ভাড়াটে-০৩
ভয়ংকর রকমের নিস্তব্ধ রুম। বাহিরে বাতাসের শনশন শব্দ, ফ্যানের ভনভন আওয়াজ সুস্পষ্ট। আমি অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে বিছানার এককোণে বসে আছি। আমার ঠিক সামনে কনক তার ক্ষীপ্ত, রগচটা নয়নে চেয়ে আছেন আমারই দিকে। যেন এক্ষুণি মেরে-কেটে এলাহি কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন।
মাঝরাতে এতটাই জোড়ে কামড়ে দিয়েছিলাম যে, ফর্সা চামড়া ভেদ করে বিন্দু বিন্দু রক্তের আভা ভেসে উঠেছিল। উপরের পাটির পাঁচটা আর নিচের পাটির চারটা দাঁতের দাগ বসে বিশ্রী অবস্থা! কনক আপাতত হাতে ব্যান্ডেজ করতে করতেই চেয়ে আছেন। খানিক বাদে দাঁতে দাঁত চেপে কটমট কণ্ঠে আদেশ দিলেন, “এদিকে আসো।”
আমি চমকিত হয়ে আমতা আমতা করলাম, “কেন?”
—“তোমাকে কামড়াবো, আসো।”
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল নিমিষেই। বিস্ফোরিত হলো গলার স্বর,
—“মানে কি? দূরে যান। পাগল লোক!”
—“এদিকে আসতে বলেছি তোমাকে ধারা।”
শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভালো লাগার শীতল স্রোত না। ভয়ে আড়ষ্ট হওয়া ঠান্ডা, অদৃশ্য স্পর্শ। কনক কখনোই স্বাভাবিক অবস্থায় আমার নাম ধরে ডাকেন না। যখন তার মাথায় কুটনা বুদ্ধীরা বসবাস করে কিংবা আমার ওপর ভীষণ রেগে থাকেন; ঠিক তখনই আমার যে একটা সুন্দর নাম আছে, সেটা মনে পরে উনার। আমি লিউইসের দিকে একবার তাকালাম। বেচারি সোফার মাঝখানটায় চোখ বুজে মোচড়ামুচড়ি করছে। এত আলো, আওয়াজে ঘুমাতে অসুবিধে হচ্ছে নিশ্চিত! এই কনইক্কা আমিসহ আমার লিউইসটারও সুখ, শান্তি, স্বস্তি সব ছিনিয়ে নিয়েছে। মীর জাফর, রাজাকার একটা!
কনক কণ্ঠস্বর আরও ভারি করলেন। দারুণ গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, “তোমাকে কি বলেছি ধারা?”
আবারও! আবারও ধারা! বলতে নেই। তবুও বলি, আমি আসলে কনককে মোটামোটি রকমের ভয় পাই। সেই ভয় থেকেই তার একটু কাছাকাছি হয়ে বসলাম। অবাধ্য হলাম না। আমার এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
—“ব্যান্ডেজ ভালো ভাবে লাগাও। খবরদার! আমি ব্যথা পেলে একদম ছাদ থেকে ফেলে দেব। লাশও কেউ খুঁজে পাবে না। তাই সাবধান!”
মনে মনে ভেঙ্গালাম, “এ্যাঁ! সাবধান! তোরে মেরে গুম করে ফেলবো মিয়া!”
অথচ সামনা সামনি এতটাই নিরহ হয়ে রইলাম যে, ভেতরটা বোঝার উপায় নেই। আমাকে দেখে যে কেউই মায়ায় সাগরে ডুবে যাবে যাবে প্রায়।
–
রাতে দেড়ি করে ঘুমানোর কারণে তন্দ্রা ছুটতে ছুটতে এগারোটার ওপাশ। তার আরও একটা কারণ আছে অবশ্য। নতুন জায়গায় ঠিকঠাক ঘুমটা ধরা দেয়নি। সারারাত এপাশ-ওপাশ করেই কেটেছে। আহ! আমি আমার রুম, বিছানাকে প্রচন্ড ভাবে মনে করছি!
তন্দ্রা ছুটতেই লিউইসের নরম-শরম শরীরটাকে নিজের বাহুর কাছে অনুভব করলাম। ও আমার ভেতর ঢুকে যেতে চাইছে। ব্যাপার কি? লিউইস তো কখনো এমন করে না। ঘুমের মাঝেই কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজের রেখা দেখা দিলো। পরপরই বিশ্রী কণ্ঠে খুব কাছ থেকে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক কানে বাজতেই ধরফরিয়ে উঠলাম আমি। অনুভব করলাম, হৃদযন্ত্রের গতি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস প্রচন্ড দ্রুত। বুকের বা পাশে হাত চেপে এদিক ওদিক তাকাতেই কনককে দেখতে পেলার দরজার কাছে। মুখ ঘেমে আছে। চুলগুলো ঝরঝরিয়ে কপালের সঙ্গে লেপ্টে। দুহাতে খুব যত্ন করে একটা ছোট্ট কুকুর কোলে নিয়ে আছে। লিউইস থেকে আকারে একটু বড়। লিউইস কি এই কুকুরের জন্যই ভয় পেয়ে আমার কাছে নিজেকে লুকাচ্ছিল? কনক এগিয়ে আসলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে শয়তানি হেসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “ভয় পেয়েছ?”
