ভিতর_বাহির ১০ এবং শেষ পর্ব

0
5977

ভিতর_বাহির
১০ এবং শেষ পর্ব
শাহরিয়ার

সোহান কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলো, আমি ওর হাতটা টান দিয়ে আমার হাতে নিতেই সোহান বলে উঠলো এই তুই কি করছিস। আমি বললাম কি করছি তোমার হাত ধরছি। কেন কোন সমস্যা?

সোহান বললো না কোন সমস্যা নেই, আমি বললাম আচ্ছা যদি তোমার গফ তোমার সাথে বসতো তুমি এখন কি করতা?

সোহান বলে উঠলো আমার কোন গফ নেই।

কথা বলতে বলতে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি বললাম উফ কত সুন্দর রোমান্টিক ওয়েদার, সব সময় গল্পেরর ভিতর এমন সব কিছু পরেছি। নায়ক নায়িকা রিক্সায় ঘুরছে আর এমন সময় বৃষ্টি আরম্ভ হয়।

সোহান বলে উঠলো তোর মাথাটা কি পুরোটাই গেছে।

আমি বললাম হুম চলো রিক্সা থেকে নামো ভিজবো।

সোহান বললো না ভিজলে জ্বর আসতে পারে তখন সব দোষ আমার হবে।

কিছু হবে না, বলেই রিক্সা থামিয়ে দুজন নেমে পড়লাম। তারপর আমি বাচ্চাদের মত বৃষ্টিতে লাফাতে শুরু করলাম। সোহান মনোমুগ্ধের মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বৃষ্টির পানি সোহানের শরীরে ছিটিয়ে দিচ্ছি। সোহান হেসে চলছে আর বলছে পাগলামী বন্ধ কর মানুষ কি বলবে।

মানুষ কি বলবে তাতে আমার কিছু না মানুষের কথা শোনার মত সময় আমার নেই। বলে সোহানের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বাসায় চলে আসলাম দুজন।

দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। সবাই দেখে বলতে শুরু করলো বৃষ্টিতে ভেজার কি খুব দরকার ছিল যদি জ্বর আসে মেয়েটার?

জ্বর সেদিন এসেছিল তবে আমার নয় সোহানের টানা চারদিন জ্বরে ভোগে ছিল সোহান। পঞ্চম পরীক্ষার দিন মা আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। তারপর সোহানের জ্বর কমলে সোহান আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়।

দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল, আমার সামনে এখন সম্পূর্ণ অবসর সময়। কোন কাজ নেই।

আমি সোহানের দেয়া বই দুটো পড়ে শেষ করলাম।
তারপর বসে গেলাম সোহানের চিরকুটের উত্তর লেখতে।

প্রিয়,
তোমাকে খুব ছোট করে বলি আমিও জানি না তোমাকে কবে কখন ভালবেসে ফেলেছি। শুধু জানি তোমার কথায় আমি কখনো রাগী না, সব সময় উপভোগ করি তোমার সাথে করা মিষ্টি দুষ্টমি গুলো যদি এটাকে ভালবাসা বলে তবে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। আর একটা কথা এই চিরকুট পাওয়ার পর থেকে যদি আমাকে তুই করে বলো তবে ব্রেকআপ।

তারপর বইয়ের ভিতর চিরকুটটা ভরে রাখলাম। এর ভিতর আদিবা কল দিল পরদিন ওর ভাইয়ের বিয়ে আমাকে যেতেই হবে। আমি বললাম ঠিক আছে যাবো। রাতেই খাবার টেবিলে বাবা মাকে জানালাম রিয়াদ ভাইয়ার বিয়ের কথা।

বাবা, মা বললেন না না তোকে একা যেতে দিতে পারি না, তোর যেতে হবে না। বড় চাচা বললেন আহা বান্ধবির ভাইয়ের বিয়ে না গেলে খারাপ মনে করবে অবশ্যই যাবে। সোহান নিয়ে যাবে নিয়ে আসবে।

পরদিন সন্ধ্যায় সুন্দর করে শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলাম। সোহান ও পাঞ্জাবী পরে রেডি হয়ে নিলো। দুজনে রওনা দিলাম আদিবাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রিক্সায় সোহান আর আমি পাশাপাশি বসে আছি।

সোহানকে বললাম আচ্ছা তোমার বিয়ের পর কি আমি তোমার সাথে এভাবে ঘুরতে পারবো?

সোহান বললো কেন পারবি না?

না মানে তোমার বউতো আমাকে আর তোমার পাশে বসতে দিবে না। তখনতো তুমি তোমার বউকে নিয়েই ঘুরবে।

সে সময় হলেই দেখা যাবে কাকে নিয়ে ঘুরি,

হুম হুম সব ছেলেরাই এমন কথা বলে পরে দেখা যায় এক একটা বউ পাগলা হয়ে গেছে।

দেখ ইকরা বেশী বুঝবি না চুপ চাপ বসে থাক না হলে নেমে যাবো।

আমি বললাম আচ্ছা আমি চুপ করে থাকলে তোমার ভাল লাগবে ওকে চুপ করে রইলাম।

সোহান বললো চুপ করে থাকতে বলছি মানে এই নয় যে একেবারে চুপ করে থাকবি, চুপ করে থাকা মানে বলেই আমার মাথাটা টান দিয়ে সোহানের বুকের মাঝে নিয়ে বললো এখানে মাথা রেখে বসে থাকবি।

ইকরা জানিস তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে,

তাই বুঝি?

হুম তাই আচ্ছা বউ সাজলে তোকে কেমন লাগবেরে?

আমি কি করে বলবো আমি মনে হয় বউ সেজে শশুর বাড়িতে গেছি যে বলতে পারবো।

হুম তাও অবশ্যই ঠিক দ্বারা তোকে খুব শিগ্রই বউ সাজার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি বলেই হেসে উঠলো সোহান। আমিও মনে মনে বলতে শুরু করলাম আমিওতো চাই তোমার বউ সেজে তোমার সামনে দাঁড়াতে। রিক্সা আদিবাদের বাসার সামনে আসতেই দুজন নেমে গেলাম।

বিশাল এলাকা জুড়ে আলোক সজ্জায় সাজানো, সোহান বলে উঠলো আমার বিয়েতে পুরো এলাকায় লাইটিং করবো।

আমি হাসতে হাসতে বললাম শুধু এলাকা কেন পুরো শহর আলোকিত করো। বলতে বলতে দুজন বাড়ির ভিতরে চলে গেলাম।

বাড়ির ভিতরে যেতেই আদিবা দৌড়ে ছুটে এলো, আমি আদিবাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম সোহানের সাথে। তারপর তিনজন মিলে রিয়াদ ভাইকে দেখতে গেলাম।

সোহানতো রিয়াদ ভাইকে বর হিসেবে দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, এতোদিন পর্যন্ত যাকে আমার প্রেমিক মনে করেছে আজ তার বিয়ে খেতে এসেছি দেখে। একবার রিয়াদের দিকে তাকায় একবার আমার দিকে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি তারপর রিয়াদের সাথে সোহানের পরিচয় করিয়ে দিলাম।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। আমি আমার রুমে চলে গেলাম সোহান ওর রুমে। আমি ফ্রেশ হয়ে চিরকুটসহ বই দুটো নিয়ে সোহানের রুমের দিকে রওনা দিলাম। আজ সোহানকে বই দুটো দিয়ে চমকে দিবো ভেবে।

কিন্তু দরজার সামনে যেয়ে আমি চমকে গেলাম। বড় চাচা, চাচী আর সোহানের কথা শোনে, সোহানের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সোহান বলে উঠলো বাবা তোমাদের মতের বিরুদ্ধে আমি কখনো যাইনি আর যাবও না। তোমরা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছো আমি তাকেই বিয়ে করবো।

কথাটা শোনে আর এক মুহুর্তও আমি সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চূরমার হয়ে গেল। সোহান তবে চিরকুটে যা লেখেছে সব মিথ্যা একটা বারও বড় চাচাকে বলতে পারলো না আমি ইকরাকে ভালবাসি।

আমি বিছানায় শুয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কেমন জানি বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে, এমন সময় সোহান রুমে ঢুকে বললো এই ইকরা একটা খুশির খবর আছে।

আমি বলে উঠলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এটাইতো বলবে তাই না?

সোহান বললো আরে তুইতো দেখি সব জানিস কিন্তু কান্না করছিস কেন?

আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম খুশিতে, এখনতো আর তোমাকে আমি জ্বালাবো না তাই তোমারতো আর আমার দেয়া যন্তনা সহ্য করতে হবে না তাই।

সোহান বলে উঠলো তুই যদি না বলিস, তবে আমি এখুনি বাবা, মাকে যেয়ে না করে দিবো।

আমার তখন মন চাচ্ছিল সোহানকে একটা থাপ্পর মেরে দেই বেঈমান কোথাকার। তারপরেও নিজের কষ্ট চাপা দিয়ে বললাম কিযে বলো আমি না করবো কেন সত্যি বলছি আমি অনেক খুশি।

সোহান বললো আচ্ছা ঘুমা আমি রুমে গেলাম বলে সোহান বের হয়ে গেল।

সারা রাত কোন ভাবেই দুচোখের পাতা এক করতে পাড়লাম না। সকালে মা নাস্তা করার জন্য ডাক দিলেন, আমি কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে চলে আসলাম।

কোন কিছুই আমার মুখে যাচ্ছিল না। মা বলে উঠলেন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে সবাই মার্কেটিং এ যাবো। আমি বললাম আমি না গেলে চলবে না। মা বললো পাগল নাকি তোর পছন্দের জিনিস তোকেই কিনতে হবে যার যার পছন্দের জিনিস সে সে কিনবে। আমি আর কিছু না বলে নাস্তা শেষ করে রুমে যেয়ে ড্রেস পরে রেডি হয়ে নিলাম।

সকলের সাথে হাসি খুশি মনে বের হলাম মার্কেটিং করতে কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না আমার মনের ভিতর কি চলছে। কি ভেবে ছিলাম আর কি হলো,

ভেবেছিলাম পরীক্ষা শেষ হলে সোহানের সাথে চুটিয়ে প্রেম করবো, কিন্তু হলো উল্টা ও আসলে একটা ভিতুর ডিম। ভালবাসতে পারে অথচ বলতে পারেনি ওর বাবা মাকে।

ভাবতে ভাবতে সকলে মার্কেটে চলে আসলাম। যে যার পছন্দমত মার্কেটিং করছে। বড় চাচা আর চাচী মিলে একটা লাল বেনারশী নিয়ে এসে আমার গায়ে রেখে বার বার দেখছে আর বলছে এটাই সুন্দর মানাবে আমি বুঝতে পারলাম তারা তাদের হবু বউ মায়ের জন্য এটা কিনছে।

মনে মনে বলছি এখনতো আর আমাকে মা বলে ডাকবে না, ঘরে নতুন বউ মা আসছে তাকেই মা বলে ডাকবে। মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম আচ্ছা তাহলে কি আমার আদর কমে যাবে না, ভাবতেই দুচোখের কোনে কেমন জানি জল চলে আসলো। কোন রকমে তা লুকিয়ে নিজের জন্য টুকটাক কেনাটাকা করলাম।

শাড়ির দোকান থেকে বের হয়ে স্বর্ণের দোকানে যেয়েও বড় চাচী সেই একই কাজ করলো। একবার ইচ্ছে করছিল বড় চাচীকে বলি যে বউ হবে তাকেই নিয়ে আসতে আমাকে কেন আনতে হবে। রাগে আর হিংসার আমার সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল সোহানের চুলের মুঠি ধরে সবার সামনে নিয়ে যেয়ে বলি আমাকে যে ও ভালবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছে এখন সেই স্বপ্ন ভাঙার দ্বায় কে নিবে?কিন্তু কেন জানি তার কিছুই করতে পারলাম না আমি।

মার্কেটিং শেষ করে সকলে বাসায় চলে আসলাম।
নিজের রুমে নিজেকে বন্দী করে রেখেছি অনেক কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাও করতে পারছি না তাহলে সবাই বিষয়টা খারাপ ভাবে নিবে। বিকেলে বের হয়ে দেখি সবাই মিলে গল্প করছে, সোহান ডেকোরেটরে গেছে সব ব্যবস্থা করার জন্য। আমি বড় চাচাকে বললাম চাচা পাত্রি দেখতে যাবে না। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বড় চাচী বললো তাইতো যেতেতো হবেই আমরাতো ভুলেই গিয়েছিলাম। যা মা তুই রেডি হয়ে নে। আর সবাইকেও বললো রেডি হয়ে নিতে।

মা আমার রুমে এসে আমার জন্য কিনে আনা একদম নতুন একটা শাড়ি পরাতে শুরু করলো। আমি বললাম শাড়ি পরতে হবে কেন মা কোন কথা না বলে চুপচাপ শাড়িটা পরিয়ে দিয়ে। বললো তুই রুমেই থাক আমি আসছি বলে মা বের হয়ে গেল।

মিনিট পনের পর মা, রুমে এসে বললেন নে চল এবার। আমি মায়ের সাথে বের হয়ে চমকে গেলাম।
সবাই দুতলায়, বড়া চাচা, চাচী সোহান সবাই, আমাকে দেখে সবাই মুচকি হাসছে আমি নিজের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম না সব ঠিক আছে।

বড় চাচা বলে উঠলেন মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আর আজই আমরা মেয়েকে আমাদের ঘরের বউ সাজিয়ে নিয়ে যেতে চাই। কথাটা শোনে আমার মাথাটা কেমন জানি ঘুরতে শুরু করলো।
এগুলা কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আমি বোকা তাই বলে কি সব সময় আমাকে বোকা বানাতে হবে?

বড় চাচা বললো তা তোমরা কি আলাদা কথা বলতে চাও? সোহান মাথা নেড়ে বললো না।
অতঃপর সকল জল্পনা কল্পনার সমাপ্তি হলো, সন্ধ্যার পরেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল হুট করেই। আমি বাসর ঘরে বই দুইটা নিয়ে বসে আছে। দ্বিতীয় বইটার নিচে সেই চিরকুটটা রেখেছি।

সোহানকে শাস্তি দিবো বলে, আপনারা কেউ বলবেন না। সোহান দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই আমি খাটের এক কোনায় চেঁপে গেলাম। সোহান দরজা লাগিয়ে আসতেই আমি বই দুইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম। এক এক পাতা করে শেষ করবে।
সোহান বললো কেন? আমি বললাম আমাকে স্পর্শ করার অনুমতি নিতে হবে না? তুমি বই পড়ে শেষ করতে পারলেই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে। এটা তোমার শাস্তি আর গল্প জোড়ে জোড়ে পড়ে আমাকে শোনাতে হবে।

সোহান আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমি খাটে আরাম করে শুয়ে পরলাম, কি কেমন হলো? বেচারা সারা রাত গল্প শোনাবে তারপর তার মুক্তি মিলবে। আর প্রেমটা না হয় বিয়ের পরেই করবো।।

সমাপ্ত..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here