ভাড়াটিয়া-২,৩,৪
নাবিল মুহমুদ
২
আনোয়ারা বেগম রুমে এসে দেখলেন, রহিমা ফ্রিজ থেকে মুরগি বের করে রেখেছে। ঘরে চাল ছিলো কিন্তু চালটা পুরান হয়ে গেছে।
এ চাল নিজেরা হয়ত খেতে পারবে। মেহমানদের জন্য সবচেয়ে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। এটা রহিমা শিখেছে ওর মায়ের কাজ থেকে। তাই আব্বাস কে চাল আনতে পাঠিয়েছে।
আনোয়ার বেগম রহিমার কাজ দেখে বেশ খুশি হলেন! মেয়েটা খুব লক্ষী হয়েছে। এ মেয়েটা যেই ঘরে যাবে সেই ঘর উজ্জ্বল করে রাখবে।
রহিমা বলল, “মা শুধু মুরগি করবা? ”
“একটু ইলিশ ভাজ আর ডালের চচ্চড়ি করলেই হবে।”
রহিমা ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছের প্যাকেট বের করল।
“রায়হান কোথায় রে মা?”
“ভাইয়া তো বাইরে গেছে। ”
“কখন গেলো বের হতে দেখলাম না তো!”
“তুমি বারান্দায় ছিলা তখন গেছে।”
রায়হান কি মেয়েটা কে দেখেছে? মনে হয় দেখেনি। আনোয়ারা বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছেলে বের হয়েছে অথচ ওনার চোখেই পড়েনি! এটা কেমন কথা।
মেয়েটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন। ছেলের দিকে নজর পড়েনি!
ওয়ারির রেনকিন স্ট্রিটের পাঁচতলা বাড়িটা বানিয়েছিলেন রায়হানের দাদা আমজাদ খান। এ ছাড়া যাত্রাবাড়িতে দুইটা আর বনানীতে ওদের একটা বাড়ি আছে। পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। রায়হানের বাবা শাহিন খান একজন সরকারি কর্মকর্তা।
সরকারি চাকরি করে তেমন কিছু করতে পারেননি। সম্পত্তি যা আছে তার সবই ওনার বাবার।
শাহিন সাহেবের ইচ্ছে ছিলো সরকারি চাকরি করবেন। তাই পড়াশোনা শেষকরে বাবার ব্যবসায় না বসে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন।
আমজাদ খানও ছেলেকে বাধা দেননি। টাকা পয়সা তার কম ছিলো না। ছেলে দেশের জন্য কাজ করতে চাচ্ছে করুক।
আনোয়ারা বেগম বাসা থেকে বের হলেন। ওনারা দুতলায় থাকেন। নতুন ভাড়াটিয়া আসলাম সাহেব উঠেছেন তিনতলায়।
জিনিসপত্র সব বাসায় আনা হয়েছে। এখন বাসা গুছানো হচ্ছে। আনোয়ারা বেগম কে দেখে আসলাম সাহেব মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ” কেমন আছেন ভাবি?”
হালকা হাসি দিয়ে বলল, ” ভালো। এর মধ্যেই সব গুছিয়ে ফেলেছেন। কী সুন্দর লাগছে বাসাটা এখন!”
একটু হাসলেন আসলাম সাহেব। কত হবে লোকটার বয়স পঞ্চাশ? না মনে হয় পঞ্চাশ হবে না। দেখে চল্লিশের মতো লাগে।
পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মতো লম্বা। হালকা পাতলা দেহের গড়ন।
আসলাম সাহেব একটু উঁচু গলায়,” সুইটি মা এদিকে আয়ত।”
মেয়েটার নাম তাহলে সুইটি। নামের মতোই দেখতে মিষ্টি। মেয়েটি এসে আসলাম সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছে। আনোয়ারা বেগম কে দেখে সালাম দিলো।
আসলাম সাহেব বললেন, “এ হলো আমার মেয়ে সুইটি।
আনোয়ারা কে দেখিয়ে সুইটি কে বললেন, ” উনি আমাদের বাড়িওয়ালী।”
সুইটি হালকা হেসে বলল,” কেমন আছেন আন্টি?”