আমার রাগী, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, “এই কুত্তা এখানে কি করছে?”
—“ওর নাম বাগা। মাই নিউ পেট! এখন থেকে ও আমার সাথেই থাকবে।”
কথাটা হজম করতে পারলাম না। অল্প রাগের রেশটা শিরা-উপশিরায় পৌঁছে বিস্তর আকার ধারণ করলো। প্রায় চিল্লিয়ে উঠলাম, “মজা করছেন আমার সাথে? এই কুত্তা এখানে থাকতে পারবে না!”
প্রতিউত্তরে সে মৃদু হাসলেন। ভাব-আবেগ খুব স্বাভাবিক রেখে বাগাকে নিয়ে আমার পাশে বসলেন। বাগার শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত সুরে শুধালেন,
—“কি যেন বলছিলে?”
প্রায় সাথে সাথেই আবার বললেন, “থাক! বলতে হবে না। শুনতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে বাগার ব্যাপারে একটা বিষয় জানিয়ে দেই। বাগা খেতে ভালোবাসে। আর ওর প্রিয় খাবার হচ্ছে বিড়ালের মাংস। সুন্দর না?”
সহ্যের সীমা ভেঙ্গে গেল। কনক কি ভেবেছেন আমাকে? আমি মূর্খ? অশিক্ষিত? কুকুর কি খায়, না খায় জানি না? চিৎকারের আওয়াজ দ্বিগুণ বাড়িয়ে বললাম,
—“অবুঝ পেয়েছেন আমাকে? কুকুর বিড়াল খায় কখনো?”
কনক নিষ্পাপ চোখে চাইলেন, “খায় না? ওহ্! আচ্ছা সমস্যা নেই। বিড়ালের মাংস প্রিয় হতে কতক্ষণ? আমি শিখিয়ে দেব বাগাকে। লিউ-টিউকে এদিকে দাও। ওকে দিয়ে প্রেকটিস করাবো।”
তাড়াতাড়ি লিউইসকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলাম। করুণ চোখে চেয়ে অসহ্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কি শত্রুতা আপনার ওর সাথে? এমন করছেন কেন?”
—“আমার ছাদের দুটো কবুতর খেয়ে ফেলেছে ও। ওকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেব?” লিউইসের দিকে সরাসরি শান্ত দৃষ্টে চেয়ে বললেন কনক।
লিউইস যেন বুঝে ফেললো কনক ওর নামে নালিশ করছে। আমার দিকে চোরা চোখে চেয়ে দৌড়ে চলে গেল রুম থেকে। সঙ্গে সঙ্গে কনকের কোল থেকে নেমে বাগাও ওর পিছু পিছু দৌঁড়ালো। আমি আঁতকে উঠলাম। উৎকণ্ঠা হলো কণ্ঠস্বর, “আপনি– আপনি কুত্তাটাকে ছেড়ে দিলেন কেন? ও আমার লিউইসকে মেরে ফেলবে।”
কনক হঠাৎ এগিয়ে এসে আমার গাল টেনে ধরলেন, “পারবে না। তোমার মতোই ধিন্দি তোমার বিড়াল। বাজে কাজে এক্সপার্ট।”
আমি তেঁতে উঠলাম, “ছাড়ুন! বারবার গাল টেনে ধরেন কেন?”
—“আমার ইচ্ছা।”
—“আপনার ইচ্ছে হলেই হবে নাকি? আমি বলে দিলাম! ওই কুত্তা এ বাড়ি থাকতে পারবেন না।”
গাল ছেড়ে কনক তীক্ষ্ণ, সূঁচালো চোখে তাকালেন, “তুমি বললেই হবে নাকি?”
আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই আবার বললেন, “তোমার না হওয়া প্রেমিক কল দিয়েছিল সকালে। কল ধরতে গিয়ে ফোন হাত থেকে পরে ভেঙ্গে গেছে। কষ্ট পেও না। তোমার মতো গরিবের জন্য আমার আলমারিতে তিন চারটে মোবাইল এমনিতেই পরে থাকে। যেটা পছন্দ নিয়ে নিও।”
কনক শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন। আমার খেয়াল সেদিকে নেই। স্বভাবসুলভ প্রতিবাদও করিনি। সব ভাবনা এনিয়েই যে, বিয়ের প্রথম সকালটাই যদি এমন কাটে, বাকিটা জীবন কিভাবে কাটবে?
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা