাহিন কে চেনার মতো অবস্থা নাই! তবে পুলিশ পুরোটা সময় ধরে সুইটি কে ঠিকই নজরে রেখেছে।

শাহিন সাহেব আর আনোয়ারা ড্রয়িং রুমে আসলেন। সুইটি মাথা নিচু করে বসে আছে। চেহারায় কেমন লজ্জার একটা ছাপ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা অনুতপ্ত!

সুইটি কে দেখার পর আনোয়ারার একটু মায়াই হলো। তবে রাগটা তার এখনো পড়েনি! গায়ের জ্বলুনিটা মিটেছে।

শাহিন সাহেব একটু হাসি দিয়ে বললেন, “কেমন আছ?” আনোয়ারা কিছু বলল না। আগুন দৃষ্টিতে একটু তাকালেন।

সুইটি একটু হাসার চেষ্টা করল। হাসতে পারল না! কেমন জানি খারাপ লাগছে ওর। এমন ভালো মানুষ দুইজন কে দেখে! এত বড়ো অপরাধ করার পরও সুইটির সাথে কী আন্তরিকতা নিয়ে সমাচার জিজ্ঞেস করছেন! এ কি সত্যি? সুইটি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

সুইটি ধরা গলায় বলল, “আমি জানি, আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। আপনাদের মতো মানুষ কে আমি কষ্ট দিয়েছি! বিশ্বাস করেন, আমি নিরুপাধি হয়ে এমন কাজ করেছি। আমার অন্য কোন পথ ছিল না।”

আনোয়ারা বেগম বিরক্তি স্বরে বললেন, “আবার নতুন নাটক করতে এসেছ?”

শাহিন সাহেব আনোয়ারা কে বললেন, “শুনি ও কি বলতে চায়। বলো মা।”

সুইটি বলল,” আমি বুঝি আপনার অবস্থা! আপনাদের সব টাকা আমি ফেরত দিতে পারব না! আমার কাছে পুরো টাকাটা নেই! দশ লাখ টাকা আছে। আর সব গয়নাগুলো নিয়ে এসেছি।”

হাত জোর করে ক্ষমা চাইল সুইটি। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,” আপনারা আমাকে যে শাস্তি দিবেন আমি তা মেনে নিবো।”

আনোয়ারা বললেন,” কেন তুমি এমন করলে! তোমার টাকার দরকার তুমি একবার আমাকে বলে দেখতে পারতে। আমি তো তোমাকে আমার মেয়েই ভেবেছিলাম। ”

সুইটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল! আনোয়ারা ও শাহিন সাহেব দুইজনেই হতবাক হয়ে গেলেন! আনোয়ারার খুব মায়া হলো! কেন জানি উনি মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না! মেয়েটা তাদের সাথে কত বড়ো একটা অন্যায় করল তা সব এক মুহূর্তে ভুলে গেলেন! উনি সুইটির পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,” কাঁদিস না রে মা।”

অনেকটা সময় নীরব কাটল। কেউ কোনো কথা বলল না। আনোয়ারা বেগম সুইটির পাশে বসে রইলেন মাথায় হাত দিয়ে।
শাহিন সাহেব ফাতেমা কে ডাকলেন, “ফাতেমা।”

ফাতেমার জবাব,” জি বাবা।”

“চা নাস্তা দিয়ে যা তো মা।”

শাহিন সাহেবের মনটা ভালো হয়ে গেছে! আনোয়ারা এত সহজে সব কিছু মেনে নিবে তিনি ভাবেননি। মেয়েটার মধ্যে সত্যি একটা মায়া আছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here