মেয়েটা হাসিটা বেশ সুন্দর! অনেক সুন্দরী মেয়েদের হাসি সুন্দর হয় না। দেখা যায় এমনিতে দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু হাসলে বিশ্রী লাগে! এ মেয়েকে হাসলেও ভালো লাগে!
কথার মাঝে উপস্থিত হয়েছেন রাশিদা বেগম। সুইটির মা। এই মহিলাও দেখতে অসম্ভব সুন্দরী! তবে সুইটির মতো না।
বেশ উচা-লম্বা মহিলা। বয়সও বেশি মনে হয় না। দেখে বুঝাই যায় না সুইটির মতন একটা মেয়ে আছে ওনার।
রাশিদা বেগম এসে বললেন, ” আপা দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসেন।”
সোফাসেট বসান হয়ে গেছে। সোফার সামনের টেবিলটায় দুইটা প্রেইন্টিং পড়ে আছে। এগুলো মনে হয় দেয়ালে ঝুলাবে।
দেয়াল ফুটা করলে খারাপ লাগে! খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। ভাড়াটিয়াদে প্রয়োজন হলে দেয়ালে পেরেক গাঁথবে। সেটা গাঁথুক সমস্যা নাই।
আগের ভাড়াটিয়া ছিলো একটা বদের বদ। সারাঘরময় পেরেক গেঁথেছে। দেখে মনে হয় পেরেক দিয়ে দেয়াল ডিজাইন করা। সব পেরেক তুলে নতুন করে আস্তর করা হয়েছে।
আনোয়ারা বেগম সোফায় বসলেন। ওনার পাশেই বসল সুইটি। ওপর পাশে আসলাম আর রাশিদা বেগম।
“আপনার মনে হয় পেরেক গাঁথথে হবে?”
আসলাম সাহেব। আলগা একটু হাসি দিলেন। বাড়িওয়ালাদের এ এক সমস্যা। দেয়ালে পেরেক ঠুকা যাবে না! আরে এত শক্ত করে দেয়াল বানানো হয়েছে কেন? যাতে করে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেয়ালে লাগাতে পারে। না হলে কাঁচ দিয়ে ঘর বানাত মানুষ।
অফিসে কিছু ঝুলাতে হয় না বলে অফিস থাকে কাঁচের।
“আমি আব্বাস কে পাঠিয়ে দেব। আপনাদের যেখানে -যেখানে প্রয়োজন ডিল দিয়ে ফুটো করে দিয়ে যাবে।”
আসলাম সাহেব একটু হালকা হাসি দিলেন কিছু বললেন না। না, বাড়িওয়ালী মনে হয় খিটখিটে না। তিনি যতটা খবর নিয়েছেন খুবই ভালো মানুষ।
আনোয়ারা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। “আপনার কাজ করুন। আমি থাকলে কাজ হবে না।”
রাশিদা বেগম বললেন, “সমস্যা নাই আপা। কাজ তো শেষ। টুকটাক গুছগাছ ধীরে ধীরে করতে হবে।”
“আপনারা আজ দুপুরে আমার বাসায় খাবেন কেমন?”
রাশিদা বেগম বললেন,” এ সব ঝামেলা কেন করতে গেলেন আপা!”
“ঝামেলা কেন হবে আপা। আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন, আপনাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা তো আমার দায়িত্ব। ”
রাশিদা বেগম মিষ্টি হাসি দিলেন। কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।আজকাল এমন মানুষ হয়!
আনোয়ারা বেগম বেরিয়ে গেলেন।
চলবে–
ভাড়াটিয়া-৩
শাহিন সাহেব ঘরে বসে আছেন। ওনার প্রচন্ড চা খেতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য রহিমা কে বললেই চা বানিয়ে দিবে। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না!
মনে হচ্ছে কেউ নিজ থেকে চা নিয়ে এলে ভালো হতো। ইচ্ছে পূরনের একটা ব্যাপার হতো। জান্নাতে এমনটা হবে। মনে মনে কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করলেই খাবার হাজির হবে!
আবার সেই খাবার নাকি কষ্ট করে খেতেও হবে না। মুখের মাঝে খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে।
জান্নাতে সব ধরনের কষ্টের অবসান হবে। যত রকম কষ্ট আছে সব দুনিয়ায় ভুগতে হবে!
আনোয়ারা বেগম চা নিয়ে শাহিন সাহেবের ঘরে ঢুকল। শাহিন সাহেবের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না! তার মতো একজন নাদান বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ পূরণ করে ফেললেন!
তবে মানুষের ছোটো অনেক ইচ্ছে হুট করে পূরণ হয়। যেমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন ভাবছে এখন যদি বৃষ্টি হতো! খুব ভালো হতো। দেখা যায় আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়!
বৃষ্টি দেখে মানুষটার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তার মনখারাপ হয়ে যায়। সে ভাবে ইশ যদি বড়ো কিছু চাইতাম! ইচ্ছে পূরণের সুযোগটা নষ্ট হলো!
শাহিন সাহেবের একটা ধারণা ছিলো চা নিয়ে আসবে রহিমা। তার এ ধারণাটাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে!
আনোয়ারা বেগম চা নিয়ে এসে শাহিন সাহেবের পাশে বসলেন। “তোমার চা।” এমনভাবে বললেন যেন শাহিন সাহেব ওনাকে চায়ের কথা বলেছেন!
“এ সময় চা নিয়ে এলে যে?”
আনোয়ারা শাহিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ” কেন জানি মনে হলো তোমার চা খেতে ইচ্ছে করছে! ”
শাহিন সাহেব কিছু বললেন না। আলগা একটু হাসি দিলেন। ব্যাপারটা ওনার কাছে কেমন রোমাঞ্চকর লাগছে!
পুরো ঘটনাটা আনোয়ারা কে বলতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু বলতে পারছেন না। কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে! তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় কথা বললেন, ” তোমার তিনতলা ভাড়া হয়েছে? ”
“হ্যাঁ, খুব ভালো ভাড়াটিয়া পাওয়া গেছে! ”
শাহিন সাহেব আনোয়ারার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বললেন, “তোমার কাছে সব ভাড়াটিয়াই তো ভালো! পরে দেখা যায় একেকটা চিজ!”
আনোয়ারা বেগম একটু বিরক্ত হলেন। “মানুষ কে না চিনে এমন বলবে না তো! তুমি জানো আসলাম সাহেব খুব ভালো মানুষ! ”
শাহিন সাহেব কিছু বললেন, “ভালো হলেই ভালো!” তিনি জানেন আনোয়ারার মনটা খুব ভালো। সব মানুষ কে কেমন আপন করে নিতে চায়।
দুনিয়া তো ফাজিলে ভরা। সেটা আনোয়ারা কে বুঝাবে? যাক থাকুক ওর মতো করে। মানুষ কে ভালোবাসায় খারাপ কিছু নাই।
“তুমি তো দেখনি! আসলাম সাহেবের মেয়েটা কী যে সুন্দর দেখতে! যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই আবার লক্ষী একটা মেয়ে।”
শাহিন সাহেব আনোয়ারার দিকে আড় চোখে তাকালেন। চোখে কেমন খুশি ঝিলিক! ঘটনা কী একটা মেয়েকে দেখে আনোয়ারা এত খুশি কেন? ও কী মেয়েটা কে ঘিরে কোনো পরিকল্পনা করছে নাকি।
কী জানি বলা যায় না! সরল মনের মানুষটা বড্ড বোকা! কত সহজে মানুষ কে বিশ্বাস করে ফেলে।
“তা-ই নাকি?”
“হ্যাঁ, খুব ভালো হবে বুঝলে–!”
বলেই আনোয়ার আর কিছু বলল না। মনে হয় এক্ষুনি সে বলতে চাচ্ছে না। একটা পরিকল্পনা সে করছে এটা শাহিন সাহেব ঠিক ধরতে পারছেন। তিনি আনোয়ারা কে এ বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না ঠিক করলেন।
অবশ্য আনোয়ারা নিজেই সব কিছু বলে দিবে। কোনো কথা বেশিদিন ও পেটে রাখতে পারে না।
————
রায়হান দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। ওর এখন ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। যদিও এখন ক্লাস-টেলাস কিছু নাই। তবু্ও ইউনিভার্সিটিতে যায়। ওর মতো আর কিছু বন্ধু আসে। আড্ডা -টাড্ডা মারে। ভবিষ্যতে কী করবে তা নিয়ে আলোচনা হয়।
দূর থেকে দেখল একটা রিকশা আসছে। হাতের ইশারায় রিকশাটাকে ডাকল। রিকশাটা কাছাকাছি আসার সাথে সাথে কথা থেকে সুইটি এসে রিকশায় উঠে পড়ল!
উঠেই বলল, “চলেন মামা।”
রায়হান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। এ মেয়ে কোথা থেকে আসল। মেয়েটা কে আগে কখনো এলাকায় দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর! নীল রংয়ের একটা জামা পরেছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা নীল পরী। কিন্তু পরীর ব্যবহার এমন কেন হবে? পরী তো হবে মায়াবী।
রায়হনের মনে হলো মেয়েটা কে কঠিন কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু ও কঠিন কথা বলতে পারে না। এমন সুন্দরী একটা মেয়েকে তো কঠিন কথা আর কঠিন!
একটা গালি দিলে হয়। রায়হান অবশ্য বেশ কয়েকটা গালি জানে। ফাজিল, বদমাশ, আর গান্ডু এ সব গালি কি মেয়েদের দেয়া যায়? নাকি মেয়েদের জন্য আলাদা গালি আছে। আর একটা গালি অবশ্য রায়হান জানে। সেটা মনে হয় বলা যাবে না! খুবই বাজে গালি।
এটা শিখেছিল টুম্পার কাছ থেকে। টুম্পা হলো রায়হানের ক্লাসমেট। ওরা একসাথে স্কুলে পড়ত। একদিন টুম্পা এসে বলল, “এই রায়হান তোরা না-কি খান বংশ?”
রায়হান কিছু বলল না। টুম্পা সব বিষয় নিয়ে ফাজলামি করে।
“কী রে বললি না? তোরা খান বংশ কিনা?”
“এ সব বংশ-টংশ এখন চলে না।”
“চলে। তবে খান কিন্তু খুবই উচ্চ বংশ।”
রায়হান কিছু বলল না।
“তুই কি জানিস তোদের উচ্চ বংশের সাথে একটা প্রশ্ন যোগ করলে ভয়ংকর একটা গালি হয়?”
রায়হান টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইল। টুম্পা মিটিমিটি হাসছে।” কী বুঝতে পারছিস না?”
তোদের বংশের সাথে একটা কি যোগ করে দিবি। হা হা হা
রায়হান দেখল মেয়েটা রিকশা নিয়ে চলে গেছে! ওকে কিছুই বললও না মেয়েটা। মনে হয় বুঝতে পারেনি। রায়হান রিকশা ডেকেছে। রিকশাওয়ালাটাও কী শয়তান! সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে চলে গেল।
এ জায়গাটাতে সকালের দিকে রিকশা পাওয়া যায় না। লম্বা সময় অপেক্ষা করে একটা রিকশা পাওয়া গেল।
রায়হানের মেজাজটা একটু খারাপ। শুধু শুধু দেরি হয়ে গেল। আজ রইসের সাথে একটা জরুরি কাজ আছে। গতকাল ও অনেকবার বলেছিলো আজ একটু আগে যেতে।
যেদিন কাজ থাকে সেদিন ঘুম ভাঙে দেরি করে। রাতে মনে ছিলো না। না হলে রহিমা কে বলে রাখলেই হতো। ও আবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে।
মা ইদানিং রায়হান কে সকালে ডাকে না। ডেকে কী হবে? এখন তো রায়হানের ভার্সিটিতে যাওয়ার তাড়া নেই।
রিকশায় উঠে বসার পরই রইসের কল আসল। কলটা রিসিভ করবে কি-না ঠিক করতে পারছে না রায়হান।
রইসের অভ্যাস হলো কল রিসিভ না করা পর্যন্ত কল দিতেই থাকবে। ইচ্ছে না করলেও কলটা ধরল রায়হান।
“কী রে কোথায় তুই?”
“রিকশায় বসে আছি।”
“এখনো রিকশায় মানে তুই মাত্র বাসা থেকে বের হয়েছিস!”
“না, বের হয়েছি ঘন্টাখানেক আগে। এসে তোকে সব কিছু বলব।” কলটা কেটে দিলো রায়হান। রায়হান মেয়েটা কঠিন কথা বলতে না পারলেও রইস তাকে ঠিকই বলবে!
চলবে–
ভাড়াটিয়া-৪
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান আর রইস। রইসের কাজ আজকে আর হবে না। পরে এক সময় যেতে বলেছে।
রইস বলল,” দ্যাখ কী সুন্দর একটা মেয়ে!”
রায়হান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। আরে এই মেয়ে এখানে কেন? সকালে রিকশা নিয়ে চলে এসেছিল মেয়েটা।
“চিনিস নাকি মেয়েটাকে?”
রায়হান বলল, “না।”
“যেভাবে তাকিয়ে আছিস, মনে হয় তোর পাশের বাসার মেয়ে!”
“কী সব বলিস না তুই! চল ক্যান্টিনের দিকে যাই।”
“মেয়েটা কি আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে না-কি রে? আগে তো দেখিনি। ”
“জানি না। পড়লে পড়তেও পারে।”
“চল পরিচয় হই।”
একটু বিরক্ত হয়ে রায়হান বলল, “তুই যা, আমি ক্যান্টিনের দিকে যাই।”
রইসও অবশ্য গেল না। দুইজনে ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা দিলো।
ক্যান্টিনে এ সময়ে খুব একটা ভির থাকে না। আজ মনে হয় ওদের কেউ আসেনি। সোহেলের সাথে দেখা করা যায়। ও মহসিন হলে থাকে। না, আজ আর কারো সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না। রইসের কাজটা যেহেতু নেই। বাড়ি চলে যাওয়া যায়।
একটা টেবিলে বসল ওরা দুইজন। রইস বলল, “আজ দেখি কেউ আসেনি রে!”
“হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।”
রইস হাঁক দিলো,” মামা দুই কাপ চা দাও তো। আর কিছু খাবি নাকি? ”
“না, এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুই খেলে খা।”
ক্যান্টিনের মামা দুই কাপ চা এনে টেবিলে রাখল। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আলত চুমুক দিলো রইস।
“তারপর তোর প্লান কি বলতো?”
রায়হান চায়ের কাপটা হাতে ধরে বলল, “দেখি কী করা যায়।”
“বি,সি এস টি সি এস দিবি না-কি? ”
“দেয়া তো দরকার। একটা সরকারি চাকুরি হলে খারাপ হয় না। জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটান যায়।”
“তোরও চাকরি-বাকরি নিয়ে চিন্তা আছে তাহলে!”
“কেন থাকবে না? আমার বাবা কি এ দেশের রাজা নাকি? ”
“রাজা না হলেও রাজার চেয়ে কম না!”
“ধুর! তোর খালি আজগুবি কথাবার্তা। ”
“হলের দিকে যাবি?”
রায়হান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” না রে। আজ বাড়ি যেতে হবে।”
“বাড়িতে কাজ-টাজ আছে নাকি?”
“আছে হয়ত। মা বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরতে। আজ বের হতেই মানা করছিলো। তোর কাজটার জন্যই আসলাম কিন্তু কাজটা তো আর হলো না।”
রইস বলল,” এখনি চলে যাবি নাকি! বস না আর কিছুক্ষন। ওরা হয়ত কেউ আসবে।”
“আজ যাই রে। দেখি সময় পেলে কাল একবার আসব।”
রায়হান ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল। কেন জানি আজ বাসায় যেতে খুব ইচ্ছে করছে!
——–
অনেকটা সময় ধরে ঘুরাঘুরি করে বাসায় ফিরল সুইটি। নতুন এলাকাটা বেশ ভালো।
বাড়িটা সুইটির খুব পছন্দ হয়েছে। বাড়িওয়ালীটাও খুব ভালো! প্রথমদিন কেমন জোর করে বাসায় নিয়ে খাওয়াল।
রাতেও আবার এসে খবর নিয়ে গেলেন। সব কিছু ঠিকঠাক হয়েছে কি-না? ভাবা যায়! রাতেও অবশ্য খাবারের কথা বলেছিলেন। সুইটিরা রাজি হয়নি। বাসায় রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করা হয়ে গেছিল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় আনোয়ারার সাথে দেখা হয়ে গেল।
সুইটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ” কেমন আছ মা?”
“ভালো আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো আছি মা। এসো ভিতরে। ”
এখন ওনাদের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। এমনভাবে ধরলে নাও বলা যায় না।
শাহিন সাহেব আজ অফিসে যাননি। তিনি ঘরে বসে বসে বই পড়ছেন। আনোয়ারা সুইটি কে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে ভিতরে গেলেন শাহিন কে ডাকতে। সেদিন শাহিন বাসায় ছিলেন না। মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি।
আনোয়ারা এসে বললেন,” তুমি একটু ড্রয়িং রুমে গিয়ে মেয়েটা কে একটু সময় দাও তো। আমি চা করে নিয়ে আসছি।”
শাহিন বইটি একপাশে রেখে বললেন, “কোন মেয়ে?”
“এত কথা বলছ কেন! গেলেই তো দেখতে পাবে।”
শাহিন উঠে ড্রয়িংরুমে গেল। মেয়েটা কে দেখে প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেলেন শাহিন সাহেব!
এটা কী করে সম্ভব? হুবহু সেই মুখ। তার বয়স এখম পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। সেই হিসাবে রুবিনার বয়স পয়তাল্লিশ তো হবে।
এ মেয়েকে দেখে তো এত বয়স্ক মনে হচ্ছে না।
রুবিনা ছিলো শাহিনের সাথে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ওদের ডিপার্টমেন্টে একটা মাত্র মেয়ে বোরকা পরে আসত। এখানকার মেয়েদের মতো বোরকা না। একাবারে হাত-পা কিছু না দেখা বোরকা!
একসাথে পড়ার দুইবছর কেটে গেছে অথচ রুবিনা নামের মেয়েটির চেহেরা দেখা হয়নি কোনো ছেলের!
ডিপার্টমেন্টের অনেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। শাহিন এখনো কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি।
সেই শাহিনের প্রেম হলো বোরকাওয়ালী রুবিনার সাথে। টানা দুইবছর প্রেম করল ওরা। শাহিনের খুব ইচ্ছে ছিলো রুবিনা কে বিয়ে করার।
ওদের সম্পর্কে নিয়ে শাহিনের বাবার আপত্তি করার কথা। এত বড়োলোকের ছেলে পছন্দ করেছে সাধারণ ঘরের একটা মেয়ে কে।
দেখা গেল শাহিনের বাবা আমজাদ খান ওদের সম্পর্ক মেনে নিলেন। এবং নিজে রুবিনার বাবার কাছে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন।
রুবিনার বাবা ছিলেন হুজুর মানুষ। কঠিন ধর্ম মানা মানুষ। তিনি আমজাদ খানের সব রকমের ব্যবসার খবর নিলেন।
আমজাদ খানের একটা সিনেমা হলো ছিলো। বাবা মারা যাওয়ার পর শাহিন খান হলটা নিজে চালাননি।
সিনেমা হল থাকার কারণে শাহিনের সাথে রুবিনার বাবা বিয়ে দিতে অস্বীকার করলেন!
চলবে–